অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-১৩+১৪

0
520

#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_১৩

“আপনি ভালো করে একদিন আয়না দেখে আসবেন। আপনার মত হনুমানকে কে বিয়ে করবে শুনি? স্বামী হিসেবে আপনার মত হনুমানকে কোনো মেয়েই পছন্দ করবে না।”

তাহা কথাটা বলে আহিরের দিকে একনজর তাকায়। আহির তাহা’র দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

“আমি হনুমান?”

“হুম। আপনি হনুমান সেটা আমরা জানি। তাই বলে এত জনে জনে তা প্রচার করতে হবে না।”

আহিরের মুখ হা হয়ে যায়। মেয়েটা তাকে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে দিল।

“কোন এঙ্গেলে আমাকে হনুমানের মত দেখতে বলোতো?”

আহিরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করে একবার।

“আপনাকে সম্পূর্ণটাই হনুমানের মত দেখতে লাগে।”

আহির চোখ উলটিয়ে তাকায় তাহা’র পানে। মেয়েটা তাকে রীতিমত পঁচাচ্ছে।

“আচ্ছা আমি হনুমানের মত দেখতে এবার তুমি খুশি?”

আহিরের কথা শুনে তাহা বিরসমুখে বলে,

“খুশি কি করে হই বলুন? একই এলাকার মানুষ আমরা। সুখে দুঃখে সবাই সবার পাশে থাকি। এখন আমার এলাকার একটা ছেলেকে হনুমানের মত দেখতে এটাতো আমাদের জন্যই খারাপ সংবাদ।”

আহির উৎসুক হয়ে বলে,

“কিভাবে?”

“আরে বুঝলেন না? আপনিতো এখন একটা জোয়ান ছেলে। এখন বিয়েও করবেন ভাবছেন। তো বিয়ে করতে গেলেতো আর আপনাকে দেখে কোনো মেয়েই বিয়েতে রাজি হবে না। হনুমানের মত যাকে দেখতে তাকে কেউ কি করে বিয়ে করতে রাজি হবে বলুন?”

আহির সরল দৃষ্টি স্থাপন করে।

“থাক, আমার জন্য তোমাকে আর কষ্ট পেতে হবে না। আর শোনো একটা কথা ছিল তোমার সঙ্গে।”

“হুম বলুন।”

“তুমিতো আবিদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলে। তাই আবিদকে আমি তোমার কথা বলেছি। ও বলেছে কালকে আমার বাড়িতে আসবে। তখন না হয় তুমি ওর সাথে দেখা করে নিও।”

তাহা মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসে।

“আমাকে কি বলা যায় না কেন ওর সাথে দেখা করতে চাও?”

“না। আচ্ছা আপনার এত আগ্রহ কেন এতে?”

“মানুষতো আমি। তাই সবকিছুতে আমাদের কৌতূহল বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”

“আমি এখন কিছু বলতে পারবো না। সময় হলে বলবোনি। আমার এখন বাড়ি যেতে হবে। আমি এখন গেলাম।”
__________

“ইংরেজিতে ফেল করলি কেন তুই?”

প্রশ্নটা করে তাহা’র দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলেন সোনিয়া বেগম। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে তাহা কিছুই বলে না। নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে পুকুর ঘাটে। সোনিয়া বেগম আকস্মিক কেঁদে দেন। হঠাৎ করে মা’কে এভাবে কাঁদতে দেখে তাহা অবাক হয়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে মা’কে প্রশ্ন করে,

“কি হয়েছে আম্মু? কাঁদছো কেন তুমি?”

সোনিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

“এই জীবনে কি আমি শান্তি পাবো না? আমায় কি তোরা কেউ শান্তিতে বাঁচতে দিবি না? স্বামীর সংসারেতো শান্তি পাইনি। তোকে আগলেইতো বেঁচে আছি আমি। তাও কেন তুই আমার কথা ভাবিস না? কেন তুই আমায় একটু শান্তি দিস না?”

