অশান্ত বসন্ত পর্ব-৭+৮+৯

0
336

#অশান্ত বসন্ত
(সপ্তম পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
(#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)

****************
বায়না করে জানলার পাশের সীটটা দখল করেছে পিউ। বেশ কিছুটা সময় ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়েও ছিলো বাইরের দিকে।এখন অবশ্য দাদাভাই এর ঘাড়ে মাথা রেখে দিব্বি ঘুমোচ্ছে।

পল্লব সময় পেয়ে ফেসবুক খুলে আবার তন্ন তন্ন করে খোঁজে মেয়েটাকে।
নাম না জানা থাকলে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়!

আজকাল সাহিত্যের গ্রুপ গুলোতেও জয়েন করেছে পল্লব।ঋতম বলেছিলো,’ মেয়েরা একটু কল্পনাপ্রবণ হয়,তুই গল্প কবিতার গ্রুপ গুলোতে খুঁজে দেখতে পারিস’।

তারপর থেকেই পল্লবের আনাগোনা চলে গল্পের গ্রুপগুলোতে।ঘুমোবার আগে অনেকটা সময় সে গ্রুপগুলোতেই থাকে।

এমনকি ছোটবেলায় নিজের ডায়েরির পাতায় সাজানো বোকা বোকা গল্প ও টাইপ করে দিতে শুরু করেছে।যদি কোনোভাবে সেই মেয়েটির লাইক কমেন্ট পায়।

পল্লব দেখেছে এই গ্রুপ গুলোতে কেউ কেউ বেশ ভালো লেখেন।কিন্তু খুব ভালো লেখায় লাইক কমেন্ট সেই অর্থে জোটেনা,বরং অতি সাধারণ প্লটের ওপরের লেখাগুলোতে কমেন্ট লাইকের বন্যা বয়ে যায়।
যেমন পল্লব ও প্রচুর লাইক কমেন্ট পায়।সুন্দরী কিছু পাঠিকাও জুটেছে পল্লবের।

‘আচ্ছা আপনি এতো সুন্দর লেখেন কি করে!’,কেউ কেউ আবার সরাসরি ইনবক্সে এসে জানতে চায়,’ভালোবাসেন কাউকে?’,পল্লব মেসেজ সিন করে ছেড়ে দেয়,রিপ্লাই দেয়না কোনো।

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।নেট অফ করে ফোনটা পকেটে ভরে নিলো।তারপর পিউকে নাড়িয়ে জাগিয়ে দিয়ে পল্লবের সীটে বসতে বললো।ঘুমের মধ্যে পিউও কথা না বাড়িয়ে দাদাভাই এর সীটে এসে বসলো।

জানালার ধারে বসতেই পল্লবের মুখে গায়ে বৃষ্টির ছাট আসতে লাগলো।
বৃষ্টির আদরে চোখ দুটো জুড়িয়ে আসছে পল্লবের।কিন্তু জোর করেই নিজেকে জাগিয়ে রাখলো পল্লব। বুকপকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করছে।হাতে নিয়ে দেখলো বসের ফোন।

খারাপ লাগলো পল্লবের না জানিয়ে আসার জন্য।
অবশ্য কি করতো!হয়তো বেশ কিছুদিন থেকে যেতে হবে কাঁথিতে!
এখন কি কারন দেখিয়ে আর কতোদিনের জন্য ছুটির এপ্লিকেশন জমা দিতো!দীর্ঘশ্বাস ফেললো পল্লব।

এরপরেও আদৌ পাবে কিনা মেয়েটিকে,সেটাও তো একটা বড়ো প্রশ্ন।তবে যেভাবেই হোক খুঁজে সে বের করবেই মেয়েটিকে।

হাসি পেলো পল্লবের,এখন ওর যা অবস্থা,তাতে নিজেকে নিয়েও বেশ একটা টানটান প্রেমের গল্প বা বিরহে কাতর প্রেমিকের গল্প লিখে ফেলা যেতো।

যতো সময় এগোচ্ছে ততোই যেন বুকে দামামা বাজছে।গিয়েই আগে ফুলমানিকে কাজে লাগাতে হবে।ফুলমানি নিশ্চয়ই খুঁজে দিতে পারবে মেয়েটিকে।

