#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_১৯
“আপনি? আপনি এমন খারাপ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত?”
আকস্মিক অন্যকোনো মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে ইব্রাহীম খলিলের হাত আলগা হয়ে আসে। তিনি পেছনে তাকিয়ে দেখেন কেউ নেই সেখানটায়। কিন্তু তিনি স্পষ্ট শুনেছেন অন্যকারো গলা। তিনি এগিয়ে গিয়ে বাহিরে উঁকিঝুঁকিও দিয়ে আসলেন। কিন্তু মানুষ কেন? মানুষের টিঁকিটিও খুঁজে পেলেন না। সাথের সাঙ্গুপাঙ্গুগুলোকে জিজ্ঞেস করলে বলে তারা কিছু শুনেনি। মূলত, জুয়া খেলার ধ্যানে ছিল বিধায় এ ব্যাপারটাতে তেমন খেয়াল করেনি। তাহলে কি ইব্রাহীম খলিল ভুল শুনেছেন? হবে হয়তো! নাহলে এখানে কারোর আসার কথা নয়। মনের ভুল ভেবে বিষয়টা আর ঘাঁটালেন না তিনি। নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু দরজার অপরপাশে দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে রইলো তাহা। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যাতে কেউ তাকে দেখতে না পায়। চরম ভুল করতে যাচ্ছিল সে। কথাটা বলেই বুঝতে পারলো সে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। তাই তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে সরে আসে। তাহা এবার কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। এখন তাকে দেখে ফেললে সেও বিপদে পড়বে। অন্যকোনো মেয়েদের সাথে এমন করতে পারলে বাবা নামক অমানুষটা তাকেও ছাড়বে না। কিন্তু এই অসহায় মেয়েগুলোকে ফেলে রেখে এখান থেকে তাহা যেতেও পারবে না। তাকে যেকোনো মূল্যেই হোক না কেন এই মেয়েগুলোকে বাঁচাতেই হবে। তারজন্য তাহা’কে সর্বপ্রথম নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে। ইব্রাহীমের খলিলের একটা গুণ পেয়েছে তাহা। ইব্রাহীম খলিলের মত তাহাও খুব বুদ্ধিমতী। তাই বুদ্ধিমত্তার সাথে ডান হাতের মুঠোয় রাখা মোবাইলটা বের করে। মোবাইলের সাউন্ড মিউট করে রাখে। তাহা এবার বেশ সাবধানের সাথে মোবাইলটার রিয়ার ক্যামেরা অন করে। মোবাইলটাকে দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে সামনে ঘটনা গুলোকে ক্যামেরা বন্দী করে। ভেতরে আলোচনা চলছে আর কিছুক্ষণ পরই মেয়েগুলোকে বর্ডারে নিয়া যাওয়া হবে। সেখান থেকে ভারতের রাজস্থানে পাচার করা হবে। এর বিনিময়ে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পান ইব্রাহীম খলিল। এমনি এমনিতো আর ওনার লাখ লাখ টাকার সাম্রাজ্য তৈরি হয়নি। ইব্রাহীম খলিল সাঙ্গুপাঙ্গুদের মধ্য থেকে একজনকে বললেন গাড়ি বের করার জন্য। এই দালানের পেছনে একটা বড় বাগান রয়েছে। সেই বাগানের মধ্যে গোপন রাস্তাও রয়েছে। যার হদিশ আশেপাশের কেউ-ই জানে না। কথাগুলো শুনে তাহা তাড়াতাড়ি করে অন্ধকার রুমটার কয়েকটা ভাঙা চেয়ারের পেছনে গিয়ে লুকোয়। সময়টা এখন আসরের শেষ ওয়াক্ত। মাগরিবের আজান হতে আরো চল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়তো আছে। এখন গরম না হলেও তাহা প্রচুর ঘামছে। ওড়নার এক কোণা দিয়ে মুখের, গলার ঘাম মুছে নেয়। সে এখন খুব ঝুঁকিপূর্ণ একটা কাজ করতে চলেছে। তাহা জানে না এর পরিণতি কেমন হবে। এতে তাহা’র জীবনের ঝুঁকি রয়েছে শতভাগ। তবে তাহা’কে কাজটা করতেই হবে। ওই মেয়েগুলোর জন্য হলেও করতে হবে।
