অভিমান পর্ব-১৯

0
382

#অভিমান
#পর্বঃ১৯
#তনিশা সুলতানা

গোধুলি বিকেলে বাড়ির সামন পুকুরের পারে বসে আছে তোহা। কতোদিন পরে নিজের বাড়িতে ফিরলো। সেই আকাশের বিয়েতে গেছিলো নানুবাড়িতে তারপর থেকে আর আশা হয় নি। খুব মিস করেছে বাড়িটাকে। নিজের পরিচিত রুম মাঠঘাট পুকুর সব কিছুকেই। প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় তোহা। কে জানে আর কখনো আসতে পারবে কি না এখানে?

আজকেও কেউ আর তোহাকে আটকায় নি এখানে আসতে। একবার বলাতেই নিয়ে এসেছে।
তোহার কাকিমা তোহার পেছনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। খুব চাইছে নিজেকে আটকানোর পারছে না ডাক্তারের বলা “যদি আল্লাহ চায়” কথাটাতে ভরসা করতে পারছে না।
ফর্সা মাথা ভর্তি চুল অপরুপ সুন্দরী তোহা। যাকে চিমটি দিলেই রক্ত পড়বে এমন গায়ের রং। সেই তোহা এখন রোগা কালো হয়ে গেছে।
দেখেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ভীষণ ভালোবাসে তোমাকে উনি।
চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়।
“তোহা
কাকিমার ডাকে তোহা মিষ্টি করে হেসে পেছনে তাকায়।
” বলো
“বাসায় চলো। এখন এখানে থাকা যাবে না। তোমার বর অপেক্ষা করছে নিয়ে যাবে তোমাকে।
মুখটা মলিন হয়ে যায় তোহার। আবার ওই চৌধুরী বাড়িতে যেতে হবে তোহাকে।
তোহা কাকিমার সাথে বাসায় যায়। মেঘ আগে থেকেই তৈরি হয়ে বসে ছিলো। তোহা আসতেই উঠে দাঁড়ায়।
” চলো
ঘড়ি ঠিক করতে করতে বলে মেঘ।
“বলছিলাম কি তোহা তো কিছু খেলো না তখন। আমি এখন ওকে একটু খায়িয়ে দেই। যদি তোমার সময় থাকে।
মাথা নিচু করে বলে তোহার কাকিমা। চৌধুরী পরিবারের সব মানুষকে উনি খুব সম্মান করে। ভয় পায়। এতো বড় বাড়ির মানুষ তারা।
” কাকিমা তুমি এভাবে বলছো কেনো? খায়িয়ে দাও তারপরই নাহয় যাবো।
তোহা কাকিমার হাত ধরে বলে।
মেঘের আর না করার কোনো সাধ্য নেই। অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও মুচকি হেসে সায় জানায়।

খুব যত্ন সহকারে তোহার কাকিমা তোহাকে খাইয়ে দেয়।
বিদায় নিয়ে আসার সময় দাদা দাদি কাকা কাকিমা সবার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। তোমারও মন খারাপ। ইচ্ছে করছিলো একটা রাত এখানে কাটানোর। আর কখনো এই মানুষ গুলোকে দেখার সামর্থ নাও হতে পারে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না মেঘকে।

চৌধুরী বাড়িতে পৌছানোর পরেই মাগরিবের আজান পরে যায়। মেঘ ওজু করে মসজিদে চলে যায় নামাজ পড়তে। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ পারবে না তোহাকে বাঁচাতে।
নামাজ শেষে মোনাজাতে খুব কাঁদবে মেঘ যাতে তোহা সুস্থ হয়ে যায়।
শেষ কবে নামাজ পড়েছিলো মনে নেই মেঘের। কিন্তু আজকে জায়নামাজের ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করে প্রতিদিন নামাজ আদায় করবে।

তোহার শরীর ধীরে ধীরে আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাথার ব্যাথাটা বেড়েছে। ঔষুধে কাজ হচ্ছে না। তবুও তোহা খুব কষ্ট করে সয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ তোহা জানে মেডিসিন বেবি টার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে।

মায়া আকাশের জন্য চা নিয়ে রুমে আসে। আকাশ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো আকাশের দিকে তাকিয়ে। থালার মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে।
“তোমার চা
মায়া আকাশের হাতের কাছে রেলিং এর ওপর চায়ের কাপটা নামিয়ে বলে।
আকাশ মায়ার দিকে তাকায়।
” মায়া তুমি কি খুব সুখে আছো? ভালো আছো তুমি?
আকাশের স্বাভাবিক গলার অস্বাভাবিক প্রশ্ন শুনে মায়ার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। মাথা নিচু করে ফেলে।
“বলো? সুখে আছো?
আমি কিন্তু সুখে নেই। নরক যন্ত্রণা ভোগ করে বেঁচে আছি। তোমাকে দেখলেই মনে হয় আমর নিষ্পাপ তোহার রোগটা তোমার মতো পাপীর হতো। আমার নিষ্পাপ তোহাটা একটু শান্তি পেতো।
শীতল গলায় বলে মেঘ।
বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা করে মায়ার। টপটপ চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে। স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে কোনো মেয়েই ঠিক থাকতে পারে না
” তুমি যদি আমার সাথে তোমার জঘন্য পিক গুলো এডিট করে সবাইকে না দেখাতে। আজকে আমি তুমি তোহা সবাই সুখে থাকতাম।
আমার তোহা বাঁচবে না জানো? আমিও মরে যাবো।
জানো আমি মনে মনে কোথাও একটা চাইতাম আমি আর তোহা দুইজনই মরে যাই। কারণ আমি তোমাকে ভাইয়ের সাথে সয্য করতে পারি না। কষ্ট হয়। বুকের ভেতর থেকে রক্ত ঝড়ে। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে তোহার সবটা অসুখ আমার হয়ে যদি তোহা বেঁচে থাকতো।
আমার ভাই বাঁচবে না তোহাকে ছাড়া। আমিও বাঁচবো না।
আকাশ হাঁটু মুরে বসে।
মায়াও কাঁদছে।

