অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০১

0
583

অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_০১

“আপেলের কেজি কত করে ভাইয়া?”

ফোনে কথা বলা অবস্থায় কারো কণ্ঠস্বর শুনে ঘুরে তাকালো আয়ান! আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো ফল বিক্রেতা নেই! ভ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে আবার ফোনে কথা বলায় মনোযোগ দিলো ও।
“কি হলো বলছেন না যে?কত করে কেজি?”
এবার আয়ান ভ্রু কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকালো।সাদা গোল কামিজ পরিহিত মেয়েটির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিজের দিকে তাকালো।মেয়েটি যে তাকেই জিজ্ঞেস করছে এ নিয়ে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই ওর!কিন্তু ওকে ঠিক কোন দিক দিয়ে ফল বিক্রেতা লাগছে এর উত্তর পেলো না!

“সরি?”
“বাহ আপনি ইংরেজিও জানেন?”
আয়ান এবার ভরকে গেলো।
“মানে?”
“আরে আজকালকার ফল বিক্রেতারা এত সুন্দর স্টাইল করে জানতামই না!আবার আপনি দেখছি ইংলিশও বলতে পারেন!তাহলে ফল বিক্রি করেন কেনো?”
মেয়েটির এমন আজব কথা শুনে নিজের দিকে তাকালো আয়ান!নিজেকে একবার পরখ করে নিলো!না,কোনদিক দিয়েই তাকে ফল বিক্রেতা মনে হচ্ছে না।যদি লুঙ্গি টুঙ্গী পড়তো তাও ভেবে দেখতো।কিন্তু সে টিশার্ট আর জিন্স পড়ে আছে!
“আচ্ছা ,বাদ দিন!হতেই পারে..মডার্ন যুগের বলে কথা!এবার দাম বলুন তো কত করে?”
“ই’ডি’য়ে’ট!”
আয়ানের ধমক খেয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো মেয়েটি! ভয়ে কাঁধে থাকা সাইড ব্যাগের বেল্ট মুঠোয় করে নিলো।লম্বা শ্বাস নিয়ে বির বির করতে করতে বলল,”না ,না!ভয় পেলে চলবে না!নাহলে ওরা ভীতু বলবে!”
ভেবেই বুকে ফু দিলো!সাহস যুগিয়ে আয়ানের দিকে তাকাতেই আবার চুপসে গেলো।আয়ানের পিছে দেয়ালের আড়ালে উঁকি ঝুঁকি মা’রা দুই পে’ত্নীকে ভ’য়’ঙ্ক’র গা’লি দিয়ে বলতে লাগলো,”কাস্টমারদের সাথে এ কেমন বিহেভিয়ার?ম্যানারস নেই?”

আয়ানের রাগ আকাশ ছুঁই ছুঁই। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আমাকে তোমার ফল বিক্রেতা মনে হয়?”

“ওমা মনে না হওয়ার কি আছে?ভ্যানের কাছে তো একমাত্র আপনিই আছেন!”

তখনই এক মধ্যবয়স্ক লোক আয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,”এই লন আপনার ভাঙতি টেহা।আম্মাজান কি লইবেন?ওই আসলে এই আব্বার কাছে খুচরা নোট আছিলো না,তাই ভাঙ্গাইতে গেছিলুম।কন কি লাগবো?”

মেয়েটি কিছুক্ষণ আশে পাশে তাকিয়ে মুখ লুকানোর ফন্দি আটলো,কিন্তু লাভ হলো না।মেকি হাসি দিয়ে বলতে লাগলো,”আসলে কি হয়েছে বলুন তো?এখন তো মডার্ন যুগ।তাই ভেবেছিলাম আপনিও হয়তো মডার্ন ফল বিক্রেতা। আজকাল তো ভিক্ষুকও মডার্ন হয়।”

তখনই এক রিকশা দেখিয়ে বললো,”ওই দেখুন!রিকশা চালকও কি মডার্ন!কেও বলবে ও রিকশা চালায়?”

বলে নিজেই হাসতে লাগলো।একটু পর লক্ষ্য করলো আয়ান ঠিক একই ভাবে তাকিয়ে আছে।আবারও মেকি হাসি দিয়ে বললো,”সরি ভাইয়া!বুঝতে পারি….”

