অবেলায় বসন্ত পর্ব-০৩

0
305

অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৩)
লেখাঃ শামীমা জামান

চিত্রা আজকাল বাসায় অনেকটা নির্বাসনের মত থাকে। যেন আলাদা বিচ্ছিন্নি একটা দ্বীপ। কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। কারো সাথে খেতেও বসে না। বাসায় থাকলে নিজের ঘরেই থাকে। সবার খাওয়া হয়ে গেলে সে খেতে যায়। আজ রাতে খেতে বসে দেখে চিত্রার পছন্দের বেগুন বাহার রান্না হয়েছে। অবাক হল সে তার পছন্দের খাবার দেখে। তার পছন্দের কথা ভাবা হয় এখনো! সে খুশি মনে খেতে বসে। খাবার মুখে তুলে দেখে তাতে লবণ দেওয়া হয়নি। চিত্রা খেয়াল করেছে ইদানীং এই বিষয় গুলো খুব বেশিই ঘটছে। কখনো লবণ বেশি, কখনো একেবারেই নেই, কখনো ঝাল বেশি, কখনো মশলা বেশি, কখনো সকালে নাশতা তৈরিই হয় না। চা পাওয়া যায় না। চিত্রা বিষয়টা নিয়ে ভাবল… এর পেছনে কী কোন বিশেষ কারণ আছে? চিত্রাদের বাড়িতে কাজে সাহায্যের জন্য সার্বক্ষণিক একটা মেয়ে থাকে। তবে রান্না বান্না সব চিত্রার ভাবিই করে। সব গোছানোই থাকে ভাবি শুধু চুলায় বসিয়ে রান্নাটা শেষ করেন। এর বাইরে চিত্রার পেছনে লাগা ছাড়া এ বাড়িতে ভাবির কোন কাজ নেই। নিশ্চই কিছু একটা হয়েছে যার কারণে রান্না এমন হচ্ছে। এমন সময় চিত্রার ভাবি এসে চিত্রাকে বলল-

-আজকের রান্না কেমন হয়েছে? তোমার জন্য স্পেশাল বেগুন বাহার করেছি খাও, বেশি করে খাও। বাড়িতে খাওয়া ছাড়া তোমার আর কাজই বা কী বল? বাপের বাড়ি বসে বসে পায়ের উপর ঠ্যাং তুলে খাওয়া শুধু।

চিত্রা এবার বুঝে ফেলল রান্না খারাপ হবার পেছনে কোন ঘটনা প্যাঁচ খেয়েছে। ভাবি চাইছে রান্না বান্নার কাজটা চিত্রা করুক। চিত্রা বলল- যাক প্রতিদিন রান্না খারাপ হবার কারণ এখন জানা গেল। আমাকে নিয়ে তোমার এত ভাবনা কেন ভাবি? রোজ কিছু না কিছু খুঁজে বের করতে হয় কীভাবে আমাকে কষ্ট দেওয়া যায়? তুমি যত বেশি এসব করো তত বেশি নিজেকে আমার সেলিব্রেটি মনেহয়। ভাবি তুমি জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করনি কেন? এক আমাকে নিয়েই প্রতিদিন কত খবর ছাপাতে পারতে।

চিত্রার ভাবি ভয়ানক রেগে গেলেন। বললেন- চাপায় তো বেশ জোর হয়েছে দেখছি। চাপাটাকে রেস্ট দিয়ে পারলে হাতে জোর বাড়াও। মুখের সামনে খাবারটা রেডি পাও তো তাই ধরাকে সরা জ্ঞান করছ।

-হুম সেটাই ভাবছি… হাতে জোর বাড়াতে হবে। কারাতে ক্লাসে জয়েন করে ফেলি কী বলো? মুখে তো পারা সম্ভব না হাতে যদি পারা যায়? চিত্রা আর কথা না বাড়িয়ে খাবার রেখে উঠে গেল। একে তো অখাদ্য তার উপর কথার যন্ত্রণা। তাই সে উঠে যাওয়াটাই ভালো মনে করল।

