#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_১২
মেঘলা আকাশ। সূর্যিমামাকে ঢেকে আছে মেঘরাশি। এ সময় চওড়া রাস্তায় একটা সাইকেল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিযোগী মোট পাঁচজন। তন্মধ্যে তাহা একজন। বাকি চারজন ছেলে। দু’টো ছেলে এইটে পড়ে আর একটা ছেলে সেভেনে। আরেকজন নাইনে পড়ে। পাঁচজন একটা সাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পিছনে দুইজন রাস্তার দুই কিনারে দাঁড়িয়ে একটা দড়ি টানা দিয়ে ধরে আছে। প্রতিযোগীদের একহাতে সাইকেল ধরে রাখা। এখান থেকে স্থানীয় বাজার এক কিলোমিটার। তাই প্রতিযোগিতার নিয়ম হল সাইকেল চালিয়ে বাজারে যেতে হবে। তারপর বাজার থেকে ঘুরে আবার এ জায়গায় আসতে হবে। যে কাজটা আগে করতে পারবে সে-ই বিজয়ী। তাহা পূর্ণ কনফিডেন্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে সাইকেল চালিয়ে আজ অব্দি কেউ পারেনি। তাই এবারও সে জিতবে, এমনটাই ভাবছে তাহা। রাস্তার পাশে সাড়ি দিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই উৎসুক হয়ে আছে কখন প্রতিযোগিতা শুরু হবে। প্রতিযোগীদের সাইকেলের ওপর উঠে বসতে বলা হল। সবাই বসল। বাঁশি বাজানোর সাথে সাথে পাঁচজন সাইকেল নিয়ে ছুটে। কে কাকে টেক্কা দেবে? এ লক্ষ্য নিয়ে সকলে সাইকেল চালাচ্ছে। তাহা সবার সামনে আছে। বাজারের কাছে এসে যখন মোড় ঘুরবে তখনই তাহা সাইকেল থেকে উলটে পড়ে যেতে নেয়। অনেক কষ্টে সাইকেলে ধরে বেঁচে যায়। এই সুযোগে তাহা’র সামনে একজন চলে যায়। তাহা দ্বিতীয় নাম্বারে চলে যায় এখন। তাহা’র চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। যদি ও ফার্স্ট না হতে পারে তাহলে তার প্রেস্টিজ থাকবে না। তাহা এবার আল্লাহর নাম নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে সাইকেলকে খুব জোরে টান দেয়। এবার তাহা সামনের ছেলেটার কাছাকাছি চলে যায়। এবার জোরে আরো একটা টান দেয়। এমন জোরে টান দেয় নিজেই তাল সামলাতে পারেনি। বেঁধে রাখা দড়ি নিয়েই উলটিয়ে পড়ে। তাহা’র পড়ে যাওয়া দেখে সবার মধ্যে হৈ হৈ পড়ে যায়। পাঁকা রাস্তায় পড়ে গিয়ে ডানহাতের কনুইয়ের দিকটায় খানিকটা ছিঁলে যায়। রক্তও বেরিয়ে গেছে কিছুটা। ব্যথার মধ্যেও তাহা’র মুখে বিজয়ের হাসি। সে জিততে পেরেছে। সবাই তাহা’কে ধরে উঠায়। তাহা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীড় ঠেলে তাহা’র কাছে যায় আফিয়া। তাহা’কে একহাতে ধরে সাইডে নিয়ে আসে সে।
“কিরে! এভাবে এখানে টেনে আনলি কেন?”
তাহা আফিয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকিয়ে প্রশ্ন করে।
“আজকে যে রেজাল্ট দিয়েছে তাতে তোর কোনো হেলদোল আছে? এখানে মহারানী সাইকেল প্রতিযোগিতায় নেমেছেন! তোর রেজাল্ট কি এসেছে জানিস তুই?”
“কি?”
আফিয়া তাহা’কে বলে,
“চল কলেজে যাই।”
তাহা ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে তাকায় আফিয়ার দিকে।
“কেন? কলেজে যাবো কেন?”