আর কিছু বলার আগেই সজোরে থা’প্প’ড় পড়লো ওর গালে।ওর মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেলো।বাম হাত আস্তে আস্তে নিজের বাম গালে চলে গেলো।দেয়ালের আড়ালে দাঁড়ানো দুজন মেয়েও চট করে নিজেদের গালে হাত দিলো।কেও কল্পনাই করেনি এরকম কিছু হবে।ফল বিক্রেতাও অবাক!আয়ান হেঁটে এগিয়ে গেলো নিজের বাইকের দিকে।কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে ভ্যানের কাছে রাখা নিজের হেলমেট আর ফলের প্যাকেট নিলো।মেয়েটি এখনও ওইভাবেই তাকিয়ে আছে হা করে!বিস্ময় জেনো ওর কাটছেই না!আয়ান হাত দিয়ে ওর মুখ বন্ধ করে আবারও বাইকের কাছে গেলো।হেলমেট পড়ে বাইক এক টানে নিয়ে গেলো মেয়েটির দৃষ্টি সীমানার বাইরে।আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো মেয়ে দুটি।তার মধ্যে একজন আহ্লাদী কন্ঠে বললো,”আয়ু!তুই ঠিক আছিস? ”

মেয়েটি নিরুত্তর।সে এখনও সামনের দিকে তাকিয়ে।
“এই ইভা!আয়ু বো’বা টো’বা হয়ে গেলো নাকি?”

“বুঝছি না রে সীমা!ও তো কথাই বলছে না।”

সীমা এবার মেয়েটির কাছে গিয়ে মৃদু চিৎকার করে বললো,”আয়ুশী!”
এবার আয়ুশী ফুঁফাতে লাগলো।এতে সীমা আর ইভা দুইজন ভরকে গেলো।আস্তে আস্তে ওর ফুফিয়ে কাঁদার আওয়াজ বাড়তে লাগলো!সীমা,ইভা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না!বাজারের প্রায় লোক ওদের দিকে তাকিয়ে আছে…অতঃপর দুইজন ওকে ধরে একটু নিরিবিলি রাস্তায় নিয়ে গেলো। আয়ুশী হিচকি তুলে কেঁদে যাচ্ছে!ওরা দুইজন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না!

“আয়ু!খুব বেশি ব্যাথা করছে গাল?”,চিন্তিত কণ্ঠে বলল সীমা!