“আম্মু তুমি কেঁদো না। দেখো, এবার ভালো করে পড়তে পারিনি তাই রেজাল্ট খারাপ এসেছে। তুমিতো জানো আমি ইংরেজিটা ভালো করে পারি না।”

“পারিস না যেহেতু, সেহেতু মন দিয়ে পড়তে পারিস না? তোর জন্য দরকার হলে আমি ভালো টিউটর রাখবো। আমি চাই আমার মেয়েটা যাতে মানুষের মত মানুষ হয়।”

“আম্মু, সাথী লালবাতি নাকি চার সাবজেক্টে ফেল করেছে?”

“ও যত সাবজেক্টেই ফেল করুক তা আমাদের দেখার বিষয় না। তুই ভালো করবি। মা’কে একটু ভালোবাসতে ইচ্ছা করে না তোর?”

“আম্মু তুমিতো জানো আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি।”

মা’কে জড়িয়ে ধরে তাহা। সোনিয়া বেগমও তাহা’কে একহাতে জড়িয়ে ধরেন।

“আন্টি আপনি আমায় ডেকেছেন?”

আহির কথাটা বলে তাহা’দের উঠোনের পশ্চিমদিকটায় আসে। এখানে খুব বড় একটা পুকুর আছে। পুকুর পাড়েই মা-মেয়ে বসে আছে।

“আহির এসেছো?”

সোনিয়া বেগম তাহা’কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আহিরকে এ জায়গায় দেখে তাহা চোখ ছোটছোট করে তাকায়। আহিরকে কেন ডাকলো তার মা? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।

“তুমিতো জানো তাহা ইংরেজিতে কত দুর্বল। প্রি-টেস্টে ইংরেজিতে ফেলও করেছে। কোচিং থেকে এবার বাদও দিয়ে দেবে। আমি বলছিলাম কি তোমার যদি সময় থাকে তাহলে তুমি যদি একটু পড়াতে। দরকার হলে ও তোমাদের বাড়ি গিয়ে পড়বে। আফিয়াও না হয় পড়লো। পড়াবে বাবা?”

আহির পড়লো বিপাকে। কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বাড়িতে। কোচিং সেন্টার থেকে আগামী মাস থেকে ভেবেছে চলে আসবে। কিন্তু এখন কি করবে বুঝতে পারছেনা। এদিকে মা’য়ের কথা শুনে তাহা’র হৃদয় ছলাৎ করে ওঠে। কি বলছে এসব মা? আহিরের কাছে ও কখনো পড়বে না। কিন্তু এটা মা’কে বলা মানে নিজের দুঃখ নিজে টেনে আনা। ইংরেজিতে ফেল করার পরও কপাল জোরে আজ বেঁচে গেল। আল্লাহ আজ বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে। তাহা আহিরকে ইশারায় বারবার বুঝাচ্ছে যাতে আহির না করে দেয়। আহির তাহা’র দিকে একবার তাকিয়ে সোনিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,

“আচ্ছা আন্টি। আপনি কাল বিকাল থেকে ওকে পাঠিয়ে দেবেন। যতদিন পারি। বেশিদিন মনে হয় পারবো না। আগামী মাসের শেষের দিকে আমার অনেকগুলো পরীক্ষা আছে।”

সোনিয়া বেগম এতেই মুচকি হেসে বলেন,

“তুমি যতদিন পারো বাবা। এতেই হবে। অনেক ধন্যবাদ তোমায় বাবা। এসো ঘরে এসো।”

আহির তাড়া দেখিয়ে বলে,

“না আন্টি আমার একটু কাজ আছে। আমায় এখন যেতে হবে। আসি আন্টি আসসালামুআলাইকুম।”

