অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-১০+১১

0
292

#অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_১০
সকাল থেকে আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না ।আয়ুশীর সাথে সাথে আকাশও পালাক্রমে বর্ষণ করছে।সীমা আর ইভা কি করা উচিৎ বুঝতে পারলো না।ইভার ফোন বেজে উঠায় ও উঠে ফোনের কাছে গেলো।দেখলো আয়ুশীর আব্বু কল দিয়েছে।

“আয়ু!আঙ্কেল!”

আয়ুশী নিজেকে সামলে নিলো।চোখ মুছে ধরা গলায় বললো,”হ্যাল্লো,বাবা!”

“এটা আপনার বাবার নাম্বার?”
আয়ুশী ভ্রু কুঁচকে নিলো।নাম্বার আরেকবার দেখে নিলো, নাহ ওর বাবারই নাম্বার ।

“কে বলছেন?”

“জি এই নাম্বারের ব্যাক্তি আপনার কে হয়?”

আয়ুশী বিরক্ত হলো।কে রে ভাই?
“আমার বাবা!”

“জি উনাদের গাড়ির এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে,আপনি জলদি ** হসপিটালে চলে আসুন!”

হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো ওর।চারদিক ঘুরছে ওর।কোনো কুল কিনারা না বুঝতে পেরে উঠেই দৌড় দিলো।ইভা আর সীমা কিছু বুঝার আগেই ও হাতের বাইরে চলে গেলো। ঝড় হচ্ছে বাইরে।কোনো গাড়ি রিকশা কিছুই পাচ্ছে না ও।অঝোর ধারায় কেঁদে চলছে ও। আশে পাশে গাড়ির খোজ করছে। বাট পাচ্ছে না।

ওদিকে গাড়ির ভিতর সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে আয়ান।মূলত ওর কিছুই ভালো লাগছে না।ওখান থেকে আসার পর এভাবেই বসে আছে।এত অস্থিরতা ,কাতরতা কোনোটার মানেই ও বুঝে উঠতে পারছে না।অবশেষে ভাবলো বাড়ি ফিরা দরকার।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ভার্সিটির গেট পেরোতেই দেখলো আয়ুশী আশে পাশে বিচলিত হয়ে কিছু খুঁজছে।ভিজে পুরো একাকার! শাড়ির আঁচল ও ঠিক নেই! আয়ান চোখ সরিয়ে নিলো।ভাবতে চায় না ও ওকে নিয়ে!আয়ানের গাড়ি দেখে আয়ুশী ছুটে এলো।

“স্যার আমাকে একটু সাহায্য করবেন প্লিজ!”

“আবার কোন নাটক শুরু করলে?”

আয়ুশী কোনমতে বললো,”স্যার প্লিজ!আমাকে একটু লিফট দিন!”

“প্লিজ,আয়ুশী!নতুন করে আর ড্রামা করো না!আমি যা বলার বলে দিয়েছি!”

বলেই গাড়ি টান দিয়ে চলে যাচ্ছে।আয়ুশী বেশ কিছুক্ষণ ডাকলো বাট শুনলো না ও।রাস্তার মাঝে বসে পড়লো ও।অঝোর ধারায় কাঁদছে।এদিকে আয়ান ব্যাক মিরোরে আয়ুশীকে এভাবে দেখে বেশ বিচলিত হলো।মেয়েটা এমন করছে কেনো?কিছুক্ষণ ভেবে দেখলো এভাবে একা রাস্তায় এভাবে রেখে যাওয়া ঠিক না ওর।গাড়ি ঘুরিয়ে আয়ুশীর কাছে চল আসলো।

“উঠে এসো!”