আয়ুশী নাক টেনে তীক্ষ্ণ চোখে সীমার দিকে তাকালো।

“দরদ দেখাচ্ছিস, হ্যাঁ?তোদের জন্য আমার এই হাল। চিনা নেই জানা নেই হুট করে অপরিচিত এক ব্যাক্তির হাতে ভরা বাজারে এভাবে চ’র খেলাম!”
বলেই আবার নাক টানতে লাগলো!
“আরে আমরা কি জানতাম নাকি যে লোকটা তোকে মা’র’বে!আর তোরই বা কি দরকার ছিল নিজেকে সাহসী প্রমাণ করতে ওই সীমার কথা শুনে যাওয়ার?”
বিরক্ত নিয়ে বললো ইভা।
“আব…দেখ আয়ু!আমি তো জাস্ট ছোট্ট ডেয়ার দিয়েছি যে ভ্যানের কাছে দাঁড়ানো ওই লোকটাকে তুই ফল ওয়ালা ভেবে আলাপ করবি যতক্ষণ না ওই ফল ওয়ালা তার ভাঙতি নিয়ে ফিরে!এখন লোকটাকে দেখে তো শান্ত মেজাজের মানুষই লাগলো!আমি কি করে জানবো?উনি এমন একটা কাজ করে ফেলবে?”,ঠোঁট উল্টিয়ে বললো সীমা।
আয়ুশী আর কিছু বললো না। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেলো একটু! টিস্যু দিয়ে নাক মুছতে নিবে তখনই ওর ফোন বেঁজে উঠলো!স্ক্রিনে আম্মু নামটা জ্বলজ্বল করছে…রিসিভ করার পর কিছু বলবে তার আগেই মরিয়ম বেগম উরফে ওর মা বলতে শুরু করলেন,”কই তুই?”
আয়ুশী নাক টেনে বললো,”বাজারের রাস্তায়,মানে ভার্সিটির কাছাকাছি!কেনো?”
“আরে তোর বেলাল আঙ্কেলের এ’ক্সি’ডে’ন্ট হইছে!”
আয়ুশী বিস্ময় নিয়ে বললো,”কিভাবে?”
“সঠিক জানি না,বললো যে ভার্সিটিতেই যাচ্ছিলো।কিন্তু মাঝ পথে কোন গাড়ির সাথে উনার ধা’ক্কা লাগে! পায়ে গুরুতর আ’ঘা’ত পেয়েছেন শুনলাম!”
“বুঝলাম না,ভার্সিটি কি উনি হেঁটে হেঁটে আসছিলেন?”
“হ্যাঁ,ভার্সিটি ওদের পাশেই তো!”,(তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো মরিয়ম)
“উফ..হেয়ালি না করে বলো না!”
“তুই কি কাঁদছিস নাকি?গলা এমন শোনাচ্ছে কেনো?আর নাক টানছিস মনে হচ্ছে?কি হয়েছে তোর?ঠিক আছিস তুই?”,মরিয়ম বেগম বিচলিত কণ্ঠে বললেন!
আয়ুশীর মন আবার বিষাদে ছেয়ে গেলো।বাড়িতে মা-বাবার কাছে ব’কা খাওয়া,মা’র খাওয়া এক জিনিস!আর ভরা বাজারে অপরিচিত কারো মা’র খাওয়া আরেক জিনিস!এভাবে ভরা বাজারে মা’র খাওয়াটা যে কতটা অপমানজনক ।মূলত অপমানবোধই ওর কান্নার কারণ!কিন্তু এটা তার জননীকে ভুলক্রমেও বলা যাবে না!নাহলে নির্ঘাত তুফানকে ইনভাইট করা হবে…
“ওই মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে,তাই এমন!”
“এইতো ,সেদিন তো বলেছিলাম! আইসক্রিম খাস না,ঠাণ্ডা লাগবে!কিন্তু কে শোনে কার কথা?দেখলি?ঠিক ঠাণ্ডা লাগলো!”
আয়ুশী এবার ফুঁসে উঠে বললো,”তোমার সেদিন মানে এক মাস আগের কথা,এক মাস আগে খেয়েছিলাম!তার ফল বুঝি এখন হবে?”
“কেন ?ওটার ইফেক্ট পড়তে একটু তো টাইম লাগবেই তাই না?”
“হ্যাঁ,এটা তো ওষুধ!তাই ধীরে ধীরে কাজ শুরু করছে!”
“এই তুই আমার সাথে তর্ক করছিস?আমার থেকে বেশি বুঝিস তুই?আমি তোর পেটে হইছি নাকি তুই আমার পেটে হইছিস?বাড়ি আয় তারপর বুঝাচ্ছি তোকে!”
আয়ুশী এবার সুর নরম করলো,কারণ এবার চিল্লালে বাড়িতে যেতেই ওর গালে আরো দুইটা চ’র পড়বে!তার চেয়ে বরং সুন্দর করে কথা বলুক!
“উফ,আম্মু!কোন কথায় ছিলাম,আর তুমি কোন কথায় আসছো?”
“ও হ্যাঁ,তো কি যেনো বলছিলাম!”
আয়ুশী লম্বা শ্বাস নিলো,আপাতত কোনো প্রকার রাগ দেখানো যাবে না।নাইলে উত্তম মধ্যম চলবে!
“আঙ্কেলের এ’ক্সি’ডে’ন্ট!”
“ওহ হ্যাঁ,তো উনাদের গাড়িতে কি সমস্যা হয়েছে!তাই রিকশা করেই যাচ্ছিলো।মাঝ পথে আরেক গাড়ির ধা’ক্কা’য় উনি সহ রিকশা উল্টিয়ে যায়,তাই পায়ে আঘাত পায়!এখন হসপিটালে!আসার সময় দেখা করে আসিস তো!আমি তো তোর বাবা ছাড়া একা একা যেতে পারি না!আর ঘরেও কাজ..সেই সাথে এত পুরনো আত্মীয় ,না দেখতে গেলেও খারাপ দেখায়!”

“আচ্ছা ,ঠিক আছে!”

“আর শুন,ফল টল পেলে নিয়ে নিস!”

