অভিনয় পর্ব-০৯

0
216

#অভিনয়
#পর্ব_৯
#মুমতাহিনা_তারিন

চাচীর দেওয়া হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি পরেছে পারু । রিপা সুন্দর করে চুল বেঁধে দিয়েছে । ঠোঁট হালকা লিপস্টিক ছাড়া মুখে কিছুই দিতে দেয়নি পারু । পারু চায় ও যেমন তেমন দেখুক । তনুজা বেগম দ্রুত পায়ে পারুর রুমে গেলো । ছোট্ট একটা আয়নায় পারু নিজেকে দেখছিল তখন ।

” পারু চল ভয় পাবি না বুঝলি ঠিক ঠিক উত্তর দিবি ”

” জি ”

তনুজা আর রিপা পারুকে নিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে দাড়ালো। ছোট ছোট চোখ নিয়ে একবার তাকালো পাত্রের দিকে । খারাপ বলে মনে হলো না ওর । তাও বুক ঢিপ ঢিপ করছে প্রথম বার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।

” ও হচ্ছে নিলয় আর এই হচ্ছে নিলয়ের খালা”

” আসসলামুআলাইকুম ”

নিলয়ের খালা কিছুটা বাঁকা হেসে পারুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলালো । এমন ভাবে খুঁটিয়ে দেখছে যে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিলে তার সুবিধা হয় । অসস্তি তে শরীরে কাটা দিচ্ছে পারুর । নিলয় কিছুক্ষন পারুর মুখের দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো ।

” কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে মা?”
“জি এইচ এস সি দিয়েছি ”

” ওহ । একটু হেটে দেখাও তো”

নিলয়ের খালার কথা শুনে বিরক্ত হলো তনুজা বেগম । চোখের ইশারায় পারুকে বলে হেঁটে দেখাতে। পারু ও বাধ্য মেয়ের মত হেঁটে দেখায় ।
” নখ গুলো দেখি ”

পারু সুন্দর ভাবে তার সুন্দর নখগুলো দেখালো । মিন্দী দিয়ে রাঙানো নখ গুলো চক চক করছে । পায়ের নখ গুলো আঙ্গুল গুলো ভালো ভাবে দেখলো। নিলয় চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। নিলয় শিক্ষিত ছেলে হওয়ায় এইসব দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে । ও কি কোনো পণ্য কিনতে এসেছে যে এইভাবে দেখতে হবে ।

” চুলগুলো দেখি মা। ইয়ে মানে অনেকের তো ছোটো চুল হয় তাই না আপা ।বাঙালি মেয়েদের বড়ো চুল না হলে কি চলে?”

তনুজা বেগম নিজের রাগ কে নিয়ন্ত্রন করে
সম্মতি দিলো ।রিপা ও চোখ বড় বড় করে নিলয়ের খালার কর্মকান্গুলো পর্যবেক্ষণ করছে । পারুর যে খারাপ লাগছে না সেটা নয়। কিন্তু প্রথম বার হওয়ায় ওর তেমন উপলব্ধি হচ্ছে না ।

ঘোমটা সরিয়ে লম্বা দীঘল চুল গুলো ছেড়ে দিলো পারু ।মুহূর্তেই কোমর ঢেকে গেলো তার চুলে । ছোটো ছোটো এলো চুল গুলো বেরিয়ে আসলো । নিলয় মুগ্ধ হলো পারুর চুল দেখে ।

” মাশা আল্লাহ খুব সুন্দর চুল তো দেখি মেয়ের । ঘরের কাজ বাজ পারো তো। বিয়ের পর থেকে কিন্তু তোমার কাজ করতে হবে নিলয়ের সম্পর্কে তো তুমি জানোই তোমার মতোই বাবা মা নেই। বড্ড কষ্ট করে বড়ো হয়েছে । ”

বাবা মা নেই শুনে পারুর মনে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগা সৃষ্টি হলো । পারুর ও তো বাবা মা নেই যতই আদর দিক চাচা চাচী আব্বা আম্মার মত কি কেউ ভালোবাসতে পারে?
______________________

আজকে অফিসে চাপ কম থাকায় একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলো শাওন । হাতে নতুন প্রজেক্টের কাগজ পাতি দিয়ে ভরা । গেট পেরিয়ে সদর দরজায় আসতে না আসতে ভিতর থেকে গুঞ্জন শুনতে পারলো । সদর দরজা খোলা থাকায় ভিতরে প্রবেশ করলো শাওন । আওয়াল শেখের বউ রোজিনা আর তাহেরা গল্পে মগ্ন । ছেলেকে দেখে উঠে দাড়ালো তাহেরা এগিয়ে এসে হাতের থেকে কাগজ নিয়ে এক পাশে রাখল । ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে শাওনকে দিয়ে আবার রোজিনার পাশে বসলো ।

” ছেলেটা কেমন দেখলি রোজিনা? বুড়ো নাকি?”