আয়ুশী কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই উঠে পড়ল! আয়ান কিছু বলার আগেই ও বলে উঠলো,”** হসপিটাল চলুন প্লিজ!জলদি…”

আয়ান এবার চিন্তায় পড়লো।কি এমন হয়েছে?সোজা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চললো হসপিটাল।পুরো রাস্তায় আয়ুশী মুখ চেপে কেঁদে যাচ্ছিলো। আয়ান কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারছে না!হসপিটালের সামনে আসতেই এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো।আয়ুশীকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে যেতে দেখে আয়ান ওকে একা ছাড়তে পারলো না।নিজেও গেলো পিছু পিছু।ভিজা অবস্থাতেই আয়ুশী রিসিপশনিস্ট এর কাছে গেলো।

“ম্যাম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”

আয়ুশীর মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।ততক্ষণে আয়ান ও এসেছে!

“ম্যাম?”

“এ’ক্সি’ডে’ন্ট এর পেশেন্ট!”

আর কিছু বলা লাগেনি ওর!ততক্ষণে এক নার্স এসে বললো,”এ’ক্সি’ডে’ন্ট এর পেশেন্ট এর বাড়ির লোক কি এসেছে?”

আয়ুশী চট জলদি বলে উঠলো,”আমি!”

নার্স মুখ ভার করে বললো,”আসুন!”

আয়ুশী ধীর পায়ে তার পিছু পিছু গেলো। আয়ান বুঝে উঠতে পারলো না কার এ’ক্সি’ডে’ন্ট।নিজেও পিছু পিছু গেলো।কিছুদূর যেতেই আয়ুশীর পা থেমে গেলো।তিনটি মানুষ ,সাদা কাপড়ে তাদের মুখ ঢাকা!মেঝেতে শুইয়ে রেখেছে!নার্স এগিয়ে বললো,”এদের বাড়ির লোক এই মেয়েটা!”

এক ডক্টর বললো,”আপনার কে হন উনারা?”

আয়ুশী কিছু বলতে পারছে না।কোনমতে এসে প্রাণহীন মানুষদের পাশে বসলো।কাঁপা কাঁপা হাতে প্রথম মানুষটির কাপড় সরাতে অপরিচিত পুরুষ দেখে বড় নিঃশ্বাস নিলো।র’ক্ত মাখামাখি পুরো!আরেকটু সরে বাকি লা’শ দুটির মাঝে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড় সরালো!মুহূর্তেই থমকে গেলো ওর পুরো দুনিয়া!কি রিয়েক্ট করা উচিত বা ঠিক কি বলা উচিত ওর সেসব হুশ নেই আর। আয়ান চমকে দু কদম পিছিয়ে গেলো।ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।আয়ুশী আলতো করে ওদের মুখে হাত বুলালো!পাশেই নার্স বলে উঠলো,”স্পটেই মৃ’ত্যু হয়েছে উনাদের!”

আয়ুশী মৃদু স্বরে ওদের ডাকলো!

“মা!ও মা!”

মা নিরুত্তর!

“বাবা !”

তিনিও নিরুত্তর ।মায়ের এক হাত মুঠোয় নিয়ে,বাবার বুকে মাথা রাখলো ও…

“ইনারা আপনার বাবা মা হয়?”

আয়ুশী জবাব দিলো না!

“কি মুশকিল!আর কেউ কি নেই নাকি ?”

আয়ান এগিয়ে এলো।
“উনারা ওর বাবা মা হয়!”

“আপনি চিনেন?”

“জি!”

“কিছু ফর্মালিটি আছে!পূরণ করে ওদের নিয়ে যান!আরেকজন সম্ভবত ড্রাইভার!উনার ফ্যামিলিকেও খোঁজার ব্যাবস্থা করছি!”

আয়ান সম্মতি দিল।

“আয়ুশী!”

কারো মুখে আয়ুশীর নাম শুনে ঘুরে তাকালো আয়ান! ফাহিন বেশ অবাক হয় তাকিয়ে আছে। আয়ান ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলো ফাহিন আয়ুশীকে কিভাবে চিনে? ফাহিন আয়ানকে খেয়াল করেনি!ঝটপট এগিয়ে গেলো ওর দিকে!

“আয়ু?”

আয়ুশী নিরুত্তর!পাশে থাকা নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই সে সব বললো। ফাহিন বুঝতে পারলো আয়ুশী ওর মাঝে নেই!ওর কাঁধে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিলো।

“আয়ু!”