আহির চলে গেলে সোনিয়া বেগম তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। এদিকে রাগে ফুলছে তাহা। আহিরকে এত করে বুঝালো যাতে না করে দেয় কিন্তু ছেলেটা করলোই না। তবে হঠাৎ করে অনুভব করলো ওর তেমন একটা খারাপ লাগছে ব্যাপারটায়। বরঞ্চ ভালোই লাগছে। ইদানীং কেন যেন তার আহিরের সাথে কথা বলতে খারাপ লাগে না। অধিকন্তু ভালোই লাগে।

“তুই পড়বিতো ওর কাছে? কোনো ঝামেলা যাতে না করিস। তাহলে কিন্তু আমার যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে চলে যাবো। তোকে ফেলেই।”

আবারও কেঁদে দেন সোনিয়া বেগম। তাহা এগিয়ে গিয়ে মাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে।

“তুমি চিন্তা করো না আম্মু সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি অন্তত আমার জন্য কেঁদো না। এসবের জন্য খুব অপরাধী মনে হয় নিজেকে। আমি মন দিয়ে পড়বো পাক্কা প্রমিস।”

______________

তাহা বইখাতা নিয়ে আহিরের সামনে বসে আছে। পাশের চেয়ারটায় আফিয়া বসে। আহির একমনে পড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পড়ানোর পর দেখে আফিয়া চুপচাপ পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছে। কিন্তু তাহা চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। তা দেখে আহির টেবিলটার ওপর হাত দিয়ে জোরে একটা বাড়ি দেয়। আকস্মিক আওয়াজে তাহা লাফিয়ে উঠে। আহিরের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। পরমুহূর্তে বুঝতে পারে ঘটনাটা। মাথা চুলকে আহিরকে বলে পড়াতে। আহিরও মুচকি হেসে পড়ানোতে মনোযোগ দেয়।

“আফিয়া, যা তাহা’র জন্য চা নিয়ে আয়।”

পড়ার একদম শেষ পর্যায়ে এসে আহির বলে। তাহা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে,

“না, না। আমি চা খাবো না এখন।”

আহির তাহা’র কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলে,

“তুই চা নিয়ে আয় তো।”

ভাইয়ের কথায় আফিয়া মাথা নেড়ে চা আনতে চলে যায়।

“একটু পর আবিদ আসবে। ওর সঙ্গে দেখা করে নিও তখন।”

তাহা মাথা নেড়ে বলে,

“আচ্ছা।”

___________

ড্রয়িংরুমের সিঙ্গেল সোফায় চারপাঁচজন অচেনা লোকের সামনে বসে অাছে তাহা। সবাই তাহা’র বাবা অর্থাৎ ইব্রাহীম খলিলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ইব্রাহীম খলিল বাড়িতে নেই। কোনো একটা কাজে শহরে গিয়েছেন। আরো আগে বলেছেন কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ি পৌঁছাবেন। কিন্তু এখনও এসে পৌঁছাননি বাড়িতে। তাহা বসে বসে ওনাদের কীর্তিকলাপ দেখছে। লোকগুলোকে দেখতে তাহা’র কাছে সুবিধার লাগছে না। কেমন যেন দেখতে। তাহা’র কেন যেন ওনাদের দেখে মনে হচ্ছে লোকগুলো কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত। আচ্ছা যদি তাই হয় তাহলে এমন লোকেরা তাহা’র বাবার কাছে কেন আসবে? তাহা’র কাছে সব গণ্ডগোলে লাগছে।

“তোমরা এখানে এসেছো কেন? বলেছি না তোমরা আমার অফিসঘরেই যাবে। বাড়ির ভিতরে আসতে বারণ করেছি না একদিন?”