ঘরে গিয়ে ফুড পান্ডা থেকে রাতের খাবার অর্ডার করল। তারপর ফেসবুক ক্রলিং করতে লাগল। তখন সে হোমমেড খাবারের একটা পেইজ দেখতে পেল। সেখানে বেশ কিছু লোভনীয় খাবারের ছবি দেখল। সেখানে হাঁসের মাংস দেখে তার অর্ডার করতে ইচ্ছে হল। কিন্তু সে তো হাঁসের মাংস খায় না! কিন্তু খাবারটা এত লোভনীয় দেখাচ্ছে যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অর্ডার করবে। সে পেইজটাতে গিয়ে হাঁসের মাংস, ডিম ভুনা, পরোটা, সবজি, পিঠা অর্ডার করল পরদিন সকালের নাশতার জন্য। সকাল ৮ টায় যেন পৌঁছে যায় সেটা কনফার্ম করে এড্ড্রেস পাঠিয়ে দিল। কাল ছুটির দিন সকালটা সুন্দরভাবে শুরু হোক।

ছুটির দিনে সবাই একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে এ যেন অলিখিত সহজাত নিয়ম। কিন্তু চিত্রা আজ সকাল সকাল উঠে গেল। আলমারি থেকে সাদা একটা শাড়ি বের করে পরল। চোখে কাজল দিল। তার মাঝে মাঝে লিপস্টিক দিতে ইচ্ছে হয় কিন্তু দেয় না। কারণ লিপস্টিক দিলে তখন নিজের কাছেই রক্ত খেয়ে আসা ড্রাকুলা মনেহয়। সে চুল বেঁধে মায়ের কাছে বলতে গেল সে একটু বের হচ্ছে। তার মা শুনেই কপাল কুঁচকে বললেন-

-ছুটির দিনে আবার কোথায় যাবি?

-কাজ আছে একটু।

-ছুটির দিনে আবার কী কাজ? বাসায় থেকে তোর ভাবিকে রান্নায় একটু সাহায্য করলেও তো পারিস?

-আমি রান্না করলে সেটা তোমাদের কাছে ভালো লাগবে না। আমি বের হচ্ছি। বলে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রা বের হয়ে গেল। পেছন থেকে তার মা বিরক্ত গলায় গজগজ করতে লাগলেন।

চিত্রা রিকশায় উঠে ভাবল- সে কী আস্তে আস্তে কঠিন হয়ে যাচ্ছে? আগে তো এমন ছিল না? এই যে মায়ের সাথে ভাবির সাথে কথায় কথায় সে কঠিন করে জবাব দিচ্ছে সে তো এমন না! সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল… সে কখনো কঠিন হতে চায়নি কিন্তু পরিস্থিতি আজ তাকে এমন করে তুলছে। এই যে ব্যস্ত শহর, এত মানুষ কোথাও কী তার নিজের জন্য একটু শান্তির জায়গা আছে? এত মানুষের ভীড়ে এমন কেউ কী আছে যার জন্য তার আলাদা করে বাঁচার ইচ্ছে জাগে?

ফাইজ প্রতিদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যায়। ফজরের নামাজ আদায় করে সে আর ঘুমায় না। একটু হাঁটাহাঁটি করে। মেলবোর্নে তাদের বাড়ির সামনে বড় লন আছে সেখানে হাঁটত। কিন্তু এখানে তা নেই তাই সে ছাদে উঠে যায়। হাঁটা শেষ করে এসে ফ্রেস হয়ে পত্রিকা পড়তে বসে। তারপর মায়ের সাথে নাশতা করে। তার প্রতিদিনের সকালের রুটিন বাঁধা। ছুটির দিনেও তার ব্যতিক্রম হয় না। ফাইজ পত্রিকা পড়ছিল এই সময় তাদের মেইড এসে বলল-

-ভাইজান, ফুডপান্ডা থেকে একজন লোক আসছে কতগুলা প্যাকেট নিয়া। একটু দেখবেন?