আয়ুশী ফাহিনের দিকে তাকালো।হালকা হেসে বললো,”আরে ডাক্তার!হুশ!এখন কথা বলো না…আব্বু আম্মু ঘুমাচ্ছে উঠে যাবে!”

ফাহিন কিছু বলার মধ্যে পেলো না!

“উঠে পড়!”

“উহু,বাবার বুকে শান্তি আর শান্তি!”

“আয়ু!”

“আহ,ডাক্তার!বললাম না আস্তে কথা বলো!ওরা উঠে যাবে তো!”

ফাহিন অসহায় চোখে তাকালো!

আয়ুশী আবার হেসে বললো,”ওহ সরি,ওরা তো আর উঠবে না!তাই না ডাক্তার?”

ফাহিন নিরুত্তর!

“ওরা আমায় একা ফেলে ঘুরতে চলে গেলো সারাজীবনের মত দেখলে ডাক্তার? কত স্বা’র্থ’প’র ওরা?”

“আয়ু!”

বাবার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আর মা আমাকে ব’ক’বে না!বলবে না,” আয়ু তুই কিন্তু এবার মা’র খাবি!'”

ফাহিন নিরুত্তর!আয়ুশী ফাহিনের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমায় কেন নিলো না ডাক্তার?আমি কি খুব খারাপ নাকি?”

“ওদের নিতে হবে আয়ুশী!”

মিষ্টি হেসে উঠে দাড়ালো!

“হুমম চলো চলো!”

সবাই ওর কাণ্ডে হতবাক!কিন্তু বুঝতে পেরেছে মেয়েটা অতি শোকে পাথর হয়েছে।

নিজের বাসার বাবা মায়ের দরজার সাথে হেলান দিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে আয়ুশী।রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি!মরিয়ম আর মোশাররফের জানাযা হয়ে গেছে!আয়ুশীর বাবা মা উভয়ই একমাত্র সন্তান ছিল পরিবারে!তাই তাদের তেমন আত্মীয় নেই! আয়ান ওর বাবাকে ফোন করে সবটা জানায়! ফাহিন এই অবস্থায় আয়ুশীকে ছাড়তে চায়নি! তাই সেও এসেছে ওর বাসায়!সীমা আর ইভা সব জেনে এখানে এসেছে।সবাই মিলে উনাদের দাফন কাফনের ব্যাবস্থা করলো।এই পুরোটা সময় আয়ুশী নিশ্চুপ ছিল।একটুও কাঁদেনি ও!বেলাল আর দুইজন মুরুব্বী চেয়ারে বসে আফসোস করছে।”মেয়েটার এখন কি হবে?”,”বাবা মা ছাড়া তো ওর আর কেউ নেই!”,”ইস এই বয়সেই কত বড় আঘাত পেলো!”,আরো নানা কথা বলছে। আয়ান দূরে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছিল।তখনই খেয়াল হলো পাশের ফ্ল্যাটের কিছু ছেলে আয়ুশীর দিকে তাকাচ্ছে। আয়ান আয়ুশীর দিকে তাকিয়ে দেখলো,ওর অবস্থা একদম বিব্রতকর! শাড়ির আঁচল কোমর থেকে অনেকটা সরে গেছে,ফলে পেটের বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে!আয়ানের রাগ হলো,এভাবে কেউ শাড়ি পড়ে?সামলে রাখতে পারে না?পরক্ষণে মনে হলো, ও এখন সেই অবস্থায় নেই!দীর্ঘশ্বাস ফেলে সীমাকে ডাকলো!ওকে বললো ওকে ভিতরে নিয়ে যেতে।তাছাড়া ভিজা শাড়ি পড়ে অনেকক্ষণ আছে ও।সীমা ওর কাছে গেলো।

“আয়ু?”

আয়ুশী নিরুত্তর।

“আয়ু!!”

তাও চুপ।

সীমা মৃদু ধাক্কা দিতেই নিচে পড়ে গেলো ও।ভয়ে চিৎকার দিলো ও,””আয়ু!”