কলিং বেল দুবার বাজাবার পরেও অর্নব দরজা খুলছেনা দেখে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ভেতরে আসে অদ্রিজা।
‘লাইট টাও জ্বালায়নি’,কথাটা বিরবির করে বলে, বিরক্তি মুখে সুইচবোর্ড হাতড়ে লাইটটা জ্বালালো অদ্রিজা।

অর্নবকে ড্রয়িংরুমে দেখতে না পেয়ে বেডরুম,কিচেন,ব্যালকনি,টয়লেট সবেতেই একবার ঢুঁ মারলো অদ্রিজা।
ভ্রুটা কুঁচকে গেলো ওর,’শরীর খারাপ নিয়ে আবার কোথায় গেল অর্নব!করুনাদি আর মেয়েদের কাছে যায়নি তো!’,

হ্যান্ডব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে অর্নবের মোবাইলে ট্রাই করতেই, ‘সেই ভালো সেই ভালো,আমারে না হয় না জানো’,গানটা বেজে উঠলো।

অবাক লাগলো অদ্রিজার।মোবাইলটা তো হাতছাড়া করেনা অর্নব।টয়লেটে যাওয়ার সময় ও মোবাইলটা হাতেই রাখে।তাহলে কোথায় গেলো!’,আজকাল যদিও অর্নবকে অসহ্য লাগে,তবুও ওর ঘরে না থাকাটা কাঁটার মতো বিঁধছে বুকে।

ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে টয়লেটে ঢুকে শাওয়ারটা চালিয়ে দিলো অদ্রিজা।একে একে নিজেকে উন্মুক্ত করলো শাওয়ারের নীচে।
শাওয়ার থেকে নেমে আসা অবাধ্য জলরাশি অদ্রিজার চুল ছুঁয়ে নেমে যেতে থাকে গভীর থেকে গভীরে।জলের স্পর্শে চনমনে হয়ে ওঠে অদ্রিজা।

প্রথম প্রথম অফিস থেকে ফিরে দুজনে এক সাথেই শাওয়ার নিতো।
রীতিমতো ধস্তাধস্তি চলতো দুজনের।অনেক সময় তো টয়লেটের জল উপচে বাইরে চলে যেতো।অথচ ওদের সেদিকে হুঁশ থাকতোনা।পাগলের মতো একে অপরকে আদর করতো।

অদ্রিজা অনেকক্ষন শাওয়ার নিয়ে টাওয়াল দিয়ে চুলটা পেঁচিয়ে মাথার ওপরে তুলে দেয়।তারপর ভেজা জামাকাপড় গুলো তুলে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে বেরিয়ে আসে টয়লেট থেকে।

নরম পায়ে বেড রুমে আসে,তারপর ভেজা গায়েই রাত পোশাকটা জড়িয়ে নেয়।
ঘড়ির কাঁটা নিজের মতোই চলতে থাকে।
অদ্রিজা কিচেনে ঢুকে মাইক্রো ওভেনে জল গরম করে কফি পাউডার মিশিয়ে নেয়।

কফিমাগে হালকা চুমুক দিতে দিতে ড্রয়িং রুমে আসে।তারপর এসিটা অন করে টেম্পারেচার বাইশে সেট করে।অর্নব থাকলেই এখন এসি চালাতে দিতোনা।বলতো ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিতে।অর্নব না থাকাতে অদ্রিজার সেই দম বন্ধ করা অবস্থাটা নেই।

‘এই করবে না’, ‘সেই করবে না’,শুনতে শুনতে মাথা গরম হয়ে যেতো অদ্রিজার।
হতে পারে বয়েসে অর্নব ওর চাইতে অনেকটাই বড়ো।তাবলে ওই বাবা মার্কা হাবভাব বিরক্ত লাগতো অদ্রিজার।

চুল থেকে টাওয়াল টা খুলে সোফাতে গা এলিয়ে দেয় অদ্রিজা।নিমেষে ঘুম নেমে আসে দুচোখে।