ইব্রাহীম খলিল তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকেন। তাড়াহুড়ো করে লোকগুলোকে বাইরে যেতে ইশারা করেন। সবাই ওনার ইশারা বুঝে বাইরে চলে যান। উনিও পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে যান। তাহা বসে বসে ভাবছে কেইসটা কি হল? উনি এভাবে সবাইকে তাড়া দেখিয়ে বাইরে বের করে দিলেন কেন? নিশ্চয়ই এতে কোনো ঘাপলা আছে। তাহা ভাবছে, এতদিন সাথীর পর্দা ফাঁস করার জন্য অনেক খেটেছে। অনেক কিছু জানতেও পেরেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সাথীর আগে ইব্রাহীম খলিলের ব্যাপারটাই দেখতে হবে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে ইব্রাহীম খলিলও কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_১৪

দিন গড়িয়ে মাস চলে আসলো। তাহা’র মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে সবাই। আগের মত ছেলে ছেলে ভাব নিয়ে কথা বলে না। কিছুটা বদল এসেছে ওর ব্যবহারে। আহিরের সাথে সম্পর্কটা খানিকটা উন্নতিও হয়েছে। তাহা’র পড়ায় কোনো সমস্যা হলে আহিরকে বললে আহির খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেয়। তবে তাহা’র তার বাবার সাথে সম্পর্কটার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। এখনো সেই ভাবেই কথা বলে বাবার সাথে। সৎমায়ের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতি অবনতি কোনোটাই হয়নি। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলে না ওনাদের সঙ্গে। তাহা নিজেকে ভালোবাসতে শিখছে। তবে নিজের এটিটিউড বঝায় রাখে সবসময়।

“তাহা চিপস খাবি?”

আফিয়ার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় তাহা। ক্লাসরুমে বসে বসে খাতায় আঁকিবুঁকি করছে তাহা। পাশের বেঞ্চ থেকে আফিয়া তাকে চিপস অফার করছে।

“দিলে কে না খায়? হাতে রেখে বলছে খাবি? দে।”

তাহা’র বলতে দেরি হলো কিন্তু আফিয়ার হাত থেকে চিপসের প্যাকেটটা কেড়ে নিতে দেরি হয়নি। আফিয়া মুখ ফুলিয়ে তাকায় তাহা’র দিকে।

“এই তুই সবটা নিয়ে নিয়েছিস কেন? আমাকেও দে। আমি এখনো একটাও খাইনি। প্যাকেটটাও খুলিনি। চল দু’জনে ভাগ করে খাই।”

“এতক্ষণ এটা তোর ছিল, কারণ এটা তখন তোর হাতে ছিল। এখন এটা আমার হাতে। তাই এটা আমার। আর আমি আমার জিনিস কারো সাথে শেয়ার করি না।”

তাহা সানন্দে বসে চিপস খাচ্ছে। গালে হাত দিয়ে অসহায় মুখ করে তাহা’র খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আফিয়া।

“এই একদম আমার খাওয়ার দিকে নজর দিবি না। তোর জন্য যদি আমার পেট খারাপ হয় তখন?”

আফিয়ার মুখটা গোল আলু আকৃতির হয়ে যায়। তার চিপস খাচ্ছে মেয়েটা। আবার তাকেই বলছে নজর না দিতে, ভাবা যায় কি এগুলা?
_____________

“আমি তাহা’কে বিয়ে করতে চাই আম্মু।”

আরহামের কথা শুনে বাড়িতে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে যায়। কি বলছে এসব আরহাম?

“তোর কি মাথা গেছে আরহাম? তুই চেয়ারম্যানের ওই বখে যাওয়া মেয়েকে বিয়ে করতে চাস? তোর জন্য কি মেয়ের অভাব পড়বে?”

মায়ের কথা শুনে আরহাম একরোখাভাবে বলে,

“আমি কোনো কিছু শুনতে চাই না আম্মু। আমার তাহা’কেই চাই। ওকে আমার লাগবে।”

“কিন্তু তাহা তোকে বিয়ে করবে কেন?”

ফাতেমা বেগম আরহামের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন।

“মানে? তুমি কি বলতে চাচ্ছো জেঠিমা? আমায় বিয়ে করবে না কেন?”

“আমি জিজ্ঞেস করলাম তোকে বিয়ে করবে কেন তাহা? তুই সেটার উত্তর না দিয়ে আবার আমায় উল্টে প্রশ্ন করছিস। আর মার্জিয়া, তুই তাহা’কে বখে যাওয়া মেয়ে বলছিস? ও যদি বখে যাওয়া হয় তাহলে তোর ছেলে কি?”

ফাতেমা বেগমের কথায় মার্জিয়া বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন।

“বড়ভাবি তুমি চেয়ারম্যানের ওই মেয়ের সঙ্গে আমার আরহামের তুলনা করছো? কি করেছে আরহাম? আর ওই মেয়ের মধ্যে মেয়েদের কোনো লক্ষণ দেখো তুমি? আস্ত বেয়াদব ও। দেখো না ও আফসানার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে? ওই মেয়েকে আমি আমার ঘরে কখনো তুলবো না।”

মার্জিয়া বেগমের কথায় ফাতেমা বেগম বিদ্রুপাত্মক হাসেন।

“এখানে তোর বোনকে তুলে আনিস না মার্জিয়া। তাহলে আমি এমন কিছু বলবো যা তোর ভালো লাগবে না। আর আরহাম কেমন আমার মনে হয় তা তুই ভালো করেই জানিস। ও আর একটা কথা তাহা’কে তুই হয়তো ইদানীং লক্ষ্য করিস নি। ও আগের মত আর নেই। অনেক সুশীল হয়েছে মেয়েটা। খুব ভালো ঘরে বিয়ে দেবে ওর। চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ের জন্য পাত্রের অভাব পড়বে না। আমাদের ঘরের চাইতে ভালো ঘরে ওর বিয়ে দেওয়া যাবে। আরহাম তাহা’র পিছনে পরে থাকে ওকে ডিস্টার্ব করে এটা তাহা’র পছন্দ নয়। তাহা আরহামকে এব্যাপারে ওয়ার্নিংও করেছে। এবার তুই তোর ছেলেকে বোঝা।”

কথা সমাপ্ত করে নিজের কাজে চলে যান ফাতেমা বেগম। আর ড্রয়িংরুমের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে আহির। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে সে। এতদিন বলেছে তাহা’কে আরহামের বৌ হতে দেবে না। কারণ তাহা আরহামের যোগ্য নয়। কিন্তু তার এখন মনে হচ্ছে আরহাম তাহা’র যোগ্য নয়। তাহা’কে নতুন করে চিনছে আহির। মেয়েটা আগের চেয়ে খুব ভালো হয়ে গেছে। মেয়েটার খুব সুন্দর একটা মন আছে। যা এতদিন সবার থেকে আড়াল করে রেখেছিল তাহা। তা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে।

_______________

“আসবো স্যার!”

আহির বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। দরজায় বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে তাহা। মেয়েটার পরণে কালো রংয়ের থ্রি-পিছ। মাথায় ব্লু রংয়ের হিজাব। মেয়েটাকে কি মিষ্টি না লাগছে। আগের মত বেপরোয়া ভাবটা নেই। মুখ থেকে কাঠিন্যভাবটা সরে গিয়ে কোমল ভাবটা জায়গা পেয়েছে।

“এসো।”

আহিরের অনুমতি পেয়ে তাহা গুঁটিগুঁটি পায়ে ভিতরে প্রবেশ করে। আহির কোনো একটা বই পড়ছে। তাহা আহিরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিয়ৎক্ষণ। আহির ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বোঝায় কি হয়েছে?

“পড়তে এসেছি।”

তাহার সহজ উত্তর। আহির ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে। উঠে বসে আস্তে ধীরে।

“আফিয়া কোথায়?”

“আসছে।”

তাহা বলতে বলতে আফিয়াও চলে আসে।

“আজকে তোমাদের আমি একটা পরীক্ষা নেবো বলে রেখেছিলাম। কাল থেকে আর পড়াতে পারবো না আমি। আচ্ছা তোমরা বইগুলো সাইডে রাখো। আর খাতা বের করো। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি কি কি লেখতে হবে।”

আহির একদমে কথাগুলো তাহা আর আফিয়ার দিকে তাকায়। আফিয়া আর তাহা খাতা বের করছে নিঃশব্দে।
__________

“দাও সময় শেষ।”

আহির কথাটা বলে খাতাটা টেনে নেয়। তাহা কলমটা রেখে দিয়ে মুচকি হাসে। আজ প্রথম ইংরেজি পরীক্ষা দিয়ে হাসছে সে।

“আফিয়া চল বারান্দায় যাই। ততক্ষণে উনি খাতা দেখুক। যাবো আমরা?”