আয়ান ওর কাছে যাবে তার আগেই ফাহিন চলে এলো।ওখানেই দাড়িয়ে গেলো ও। ফাহিন ওর হাত স্পর্শ করতেই বুঝলো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।সেই থেকে এত দখল,মেন্টাল স্ট্রেস সব মিলিয়ে সেন্সলেস!

“ওকে রুমে নিয়ে চলো!”(ফাহিন)

“আমি একা?”

ফাহিন ভাবলো।

“ওর শাড়ি টা ঠিক করে দেও!”

সীমা তাই করলো।পড়ে ফাহিন ওকে কোলে তুলে নিলো।তাই দেখে আয়ানের মনে কেমন একটা ফিল হলো।যা কেনো,কি কারণে ও জানে না!

ফাহিন ওকে বিছানায় শুইয়ে দিল। আয়ান দরজায় দাড়িয়ে সবটা দেখছে। হুট করেই ফাহিন বলে উঠলো,”ওর গালে এগুলো কিসের দাগ?”

সীমা আড়চোখে আয়ানের দিকে তাকালো!

“ও কিছু না!আমাদের দু’ষ্টুমির সময় এমন হয়েছে!”

“কিন্তু মনে হয় কেউ মে’রে’ছে!”

“ঐতো,ওর মাঝেই একটু হয়ে গেছিলো আরকি!”

“বরফ লাগিয়ে দেও!”

আয়ান নিজের হাতের দিকে তাকালো!আফসোস হচ্ছে,ভীষণ আফসোস!কেনো ও নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না?আজ আবারও ভুল করেছে ও! ও চাইলেই পারতো বুঝিয়ে বলতে।ভাবতেই নিজের উপর রাগ হলো।হন হন করে বেরিয়ে গেলো ও।নিজের কাছে নিজেই উত্তর খুঁজছে!কেনো করলো এমন?আয়ুশীকে এভাবে কষ্ট দিলো ও?

#চলবে…

#অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_১১

“আয়ুশী মামনি!”

বাড়ীওয়ালার আওয়াজে মুখ তুলে তাকালো ও।সেদিনের পর কেঁ’টে গেছে দুটো দিন!ইভা এই কয়দিন আয়ুশীর কাছেই ছিল। সীমাও থাকতো,কিন্তু হোস্টেলের ব্যাপার !একজনকে তো থাকতেই হবে!তার উপর ওর টিউশনি মিস গেলে টাকা কেঁ’টে রাখবে।সব মিলিয়ে ও ওর প্রিয় বান্ধবীর এই অবস্থাতেও সাথে থাকতে পারছে না।এর মাঝে বেলাল, আয়ান আর ফাহিন এসে দেখা করে গেলেও আয়ুশী প্রতিটা ক্ষেত্রেই চুপ ছিল।আয়ুশী সেভাবে প্রকাশ না করলেও দুইরাত নীরবে কেঁদে গেছে।তেমন কোনো আত্মীয় নেই যে ওকে সামলে রাখবে।আর না আছে নিজেদের বাড়ি!

আয়ুশী তাকাতেই তিনি ভীষণ অস্বস্থি নিয়ে বললেন,”এই মাসের ভাড়া বাকি!তার উপর তোমার নিজেরও কোনো ইনকাম নাই। এখনও মাসের ১০ দিন বাকি!তো কি ঠিক করলে?খরচ চালাতে পারবে বাসার?না মানে বুঝোই তো!এভাবে তো আর রাখা যায় না তাই না?”

আয়ুশী বেশ ভালোই এর মানে বুঝেছে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারই বা দোষ কি?সে তো বাসাতে টাকার বিনিময়েই থাকতে দেয়!

“আপনি টুলেট লাগিয়ে দিন আঙ্কেল,আমি আর এত টাকা কোথা থেকে পাবো!বাবার তো আর সঞ্চয় ছিল না।তবে এই মাসের ভাড়াটা আমি দিয়ে দিবো!”