ফাইজ নিচে এসে দেখল কিছু খাবারের পার্সেল। কিন্তু সে তো কোন খাবার অর্ডার করেনি। তার মাও করেনি সে জানে। তাহলে নিশ্চই ভুল করে এসেছে। সে দরজায় দাঁড়ানো ছেলেটাকে বলল- আমি তো কোন অর্ডার করিনি। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।

-স্যার ঠিকানা তো এটাই, একবার দেখুন তো?

-হুম, ঠিকানা তো এটাই দেখছি। কিন্তু আমরা তো কেউ খাবার অর্ডার করিনি!

-স্যার খাবারের ফুল পেমেন্ট করা হয়েছে তাছাড়া ঠিকানাও ঠিক আছে তাহলে হয়ত কেউ আপনাদের সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। এখন এগুলো তো আপনার রাখতেই হবে। বলে সে প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। ফাইজ খাবার গুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে ভাবতে লাগল কে করতে পারে এই কাজ? কিন্তু সে কাউকেই খুঁজে পেল না। এখন সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মেইডকে বলল- খুলে দেখ তো কী কী খাবার আছে?

রাজিয়া প্যাকেট গুলো খুলে বলল- হাঁসের মাংস, সবজি, ডিম ভুনা, পরোটা আর দুই পদের পিঠা আছে।

ফাইজ দেখল এখানে তার পছন্দের খাবার রয়েছে, তারমানে খাবার ঠিক জায়গাতেই এসেছে এবং পরিচিত কেউ-ই পাঠিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু পাঠাল কে? এমন সময় চিত্রা এসে উপস্থিত হল। এসে ফাইজকে ডাইনিং টেবিলে দেখে বলল-

-আমি কী খুব লেট করে ফেলেছি?

ফাইজ চিত্রাকে দেখে অবাক হল। সকালের মতই কেমন স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ওকে। সে অবাক ভাবটা না লুকিয়ে বলল- আজ কী আপনার আসার কথা ছিল?

-ছিল। কাল রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তো, তাই আপনাদের কাউকে জানানোর সুযোগ হয়নি। আপনারা কী নাশতা করে ফেলেছেন?

ফাইজ চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইল… মেয়েটা সব সময় এমন অদ্ভুতভাবে কথা বলে কেন? সে হতাশ গলায় বলল- না।

-আন্টি খেয়েছেন?

-না।

চিত্রা মেইড রাজিয়াকে মিসেস চৌধুরীর জন্য খাবার বেড়ে দিতে বললেন। তারপর ফাইজের দিকে তাকিয়ে বলল- অবাক হবার কিছু নেই। আজ ইচ্ছে হল আপনাদের সাথে নাশতা করতে তাই চলে এসেছি। খুব ভালো হত আমাদের সাথে আন্টি যোগ দিতে পারলে কিন্তু সেটা তো আর হচ্ছে না… আন্টির খাবারটা আমি দিয়ে আসছি। বলে চিত্রা ওপরে চলে গেল।

ফাইজ চিত্রার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তার এখন সন্দেহ হচ্ছে খাবারগুলো চিত্রাই পাঠিয়েছে। তারা তো চিত্রার কিছু হয় না, সামান্য ক্লাইন্ড মাত্র। চিত্রা কেন তাদের জন্য এসব করছে? প্রশ্নটার উত্তর চিত্রার কাছ থেকেই পাওয়া যাবে। তাই সে বসে রইল।

১৫ মিনিট পর চিত্রা নিচে এলো। তারপর বলল- আন্টির সাথে বসে খুব খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছে তো পূরণ হবার নয়। চলুন শুরু করি?

-খাবারটা তো আপনিই অর্ডার করেছেন তাই না? এর বিশেষ কোন কারণ আছে কী?

-হুম আছে। আজ আমার জন্মদিন। প্রতি বছর এই দিনে উল্টো পাল্টা কিছু করতে ভালো লাগে আমার। দিনটা তো আমার তাই এইদিনে আমি যা ইচ্ছে হয় করি। তবে সেটা অচেনা বা দূরের লোকেদের সাথে করি।

-ও… birthday মানুষ তার কাছের মানুষ আর ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে করে বলে জানতাম আমি। whatever, wish you a very happy birthday.

