অবেলায় বসন্ত পর্ব-০৬

0
272

অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৬)
লেখাঃ শামীমা জামান

চিত্রার সমস্ত দিন কাটল এলোমেলো ভাবনার ভেতর দিয়ে। কাজে মনোযোগী হতে পারল না কিছুতেই। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না আজকের দিন কীভাবে কেমন করে শুরু হয়েছে। যাকে সে স্বপ্নেও নিজের করে ভাবতে পারেনি সে কিনা নিজেই বাস্তব হতে চাইছে! চিত্রা কী এটাকে সত্য বলে ভাবতে পারে? নাকি পুরো ব্যাপারটা কল্পনা কেবল? নাকি ঘুম ভাঙলেই ভোজবাজির মত সব হাওয়া হয়ে যাবে? আর যদি সত্যি হয় তাহলে তার কপালে কী এত সুখই লিখা ছিল? চিত্রা কী এত সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে?

চিত্রার রাত কাটল ছাড়া ছাড়া ঘুম দিয়ে। সে সকাল সকাল উঠে পড়ল। নামাজ পড়ে চা হাতে বারান্দায় গেল। সকালের এই সময়টা তার খুব প্রিয়। চা পান করতে করতে দেখল বাসার সামনে সাইকেল নিয়ে একটা ছেলে এলো। তাদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে গেল। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে চিত্রার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। চিত্রা এতক্ষণে চিনতে পারল, ফাইজ! একটা টি শার্ট, শর্টস, মাথায় ক্যাপ পরে আছে তাই হুট করেই এই বেশে তাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু প্রফেসর সাহেব এত সকালে এই বেশে এভাবে এখানে কী করছে? ফাইজ তখন আবার ডানে বামে তাকিয়ে তার টি শার্টের ভেতর থেকে একটা বড় খাম বের করে তাকে দেখিয়ে তাদের বাড়ির গেটের উপর দিয়ে ছুড়ে মেরে চলে গেল! চিত্রা পুরো ব্যাপারটায় হকচকিয়ে গেল তারপর দৌড়ে নিচে গিয়ে খামটা তুলে আনল। তারপর নিজের ঘরে এসে খামটা খুলল- ভেতরে একটা কার্ড আছে যার উপর দুটো ছোট বাচ্চার ছবি, ছেলে বাচ্চাটা মেয়ে বাচ্চাটার হাত ধরে কপালে কিস করছে আর উপরে লিখা “I love you”! কার্ডের সাথে কস্টেপ দিয়ে একটা লাল গোলাপ আটকানো। চিত্রা এর মানে কিছুই বুঝল না। আর তখনই তার ফোনে ম্যাসেজ এলো ফাইজের-

“টিনএজ ছেলে মনে হচ্ছে তো?”

চিত্রার হাসি পেয়ে গেল, কেমন সুখ সুখ আনন্দময় হাসি। প্রফেসর সাহেব তো সত্যিই টিনএজ হয়ে গেছে! তাও ৯০ এর দশকের টিনএজ।

চিত্রা অফিসে এসেছে ২ ঘন্টা হয়েছে। একটা ফাইল চেক করছিল এমন সময় তার কলিগ উদয় এলো। এই কলিগের সাথে চিত্রার সম্পর্কটা একটু আলাদা, বন্ধুর মত অনেকটা। সে এসে একটা খাম চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দিল। চিত্রা সেটা হাতে নিতে নিতে বলল- কী এটা?

-চিঠি।

-চিঠি? কে দিল? খামের উপর তো কিছু লিখা নেই!

-আপনার লাভার দিয়েছে।

চিত্রা অবাক গলায় বলল- লাভার?

-হুম, আমার হাতে দিয়ে বলল “এটা চিত্রাকে দেবেন প্লিজ, জিজ্ঞেস করলে বলবেন তার লাভার দিয়েছে।” বললাম, আপনি অফিস অব্দি এসেছেন নিজে দিয়ে আসুন? কিছুতেই রাজি হল না। ভদ্রলোক তো আমাদের ক্লায়েন্ট ছিল কিছুদিন আগেই কাজ শেষ হল তার। ঘটনা কী বলুন তো? ওনার মত একজন মানুষ এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করছে?