” আরে না বুড়ো কেনো হতে যাবে লম্বা আর হাট্টা কাট্টা দেখতে । ”

” কি করে রে? ”

” চুমকির মা বলেছিল নাকি ছেলে শহরের কোন বেসরকারি কোম্পানি তে চাকরি করে। পারুর মতোই বুঝলে আপা বাপ মা নেই। মা নাকি ছোটো বেলায় হওয়ার সময় মরে গিয়েছিল । বাপ তিন বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাক করে পর পারের বাসিন্দা হয়ে গেছে ”

” আহারে পারুর সাথে তাহলে তো ভালই মিল তাই না”

এতক্ষন সিঙ্গেল সোফায় বসে পানি খাচ্ছিল আর সব শুনছিল শাওন । শেষে কয়েকবার পারুর কথা শুনে থমকে গেলো শাওন।

” আম্মা কোন ছেলের কথা বলছো ”

” আরে পারুকে আজকে দেখতে আসছে না। সেই ছেলে নাম নিলয় । ”

” মানে!!!!”

“মানে আর কি যার জন্য নয়নের মত লক্ষ্মী সোনার টুকরো মেয়েরে অপমান করে তাড়িয়ে দিলি সে নাচতে নাচতে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে । শুনছি আকদ ও হয়ে গিয়েছে ।ছেলেদের নাকি পারুকে খুব ভালো লেগেছে ।সালাম ভাই বললো”

তাহেরার কথা শুনে শাওনের তো জান যায় যায় অবস্থা। পারু কি তবে এই ভাবে শাওনকে ফাঁকি দিলো?
______________________________

” আলহামদুলিল্লাহ”

আপনারা তাহলে বসেন আমরা খাবার নিয়ে আসি । রিপা পানির জগ ভরে গ্লাস গুলো গুছিয়ে বিছানায় রাখলো । তনুজা বেগম ভাতের গাবলা ,,সবজি ,মাংস , ডাল সহ অন্য সব তরকারী সাজিয়ে রাখলো সামনে । সালাম মিয়া তাদের বেড়ে দিচ্ছে ।

পাশের রুমে পারু ছোটো আয়নায় নিজেকে দেখে ।চোখে পানি টল মল করছে তার । হাজারো স্বপ্নকে বুকে চেপে ও কি নয়ন ভাবে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে ।নাকি বারো বছরের ভালোবাসার টানে আবারও বাধা পড়বে ?

“এই পারু হবু দুলাভাইকে কেমন লাগলো? আমার কিন্তু হেব্বি ভালো লেগেছে অবশ্যয় তোর বড় হিসেবে ”

” এতো ভালো লাগল তুই বিয়ে করে নে”

” আমি কিন্তু বলেছি তোর বড় হিসেবে আমার বর হবে সহজ সরল হাদারাম টাইপ বুঝলি ।আমি তারে দিয়ে সব কাজ করাবো ”

” হয়ছে ঢং ”
_________________________

শাওন নিজের গোসল না করেই পারু দের বাড়িতে চলে এসেছে। গায়ে ঘামে ভেজা শার্ট ।চুলগুলো এলোমেলো,, কিছু চুল কপালের সাথে লেপ্টে আছে ফর্সা শরীরে কালো রঙে অসাধারন লাগছে শাওনকে ।

শাওন কারোর সাথে কোনো কথা না বলেই পারুর ঘরে ঢুকে গেলো । রিপা পারুর সাথে বসে তখন হাসি ঠাট্টায় ব্যাস্ত ছিল। ভাই কে দেখে ওর মুখে তালা লেগে গেলো মিষ্টি হাসিটা মুহূর্তেই উবে গেল । পারু ও শাওনকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছে এই সময় তো শাওন অফিসে থাকে । তাহলে এখানে কিভাবে?

শাওনের চোখ গুলো লাল হয়ে আছে বোঝায় যাচ্ছে অনেক উত্তেজিত হয়ে আছে শাওন । রাগে গজগজ করছে সে । একে তো গরম তারপর প্রচণ্ড রাগের জন্য ঘেমে যাচ্ছে শরীর । সরু নাকটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ।

” রিপা বাইরে যা তোর খবর আমি বাড়ি গিয়ে করবো ”

” রিপা কোথাও যাবে না ।আমার কাছেই থাকবে তুই বাইরে যা ”
” রিপা তোরে বলেছি বাইরে যা ”

” যা বলার ওর সামনে বল । ও এক চুল ও নড়বে না ”
পারু আর শাওনের মাঝে ফেঁসে গেছে রিপা ভাইয়ের ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছে সে অসম্ভব রেগে আছে । আর অন্যপাশে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না ।

” ঠিক আছে ও থাক তবে । কার জন্য এতো সাজ গোজরে তোর? বিয়ে করার মেলা ইচ্ছা ?”

” সব তো জানিস শুনছিস কেন?”