“আরে রেজাল্ট দেখবি না?”
“লিসা নিয়ে আসবে।”
“চলেও এসেছি মহারানী। এই নে তোর মার্কশীট। তুই-ই এটা খুলে দেখ। নিজের চোখেই নিজের কীর্তি দেখ।”
লিসা মার্কশীট এনে তাহা’র হাতে দেয়। তাহা হাত বাড়িয়ে মার্কশীটটা তুলে নেয়। মার্কশীটটা খুলে একনজর দেখে আবার বন্ধ করে ফেলে।
“তাহা! দেখি তোর মার্কশীটটা।”
আফিয়া মার্কশীটটা চাইলে তাহা দেয় না। বলে দেওয়া যাবে না। আফিয়া মুখ ফুলিয়ে তাকায়।
“তাহা প্রতিযোগিতা তো দেখছি শেষ। কে জিতলোরে? নিশ্চয়ই তুই?”
লিসা প্রশ্নটা করে বেশ উৎসাহ নিয়ে তাহা’র দিকে তাকায়। তাহা বিশ্বজয় করা হাসি দিয়ে বলে,
“অবশ্যই। আমি ছাড়া আর কে জিতবে?”
“আফিয়া বাড়ি যা। আম্মু তোকে জলদি বাড়ি যেতে বলেছে।”
পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে। ওরা তিনজনই পেছনে তাকিয়ে দেখে পেছনটায় আহির দাঁড়িয়ে। আফিয়া তাহা’দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে। লিসাও পরপরই বলে ওঠে,
“এই তাহা! আমিও চললাম। তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। দেরিতে গেলে আন্টি আবার তোকে বকবে।”
লিসাকে হাতের সাহায্যে যেতে বলে তাহা। লিসা চলে যেতেই আহির তাহা’র পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। রাস্তার দিকে একবার তাকিয়ে তাহা’র উদ্দেশ্যে বলে,
“রেজাল্ট কি এসেছে? হাতেতো এটা মার্কশীট মনে হচ্ছে। দেখি মার্কশীটটা দাও।”
তাহা কাচুমাচু করে মার্কশীটটা আহিরের হাতে তুলে দেয়। আহির মার্কশীটটা খুলে দেখে। সব বিষয়ের নাম্বার ঠিক আছে। ইংরেজি নাম্বার দেখেই ওর চোখ ছানাবড়া।
“ইংরেজিতে এত বেশি নাম্বার?”
তাহা চোখ উল্টিয়ে তাকায় আহিরের পানে। ইংরেজিতে নাকি বেশি নাম্বার?
“আমি কি জানি? স্যার বেশি দিলে আমি কি করবো?”
তাহা’র কথা শুনে আহির ফিক করে হেসে দেয়। আহিরকে হাসতে দেখে তাহা মুখ ফুলিয়ে তাকায়।
“তুমি যা লিখেছো স্যার নাম্বার তা-ই দিবে। আর তুমি কি জানো এর জন্য তোমাকে কোচিং সেন্টার থেকে বের করে দেওয়া হবে?”
আহিরের কথা শুনে তাহা গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,
“দিক। আমি নিজেই আর কোচিংয়ে যাবো না।”
“তুমি আর শোধরালে না। এত কম নাম্বার পাওয়ার কারণ কি যে তুমি পাশই করতে পারলে না? অন্য সাবজেক্টেতো মার্কস ভালোই এসেছে।”
“ইংরেজি আমার মাথায় ঢুকে না। আর ইংরেজি পরীক্ষার দিন ভালো করে পড়িও নি।”
তাহা মাথা চুলকে বলে। আহির চোখ ছোটছোট করে তাকায়।
“এখন মার্কশীটটা তোমার আম্মুর কাছে কিভাবে দেবে?”