চিত্রা পুরোপুরি অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না চিঠি কোন লাভার পাঠিয়েছে। বলল- ঘটনা আমিও বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আমি দেখছি কী হয়েছে। উদয় চিত্রার অপ্রস্তুত ভাব দেখে চলে গেল। সে চলে যেতেই চিত্রা চিঠি বের করল, তাতে লিখা-

“প্রিয় ভালোবাসার চিত্রা,
” ফুলের মত দেখতে তুমি, চাঁদের মত হাসি
সত্যি করে বলছি
আমি তোমায় ভালোবাসি।”

“গাছের পরাণ মাটি
আর আমার পরাণ তুমি
তোমার জন্য পৃথিবীতে জন্ম নিলাম আমি।”

“তুমি আমার জীবন সাথী
তুমি আমার সব
আমি তোমায় ভালোবাসি
বলে দিলাম আজ”

“আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটারে… এই জগতে পরাণ বন্ধু দিও তোমার মনটারে”

“তুমি আমার চাঁদ আমি চাঁদেরই আলো। যুগে যুগে আমি তোমায় বাসব ভালো।”

“কী দিয়া মন কাড়িলা ও বন্ধুরে, অন্তরে পিরিতির আগুন জ্বালাইলা”

“আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে
ধুত্তর ধুত্তর ধুত্তর ধুর সানাই বাজিয়ে
যাব তোমায় শ্বশুরবাড়ি নিয়ে”

তোমার লাভার”
চিঠির শেষে একটা লাভ আঁকানো। আর খামের ভেতর বেশ কিছু গোলাপের পাপড়ি দেয়া।

চিত্রার ভীষণ হাসি পেল চিঠি পড়ে। এই লোকটা তো আসলেই পাগল একটা! তখন ফাইজের ফোন এলো। ফোন ধরতেই বলল- চিঠি পেয়েছ?

-এসব কী শুরু করেছেন আপনি?

-প্রেম।

-আমার কলিগের হাতে দিয়ে পাঠিয়েছেন কেন? তাও আবার এসব বলে?

-দেখো টিনএজ ছেলেমেয়েরা 9/10 অথবা ইন্টারে পড়ুয়া হয়। আর তারা তাদের প্রেমিক/প্রেমিকাকে চিঠি তার বন্ধুর হাতে দিয়েই পাঠায়। আমিও তাই করেছি।

-তাই না? এসব উটকো চিঠি পেলে মেয়েরা তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালের কাছে জমা দিয়ে নালিশ করে। করব নালিশ?

-আমি তো তোমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ি না। নালিশ করবে কী করে?

-তাহলে বাড়ি গিয়ে লাভারের মায়ের কাছে নালিশ করব।

-এত কষ্ট করে ক্লাস নাইনের এক ছেলে জোগাড় করে তার কাছ থেকে আইডিয়া নিয়ে তারপর রাতভর বাংলা সিনেমার গান, কবিতা ঘেটে মাথা ঘামিয়ে এত রোমান্টিক একটা চিঠি লিখলাম আর সেটার বিপরীতে তুমি আমাকে মার খাওয়াতে চাইছ? ভেরি স্যাড।

চিত্রা হাসি চেপে বলল- টিনএজ মেয়েরা এমনই।

-তাহলে মার খেতে হবে?

-না, এসব থেকে স্টপ হয়ে যান।

-উহু, মার খেয়ে হলেও যদি ভালো কিছু হয় তাহলে মার খাওয়াই ভালো। বলে ফাইজ লাইন কেটে দিল। চিত্রা চিঠিটা আবার পড়ল… কীসব অদ্ভুত হাস্যকর কথাই না লিখেছে। তার মুখ থেকে হাসি যেতেই চাইছে না। এ হাসি প্রগাঢ় ভালোবাসার হাসি, সুখের হাসি।

বিকেলে বারান্দা থেকে কাপড় তুলতে গিয়ে চিত্রার মা জাহানারা বেগম দেখলেন একটা ছেলে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে এখানে ঘুরঘুর করছে আর বার বার তাদের বারান্দার দিকেই তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন সন্দেহজনক! ছেলেটাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা দরকার। তাই সে নিচে নেমে গেল। এদিকে চিত্রা অফিস থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে চা হাতে বারান্দায় গেল। বুলবুলির ৪টা বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাগুলো খানিকটা বড় হয়েছে, খুব কিচিরমিচির করে। দেখতে ভালো লাগে। সে বারান্দায় গিয়ে দেখল ফাইজ সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রাকে দেখেই হাত নেড়ে টিশার্টের ভেতর থেকে একটা খাম বের করে চিত্রাকে দেখিয়ে গেটের উপর দিয়ে ছুড়ে মারতেই জাহানারা বেগম চেচিয়ে উঠল- এই কে ওখানে? ফাইজ সাথে সাথে দৌড়ে সাইকেলের কাছে চলে গেল আর জাহানারা বেগম চিৎকার করে তাকে ডেকে যাচ্ছে এই ছেলে, এই কোথায় যাচ্ছ দাঁড়াও বলছি… ফাইজ কোনদিকে না তাকিয়ে সাইকেল নিয়ে দ্রুত চলে যেতে লাগল। কিছু দূর গিয়ে একবার পেছনে তাকাল দেখল তার দেয়া খামটা মহিলার হাতে! সে দাঁতে জিভ কেটে চলে গেল। এদিকে পুরো ঘটনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিত্রা দেখল, হাসতে হাসতে তার পেটে খিল ধরে গেল। চিত্রার মা উপরে আসতেই চিত্রা বলল- কী হয়েছে মা?