বাড়ীওয়ালা চলে গেলেন!ইভা আয়ুশীর কাছে বসলো!

“আয়ু,বাসা ছেড়ে দিলে থাকবি কোথায়?”

“না ছাড়লে ভাড়া দিবো কই থেকে?”

ইভা চুপ রইলো!আবার বললো,”হোস্টেলের সিট আছে কিনা দেখি?”

“ওখানে থেকেই বা কি করবো?পড়াশোনার খরচ কি উঠাতে পারবো?”

“দেখ হোস্টেলের ব্যাবস্থা হয়ে গেলে আর মাসে দুই থেকে তিনটা টিউশনি করলে তুই এমনেই খরচ চালাতে পারবি নিজের।একবার পড়াশোনাটা শেষ কর!তারপর আর কোনো সমস্যা হবে না!”

“দেখ, এমনিও আর করারই বা কি আছে?”

“আচ্ছা আমি তাহলে খোজ নিয়ে আসি,সীমা তো এখন টিউশনিতে!তুই খেয়ে নে আগে,তারপর আমি যাবো!”

“আমি খেয়ে নিবো,তুই যা!”

“তোর উপর বিশ্বাস নেই!বিকেল হয়ে গেছে।তুই কখন থেকে পরে খাবি পরে খাবি করছিস!”

“প্লিজ ইভা!যা না তুই,বললাম তো খেয়ে নিবো!”

“বেশ খেয়ে নিস!আমি জলদি চলে আসবো!”

ইভা রেডি হয়ে নিলো।
“দরজা লাগিয়ে দে!আমি আসছি…”

বলেই বেরিয়ে গেলো।

আনুমানিক সন্ধ্যা সাতটা!সাধারণত এখন বর্ষাকাল!যদিও শেষের দিকে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।বিছানা ছেড়ে উঠে বাবা মায়ের রুমে গেলো ও!বিছানার দিকে তাকাতেই চোখ ভরে উঠলো ওর।এই সময়টায় মা বসে বসে বাবার সাথে ঝগড়া করতো।আর ও মজা নিতো।ধীর পায়ে আলনার কাছে গেলো।সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।রুমে একটা ছোট ড্রয়ার আছে।ওইটা খুলতেই ওদের ফ্যামিলি অ্যালবাম চোখে পড়লো।ওটা নিয়ে বসে দেখতে লাগলো।কত শত স্মৃতি ওদের।মুখে হাসি ফুটলো ওর। হঠাৎ চোখ পড়লো ওদের ফ্যামিলি ফটো ফ্রেমের উপর।সাধারণত এইসব ছবি ওরা সাজিয়ে রাখেনা!ফ্রেমের ফটোতে আনমনে তাকিয়ে রইলো।ফোনের শব্দে ঘোর ভাঙলো ওর।ফ্রেম হাতেই গেলো নিজের রুমে!ইভার কল!

“আয়ু!”

“হুমম বল!”

“বাইরে তো ঝড় বইছে,তার উপর সন্ধ্যা অনেক।সীমাও নেই যে ওকে নিয়ে যাবো।আটকে গেছি আমি!”

“সীমা কোথায়?”

“ও বাড়িতে গিয়েছে,ওর বাবা নাকি অসুস্থ অনেক!”

“তুই থাক!আসা লাগবে না…”

“তুই একা থাকতে পারবি?”

“জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপই এখন একা নিতে হবে,আর এটাই হয়তো তার সূচনা!চিন্তা করিস না…পারবো!”

ইভা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ঝড় বৃষ্টির মাঝে হলেও সে যেতো।কিন্তু সন্ধ্যা একে তো।রাস্তা ঘাট যেমন শুনশান তেমন অ’মানুষের উৎপাত বেশি!আর এমনিও সে ভীতু ভীষণ! জুনাইদকে বলবে ভেবেছিলো।কিন্তু ও আপাতত এলাকার বাইরে।সব মিলিয়ে কুল কিনারা পাচ্ছে না!

“খেয়াল রাখিস,আমি সকালেই চলে আসবো!”