______________
“চেয়ারম্যান ইব্রাহীম খলিল! আপনি জায়গাটা থেকে বেরোনোর চেষ্টা করবেন না। যে মেয়েগুলোকে এখানে আটকে রেখেছেন তাদেরকে ছেড়ে দিন। আর আত্মসমর্পণ করুন। পুলিশ আপনাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। তাই এখান থেকে পালানোর বৃথা চেষ্টা করবেন না।”
দালানের বাহির থেকে পুলিশের আওয়াজ পেয়ে ইব্রাহীম খলিলের পিঁলে চমকে ওঠে। পুলিশ? পুলিশ এখানে কিভাবে আসলো? তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তিনি মেয়েগুলোকে পাঠানোর বন্দবস্ত করেই ফেলেছেন ইতোমধ্যে। একটু পরেই পাচার করা হত কিন্তু এর মধ্যে পুলিশ কিভাবে আসলো? আর পুলিশ এখানকার খবর জানলোই বা কি করে? তার মাথায় এসবের কিছুই ঢুকছে না আপাতত। এখন মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। যেকোনো মূল্যেই হোক এখান থেকে তাকে পালাতে হবে। পুলিশের কাছে ধরা দিলে চলবে না। ইব্রাহীম খলিল এবার তরপর করে উঠে গিয়ে বাগানের কাছের ভাঙা জানালাটার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ান। যেভাবেই হোক এই জানালাটা দিয়েই তাকে বেরোতে হবে। একবার এখান থেকে পালাতে পারলে তার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না এখানে। আর পুলিশের কাছে তার বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রমাণও থাকবে না। একবার এখান থেকে পালাতে পারলেই হলো। তিনি পালাতে নিলে তাহা পেছন থেকে তার সাদা পাঞ্জাবির কিছু অংশ হাত মুঠো করে ধরে রাখে। আকস্মিক আক্রমণে ইব্রাহীম খলিল নিজের জায়গা থেকে কিছুটা নড়েচড়ে যান। পিছনে তাকিয়ে দেখেন তার ঠিক একহাত দূরে তাহা দাঁড়িয়ে। তাহা’কে এ জায়গায় দেখে ইব্রাহীম খলিল আরো ভয় পেয়ে যান। “আচ্ছা তাহা এখানে কেন?” এই প্রশ্নটা মাথায় আসলেও সময় হলো না ভাববার। তাহা’র হাত থেকে পাঞ্জাবির অংশটুকু ছাড়িয়ে দৌঁড়ে জানালা টপকে বাহিরে পালিয়ে যান। এভাবে পালাতে দেখে তাহা চিল্লিয়ে পুলিশদেরকে ডেকে বলে,
“উনি পালাচ্ছেনননন। সবাই বাগানের দিকটায় আসেন।”
কথাটুকু বলে তাহা নিজেও জানালা টপকে দেয়ালের বাহিরে বেরিয়ে যায়। ইব্রাহীম খলিল প্রাণপণ নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। যেভাবেই হোক এ বিপদ থেকে ওনাকে বাঁচতে হবে। পেছনে তাহাও নাছোড়বান্ধার মত পড়ে আছে। যে কোনো মূল্যেই হোক সে ইব্রাহীম খলিলকে ধরবেই। এখন সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়। কিছু সময় বাদে অন্ধকার নেমে আসবে ধরনীতে। তাহা’র পেছনে পুলিশরাও দৌড়াচ্ছে। অনেক পুলিশ থাকায় সবাই বাগানের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। সবাই সব জায়গা থেকে ইব্রাহীম খলিলকে ধরার জন্য প্রস্তুত। দৌড়াতে দৌড়াতে একটা সময় ইব্রাহীম খলিল মূল রাস্তায় চলে আসেন। দিগ্বিদিক হারিয়ে তিনি ঢুকে গেলেন চলমান রাস্তায়। চারদিকে সব ধরনের যানবাহনের আওয়াজ। সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছুটছে নিজ গন্তব্যে। সেই চলমান গাড়ির মধ্যেই বাবা মেয়ে ছুটছে। কি অদ্ভুত দৃশ্য তাই না! ছোটবেলায় বাবা তার সন্তানের পেছন পেছন ছুটে খেলা করতো। সন্তানকে ধরে ফেললেই সন্তানের খিলখিলিয়ে হাসির আওয়াজ শোনা যেত। কিন্তু এখানের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাবা নামক এক নরপিশাচের পেছনে ছুটছে এক মেয়ে। বাবাকে ধরবে বলে। বাবার সাথে খুনসুটি করার জন্য নয়, বাবাকে তার পাপ্য শাস্তি দেওয়ানোর জন্য।
__________
একটা সময় দৌড়াতে দৌড়াতে তাহা একটা বড় ইটের টুকরোর সাথে পা লেগে পড়ে যায়। ধপ করে পিচঢালা রাস্তায় বসে পড়ে। তাহা’র বসে পড়ার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই ইব্রাহীম খলিল যেন অনেকটা সামনে চলে গেছেন। আর কিছুটা গেলেই ওনি ধরাছোঁয়ার বাহিরে চলে যাবেন। তাহা পায়ের ব্যথার জন্য উঠতে পারছে না। পেছনে একবার তাকিয়ে দেখে পুলিশরা আসছে। তারা আসতে আসতে ইব্রাহীম খলিলকে আর ধরা যাবে না। কিন্তু তাহা তা হতে দেবে না। এত অপরাধ করার পরও তার বাবাকে সে বাঁচতে দেবে না। লোকটা তার পাপের শাস্তি পাবেই। তাহা পায়ের কাছে পড়ে থাকা ইটের টুকরোটা হাতে তুলে নেয়। ইব্রাহীম খলিলের চলমান পায়ের দিকে তাকিয়ে ছুঁড়ে মারে ইব্রাহীম খলিলের পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে তার পা থেমে যায়। পায়ে ব্যথা পেয়ে পা ভেঙে তিনি সেখানেই পড়ে যান। পুলিশ তাৎক্ষণিক দৌড়ে এসে ইব্রাহীম খলিলকে ঘিরে ধরে। পেছন থেকে কিছু পুলিশ আটকে রাখা মেয়েগুলোকে গাড়ি করে নিয়ে আসে। সঙ্গে ইব্রাহীম খলিলের চ্যালাপ্যালাদেরও ধরে এনেছে। তারা চাইলেও পালাতে পারেনি। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের মানুষ এ জায়গাটায় এসে ভীড় জমায়। স্থানীয় মোটামুটি সব মানুষই চলে এসেছে। তন্মধ্যে আহিরের পরিবারের মানুষেরাও আছে। ইব্রাহীম খলিলকে এ অবস্থায় দেখে সবাই যারপরনাই অবাক হচ্ছে। বিষয়টা কারোরই বোধগম্য হচ্ছে না। তাহা এবার আস্তে আস্তে হেঁটে যায় বাবার সামনে। তারপর পুলিশদের উদ্দেশ্য করে বলে,
“এরেস্ট করুন ওনাকে। নারী পাচারকারী চক্রের সাথে যুক্ত উনি। ওনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য আমি দেবো। আর ওনার পাপকাজের প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমার মোবাইলে ভিডিও আছে সব। আশা করছি উনি ওনার প্রাপ্য শাস্তিটাই পাবেন।”
তাহা মোবাইলটা পুলিশের হাতে হস্তান্তর করে ইব্রাহীম খলিলকে ধরতে বলে। ইব্রাহীম খলিলকে পুলিশ ধরতে আসলে তিনি তাহা’কে একহাতে টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। পকেট থেকে চকচকে একটা ছুড়ি বের করে তাহা’র গলায় চেপে ধরেন। তাহা যদি একটু নড়ে তাহলেই ছুড়িটা তাহা’র গলায় বসে যাবে।
“আমাকে যদি কেউ ধরতে আসে আমি কিন্তু এই মেয়েটাকে মেরে ফেলবো। নিজের মেয়ে বলে কিন্তু ছাড়বো না। তাই কেউ এক পা-ও এগোনোর চেষ্টা করবেন না। আমাকে এখান থেকে যেতে দিন তাহলেই আমি এই মেয়েটাকে ছেড়ে দেবো।”
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ
#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_২০
