শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
766

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#সমাপ্তি_পর্ব
#সামিয়া_মেহেরিন

আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই,তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।

আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।

তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে,
আর কিছু নাহি চাই গো।

তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো।

আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ-মাস।

যদি আর কারে ভালোবাসো,
যদি আর ফিরে নাহি আসো,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো।

আমার পরান যাহা..
পরেরটুকু আর গাওয়া হলো না। কলিংবেল বাজার শব্দ কানে এলো। মহিমা বেগম ও মাযহার সাহেব আজ বাড়ি নেই। বারান্দা থেকে বের হয়ে বন্যা চললো দরজা খুলতে।

আদিত্য দেশের বাইরে গেছে তিনদিন হলো। বন্যা অনেক করে বলেছিল আদিত্য যেন তাকে একা করে দিয়ে না চলে যায়। কিন্তু আদিত্যর কাছে উপায় ছিল না। যেতেই হতো। যাওয়ার আগে বন্যার সাথে একবার দেখাও করে যায়। একবার বিদায়ও জানিয়ে যায়নি।

দরজা খুলে বন্যা কাউকে পেল না। দরজা বন্ধ করতে নিবে তখনই চোখে পড়ে দরজার সামনে অর্থাৎ তার পায়ের কাছে একটা খাঁচা রাখা যার ভেতর একজোড়া শুভ্র রঙের পায়রা ডানা খেতে ব্যস্ত।
বন্যা আরেক পলক এদিক ওদিক তাকায়। নাহ কেউ নেই। তাহলে খাঁচাটা এখানে রাখলো কে?
বন্যা খাঁচা হাতে তুলে নেয়। বাহার ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। হুট করে খাঁচার নিচ থেকে একটা নীল রঙা কাগজ মেঝেতে পড়ে। বন্যার প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। খাঁচাটা একপাশে রেখে ঝুকে কাগজটা হাতে নেয়। পাশে থাকা সোফায় বসতে বসতে চিরকুটের ভাঁজ খোলে।

নীল রঙা কাগজে কালো কালির আঁচড়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “অভিমানি বৃষ্টিকন্যার জন্য প্রেমিক পুরুষের সামান্য উপহার।”
বন্যা থ মেরে বসে থাকে। অজান্তেই দু ফোঁটা তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ে দাগড় দাগড় চোখজোরা থেকে। পরমুহূর্তেই আবার ঠোঁটে ফুটিয়ে তোলে ম্লান হাসির রেখা। কি অদ্ভুত তাই না! চোখে জল অথচ মুখে এক টুকরো হাহির রেখা।

বৃষ্টিকন্যা আপন মনে বিরবিরায়
-বদলা নিচ্ছেন আমার থেকে? পালিয়ে গিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছেন। আপনাকে এড়িয়ে যাওয়ার শাস্তি দিচ্ছেন। বেশ আপনার শাস্তি আমি মাথা পেতে গ্রহণ করলাম। অপেক্ষায় রইলাম। আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায়।

বৃষ্টিকন্যার গলার স্বর করুণ শোনায়।
– সাময়িক বিরহে নাহয় বিলীনই রব। তবুও বিশ্বাস তো আছে। ফিরবে তো আমার কাছেই। আবারো আমি তোমার চোখের ওই গভীর দৃষ্টিতে নিজেকে হারাবো। তোমার ভালোবাসার সাগরে নিজেকে ভাসাবো। শেষ গল্পটায় তুমিই তো রবে বৃষ্টিকন্যার পাশে। বৃষ্টিকন্যা যে প্রেমিক পুরুষের পথ চেয়ে রয়েছে। জলদি ফিরে এসো।

প্রেমিক পুরুষের পলায়নে বৃষ্টিকন্যার রিক্ত-শূন্য দিন গুলো কাটতে থাকে অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে। প্রেমিক পুরুষও কি বৃষ্টিকন্যার মতোই বিরহের আগুনে পুড়ে?

দশতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে সে রুপালি আলো ছড়ানো চাঁদের দিকে। দূর হতে বৃষ্টিকন্যার প্রতিচ্ছবি আঁকছে সে চাঁদের বুকে। এখন শুধু অপেক্ষা, অপেক্ষা আর অপেক্ষা। বৃষ্টিকন্যার কাছে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা।
একটা সময় আসলে হয়তো সব সম্পর্কেই একটু দূরত্ব তৈরি করা দরকার। একে অপরের জীবনে একে অপরের ঠিক কতটা তা তখন টের পাওয়া যায়।

চার বছর পর-
লন্ডনের একটা মেডিক্যাল কলেজের সামনে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদিতি। রোজকার মতো আজও মানুষটা আসতে দেরি করছে। আরো পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর জায়ান গাড়ি নিয়ে অদিতির সামনে এসে থামায়। অদিতি গাল ফুলিয়েই গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে বসে। মেয়েটার অভিমানি চেহারা দেখে জায়ান নিঃশব্দে হাসে। সে যে কেন সবসময় অদিতিকে নিতে আসতেই দেরি করে ফেলে নিজেও বোঝে না।

জায়ান আর অদিতি লন্ডনে এসেছে আরো তিন বছর আগে। জায়ান তার পরিবারের সাথে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছে। তার অভিমত লোভী অহংকারী মানুষদের সাথে সে এক ছাদের নিচে থাকতে পারবে না। জায়ান এই কথাটা যখন বলে তার মা জামিনী বেগম উল্টো অদিতিকে দোষারোপ করতে শুরু করে। অদিতি নাকি তার ছেলের কান ভাঙিয়েছে।
একপর্যায়ে এসে জায়ান অদিতিকে নিয়ে বাড়ি তো ছাড়েই সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একেবারে বিদেশে চলে আসে। এখানে সে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করে। আর অদিতি মেডিক্যাল কলেজের স্টুডেন্ট।

শাবাব আর জুঁইয়ের ডিভোর্স হয়েছে আরো আড়াই বছর আগে। ডিভোর্সটা করিয়েছিল শাবাবের মা রাজিয়া বেগম। রাজিয়া বেগম নিজের চোখের সামনে ছেলের জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলেন না। ভেবেছিলেন ছেলের ডিভোর্সটা করিয়ে দিয়ে আবার বিয়ে দিবেন। কিন্তু ডিভোর্স হলেও শাবাবকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে পারেননি। শাবাব দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। রাজিয়া বেগম এবার আর ছেলেকে জোর করেন নি। একবার জোর করে বিয়ে দিয়ে দেখেছেন তার পরিণাম কেমন। রূপের পূজারী হওয়ার ফল তিনি পেয়েছেন।

দুনিয়া উল্টে গেলেও এটা সত্য যে শাবাব বন্যাকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই হয়তো জুঁইকে কোনোদিন স্ত্রীর পূর্ণাঙ্গ অধিকার সে দিতে পারে নি। ভালোবাসে বলেই হয়তো দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে জুঁই ডিভোর্সের ব্যাপারে দ্বিমত করেনি। রাজিয়া বেগম তাকে ডিভোর্স দিতে বললে সে এক বাক্যেই রাজি হয়ে যায়। কারণ ততদিনে সে বিদেশি বড়লোক এক লোকের সঙ্গে পরকীয়ায় মেতে উঠেছিল। বারেক সাহেব আর জামিনী বেগমও বিষয়টা জানতেন।

লোভের বশে জুঁইয়ের প্রেমিকের প্ররচণায় তারা তিনজন দেশের সব সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে পা দিয়েছিল বিদেশের মাটিতে। কিন্তু ওই যে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। জুঁইয়ের প্রেমিক, সে তো মানব পাচার চক্রের সাথে জড়িত। জুঁইকে একবারের জন্য নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নাচিয়ে জুঁইকে আর তার বাবা-মাকে পাচার করে দেয়।
জুঁই, বারেক সাহেব আর জামিনী বেগম কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল ঠিকই কিন্তু দেশের মাটিতে খেয়ে-পড়ে বাঁচার মতো না বাকি ছিল অর্থ না ছিল জমিজমা। যে টাকার লোভের বশে তারা একের পর এক অন্যায় করে গেছে সেই লোভই তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। মাস গেলে জায়ান এক কালীন কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয়। যতই হোক নিজের বাবা মা বোনকে তো আর ফেলে দিতে পারে না। খেয়ে-পড়ে অন্তত বাঁচিয়ে রাখা ছেলে হিসেবে তার কর্তব্য।
বারেক সাহেব আর জামিনী বেগম বন্যার দাঁড়ে গিয়েছিল ঠিকই তাদের কৃতকর্মের ক্ষমা চাইতে। তবে ক্ষমা চাওয়াটাই আসল উদ্দেশ্য ছিল নাকি ক্ষমা চাওয়ার বাহানায় কিছু অর্থ সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। বন্যা সেদিন সরাসরি তাদের জানিয়ে দিয়েছিল- “আমি তোমাদের কোনোদিন ক্ষমা করব না। তবে তোমাদের ক্ষতিও আমি চাই না। যতই হোক তোমাদের জন্যই আমি আমার সুখের সন্ধান পেয়েছি। তোমাদের কর্মের শাস্তি পরকালে উপরওয়ালাই তুমাদের দেবে। আর থাকে ইহকালে তোমাদের ক্ষমা করার কথা। তাহলে বলব বিশ্বাসঘাতককে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়া মানে দ্বিতীয়বার বিশ্বাসঘাতকটা উপহার হিসেবে পাওয়া।”