-ধন্যবাদ। আমি যে গতানুগতিক ধারার নই সেটা তো প্রথম দিনেই বুঝেছেন। বাই দ্যা ওয়ে, খাবারের মেন্যু ভালো হয়েছে তো?

-হুম, খাবারও।

-খাওয়া শেষ করে আপনি জলদি তৈরি হয়ে নেবেন। আমরা বের হচ্ছি।

ফাইজ অবাক গলায় বলল- “আমরা বের হচ্ছি” মানে? কোথায় বের হচ্ছি?

-এই একটু পদ্মার পার যাচ্ছি, মাওয়াঘাট।

-কেন?

-যেতে যেতে বলব।

-আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি কী বলবেন এসব কী হচ্ছে? তাহলে আমার সুবিধা হত।

-উফ আপনি এত প্রশ্ন করেন কেন? আপনার প্রয়োজনেই যাচ্ছি। বললাম তো যেতে যেতে বলব।

-মাওয়াঘাট কোথায়, কীভাবে যেতে হয় আমি জানি না।

-আপনার ফোনটা কী বাটন ফোন?

-না, স্মার্ট ফোন। কেন?

-স্মার্ট ফোনে গুগল ম্যাপ আছে সেটা জানেন তো?

ফাইজ আর কিছু বলল না। তবে সে এবার একটু বিরক্ত হল মনে মনে। চিত্রার সাথে তার এমন কোন সম্পর্ক নেই যে চিত্রা তার সাথে এভাবে হেয়ালী করবে। তবু খাওয়া শেষ করে সে তৈরি হয়ে এলো। চিত্রা ফাইজের মুখ দেখে বুঝতে পারছে সে বিরক্ত কিন্তু কিছু বলল না। আজকের দিনটা সে মাটি করতে চায় না।

গাড়ি তখন লোকালয় ছেড়ে চলে এসেছে। রাস্তাটা নিরিবিলি, দু’পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে খোলা মাঠ। চিত্রার খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু ফাইজ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। সে চাইছিল চিত্রা আগে বলুক কী হচ্ছে? কিন্তু চিত্রা কিছুই বলছিল না। আরও কিছুক্ষণ চলার পর চিত্রা বলল-

-ইলিশ মাছ পছন্দ আপনার?

-কেন?

-কারণ আমরা আসলে কোন কাজে যাচ্ছি না। যাচ্ছি পদ্মার ইলিশ খেতে। পদ্মার ইলিশের মত ভালো খাবার পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

-আপনি এই ইলিশ খাবার জন্য আমাকে এতদূর টেনে নিয়ে যাচ্ছেন!

-এই যে বললেন “এতদূর টেনে নিয়ে যাচ্ছেন” এই কথার ভেতরেই কিন্তু কথাটা রয়েছে।

– কী কথা?

-আপনি বলেছিলেন আমাকে নিয়ে একদিন লং ড্রাইভে যাবেন। আপনি জানেন তো আমি ঋণ রাখি না। তাই এভাবে ধরে নিয়ে এলাম আপনাকে। এবার নিশ্চই আপনার বিরক্তিভাব কাটবে?

ফাইজ কিছুটা অপ্রস্তুত হল, কী বলবে বুঝতে পারছিল না। Sorry…

-আপনি একদম sorry হবেন না। আমি আসলে একদম ছোটবেলা থেকেই মানুষের বিরক্ত মুখ দেখেই বড় হয়েছি। তাই এসব আমাকে নতুন করে নাড়া দেয় না। ছোটবেলা থেকেই কেউ কখনো আমার বন্ধু হতে চায়নি, কাছের হয়নি। সবার মাঝে থেকেও জীবনের পুরো পথ একা পাড়ি দিতে হয়েছে আমাকে। পথটা কখনোই সহজ ছিল না। আমি ইচ্ছে হলেই একটা দিন বিশেষভাবে কাটাতে পারি না। কারণ আমার কোন বন্ধু নেই! আমিও এখন আর কারো কাছের হতে চাই না। আমি তো বুঝে গেছি সমাজের চোখে আমি অপাঙতেয়! অথচ আমার খুব ইচ্ছে হয় সবাইকে নিয়ে থাকতে। অপূর্ণতা আছে বলেই হয়ত এটা বেশি করে ফিল করি।