শাওন হুট করে পারুর পায়ের কাছে বসে পড়লো । চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল ওর ।বুকে অনেক বেশি ব্যাথা করছে মনে হচ্ছে কেউ ওর হৃদপিণ্ডে বার বার সুই দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করছে ।

” পারু আমি মানছি ভুল করেছি আমি ।কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোরে খুব বেশি ভালোবাসি প্লীজ আমাকে মাফ করে দে। দয়া কর আমার উপর আমি যে তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না । আমার নিশ্বাস নিতে ও কষ্ট হচ্ছে তোরে হারায় ফেলবো ভেবে ”

শাওনের এমন অবস্থা দেখে রিপার বুকটা কেঁদে উঠলো। রিপা ওর ভাইকে কখনো কাদতে দেখিনি । কিন্তু আজকে ভালোবাসা হারানোর ভয়ে কেমন কেঁদে দিলো । হাসি খুশি মানুষটাকে কান্না কতি করতে দেখলেই এমনি কষ্ট হয় তারপর আবার নিজের ভাই। কিন্তু ওর যে কিছু করার নেই । শাওন যে অপরাধ করেছে তার যে প্রায়শ্চিত্ত ওর নিজেকেই করতে হবে ।

” আচ্ছা কোন কোন ভুলের জন্য মাফ করবো?দিনের পর দিন আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য? নিজের ওয়াদা ভাঙার জন্য?আমাকে দুশ্চরিত্রা বানানোর জন্য? নাকি আমাকে চোর বানানোর জন্য? বল কোন কোন ভুলের জন্য তুই মাফ চাচ্ছিস”

” পারু মাফ করে দে । আমি আর কখনও এমন করবো না । ক্ষমা করে দে আমাকে । মানুষ তো কত ভুল করে আমি ও করেছে আমি তো অনুতপ্ত । এই অনুতপ্ততার যে অনেক বেশি কষ্ট ।আমার পক্ষে একে বয়ে বেড়ানো সম্ভব না”

” যে একবার করতে পরে সে বার বার করতে পারে তুই চলে যা ”

পারুর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়ছে । অনেক চেষ্টা করা সত্বেও শেষরক্ষা হয় নি । বুকে চিন চিনে ব্যাথাটা অনেক বেড়ে গেছে পারুর । কিন্তু না এতো সহজে ও শাওনকে মাফ করবে না । যে কষ্ট শাওন পারুকে দিয়েছে সেই কষ্টের কাছে এই কষ্ট কিছুই না । প্রিয়মানুষের পাশে অন্য জনকে দেখলে যে বুক ফেটে যাওয়া ব্যাথা অনুভব হয় সেটা শাওন অন্তত বুঝুক।

এইসব কথা পাশের রুম থেকে নিলয় আর নিলয়ের খালা সব শুনলো ওদের যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে । তাই তনুজা বেগম কে কয়টা কড়া কথা শুনিয়ে চলে গেলো ।

শাওন শুধু পারছে না পারুর পা ধরতে । শাওনের করা আহাজারি পাশের ঘর থেকে সব শুনছে সালাম মিয়া আর তনুজা। তনুজা এবার আর না পেরে পারুর ঘরের সামনে দাড়ালো ।

” নিলয় রা চলে গেছে ”

শাওনের কানে কথাটা আসা মাত্রই ওর কান্না থেমে গেলো চোঁখের পানি প্যান্টের পকেট থেকে টিস্যু বের করে সুন্দর করে মুছে নিলো। ওকে দেখে বোঝার কায়দা নেই কেবল এতো কান্নাকাটি করেছে।

” ওহ তাহলে এবার যায় হ্যাঁ ,,,রিপা আম্মা তোর ডাকতেছে”

রিপা পারু দুইজন বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে। শাওনের কর্মকাণ্ডের আগা মাথা কিছু বুঝতে পারছে না ।সালাম মিয়া ও অবাক এত্ত আহাজারি করা ছেলেটা হঠাৎ সাভাবিক কিভাবে হলো ।সবার দৃষ্টিতে থাকা প্রশ্ন শাওন বুঝতে পারলো।

” আসলে এমনটা না করলে বিয়েটা তো ভাঙতো না ।এতো জোরে জোরে কান্নাকাটি করছি আশেপাশের মানুষ ও শুনেছে । পার্মানেন্টলি পারুর বিয়ে আটকাতে এইটুকু যথেষ্ট আর কেউ ওকে দেখতে আসবে না ভুলে ও ”

“মানে ভাইয়া সব অভিনয় ছিল!!!”

” তো কি মনে হয় এই চুনো পুটির পায় ধরবো বিয়ের জন্য ?ওর বিয়ে করতে আমার দুই মিনিট ও লাগবে না ।”

শাওনের কথায় পারু চোখ টা মুছলো । কিছু না বলে বাইরের রান্নাঘরে গিয়ে ভালো দেখে একটা মোটা লাঠি আনলো । শাওন ঘর থেকে তখন বের হচ্ছে পিছনে রিপা হা করে আছে এখন ও। এক হাতে শাড়ির কুচি ধরে লাঠিটা শক্ত করে ধরলো পারু ।

” ভাইয়া পারু ……”