অরুণরাঙা প্রেম পর্ব-০১

0
1887

#অরুণরাঙা_প্রেম
#পর্বঃ০১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

বিয়েতে দেখা যায় হয়তো বউ কিডন্যাপ হয়ে থাকে নাহয় বর কিডন্যাপ হয়ে থাকে কিন্তু বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেও যে কেউ কিডন্যাপ হয় এটা নিজের সাথে না হলে কখনই জানতোনা আরোশী।মাত্রই খেয়ে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলো আরোশী এরই মধ্যে কেউ পেছন থেকে তার মুখে রুমাল চেপে ধরে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে।

চোখ খুলে আরোশী নিজে একটা চেয়ারের সাথে হাত বাঁধা অবস্থায় পায়।আরোশী আশেপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পায়না।সে একবার রুমটাতে চোখ বুলিয়ে নেয়।না রুম ওই সিরিয়ালে দেখা রুমগুলোর মতো ভাঙাচোরা না বেশ ভালোই রুমটা।কিন্তু আরোশী ভেবে পাচ্ছে না তাকে কে তুলে নিয়ে এসেছে আর কেনই বা এনেছে।

” তো মিস স্মিতা,ও সরি মিস অথৈ নাকি মিস আফরা,আপনাকে কোন নামে ডাকা যায় বলুন তো?”

হুট করে অপরিচিত মানুষের কন্ঠস্বর শুনে ঘাবড়ে যায় আরোশী।সে বিরক্তি নিয়ে লোকটার দিকে তাকাই।না লোকটাকে দেখে তো তার পরিচিত কেউ মনে হচ্ছে না।

” কি হলো মিস রাইমা,নিজের এতোগুলা নাম শুনে শক খেলেন বুঝি?”

” এই যে আপনি কে মশাই?আপনাকে কি আমি চিনি?” বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে আরোশী।

” না আপনি আমাকে চেনেন না হয়তো কিন্তু আমি আপনাকে খুব ভালো করেই চিনি।তো এবার বলে ফেলুন আর কাকে কাকে এভাবে প্রেমের জালে ফেলেছেন?”

” এসব বলছেন আপনি?নে*শা করেছেন নাকি?”

” আরে আরে এতো বিরক্ত হলে হবে মিস রাইমা?আরো কত কথা এখনো বাকি।”

” ধুর মশাই,কি কখন থেকে রাইমা রাইমা করে চলেছেন?কে এই রাইমা?আমি কোন রাইমা টাইমা না,আমি আরোশী।ছেঁকা খেয়েছেন নাকি এই রাইমা থেকে?”

” ও তার মানে এখন আবারো নতুন নাম নিয়েছেন,ভালো।তা এবার কাকে ফাঁসিয়েছেন নিজের মিথ্যা প্রেমের জালে?”

” আপনি আসলেই মনে হয় নে*শা করে মা*তাল হয়ে আছেন আর না হয় ছেঁকা খেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।আরে বাবা আমি বলছি তো আমি রাইমা না আর আমি নিজের কাজ করে সময় পায়না আবার প্রেম করবো।দেখি হাত খুলুন আমার।”

” তুমি সত্যিই রাইমা না?” এবার একটু বেশিই সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করে লোকটা।

” আরে বাবা না আমি রাইমা না।আমার নাম আরোশী ঊর্মি।”

লোকটা এবার নিজের ফোন বের করে একটা ছবি আরোশীকে দেখাই।

” এই ছেলেটাকে চেনো?”

” এটা আবার কোন ক্ষেতের মুলা?”

লোকটা কিছু একটা ভেবে তাড়াতাড়ি রুমটা থেকে বেরিয়ে যায়।পেছন থেকে আরোশী চেঁচাতে থাকে,

” আরে মিস্টার আমার হাতটাতো খুলে দিয়ে যান।”

কিন্তু উল্টোপাশ থেকে কেউ কোন উত্তর দিলোনা।বিরক্তি নিয়ে আরোশী লোকটাকে গা*লি দিতে লাগলো।আরোশী ভেবেছিলো লোকটা মনে হয় আর আসবে না কিন্তু কিছুক্ষণ পর লোকটা একটা ছেলেটাকে সাথে নিয়ে আবারো রুমে ফিরে এলো।

” অভ্র দেখতো এটা রাইমা কিনা?”

” এটা কে ভাই?”

” কেন এটাই তো রাইমা।”

” হায় আল্লাহ,তোর মাথা।এটা রাইমা না,তুই এটা কাকে তুলে নিয়ে এসেছিস আকাশ?”