আয়ুশী কিছু না বলেই রেখে দিল।ওর এখন সব অসহ্য লাগে।সবার এত সিমপাথি ওর কাছে মনে হয় দয়া।অবশ্য কি আর করার!এখন ওর কোনো সম্বল নেই! ফটো ফ্রেম হাতে নিয়ে বারান্দায় গেলো।আগের তুলনায় বৃষ্টি বাড়ছে।পানি ছিটকে আসছে বাইরে থেকে।কিন্তু তাও বারান্দার গ্রীল ঘেঁষে বসে পড়লো।পানি ছিটা মুখে আসতেই পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠলো।

ক্লাস এইটের কিশোরী আয়ুশী।টিনের চালের ঘর!বৃষ্টি পড়ার ঝুপঝাপ শব্দ হচ্ছে টিনের চালে!দু হাত পেতে গড়িয়ে পড়া জল হাতের মুঠোয় নিলো ও।বারান্দায় মাদুর পেতে বসে থাকা মোশাররফ সাহেবের কাছে গেলো ।

“আব্বু!”
মোশাররফ মেয়ের ডাকে তাকালেন।হাতের পানি বাবার মুখে ছিটিয়ে দিতেই খিল খিলিয়ে হেসে উঠলো আয়ুশী ।
“পাজি মেয়ে, দাড়া!”

বলে পিছু নিতে গেলেই আয়ুশী দিলো দৌড়।বাবার তাড়া করায় কোনো প্রকার ভাবনা চিন্তা ছাড়াই বৃষ্টির মাঝে উঠানে নেমে গেলো।

“আয়ু,বৃষ্টিতে ভিজে না মা!”

আয়ুশীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।সে তো বাবার কাছে ধরা না দিতে ব্যাস্ত।মেয়েকে ধরতে তার পিছু ছুটলো মোশাররফ!কিন্তু উঠান ভিজা হওয়ায় স্লিপ কেঁ’টে পড়ে গেলেন!তাই দেখে আয়ুশী আবার হাসলো!

“আব্বু ব্যাথা পাইছি,এসে তোল আমায়!”

আয়ুশী বাধ্য মেয়ের মত বাবাকে তুলতে এলো।কিন্তু মোশাররফ মেয়েকেও নিজের সাথে পিচ্ছিল উঠানে ফেলে দিলেন!আর হাসতে লাগলেন।

“এটা কি করলে আব্বু!মা বকবে তো…পুরো মাটি লেগে গেছে!”

“আমি একা কেন বকা খাবো?তোকেও সাথে নিলাম!”

তখনই মরিয়ম এলেন!

“বাহ,বাপ বেটি মিলে বৃষ্টির মাঝে বসে মাটিতে মাখামাখি করছে।এই যে বৃষ্টিতে যে ভিজছেন!যদি জ্বর আসে,আমি কিন্তু একদম কোনো খেয়াল রাখতে পারবো না!”

আয়ুশী ঠোঁট উল্টে বললো,”মা এসে তুলো আমাদের!”

“আমি পারবো না বাপু!তোরা নিজেরা উঠ!”

“পারছি না তো!”

মরিয়ম উপায় না পেয়ে ওদের তুলতে গেলে নিজেও স্লিপ খেয়ে পড়ে গেলো। তা দেখো ওরা দুইজন হেসে দিল।

“সব দোষ তোমাদের!খালি অসুখ হোক!আমি কিচ্ছু টি করবো না বলে রাখলাম!”

আয়ুশী আবার হাতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে ওর মায়ের মুখে মারলো!

“আয়ু কি করছিস?”