তাহা প্রশ্ন করে আহিরের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে। আহির মাথা নেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। তাহা আর আফিয়া উঠে গিয়ে বারান্দার ফ্লোরে আসাম করে বসে পড়ে। মোবাইল বের করে দু’জনে ফানি ভিডিয়ো দেখা শুরু করে। একপর্যায়ে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ের ওপর পড়ে যায়।

“তাহা! এই তাহা! দেখ এটা তোর বাবা না? এই চিপা গলিতে উনি কেন যাচ্ছেন?”

আফিয়ার কথা শুনে তাহা মোবাইলটা রেখে ফ্লোর ছেড়ে উঠে বসে। উঁকি দিয়ে দেখে সত্যিই তার বাবা আহিরদের বাড়ির দক্ষিণদিকের সরু গলিটা দিয়ে ভিতরে ঢুকছেন। চারদিকে বারবার তাকাচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাকে এখানে দেখে ফেলার ভয় পাচ্ছেন তিনি। তাহা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রয় বাবার দিকে। তিনি এই গলিটা দিয়ে যাচ্ছেন কোথায়? এখানটায়তো কেউ যায় না। এই জায়গাটা পরিত্যক্ত। এখানে ইব্রাহীম খলিলের যাওয়ার কারণটা ঠিক বোধগম্য হলো না তাহা’র।

“তোমরা ভিতরে এসো।”

আহিরের ডাকে তাহা বাবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ভিতরে তাকায়। আস্তে আস্তে ভিতরে যেতে নেয়। আরেকবার পিছন ফিরে বাবার দিকে তাকায়।

“একমাস এত পরিশ্রম করে পড়ালাম কিন্তু তোমার কোনো পরিবর্তনই দেখছি না। ত্রিশ নাম্বারের মধ্যে মাত্র পনেরো। মানে হান্ড্রেডে ফিফটি পার্সেন্ট। সেখানে দেখো, আফিয়া ত্রিশে উনত্রিশ পেয়েছে। তুমি নিজের খাতা আর ওর খাতটা একটু মিলিয়ে দেখো।”

আহির তাহা’র সামনে খাতাদু’টো রাখে। তাহা নিজের খাতাটা হাতে তুলে নিয়ে ঠোঁট একদিকে প্রসারিত করে হাসে।

“আপনি কি বলছেন? এটা কি কম নাম্বার? আপনি কত কঠিন কঠিন দেখে দিয়েছেন তাও আমি পনেরো পেয়েছি। এতেই বা কম কি? আর আপনি কি জানেন আমি আগের চেয়ে ইংলিশে বেশ কিছু শিখে গেছি। আপনি আফিয়ার সাথে আমার তুলনা করছেন? ওর এসএসসিতে রেজাল্ট ছিল গোল্ডেন সেখানে আমার রেজাল্ট ছিল এ গ্রেড। ওর আর আমার তফাৎটাতো বুঝতেই পারছেন। আমার কাছে এই নাম্বারটাই বেশি লাগে।”

নিজস্ব স্টাইলে দাঁড়িয়ে ভাব নিয়ে বলে তাহা। আহির নিজের কপাল চাপড়ায়। এ মেয়েকে কিছু বলে লাভও নেই। কোনো কিছু বোঝার ধারেকাছে নেই তাহা। আফিয়া গোলগোল চোখে তাকিয়ে রয় তাহা’র দিকে। এই মেয়ের দ্বারা দুনিয়ার সব অসম্ভবই সম্ভব।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