আরও তিনটা মাস কেটে গেছে। তোহার লম্বা চুল গুলো ঝড়ে যাচ্ছে। টানা টানা চোখ দুটোর নিচে কালি পড়ে গেছে। শুধু পেটটা একটু উঁচু হয়েছে। পাঁচ মিনিট এক টানা চোখ খুলে থাকতে পারে না।
মেঘ তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। তোহা চোখ বন্ধ করে খাচ্ছে।
“একটা কথা বলি
তোহা বলে।
” বলো
“এই রুম থেকে আয়না সরিয়ে ফেলবেন প্লিজ
” কেনো?
“আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে চিনতে পারি না আমি। কষ্ট হয়।
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে তোহা।
মেঘের চোখও ভরে ওঠে।
তোহা মেঘের হাত আকড়ে ধরে। হাতে থাকা সুপের বাটি পড়ে যায়।
” আমি বাঁচতে চাই মেঘ। আমি সুস্থ হতে চাই।আপনার সাথে আমাদের বেবি টাকে বড় করতে চাই। তিন জন গোধূলি দেখতে চাই।
একটু থামে তোহা।
“আমি মরে গেলে তো আপনি আবার বিয়ে করবেন। আমি কি করে সয্য করবো। আমার বাচ্চাটা অন্য কাউকে মা বলে ডাকবে।
আপনার তো অনেক টাকা প্লিজ আমাকে বাঁচিয়ে তুলুন না। আমি মরে যাবো মেঘ। আমাকে বাঁচান মেঘ। আমি একটু সুখে থাকতে চাই মেঘ।
হাউমাউ করে কেঁদে বলে তোহা।
তোহার কান্নার শব্দ পেয়ে সবাই চলে আসে তোহার রুমে। তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে সবাই কেঁদে ফেলে।
মেঘ স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তোহাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদছে।
“আমার লম্বা চুল গুলো ঝড়ে যাচ্ছে। আমি টাক হয়ে যাচ্ছি। আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা করে।
আমাকে বাঁচাও না তোমরা। আমি সয্য করতে পারি না। আমি তো মেঘের সাথে পুরো ঢাকার শহর ঘুরবো। আমি মরতে চাই না। আমি বেবি চায় না। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচাও তোমরা। সুস্থ হতে চাই আমি।
চিৎকার করে কান্না করছে আর বলছে তোহা।
তোহার কান্নায় সবার আত্মা ফেটে যাচ্ছে।

মেঘকে সরিয়ে দেয় তোহা। একটু শান্ত হয়। হাতের ইশারায় আকাশকে ডাকে।
আকাশ এগিয়ে আসে তোহার সামনে। তোহার কাছে বসার ইশারা করে তোহা। আকাশ বসে।
” তুমি বাঁচাও না আমাকে। খুব তো বলতে খুব ভালোবাসো আমায়। আমার জন্য সব করতে পারবে। ও আকাশ তুমি আমাকে বিদেশের বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। আমি যে পারছি না।
বলতে বলতে ঢলে পড়ে তোহা। আকাশ দুই হাতে আগলে নেয় তোহাকে। বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
মেঘও কাঁদছে।

সাত মাস চলছে তোহার প্রেগন্যান্টির। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে৷ সেই দিনের পর আর তোহা প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে নি। মেঘ দেশ বিদেশে সব জায়গায়,খোঁজ নিয়েছে। ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করা সম্ভব না।
আকাশ ডাক্তার আর বাড়ির লোকদের ডেকে আনে।
“এখনই তোমাকে সিজার করে টিট মেন্ট শুরু করে দিন।
গম্ভীর গলায় বলে আকাশের। আকাশের কথায় সবাই অবাক হয়। মেঘ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
” কিন্তু
ডাক্তার কিছু বলতে যায়। আকাশ থামিয়ে বলে
“আমরা তোমাকে সুস্থ করতে চাই। বাচ্চার কথা ভাবছি না।
” ওনার হাজবেন্ড যদি পারমিশন না দেয়।
“ওনার হাজবেন্ড টাকার পাগল। তিনি পারমিশন দেবে না। কিন্তু আমার তোমাকে চাই। আমি সুস্থ দেখতে চাই তোহকে।
ডাক্তারের পায়ে ধরে কেঁদে ওঠে আকাশ। শেষমেশ ডাক্তার রাজি হয়। মেঘ কোনো কথা বলে না।

চলবে