-আরে কোথা থেকে এক ছোকরা এসে সেই কখন থেকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কী সমস্যা জানতে নিচে যেতেই এই কান্ড। নিশ্চই বিল্ডিং এর কোন মেয়ের কাছে এসেছিল। আমাকে দেখে পালিয়েছে।

চিত্রা বলল- দেখি খামটা? আমাকে দাও

-তুই এটা দিয়ে কী করবি?

-দেখি কী আছে এতে…

জাহানারা বেগম খামটা চিত্রার হাতে দিয়ে চলে গেল।

চিত্রা খামটা নিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। এসে দেখে তার ফোন বাজছে, হাতে নিয়ে দেখে ফাইজ। ফোন ধরে চিত্রা হাসতে লাগল। ফাইজ বলল-

-খুব মজা পাচ্ছ না? এই বয়সে এভাবে তাড়া খেতে কেমন লাগে বুঝতে পারছ? ধরা পড়ে গেলে কী কেলেঙ্কারি হয়ে যেত!

চিত্রার হাসি আরও বেড়ে গেল। হাসি সামলে বলল- কেন আপনি তো টিনএজ ছেলে, আর এই বয়সী ছেলেদের এরকম তাড়া খেয়ে অভ্যাস থাকে।

-বলেছে তোমাকে। ভদ্রমহিলাকে বেশ কড়া মনে হল, চেনো নাকি?

-হুম, ভদ্রমহিলা একটু কড়া না অনেক বেশিই কড়া। তিনি আমার মা। আপনাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়েছে তার তাই জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিল এখানে কী চাই আপনার।

-কী সাংঘাতিক! পড়বি তো পড় মালির ঘাড়েই! চিঠিটার কী গতি হবে তাহলে?

-মা তো জানে না ওটা কার জন্য তাই নিয়ে নিতে অসুবিধে হয়নি।

-এর মধ্যে চিঠি নেয়াও হয়ে গেছে! চিঠির জন্য এত ভালোবাসা আর আমার জন্য?

-কচু।

-কচু কিন্তু পুষ্টিকর একটা খাবার। তবে ভাগ্যিস তোমার মা এটা বোঝেননি যে আমি কার জন্য এসেছিলাম। এরপরেও আমাকে দেখলে তো তিনি পুলিশে খবর দিয়ে বসবেন মনে হচ্ছে।

-সেটাই তো মনে হচ্ছে।

-কিন্তু গল্পের স্ক্রিপ্টে তো ভিলেনের উল্লেখ ছিল না।

-ভিলেন ছাড়া গল্পে টুইস্ট থাকে নাকি?

-আরামে বসে বসে লাভ লেটার পাচ্ছ তো তাই বুঝতে পারছ না তাড়া খেতে কেমন মজা লাগে।

চিত্রা হাসতে হাসতে বলল মি. তাড়া খেতে পছন্দ করা লোক আমি এবার ফোন রাখছি কারণ খুব জরুরী একটা লেটার আমার হাতে এসেছে সেটা পড়া দরকার আগে।

-চিঠিটা জরুরী হলো, আমি কবে জরুরী হব?

চিত্রা মুচকি হেসে ফোন রেখে দিল। তার মনে হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় পার করছে সে!

পরদিন সকালে চিত্রা অফিসের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে নেয়। রিকশা গলির মাথায় যেতে যেতেই সাইকেল নিয়ে ফাইজ হাজির হয়। মুখে একটা গোলাপ কামড়ে ধরে রাখা। রিকশার কাছে আসতেই রিকশা থামাতে বলে ফুলটা চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দেয়। চিত্রা কপট রাগ দেখিয়ে বলে- রাস্তাঘাটে এসব কী হচ্ছে?