ঘুম ভাঙতে দেখে রাত সাড়ে এগারোটা। গলাটা কেমন ব্যথা ব্যথা লাগছে।অদ্রিজা এসিটা বন্ধ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। মনে হয় বৃষ্টি পড়ছিলো রাস্তা গুলোতে জমা জল।

অদ্রিজা ঘরে ঢুকে অর্নবের ফোনটা নিয়ে আসে।লক খুলতে চেষ্টা করে কিন্তু পাসওয়ার্ডটা যে কি দেওয়া সেটাই বুঝতে পারছেনা।ফোনটা আনলক করতে পারলে অন্তত বুঝতে পারতো লাস্ট কল কাকে করেছিলো।সেখানে ফোন করে হয়তো কোনো খবর পাওয়া যেতো।

মাথাটা দপদপ করছে অদ্রিজার,গলাটাও শুকিয়ে আসছে অজানা ভয়ে।আজকাল একটু বেশিই খারাপ ব্যবহার শুরু করেছিলো অর্নবের সাথে।

অথচ একটা সময় অদ্রিজা চেয়ার টেনে নিয়ে ব্যালকনিতে বসলেই অর্নব এসে দাঁড়াতো ওর পিছনে। তারপর ওর চুলে হাত ডুবিয়ে ম্যাসেজ করে দিতো,চুলটা আঁচড়ে তেল লাগিয়ে দিতো।অদ্রিজার ঘুম চলে আসতো আবেশে।তখন ঘুমন্ত অদ্রিজাকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় শুইয়ে দিতো।

ঘুম ও জাগরনের মধ্যেই অদ্রিজা টের পেতো ওর সারাটা শরীর জুড়ে অর্নবের পুরু ঠোঁটের স্পর্শ।
অনেকদিন বাদে আজ অর্নবের স্পর্শটা ভীষণ মিস করছে অদ্রিজা।

(চলবে)

#অশান্ত বসন্ত।
(অষ্টম পর্ব)
(#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
জয়া চক্রবর্তী
***************
অনেক সময় মন আর মনের শূন্যতা নিজেরাই পরস্পরের দিকে চেয়ে অনর্গল কথা বলতে পারে।আজ রাত্রিটা যেন তেমন ভাবেই ধরা দিয়েছে করুনার কাছে।শিখা বহ্নি দুজনে ঘুমিয়ে পরলেও কেন জানি না ঘুম নেই করুনার চোখে।

যখন অর্নবের হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো,ওর ঠোঁটের কোনে ছিলো ফালি চাঁদের হাসি।কি জানি ভাগ্যদেবী হয়তো আড়ালে হেসেছিলো সেদিন!

করুনা কিন্তু অর্নবকেই ভালোবেসে নিজের ইষ্ট মেনে ছিলো।নিজের মনের ফুল দিয়ে অর্নবকে সাজিয়েছিলো।তাই প্রথম যেদিন শেফালী অর্নবের অন্য সংসার পাতার গল্প শুনিয়েছিলো,কিছুতেই মন সায় দেয়নি করুনার।মেয়েদের সামনেই জিজ্ঞেস করেছিলো অর্নবকে।একটাই শান্তনা, অর্নব মিথ্যে বলেনি,মেনে নিয়েছিলো সবটা।

তারপর থেকে একার সংগ্রাম।একার বললে ভুল হবে,বহ্নিও সেই সংগ্রামের অংশীদার। আজ বহ্নি প্রভাত কুমার কলেজে ভর্তি হয়েছে, এর চাইতে বড়ো পাওনা আর কি হতে পারে করুনার কাছে।বহ্নির এক টিউশন বাড়ির কাকু ওই কলেজেরই প্রফেসর। তার উদ্দোগ্যেই কোনো টাকাপয়সা লাগেনি বহ্নির।

কিন্তু আজ এমন অস্থির লাগছে কেন করুনার!সবে তো বহ্নির কলেজে ভর্তির খবরে একটু শান্তির প্রলেপ লেগেছিলো বুকে।করুনা দরজা খুলে বাইরে এলো।একি!দরজার বাইরে কে পরে আছে!’বহ্নি মা শিগগিরই আলোটা জ্বালা,কে যেন বাইরের চাতালে শুয়ে আছে!’,মায়ের চিৎকারে বিছানায় ধড়ফড় করে উঠে বসলো বহ্নি।