মানুষের পার্থিব কর্মের ফল মানুষ কোনো না কোনোভাবে পৃথিবীতে পেয়েই যায়। আর থাকে পরপারের কথা। উপরওয়ালার বিচারকর্ম তো অতি সূক্ষ্ম। পাপের শাস্তির থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব না।
————-
প্রকৃতিতে তখন বর্ষাকাল বিরাজ করছে। আকাশে কাজল কালো মেঘের আনাগোনা। হুটহাট জলের বর্ষণ।
তেমনি এক বৃষ্টি মুখর রাত। রাতের আঁধারের কারণে কাজল কালো মেঘ গুলোর আলাদা অস্তিত্ব চোখে ধরা পড়ে না।
আকাশ তখন জলের বর্ষণে ধরণীকে ভিজিয়ে দিতে মত্ত। আর বৃষ্টিকন্যা, সে যে বৃষ্টিবিলাসে প্রমত্ত। পরনের লাল শাড়িটা ভিজে তার গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। মুক্ত দানার মতো জল কণা তার চেহারায় লেগে রয়েছে। ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে বৃষ্টির ফোঁটা নিজের গায়ে মাখতে সে ব্যস্ত।

রাত ৯.৩০ আদিত্য ছোট্ট আব্র কে কোলে নিয়ে বেডরুমে ঢোকে। ছেলেটা একদম তায নেওটা। ঘুম থেকে উঠেও তার বাবাকে চাই। রাতে ঘুমাতে গেলেও তার বাবাকে চাই। এতক্ষণ আদিত্য ডাইনিং রুম আর ড্রইংরুম জুরে পায়চারি করতে করতে আব্রকে ঘুম পারাচ্ছিল।
ঘরে ঢুকে বারান্দায় ঢোকার দরজায় অর্থাৎ থাইগ্লাসের সামনে পর্দা দেয়া দেখে খটকা লাগে আদিত্যর। আব্রকে কোলে নিয়েই এগিয়ে যায় দরজার দিকে। পর্দাটা একদিকে সরিয়ে দেয়। তখনই চোখে পড়ে বৃষ্টি বিলাসে মত্ত বৃষ্টিকন্যার দিকে। আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই রাত বিরাতে বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটা অসুস্থ হবে। নির্ঘাত কাল সকাল হতে না হতেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে জ্বরের ঘোরে কাঁপাকাপিঁ শুরু করবে। আদিত্য কপট রাগ দেখাবে। বৃষ্টিকন্যা গাল ফুলিয়ে বলবে-“বকাবকি না করে আসো তো আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকবে। দেখবে আমার জ্বর লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।”
আদিত্য, সেও তাই করবে। অফিহে যাওয়া বাদ দিয়ে তার বৃষ্টিকন্যাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকবে নয়তো জলপট্টি দিবে।

আব্রকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দুই পাশে দুইটা বালিশ দিয়ে দেয় আদিত্য। পা বাড়ায় বারান্দার দিকে।
বৃষ্টির পানিতে আদিত্যর ফিনফিনে পাতলা শুভ্র রঙের শার্টটা গায়ের সাথে লেপ্টে যায়। বন্যা তখনো আদিত্যর উপস্থিতি টের পায় নি। তাদের মধ্যকার দূরত্ব যখন এক হাত থেকেও কমে যায় তখন বন্যা নাকে আসে চির পরিচিত ঘ্রাণ। পিছন ফিরতেই আদিত্য কৌশলে বন্যার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে।
বৃষ্টিকন্যার কানের কাছে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে
-শেস গল্পটা শুধুই তুমি।

সমাপ্ত।