বাবাও সেম কাজ করলো।ওদের জন্য মরিয়মও এরকম করতে লাগলো।তিনজন মিলে হাসছে আর বৃষ্টিতে মজা নিচ্ছে।

পুরনো স্মৃতি মনে পড়তেই ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো আয়ুশী। ও কারো সামনে কাঁদতে পারে না।কিন্তু একা থাকলে মন প্রাণ উজার করে কাঁদে।ওভাবেই বৃষ্টিতে বসে রইলো।বৃষ্টির গতি বাড়তে বাড়তে একটা পর্যায়ে অনেক বেশি করে ঝড় বইতে লাগলো।আয়ুশীর কোনো হেলদোল নেই! ও সেভাবেই বসে রইলো।পুরো রাত বৃষ্টি থামার কোনো নাম নেই।ভোরের দিকে কমে এলো।

সকাল ছয়টা!ইভা সকাল হতেই চলে এসেছে।আয়ুশীকে একা ছাড়ার মত কাজ কখনোই করতো না।কিন্তু কাল চেষ্টা করেও পারেনি আসতে!আয়ুশীদের বাসার সামনে আসতেই দরজায় নক দিলো।কেউ খুলছে না!ইভা একটু জোরে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।কালকে এভাবেই দরজা চাপিয়ে গেছিলো ও।আয়ুশী কি তবে দরজা লাগায় নি?ভেবেই ভিতরে ঢুকলো।রুমে আয়ুশীকে না পেয়ে বারান্দায় যেতেই দেখলো আয়ুশী গ্রীলে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।জামার অনেক অংশই ভেজা! বারান্দাতেও পানি আছে এখনো!তবে কি আয়ুশী সারারাত এখানে ছিল?ভাবতেই দৌড়ে ওর কাছে গেলো।

“আয়ু..”

বলে ওর গালে হাত দিতেই দেখলো জ্বর এসেছে।এটাও বুঝলো আয়ুশী সেন্সলেস! ইভার হাত পা কাঁপছে।এখন কাকে ফোন করবে ভাবতেই ফাহিনের কথা মাথায় এলো।কিন্তু ওর কাছে তো ফোন নাম্বার নেই!অতঃপর আয়ানের কথা মাথায় আসতেই চট করে আয়ুশীর ফোন নিয়ে ওকে কল দিল।এক রিং হতেই রিসিভ হলো।যেনো জেগেই ছিল।ইভা কথা বলার আগেই আয়ান বলে,”আয়ুশী,তুমি ঠিক আছো?”..

ইভা কেঁদে দিল।

“ভাইয়া,আয়ু সেন্সলেস!আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না ।তাই আপনাকে ফোন দিলাম!”

ওপাশ থেকে ফোন কেঁ’টে গেলো.।ইভা জানে আয়ান এখন আসছে।বহু কষ্টে আয়ুশীকে তুলে রুমে নিয়ে জামা পাল্টে দিলো।

আয়ুশীর মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে ইভা।তার কিছু দূরেই দাড়িয়ে আছে আয়ান।আর বিছানার এক মাথায় বসে আছে বেলাল সাহেব! ফাহিন এসে দেখে গেছে ওকে।কিছু ওষুধ আনতে বাইরে গেছে ও।মূলত আয়ানই ওদের জানিয়েছে।বেলাল চিন্তিত অবস্থায় বললেন,”এভাবে মেয়েটাকে একা ছাড়া যাবে না!”

“আমি দুঃখিত,আসলে বাড়ীওয়ালা বাসা ছাড়তে বলেছে।এখন ও থাকবে কই,খরচ চালাবে কিভাবে..তাই এসব জোগাড় করতে গিয়েছিলাম!রাতে বৃষ্টিতে আটকে গিয়েছিলাম।কিন্তু ভাবিনি এর মাঝে এত কিছু হয়ে যাবে!”

“বেশ চিন্তার বিষয়!”

ফাহিন ততক্ষণে চলে এসেছে।

“ওর সাথে এখন কারোর সবসময় থাকা দরকার!”(ফাহিন)

“আমি থাকবো!কিন্তু আপাতত ও কোথায় থাকবে?হোস্টেলের সিট পাইনি তো?”

ফাহিন চিন্তায় পড়লো।

ফট করে আয়ান বলে উঠলো,”বাবা ,ওকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই?”

বেলাল সাহেব আয়ানের দিকে তাকালেন!কিছু একটা ভাবছেন।কিন্তু কি তা উনার জানা!

#চলবে