“আমাকে যদি কেউ ধরতে আসে আমি কিন্তু এই মেয়েটাকে মেরে ফেলবো। নিজের মেয়ে বলে কিন্তু ছাড়বো না। তাই কেউ এক পা-ও এগোনোর চেষ্টা করবেন না। আমাকে এখান থেকে যেতে দিন তাহলেই আমি এই মেয়েটাকে ছেড়ে দেবো।”
ইব্রাহীম খলিল কথাটুকু বলতেই সবার মধ্যে চাপা গুঞ্জন আরম্ভ হয়ে গেল। পুলিশরাও খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো। এমন চকচকে ছুরি দিয়ে একটা আঘাতেই তাহা শেষ হয়ে যাবে। তাই ইব্রাহীম খলিলকে আটকাতে যাওয়া এখন বোকামো বই কিছু নয়। গলায় ছুরিটা লাগায় তাহা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। এমন অবস্থায় যে কেউই ভয় পেয়ে যাবে। তাহা’র এখন ভয়ে নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে জপছে। তাহা’র এ অবস্থা দেখে আহির বিচলিত হয়ে পড়ে। প্রিয়তমার এমন অবস্থা কোন প্রেমিকই বা সইতে পারে?
“খুব চালাক না তুই? আমায় জেলে দিতে চাইছিলিস। আরে আমি তোর জন্মদাতা। তাই তোর চেয়ে বুদ্ধি আমার অনেকটাই বেশি। নিজের মেয়ে বলে তোকে ছেড়ে দেবো এমনটা ভুলেও ভাবতে যাস না যেন। কারণ আমার কাছে এসব সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই। আমার সব সম্পর্ক শুধু টাকার সাথে। টাকার। আর জানিস, আমার পরবর্তী নিশানা কিন্তু তুই ছিলিস। তোকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিতাম। সোজা দুবাইয়ে পাচার করতাম তোকে। তার আগেই তুই আমার গেঁড় ধরে টানাটানি শুরু করে দিলি। আমার পর্দা ফাঁস করতে চাইছিলিস না? আমায় জেলে দিবি তুই? হাহ! এবার তুই-ই আমায় এখান থেকে বেরোতে সাহায্য করবি।”
ইব্রাহীম খলিল তাহা’কে নিজের সাথে টানতে টানতে পুলিশদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে চলে গেলেন। তাহা এবার নিজের জন্য ভাবছে না। যদি তার বাবাকে শাস্তি দিতে তার অনেক বড় ক্ষতি হয় তাহলে হবে। তাহা’র এখন মূল উদ্দেশ্য তার বাবাকে শাস্তি দেওয়া। তাহা চোখ বন্ধ করে খুব সময় নিয়ে নিঃশ্বাস আটকে রাখে। শেষে জোরে নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করেই ডান হাতটা তুলে গলায় আটকে ছুরিটা মুঠো করে ধরে। চকচকে ধারালো ছুরি খালি হাতে ধরায় তাহা’র ডানহাত পুরো কেঁটে যায়। হাত থেকে টকটকে লাল রক্তগুলো উবছে উবছে পড়ছে রাস্তায়। সেদিকে তাহা কোনো ভ্রুঁক্ষেপ না করে আরেকহাতে বাবা নামক নরপিশাচকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। তাহা’র ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে ইব্রাহীম খলিল রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়েন। পুলিশ এবার ওনাকে ধরে ফেলে। এবার আর পালানোর কোনো জায়গা রইলো না ইব্রাহীম খলিলের। তাহা হাত ঝাড়া দিয়ে রক্ত কিছুটা মুছে ফেলে হাত থেকে। আহির এগিয়ে এসে তাহা’র হাতটাকে নিজের দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে।
“তাহা তোমার হাতে রক্ত ঝড়ছে। ইশ! কতটা রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। চলো, বাড়ি চলো তোমার হাতে ব্যান্ডেজ করতে হবে।”
তাহা আহিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“হাতের রক্তক্ষরণটাই দেখছেন আহির। ভেতরের রক্তক্ষরণটা দেখছেন না? ভেতরের রক্তক্ষরণের কাছে এই রক্তক্ষরণটা যে খুবই সামাণ্য।”