“মোটেও না!”,মৃদু চিৎকারে বললো আয়ুশী!
“তোর আবার কি হলো?”
আয়ুশী একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,”ফল দিয়ে কি হবে?আর আমার কাছে কি এত টাকা হবে নাকি?”
“ওহ তাও ঠিক,আচ্ছা! বুকেট নিয়ে যাইস কমের মধ্যে! টাকা কম হলে সীমা বা ইভার থেকে নিস! পরে দিয়ে দিস!”
“আচ্ছা,রাখো!আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!ভার্সিটির সামনে আমি!”
বলেই রেখে দিল।কথার মাঝেই সীমা আর ইভার তাড়ায় হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলো ওরা!
“ভাই,আজকে ফার্স্ট ক্লাস মিস হয়ে গেলো!”,আফসোসের সুরে বললো সীমা!
“চল ,সেকেন্ড ক্লাসে যাই!নাইলে কেমিস্ট্রি ক্লাসেরও দফারফা হবে!”,ইভা তাড়া দিয়ে বললো।
ওদের কথার মাঝেই ফোড়ন কেঁটে আয়ুশী বলে উঠলো,”কেমিস্ট্রি ক্লাস হবে না!”
“তুই জানলি কিভাবে?”(ইভা)
“স্যার এর এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে!”, পরে সম্পূর্ণ ঘটনা বললো।
“তো ভার্সিটির পর আমরা যাচ্ছি স্যার কে দেখতে?”,সীমা উৎসাহের সহিত প্রশ্ন করলো।
আয়ুশী মাথা নাড়লো।
ইভা হামি তুলতে তুলতে বললো,”চল বাকি ক্লাস গুলো করি!”
তিনজনই ক্লাসে চলে গেলো।
_______________________________
হসপিটালের সামনে বাইক থামালো আয়ান!বাইক এক পাশে পার্ক করে ফলের প্যাকেট নিয়ে রিসিপশন থেকে মিস্টার বেলাল আহমেদ এর কেবিন জেনে উপরে চলে গেলো ও।
কেবিনের দরজা ঠেলে মাথা সামান্য উকি দিয়ে বললো,”আসতে পারি মাস্টার মশাই?”
বেলাল সাহেব তখন নিজের অর্ধাঙ্গিনী নাহারের হাতে স্যুপ খাচ্ছিলেন!আগন্তুক ব্যাক্তির এমন কথায় ভ্রু কুচকে গেলো তার।নাহার বেগম বেশ বিরক্ত নিয়েই বললো,”আয়ান!তোমাকে কতবার বলেছি তোমার বাবাকে এই অদ্ভুত নামে ডাকবে না!”
আয়ান মৃদু হেসে ভিতরে আসলো।
“অদ্ভুত কোথায়?আমি তো সঠিক নামেই ডাকছি!”
বেলাল সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,”আমি একজন ভার্সিটির প্রফেসর!আর তুমি আমাকে মাস্টার মশাই বানাচ্ছো!”

বেডের কাছে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,”এই দেখো,তুমি কি ভাবছো?আমি তোমার পেশাকে অসম্মান করছি?মোটেও না বাবা!আমি তো সম্মান দিয়েই বলছি!শুধু শুদ্ধ বাংলার ব্যাবহার!এই আরকি!”

তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”ডাক্তার কি বললো?”

নাহার বেগম তড়িঘড়ি উত্তর দিলেন,”একমাস বেড রেস্টে থাকতে বলেছে,আর প্লাস্টার একমাস পর খুলতে বলেছে!”
বেলাল সাহেব বেশ চিন্তিত হলেন।সামনে স্টুডেন্টদের এক্সাম। কি করে কি হবে?তখনই নার্স আসলো!একটা প্রেসক্রিপশন নাহার বেগমের হাতে দিয়ে বললো,”কাইন্ডলি এই ওষুধ গুলো নিয়ে আসুন!এগুলো লাগবে উনার!নাহলে ব্যাথা কমবে না!এখানের ফার্মেসীতে নেই এগুলো।তাই দয়া করে বাইরে থেকে জোগাড় করুন!”
আয়ান প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বললো,”আমি নিয়ে আসছি!”
“রাস্তা দেখে পার হবে কিন্তু!”
“আমাকে কি বাবার মতো পেয়েছো?”
বেলাল সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেম,”বলতে কি চাও?”
আয়ান কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো।বেলাল সাহেব নাহার বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো,”তোমার ছেলে আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি পঁচানি দিলো!”
“তোমাদের বাপ ছেলের মাঝে আমি নেই!স্যুপটা শেষ করো!”
বেলাল সাহেবও আর কিছু বললো না!

#চলবে