আকাশ নামের ছেলেটাকে এবার বড় বড় চোখ করে আরোশীর দিকে তাকাই।আরোশী কটমট করে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।

” এসব তুই কি বলছিস অভ্র!তুই না বলেছিলি রাইমা একটা কালো রঙের জামা পড়ে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হবে।”

অভ্র নামের ছেলেটা কিছু বলবে তার আগেই রাইমা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” তাহলে যান না পৃথিবীতে যতগুলো মেয়ে এখন কালো রঙের জামা পড়ে বাইরে বেরিয়েছে তাদের সবাইকে তুলে নিয়ে আসুন।”

” আপু সরি,আকাশের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।আপনি প্লি……”

” আরে রাখুন আপনার প্লিজ।আগে আমার হাতের দড়িগুলো খুলুন।”

অভ্র তাড়াতাড়ি এসে আরোশীর হাত খুলে দেয়।আরোশী একবার নিজের হাতগুলো দিকে তাকিয়ে তারপর রেগে আকাশ আর অভ্রের দিকে তাকাই।

” আমাকে কেন কিডন্যাপ করেছেন আপনারা?আমি তো আপনাদের চিনিই না।আপনাদের কোন ক্ষেতে আমি মই দিয়েছিলাম যে আমাকে এভাবে তুলে এসেছেন?”

” আসলে আপু আকাশ ভুল করে আপনাকে তুলে এনেছে।আমরা আপনাকে না রাইমা নামের একটা মেয়েকে তুলে আনতে চেয়েছিলাম।”

” পোশাক দেখে তো ভদ্র ঘরের ছেলে মনে হচ্ছে।মানুষ তো বুঝতেই পারবেনা যে আপনারা আসলে কিডন্যাপার।”

” আপু আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন।আকাশ তো আপনাকে ভুল করে তুলে নিয়ে এসেছে।আসল ঘটনা হচ্ছে যে….”

” অভ্র।”

অভ্র আর কিছু বলবে তার আগেই আকাশ তাকে থামিয়ে দেয় আর চোখের ইশারায় কিছু বলতে বারণ করে আর তাদের এই চোখের ইশারায় কথা বলাটা আরোশী ঠিকই লক্ষ করে তবে কিছু বলেনা।

” আব….আপু চলুন আমি আপনাকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছি।”

” না তার দরকার নেই,শুধু আমাকে বাইরে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দিন।”

” না আপু তা হয়না,আপনাকে যখন আমারা ভুল করে হোক আর যেভাবেই হোক তুলে নিয়ে এসেছি।আমাদেরও একটা দায়িত্ব আছে,তাইনা?আপনার যদি কিছু হয়ে যায় তখন আমরা নিজেদের ক্ষমা করতে পারবোনা।তার উপর অনেক রাতও হয়ে গিয়েছে,এখন আপনার একা বাইরে বের হওয়াটা মোটেও ঠিক নয়।”

আরোশী চুপ করে চিন্তা করে দেখে অভ্র ঠিকই বলছে।এতোরাতে একা বের হলে যদি কোন বিপদ হয়ে যায়।তাই সে অভ্রের সাথে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যায়।অভ্র আরোশীকে নিয়ে রুমটা থেকে বের হবে সেইসময়ই আকাশ অভ্রকে পেছন থেকে ডেকে উঠে।

” অভ্র তুই যা বাসায় চলে যা,আন্টি বাসায় একা।আমি ওকে দিয়ে আসছি।”

অভ্র পেছন ফিরে আকাশকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে, “আসলেই কি সে আরোশীকে পৌঁছে দেবে কিনা?” আকাশও চোখের ইশারায় অভ্রকে হ্যাঁ বলে।অভ্র আর কথা না বাড়িয়ে আরোশী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।রুমটা থেকে আকাশ বের হলে আরোশীও তার পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে আসে।

একটা বিল্ডিং এর সামনে এসে আকাশ গাড়ি দাঁড়ায় করালো।আরোশী আকাশের উপর প্রচুর বিরক্ত হলেও সৌজন্যের খাতিরে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে আসতে নিলে আকাশের কথা শুনে সেখানেই থমকে যায়।

” আই এম সরি মিস আরোশী।আমি সত্যিই জেনে-বুঝে আপনাকে তুলে নিয়ে আসিনি।আমি জানতাম না যাকে তুলে আনার কথা ছিলো সেটা আপনি নয় অন্যকেউ।”