ফাইজ চিত্রার কথায় অবাক এবং দুঃখিত বোধ করল। চিত্রা এভাবে কেন বলছে? ওর জীবনে গভীর কোন কষ্ট আছে সেটা বোঝা যায় কিন্তু সেটা কেন? ব্যক্তিগত প্রশ্নে যাওয়াটা ঠিক হবে না বিধায় সে শুধু প্রশ্ন করল- আপনি নিজেকে এভাবে কেন ভাবেন?

-বিধাতা চেয়েছে বলে এভাবে ভাবতে হয়। এই যে তিনি আমায় কালো চামড়ায় মুড়ে দিয়েছেন এটা কী আদৌ আমার দোষ? কিন্তু এর শাস্তি সারা জীবন আমাকেই পেয়ে যেতে হচ্ছে! বিধাতা চেয়েছে আমার জীবন হবে অবহেলার জীবন, অপ্রাপ্তির জীবন। ব্যক্তি আমি কখনো কারো জন্য স্পেশাল হতে পারব না।

ফাইজ কী বলবে ভেবে পেল না। চিত্রা দেখতে কালো আর এটা যে খুব বিশেষ কিছু সেটা সে কখনো আলাদাভাবে ভেবে দেখেনি। অথচ এটা নিয়ে এই মেয়ে দুর্বিষহ জীবন পার করছে! এবং তখনই খেয়াল করল সমাজ আসলেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন অসামাজিক। সে পরিবেশ হালকা করার জন্য বলল- আপনি ঋণ রাখেন না অথচ এখনো কিন্তু আমার পঞ্চাশ টাকা পরিশোধ করেননি!

চিত্রা চট করেই বুঝতে পারে না কিসের পঞ্চাশ টাকা? যখন বুঝতে পারল তখন সে শব্দ করে মন খুলে হাসল, বলল- সে টাকা আপনি জিন্দেগীতেও পাবেন না।

ফাইজ চিত্রার হাসি দেখে চমকাল, কারো হাসি এত সুন্দর হয়? এর হাসি তো সে আগে কখনো খেয়াল করেনি!! সে কোথায় যেন পড়েছিল কালো মেয়েদের হাসির সৌন্দর্য কখনো উপেক্ষা করা যায় না। যে লিখেছিল সে আসলে সত্যিই লিখেছিল।

সারাটা দিন চিত্রার ভালো কাটল। ফাইজও চেষ্টা করল তাকে যথাসম্ভব আনন্দ দেবার। তারা যখন ফিরছিল তখন চিত্রা ফাইজকে আজকের দিনটার জন্য ধন্যবাদ জানাল। ফাইজ বলল-

-আমাকে ধন্যবাদ কেন দিচ্ছেন? যা করার সব তো আপনিই করলেন!

-আপনাকে ছাড়া তো আর সম্ভব হত না। তবে আপনাকে একটা জরুরী কথা বলার ছিল…

-কী কথা?

-মাঝে মাঝে আমি খুব হাপিয়ে যাই… প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়াটা কষ্ট হয়ে যায়… আজ আসলে আমার জন্মদিন ছিল না। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চেয়েছিলাম একটু তাই আপনাকে মিথ্যে বলেছি। এই মিথ্যেটার কারণেই আপনাকে এভাবে ধরে আনার ব্যাপারটা আপনি ক্ষমা করতে পেরেছিলেন, আমার দিনটা আনন্দময় করতে সাহায্য করেছেন। নয়ত পুরো ব্যাপারটা আপনার কাছে বিরক্তিকর মনে হত! কখনো কখনো মিথ্যেরও আসলে প্রয়োজন হয়… কী অদ্ভুত না? আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা শুধুই কাজের, অফিশিয়াল। তাই আপনার সাথে এমন আচরণ অবশ্যই মানায় না। আমার এমন অদ্ভুত আচরণের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