আহির তাহা’র দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটার মনের ওপর দিয়ে এখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে সামলানোর জন্য এখন কাউকে প্রয়োজন। তার এখন ইচ্ছে করছে তাহা’কে জড়িয়ে ধরে তাহা’র মাথায় হাত রেখে বলতে,”তুমি কেঁদো না তাহা। একদম কাঁদবে না তুমি। এসব নিয়ে কোনো কষ্ট পাবে না তুমি। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। আমি তোমায় আর কাঁদতে দেবো না।” কিন্তু আফসোস! মনের ইচ্ছেটাকে পূরণ করার কোনো অধিকার নেই আহিরের। আহির তাহা’কে সামনে এগোতে বলে। ইব্রাহীম খলিল তার পাপের শাস্তি পাচ্ছেন। এলাকার সবাই ছিঃ ছিঃ করছে এসব জেনে। পুলিশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। তিনি তাহা’র দিকে তাকিয়ে রইলেন অনিমেষ। এত কিছুর পরও তিনি আশা করছেন তাহা ওনার পক্ষে কিছু বলবে। তিনি আশা করছেন যদি মেয়েটা তার বাবার দিকে ফিরে তাকায়! কিন্তু না। তাহা একবারের জন্যও বাবার দিকে ফিরে তাকায়নি। কেউ একজন পেছন থেকে পায়ের জুতা খুলে মারেন ইব্রাহীম খলিলের গায়ে। রাগে, অপমানে তিনি রোষানল দৃষ্টিতে তাকান ব্যাক্তিটির দিকে। সবসময় মাথা উঁচু করে চলা ব্যাক্তিটির আজ এই হাল! তাহা এখনও মাটির দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তাহা’র বাবাকে নিয়ে গেল পুলিশ। আহির তাহা’র হাত ধরে উল্টোপথে হাঁটা দেয়। পুলিশের গাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গেলে তাহা পিছনে ফিরে তাকায়। যেখান থেকে তার বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেন যেন তার মধ্যে এখন কোনো অনুভূতি-ই কাজ করছে না।
__________
“এসব কি বলছো তুমি আহির? আআমি এএসব বিশ্বাস করি না। উনি খারাপ হতে পারেন কিন্তু এতটা খারাপ নয়।”
কান্নামাখা কন্ঠে কথাগুলো বলেন সোনিয়া বেগম। আহির মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তাহা অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। আহির এবার সোনিয়া বেগমকে শান্ত হতে বলে সব ঘটনা আস্তে আস্তে খুলে বলে। সব শুনে সোনিয়া বেগম কান্নাভেজা দৃষ্টিতে তাকায় তাহা’র দিকে। তাহা’র দৃষ্টির সাথে নিজের জায়গারও কোনো নড়চড় নেই। সোনিয়া বেগম এগিয়ে এসে মেয়েকে দু’হাতে আগলে ধরে চোখেমুখে শত আদরে ভরিয়ে দেন। ব্যান্ডেজ করা হাতটা তুলে সেটাতেও ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে দেন। আজ তার মেয়েটার ওপর দিয়ে কত বিপদই না আসছিল। মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে তাহা এবার হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। আজ প্রায় অনেক বছর পর তাহা এভাবে কাঁদছে। এতদিনের পুষিয়ে রাখা দুঃখ, কষ্ট, অভিমানগুলো আজ চোখের জল হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে তাহা বলে,