ফাইজ চিত্রার হাতে ফুলটা গুজে দিয়ে “এইজন্য” বলে চলে গেল। চিত্রা দেখল ফুলটার গায়ে ছোট্ট একটা কাগজ মোড়ানো। খুলে দেখল তাতে লিখা- “ভালোবাসি তোমাকে” চিত্রা মুখ টিপে হাসল।

চিত্রার আজ নতুন প্রজেক্টের কাজ দেখতে যাবার কথা। সে ঠিক করল দুপুরের আগে যাবে তারপর কাজ শেষ করে লাঞ্চ করে ফিরবে। অফিসে হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে ১১টার দিকে সে যখন বের হতে যাবে তখন উদয় এসে তার দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলল- আপনার লাভার এটা আপনাকে দিয়ে গেছে আর যদি একটু বাইরে আসতেন তাহলে দেখতে পেতেন তিনি অফিসের বাকি স্টাফদের জন্য কী দিয়ে গেছেন।

-মানে!

-উদয়ের মুখে চাপা হাসি। বলল- মানে আপনার লাভার বয় সকল স্টাফের জন্য ফুচকা পাঠিয়েছে। এলেই দেখতে পাবেন। সবাই খুব এনজয় করছে।

চিত্রা বিস্মিত হয়ে গেল, বলল- ঠিক আছে আপনি যান আমি আসছি। উদয় চলে যেতেই চিত্রা তার কেবিন থেকে বের হয়ে দেখে সবাই ফুচকা খাচ্ছে। তাকে দেখে সবাই মুখ টিপে হাসতে লাগল। সেই সাথে তার দিকে নানা রকম প্রশ্ন ছুটে আসতে লাগল। চিত্রা কী বলবে ভাষা হারিয়ে ফেলল। কোনরকমে তাদের এটা ওটা বুঝিয়ে নিজের কেবিনে ফিরে এলো, ফাইজের সাথে কথা বলা দরকার কী করছে সে এসব? ফাইজ ফোন ধরতেই চিত্রা বলল- কী করেছেন এসব?

-কোন সব?

-অফিসে সবাইকে ফুচকা কে খাওয়াতে বলেছে?

-প্রেমিকার বন্ধু-বান্ধবকে ফুচকা খাওয়ানোটা অলিখিত কিন্তু অবশ্য পালনীয় নিয়ম। সেই নিয়ম পালন করেছি।

-এরা কেউ আমার বন্ধু-বান্ধব না। কলিগ আর বন্ধু-বান্ধব এক হয় কখনো?

-আমি তো তোমার বন্ধু-বান্ধব চিনি না। তাই এদেরকেই বন্ধু মনে করে নিয়েছি।

-তাই বলে এটা আমার অফিস সেটা মাথায় রাখবেন না?

-এত কিছু মাথায় রেখে প্রেম করা যায় নাকি?

-আপনি এসব বন্ধ করুন।

-তুমি কী তাহলে “হ্যাঁ” বলছ?

-অফিসের সবাই হাসছে।

-ব্যাপারটাকে এভাবে দেখো যে, সবাই জানতে পারছে তোমার জন্য কেউ একজন এক আকাশ ভালোবাসা লালন করে বুকে।

-চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলল…

-“I love you Chitra.”

-“আপনি একটা পাগল” বলে চিত্রা ফোন রেখে দিল। তারপর খাম খুলে চিঠি বের করে পড়ল। তাতে লিখা-

“প্রিয় চিত্রা,
আজ পৃথিবীতে যত ফুল ফুটেছে সেই সমস্ত ফুলের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নিও।

চিত্রা তুমি কী জানো তুমি যখন রেগে যাও তখন তোমাকে দেখতে অনেক ভালো লাগে। তুমি যখন অবাক হয়ে তাকাও তখনও তোমাকে দেখতে অনেক ভালো লাগে। তুমি যখন বারান্দা থেকে আমার দিকে তাকাও তখন অনেক বেশি ভালো লাগে। আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তুমি যদি এখনো আমাকে বিশ্বাস না করো তাহলে পরের চিঠিটা আমি আমার হাত কেটে রক্ত দিয়ে লিখব।

” ভালোবাসা বুকের ভেতর হয়েছে নিঃশ্বাস,
তোমার প্রেমে বেঁচে আছি এই তো বিশ্বাস।”

তোমার লাভার

বিঃ দ্রঃ এই বয়সে এইসব টিনএজ টাইপ ভাষা লিখতে অনেক ভাবতে হয়, কষ্ট করতে হয়। জোকার জোকার লাগে নিজেকে। আর কত?”