ফাইজ চুপ করে সব শুনছিল তারপর বলল- আপনার কথার ভাজে সব সময় গভীর কষ্ট আর অভিমান লুকানো থাকে। আপনি হয়ত বাস্তবিকপক্ষে খুব দুঃখী মানুষ। আপনার এত সুন্দর ক্যারিয়ার আর মানুষ হিসেবেও আপনি চমৎকার… তারপরও কেন আপনার মনে এত কষ্ট, কিসের দুঃখ আপনি বয়ে বেড়ান জানি না। তবে যদি কখনো মনেহয় কাউকে শেয়ার করলে আপনি হালকা হবেন তাহলে শেয়ার করবেন। সেই মানুষটাকে কাছের বন্ধু বা নিকটজন হতে হবে এমন কোন কথা নেই। অনেক সময় অনেক দূরের কাউকেও সব কিছু ভেঙে বলা যায়।

-আপনি প্রফেসর মানুষ, তাই সুন্দর গুছিয়ে বলতে পারেন। কিন্তু জীবন আসলে এত সহজ না…

-জীবন কখনো সহজ হয় না, তাকে সহজ করে নিতে হয়।

ফাইজের কথাগুলো চিত্রার খুব ভালো লাগল। যদিও ফাইজের সাথে তার চিন্তাধারার অনেকটাই মিল। তবু এর কাছ থেকে শুনতে ভালো লাগে, অন্যরকম লাগে, সহজ লাগে। আচ্ছা প্রফেসর সাহেব কী চিত্রার সেই দূরের মানুষটা হতে পারে? যার কাছে চিত্রা নিজের যত যন্ত্রণা ভাগাভাগি করে নিতে পারে?

৪দিন পর ফাইজের ফোন এলো চিত্রার কাছে, তারা এখন কাজ শুরু করতে পারে। পরদিনই কাজ শুরু হয়ে গেল। মিসেস চৌধুরী চিত্রার অপেক্ষায় ছিল। মেয়েটা তার অসুখের সময় কেমন তার পাশে এসে বসত, গল্প করত… খুব মায়া জন্মে গেছে মেয়েটার উপর। মায়া জন্মানোর আরও একটা কারণ আছে, মিসেস চৌধুরীও খেয়াল করেছেন চিত্রা বুকের ভেতর অনেক যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখে কিন্তু কিসের যন্ত্রণা সেটা বোঝা যায় না। তার খুব ইচ্ছে চিত্রা সব যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসুক। যে মেয়ে অন্যের ভালো থাকা নিয়ে এত কিছু করতে পারে প্রকৃতি তার নিজের ভালো থাকাটার কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না। তিনি আজ সারাটা দিন চিত্রার অপেক্ষা করেছিল কিন্তু চিত্রা আসেনি! তিনি ফাইজকে চিত্রার কথা জিজ্ঞেস করলে ফাইজ বলেছে চিত্রার আসার ব্যাপারে সে কিছু জানে না। ফাইজ নিজেও ভেবেছিল চিত্রা আসবে… না আসায় তার কী একটু মন খারাপ হল? ফাইজ খেয়াল করেছে সেদিনের সেই ঘুরতে যাবার পর থেকে চিত্রার ভাবনা মাঝে মাঝেই টুপ করে তার মনে উঁকি দিয়ে যায়! অবশ্য এর যথেষ্ট কারণও আছে। আর সেই কারণটা হল চিত্রার ভেতরে জমানো কষ্ট। চিত্রার কোন বন্ধু নেই এই ব্যাপারটা ফাইজকে ভাবাচ্ছে। চিত্রার বুকের ভেতর অভিমানের যে পাহাড় রয়েছে সেটা কেউ একজন এসে আস্তে আস্তে ভেঙে গুড়িয়ে দিবে এমন একজন মানুষ চিত্রার খুবই দরকার।

আরও দুদিন চলে গেল কিন্তু চিত্রা আসেনি। ফাইজ ফোন করেছিল কিন্তু সে ফোন ধরেনি। ফাইজ একটু চিন্তিত হয় তাই সে চিত্রার অফিসে ফোন দেয়। জানতে পারে চিত্রা অসুস্থ, ৪ দিন যাবত অফিস যাচ্ছে না!