“আম্মু, আম্মু, ওই লোকটা খুব বাজে। উনি আমার বাবা হতে পারেন না। উনি কত কত মায়ের বুক খালি করেছেন। কত মেয়েকে মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন জানো? উনি খুব নিকৃষ্ট একটা মানুষ। উনি কেন আমার জন্মদাতা হলেন? কোনো ভালো মানুষ কেন আমার জন্মদাতা হলেন না? আমি ওই লোকটাকে খুব ঘৃণা করি। জানো, ওই লোকটার রক্ত আমার শরীরে বইছে বলে এখন আমার নিজের প্রতি নিজেরই ঘেন্না হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নিজেকে নিঃশেষ করে দিই। এই পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিতে আর ইচ্ছে করছে না আমার। আম্মু, আম্মু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার কলিজাটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। আম্মু আমার নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে খুব।”
শেষের কথাটুকু বলতে বলতে তাহা নিজের সবটুকু ভার মায়ের ওপর ছেড়ে দেয়। আকস্মিক তাহা’কে এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে দেখে আহির এগিয়ে এসে তাহা’কে আগলে নেয়। অতিরিক্ত স্ট্রেস মেয়েটা নিতে পারেনি বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আহির তাহা’কে ধরে সোফায় নিয়ে শোয়ায়। তাহা’র জ্ঞান ফিরাতে হবে আগে। মেয়েটা সহজে কি এসব ভুলতে পারবে? তাহা’র এসব কাঁটিয়ে উঠাতে আহিরকেই তাহা’র পাশে থাকতে হবে।
____________
“নিজেই অন্যায় করলো আবার নিজেই নিজেকে শেষ করে দিল। আজব দুনিয়া!”
তাহা এক পলক বাবার লাশটার দিকে তাকিয়ে আবার অন্যদিকে দৃষ্টি স্থাপন করে। তাহা বর্তমানে স্থানীয় এলাকার থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। থানার সামনের বড় মাঠটার ওপর একটা খাটিয়া পড়ে আছে। এই খাটিয়ার লাশটা হলো ইব্রাহীম খলিলের। পুলিশের চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেতে নিলে ঘটনাস্থলেই রাস্তায় পড়ে গিয়ে অন্য এক গাড়ির চাকার সাথে পিষ্ট হয়ে যান। সাথে সাথে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। খবরটা পেয়ে সোনিয়া বেগম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওনার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। আহিরের সাথে জেদ ধরে তাহা থানায় এসেছে। বাবার লাশটার দিকে তাকিয়ে তাহার চোখ থেকে টসটসে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। কি থেকে কি হয়ে গেল তা তাহা’র বোধগম্য হচ্ছে না। একি সুখের কান্না নাকি দুঃখের? তাহা’র চোখের দিকে এখন যদি কেউ তাকাতো তাহলে দেখতে পেত তাহা’র চোখের ভাষা ভিন্ন। বাবার জন্য তাহা’র মনে শত ঘৃণা থাকলে তার অন্তরালে বাবার জন্য লুকিয়ে রাখা সুপ্ত কিছু অনুভূতিও রয়েছে। যেগুলোকে হয়তো বাবার জন্য একজন সন্তানের ভালোবাসা বলে। শত খারাপ হলে বাবাতো বাবা-ই হয়। বাবার মৃত্যু কোনো সন্তানেরই কাম্য নয়। সে বাবার শাস্তি চেয়েছিল কিন্তু এমনটা চায়নি। বাবার মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না তাহা। ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছিল বলে তাহা উলটোদিকে দৌড় দেয়। কান্না করবে না সে। একদমই কান্না করবে না। বাবা নামক ওই মানুষটা যে তার জীবনে ছিল তা সে ভুলে যাবে। লোকটার অস্তিত্ব চিরতরে মুছে ফেলবে তার জীবন থেকে।
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