চিত্রা হেসে ফেলল। নাহ এই পাগল লোকটাকে থামানো দরকার। মায়ের কাছে ধরা পরেছে, অফিসের সবাইকে জানিয়ে বেড়াচ্ছে, পাড়ার লোকের জন্য মুখরোচক গল্প হতেও আর দেরি নেই। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। তাছাড়া টিনএজ বাচ্চাদের মত একে কোন ভরসা করা যায় না। সত্যি সত্যিই হয়ত পরের চিঠি হাত কেটে লিখে নিয়ে আসবে। কিন্তু করবেটা কী চিত্রা? ফাইজকে সে নিজেও পছন্দ করে, অনেক বেশিই করে কিন্তু তাই বলে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস সে করতে পারে না। তার কী এত বড় স্বপ্ন দেখা সাজে? যদি স্বপ্ন ভাঙে? স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রণা সয়ে নেবার ক্ষমতা কী তার আছে?

রাতে বিছানায় বসে ল্যাপটপে নাটক দেখার চেষ্টা করল চিত্রা কিন্তু দেখা হচ্ছে না কিছুই। তার মন দখল করে বসে আছে ফাইজের ভাবনা। ফাইজের সাথে দেখা করে সব কিছু ক্লিয়ার করা দরকার। সে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল ফাইজ কল করেছে। ফোন সাইলেন্ট থাকায় দেখতে পায়নি। ২৭ টা মিসড কল! আবার কল এলো, চিত্রা ফোন রিসিভ করতেই ফাইজ বলল- ঘুমিয়ে গিয়েছিলে নাকি?

-না, নাটক দেখছিলাম।

-তোমাদের এলাকার মশাগুলো এত অভদ্র কেন? কী করে জামাই আদর করতে হয় কিছুই জানে না!

-চিত্রা অবাক হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে জানালার পর্দা অল্প সরিয়ে দেখল ফাইজ নিচে দাঁড়িয়ে! রাত বাজে ১২ টার বেশি এত রাতে এখানে কী করছে!

-হ্যালো… কোথায় গেলে?

-আপনি এত রাতে এখানে এসেছেন কেন?

-তোমাকে দেখতে। তুমি জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি না দিয়ে একটু বারান্দায় এসো না?

-পুলিশের ভয় নেই আপনার? ডাকব মাকে?

-আন্টির ভয়েই তো এত রাতে আসতে হলো। বিচ্ছু মশা আমার সবটুকু রক্ত খেয়ে ফেলার আগে ৫ মিনিটের জন্য বারান্দায় এসো। নয়ত আগামীকালের চিঠি লিখার জন্য গায়ে রক্ত বলে কিছু থাকবে না।

-চিত্রা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

ফাইজ তাকে দেখে হাত নাড়ল। তারপর বলল- আজ আকাশে চাঁদ ওঠেনি কিন্তু চাঁদের হাসি না দেখে আমার ঘুম আসছিল না। তাই চলে এসেছি।

-চাঁদ খুঁজতে এই অন্ধকার গলিতে এসেছেন? যেখানে অমাবস্যা ছাড়া কিছু নেই!

-Chitra, I’m telling you for the last time, don’t hurt me like this.

ফাইজের বলায় গাঢ় অভিমান আর কর্তৃত্বের সুর ছিল তাই চিত্রা আস্তে করে বলল- sorry…

ফাইজ কোন কথা বলল না। চিত্রা বলল- বাড়ি চলে যান, আর কত মশার সেবা নেবেন? কাল আর দয়া করে চিঠি লিখার দরকার নেই। বিকেলে বরং অফিস শেষ করে আমি কফিশপে আসব। কথা হবে।

-তাহলে আরও ৫ মিনিট থাকো। তোমাকে দেখি, কথা বলি?

-তাহলে সাথে করে মশার কয়েল নিয়ে আসতেন?

-এটুকু সেবা তো তুমিও দিতে পারো?

-তখন আপনি ৫ মিনিটের জায়গায় ৫ ঘন্টা চেয়ে বসবেন।

-very smart! তারিয়ে দিচ্ছ তাহলে?

-হুম দিচ্ছি।

-ঠিক আছে যাচ্ছি। তারিয়ে দিচ্ছ বলে যাচ্ছি না। ৫ মিনিট শেষ হয়েছে বলে যাচ্ছি। good night.

ফাইজ চলে গেল… চিত্রা সেদিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। চিত্রার ইচ্ছে করে এই লোকটাকে সে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে কিন্তু চাইলেই কী সব হয়? সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল… তারপর কাল দেখা করে কী বলবে সে ভাবনায় ডুবে গেল।

চলবে।