৫দিন ধরে চিত্রার আকাশ-পাতাল জ্বর। এন্টিবায়োটিকেও জ্বর নামছিল না। আজ সকাল থেকে জ্বর নেই, তবে শরীরের ভার যেন সে আর নিতে পারছিল না। ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে তার খুব খিদে পেয়েছে… আলু ভর্তা আর ঝাল ঝাল ডিম ভাজা দিয়ে গরম ভাত খেতে ইচ্ছে হচ্ছে মায়ের হাতে… কিন্তু আরও কতশত ইচ্ছের সাথে এই ইচ্ছেটাকেও সে চাপা দিয়ে ফেলল। সে উঠে গোসলে চলে গেল। ঠান্ডা পানিতে গোসল দিলে শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবে। তারপর সে নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে যা পারে একটা কিছু করে খেয়ে নেবে। চিত্রা গোসলে যাবার কিছুক্ষণ পর ফাইজ এসে হাজির হল। তাকে বসতে দিয়ে চিত্রার ভাবি চিত্রাকে ডাকতে চিত্রার ঘরে এসে দেখে ও গোসল করছে। দরজায় দাঁড়িয়ে চিত্রাকে ডেকে বলল- তার কোন এক ক্লাইন্ড এসেছে দেখা করতে। চিত্রা একটু অবাক হল যে, এমন কোন ক্লাইন্ড আছে যে তার বাসায় আসতে হল? সে গোসল সেরে ড্রইংরুমে এসে দেখে ফাইজ বসে আছে! ফাইজ ওকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে গেল। চিত্রাকে আজ কেমন অন্যরকম লাগছে… অসুস্থতার কারণে চেহারা একটু রোগাটে হয়ে গেছে যেটা ওর চেহারায় একটা শার্পভাব এনেছে। সদ্য শাওয়ার নিয়ে এসেছে, চুলগুলো ভেজা কেমন শান্ত স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ওকে। এই চিত্রাকে দেখতে কেমন যেন ভালো লাগছে! ফাইজ আস্তে করে বলল-

– I heard you are sick…

-প্লিজ বসুন। হুম একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছি। তবে আজ একটু সুস্থবোধ করছি। বলে চিত্রা তাকিয়ে দেখে টেবিল ভর্তি ফলমূল আর খাবারের প্যাকেট! বলল- আপনি কী এতসব আমার জন্য এনেছেন?

– রোগীর জন্য।

-আপনি তাহলে আমাকে রাক্ষস ভাবেন!

– ফাইজ একটু হাসল তারপর বলল- রাক্ষস ভাবিনি। আপনি কী খেতে পছন্দ করবেন বা অসুস্থ মুখে কী খেতে ভাল লাগবে সেটা আমার জানা নেই, তাই…

– তাই আপনি পুরো বাজার তুলে এনেছেন?

-ফাইজ হেসে বলল- “সম্ভব হলে সেটাও করতাম”।

চিত্রা এই কয়দিন জ্বরে ভুগেছে অথচ বাড়ির কেউ তার খুব একটা কাছে আসেনি… সে নিজের বিছানায় পড়ে থেকে একা কষ্ট পেয়েছে। তাই ফাইজের “সম্ভব হলে সেটাও করতাম” কথাটা শুনে তার চোখে পানি এসে গেছে। সে আলগোছে সেটাকে চোখেই আটকে দিল… ভালোবাসা থেকে আসা চোখের পানি ফেলতে নেই, সেটাকে জমিয়ে রাখতে হয়। বলল- আপনি আমার জন্য এত কিছু কেন করেছেন?