“এভাবেই দেবো। যেভাবে আপনাকে দিলাম।”
তাহা’র গা ছাড়া ভাব দেখে আহির ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে।
“নিজের জীবন নিয়ে একটু ভাবো। এখন প্রি-টেস্টে খারাপ এসেছে। যদি ফাইনালে খারাপ হয় তাহলে কিন্তু তোমার পুরো জীবনটাই শেষ তাহা। একটু ভালোবাসতে শেখো নিজেকে। এমনতো নয় তুমি খারাপ স্টুডেন্ট! তুমি একটু ভালো করে চেষ্টা করো তাহলেই পেরে যাবে। দরকার হলে ভালো টিউটর রাখবে তোমার জন্য। আন্টিকে তো বলতে পারো। আচ্ছা তুমি যদি চাও আমি-ই তোমার জন্য ভালো টিউটর খুঁজে দিতে পারি। করবো কি?”
তাহা নিশ্চুপ থাকে। তা দেখে আহির আর কিছু বলে না। সেতো সেঁধে সেঁধে বলেছে এখন যদি তাহা রেসপন্স না করে তাহলে তার আর কিছু করার থাকে না।
“আমি বাড়ি যাবো।”
তাহা একপলক আহিরের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে নিলে আহির কিছু বলে ওকে আটকিয়ে দেয়।
“কাল তুমি আরহামকে কি বলেছো?”
তাহা চকিতে তাকায় আহিরের দিকে। এ ব্যাপারটা নিয়ে কালকে ভয় পেয়েছিল। যদি আহির কিছু শুনে নিতো! এমনটাই ভয় ছিল তাহা’র। পরে আহিরের সাথে কথা বলার পর মনে হয়েছিল আহির কিছু শুনতে পায়নি। কিন্তু এখন আবার সে ব্যাপার নিয়ে কেন জিজ্ঞেস করছে?
“মানে?”
তাহা আমতাআমতা করে বলে ওঠে।
” তুমি আরহামকে বলেছো, তুমি ওকে দেবর বানাবে। মানে, আমাকে বিয়ে করবে এসব কেন বলেছো?”
তাহা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। আহির সব শুনেই ফেলেছে। এবার আর তাহা’র মান-সম্মান রইলো না। আহিরকে এখন কি উত্তর দিবে তাহা? কোনো কিছুতো মাথায় আসছেও না।
“কি হলো কথা বলছো না যে?”
আহির আবারও বলে ওঠে। তাহা দু’মিনিট চুপ থেকে অন্তরালে কথাগুলো গুছিয়ে নেয়।
“আসলে, ও আমাকে কথায় কথায় বলে না ও আমায় বিয়ে করবে? তাই আমিও ওর সাথে ফাজলামো করে এটা বলেছি। না হলে আমার কোন আক্কেলে এমন সখ জন্মাবে? যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইবো?”
আহির কুঁচকানো ভ্রুঁ এবার সোজা করে।
“মানে? তুমি আমায় বিয়ে করতে চাইবে এতে আক্কেলের প্রশ্ন আসছে কেন? আমি যতদূর জানতাম আমি দেখতে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। একজন মেয়ে আমায় স্বামী হিসেবে পছন্দ করবেই। স্বামী হিসেবে পছন্দ করার জন্য যে যে গুণাবলী থাকা প্রয়োজন আমার মধ্যেতো তার সব গুণাবলী-ই আছে বলে আমার মনে হয়। তাহলে তোমার এসব বলার মানেটা ঠিক বুঝলাম না।”
তাহা একটা শুঁখনো কাঁশি দেয়। কাঁশতে কাঁশতে আড়চোখে একবার আহিরকে অবলোকন করে। আহির আসলেই সুন্দর। ভালো ফ্যামিলির। পড়াশুনায় বরাবর ভালো ছিল। এখন শুধু একটা ভালো চাকরির অপেক্ষা। ভালো কোনো ফ্যামিলির সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিত মেয়েকে নিশ্চয়ই আহিরের জন্য পছন্দ করা হবে। তাহা মনে মনে এসব ভাবলেও আহিরের সামনে কখনো এসব বলবে না।
“আপনি ভালো করে একদিন আয়না দেখে আসবেন। আপনার মত হনুমানকে কে বিয়ে করবে শুনি? স্বামী হিসেবে আপনার মত হনুমানকে কোনো মেয়েই পছন্দ করবে না।”
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