” ঠিক আছে,তবে পরবর্তীতে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করে তারপর তুলে নিয়ে যাবে।” আকাশের দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলে আরোশী গাড়ি থেকে নেমে বিল্ডিং এর ভেতরে ঢুকে পড়ে।

ফ্ল্যাটে এসে আরোশী তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দেয়।বাইরে থেকে এতোক্ষণ সে শান্ত আর ভয় পাইনি দেখালেও সে প্রথম থেকেই প্রচুর ভয় পেয়ে ছিলো।কিন্তু আরোশী জানে যদি সে তার দুর্বলতা দেখায় তার সাথে ভালো কিছু হবেনা।সামনে থাকা পানির গ্লাসটা উঠিয়ে অতিদ্রুতই পানিগুলো খেয়ে ফেলে আরোশী।পানি খেয়ে সে দ্রুতপায়ে রুমে এসে সব জানালা দরজা বন্ধ করে দিয়ে পুরো গায়ে কাঁথা পেঁছিয়ে শুয়ে পড়ে।

পরেরদিন সকালে,

বাড়ির সব কাজ শেষ করে সোফায় বসে আছে আরোশী।কালকের ঘটনার কারণে তার এখন বাইরে যেতেও ভয় লাগছে কিন্তু বাইরে না গিয়েও তো উপায় নেই।তাই একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে আরোশী বেরিয়ে পরে।

একটা মোটামুটি মাঝারি সাইজের ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে আরোশী।

আরোশী ঊর্মি,আপন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই তার।তার বেড়ে উঠা একটা অনাথ আশ্রমে।যেহেতু বাবা-মা নেই তাই তার আত্নীয় স্বজনও নেই।১৮ বছর পর্যন্ত সে অনাথ আশ্রমেই ছিলো কিন্তু এরপর নিয়মের কারণে তাকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হয়।বর্তমাসে আরোশী একা একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে।আরোশী পড়াশোনায় খুব একটা ভালো না,তাই সে অর্নাস দ্বিতীয় বর্ষ পড়ার পর আর পড়াশোনা করেনি।এখন সে একটা চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে পার্টটাইম জব করে।আর সেখান থেকেই তাকে এই বাড়িতে পাঠানো হয়েছে একটা বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য।

বাড়ির সামনে এসে বেল বাজালে একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।

” মিস্টার আরিফ আছেন?আমাকে চাইল্ড কেয়ার সেন্টার থেকে পাঠানো হয়েছে,বেবির দেখাশোনা করার জন্য।”

” স্যার ভেতরেই আছে,আপনি আসুন।”

আরোশী ভেতরে গিয়ে দেখে মিস্টার আরিফ সোফায় বসে কিছু একটা লিখছে।

” হ্যালো স্যার,আমি আরোশী।আপনি চাইল্ড কেয়ার সেন্টার থেকে একজনকে চেয়েছিলেন যিনি বাসায় এসে আপনার বাচ্চার দেখাশোনা করবে,আমাকে সেখান থেকে পাঠানো হয়েছে।”

” প্লিজ সিট।”

আরোশী বসে কিছু বলবে কিন্তু লোকটা মুখ থেকে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায় কারণ মিস্টার আরিফই সেই কিডন্যাপার আকাশ।আকাশকে এখানে দেখে আরোশী একটু ঘাবড়ে যায় তবে বাইরে থেকে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সে।কিন্তু আরোশীকে দেখে আকাশ অবাক হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।সে ফাইলগুলো গুছিয়ে একপাশে রেখে আরোশীর দিকে তাকালো।

” তো মিস আরোশী,কি খাবেন চা নাকি কফি?”

” না কিছু লাগবেনা,ধন্যবাদ।আমি মনে হয় ভুল ঠিকানায় চলে এসেছি কারণ এখানে আমাকে বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য পাঠানো হয়েছিলো আর নিশ্চয়ই আপনার কোন বাচ্চা নেই।আমি ভুল ঠিকানাই চলে এসেছি,দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।”

আরোশী উঠে চলে যেতে নেবো কিন্তু আকাশের কথা শুনে সে থমকে যায়।

” আপনি ঠিক জায়গায় এসেছেন মিস আরোশী।আপনাকে আমার বাচ্চার দেখানো করানোর জন্যই পাঠানো হয়েছে।”

আরোশী বড় বড় চোখ করে আকাশের দিকে তাকালো।

” ইনি বিবাহিত!এনার বাচ্চাও আছে!আমি কি ভুল শুনছি?”

চলবে………