– আপনিও তো করেছিলেন।

-ও… আপনি তাহলে প্রতিদান দিতে এসেছেন?

-ভালোবাসার প্রতিদান ভালোবাসাই হয়, এটা দোষের কিছু নয়। আপনি আমার অসুস্থ মায়ের জন্য করেছিলেন সেটা থেকে আমি অনেক কিছুই শিখেছি।

চিত্রা ফাইজের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটা এত সুন্দর করে বলে যে শুনতেই ইচ্ছে হয়। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল- আমি রাক্ষসের মত খেতে না পারলেও জ্বরের কারণে এই ক’দিন ঠিক মত খেতে না পারায় এই মুহূর্তে রাক্ষসের মতই খিদে পেয়েছে। চলুন আপনিও আমার সাথে নাশতা করবেন।

-এখন ক’টা বাজে দেখেছেন? নাশতার সময় অলরেডি শেষ। আর তাছাড়া দিনে দুবার নাশতা করা যায় না।

-এসব নিয়ম আমার ডিকশনারিতে নেই। কোন বাহানা না করে চলুন নাশতা করবেন।

-ধন্যবাদ। কিন্তু আমার ডিকশনারিতে অনেক নিয়ম আছে যেটা আমাকে মেইনটেন করতে হয়।

-নিয়ম তৈরিই হয় ভাঙার জন্য।

-কিন্তু সবাই নিয়ম ভাংতে পারে না। আমি আজ আসি। আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে কাজে ফিরে আসুন।

-আপনি অন্তত আর ৫ মিনিট বসুন আমি আপনার জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আসি। এটা আমি মন্দ বানাই না।

-অসুস্থ মানুষকে দিয়ে চা বানানোটা কী ভালো কাজ হবে? চা নাহয় পাওনা থাকুক অন্য কোনদিন খাওয়াবেন। বলে ফাইজ আর দেরি করল না, চলে গেল। চিত্রা তবু উঠল না, বসে রইল। ফাইজ চলে গেলেও পুরো ঘর জুড়ে তার অদৃশ্য উপস্থিতি রয়ে গেল যেন! চিত্রা সেই উপস্থিতি উপভোগ করছিল। তার মনে হল প্রফেসর সাহেব আর কিছুক্ষণ থাকলে সে পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে যেত! এমন সময় চিত্রার ভাবি এসে বলল-

-লোকটা কে? আর তোমার অসুখ শুনে এত কেন মাথা ব্যথা তার?

-এই পৃথিবীতে ৭০০ কোটি মানুষ, তার ভেতরে কেউ না কেউ থাকতেই পারে যার আমার জন্য মাথা ব্যথা করে।

-ও বাবা! তাই নাকি? সে কী আসলেই তোমার ক্লাইন্ড নাকি এর ভেতরে অন্য কিছু আছে?

-অন্য কিছু মানে?

– অন্য কিছু মানে প্রেম ট্রেম কিছু মিন করছি না ওসব তো আর তোমার দ্বারা সম্ভব না। থাকে না… কাজ পাওয়ার জন্যও তো মানুষ কত কী করে…

চিত্রা চিৎকার করে বলল- ভাবি! সীমা অতিক্রম করে ফেল না। সেটা কোনভাবেই ভালো হবে না কিন্তু। বলে চিত্রা এ ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছিল আর তখনই খেয়াল করল ফাইজ দরজায় দাঁড়িয়ে! চিত্রা হতভম্ব হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল- আপনি?

ফাইজ আমতা আমতা গলায় বলল- গাড়ির চাবিটা ফেলে গিয়েছিলাম…

চিত্রা দেখল চাবিটা টেবিলের উপর পড়ে আছে, সেটা তুলে ফাইজের হাতে দিতেই সে আর এক এমুহূর্ত দাঁড়াল না চলে গেল। চিত্রা খুব বিব্রত হল… ফাইজ কিছু শুনে ফেলল না তো?

চলবে।