দ্রুত বাইরের আলো জ্বালাতেই করুনা ব্যস্ত হাতে লোকটাকে সোজা করলো।একি,এ তো অর্নব,শিখা বহ্নির বাবা।কিন্তু নড়ছে না কেন?করুনা কান্নায় ভেঙে পরলো।বহ্নি কথা না বাড়িয়ে পাশেই ডাক্তার কাকুর বাড়ির দিকে ছুটলো।

না এ যাত্রায় বেঁচেই গেলো অর্নব।ধুম জ্বরে সাময়িক ভাবে জ্ঞান হারিয়েছিলো সে।ডাক্তার কাকু দুটো ইঞ্জেকশন দিয়ে, ঘসঘস করে বেশ কিছু ওষুধের নাম লিখে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিলো বহ্নির দিকে।

বহ্নি ওর বাবার প্যান্টের পকেট থেকে টাকা বের করে ডাক্তার কাকুকে দিলো।ডাক্তার কাকু বললো,’ভয়ের কিছু নেই,আপাতত ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছি।সকালে গিয়ে ওষুধ গুলো আনলেই হবে’।

ডাক্তার কাকুকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে এসে, মায়ের সাথে হাত লাগিয়ে বাবাকে ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয় বহ্নি।ওর দিদিয়া এখন ওর বাবার পাশের বালিশেই ঘুমোচ্ছে।যেই দিদিয়াকে ওর বাবা দুচক্ষে দেখতে পায়না।করুনা বহ্নিকেও শুয়ে পরতে বলে,অর্নবের মাথার পাশে চেয়ারটা টেনে বসলো।

অদ্রিজার এবার বিরক্ত লাগছে। কোনো কান্ডজ্ঞান নেই অর্নবের।ফোনটা পর্যন্ত নিয়ে যায়নি।এমন নয় যে অদ্রিজা অর্নবকে নিজের ঘরসংসার বিসর্জন দিয়ে ওকে নিয়ে সংসার পাততে বলেছিলো!
ও তো ভাবেইনি কখনো অর্নবকে বিয়ে করবে।

এমনিতেই অর্নব ওর চাইতে বয়েসে অনেকটাই বড়ো। অর্নবকে দেখে ওকে কাছে পেতে ইচ্ছে করতো,সেটা অস্বীকার করবার জায়গা নেই।অর্নবের পেশিবহুল চেহারা,মুখে দৃঢ প্রত্যয় ভীষণ ভাবে টানতো অদ্রিজাকে।

তবে অদ্রিজা সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলো, যেদিন অর্নব ওকে না জানিয়েই রেজিস্ট্রার আর সাক্ষ্মীসাবুদ নিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো।সেদিনের পর থেকে অর্নবের আদরটা ওকে আর উত্তেজিত করতে পারেনি।বরং যখন অর্নব ওর নিজের ছিলো না তখন অর্নবকে পাওয়ার মধ্যে চরম উত্তেজনা কাজ করতো।

অফিস ফেরত ওই ঘন্টা দুয়েক সময় দারুন ভাবে উপভোগ করতো অদ্রিজা।মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা অবধি আদরে ভরিয়ে দিতো অর্নব।অনেক সময় অর্নবকে আদরের সুযোগটাও দিতোনা অদ্রিজা। নিজেই অর্নবকে আদরের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিতো।অথচ বিয়ের ট্যাগ লাগানোর সাথে সাথেই সব উত্তেজনা অন্তর্হিত।

আজকাল সমীরকে বেশ ভালো লাগছে অদ্রিজার।সমীর বিবাহিত নয়।ওর ফ্ল্যাটে বেশ কয়েকদিন গিয়ে সময় কাটিয়েছে অদ্রিজা।সমীর বলেছে,অর্নবকে মিউচুয়াল ডিভোর্স দিয়ে ওর ফ্ল্যাটেই পাকাপাকি ভাবে অদ্রিজাকে থাকতে।সমীরের কথাটা বেশ মনে ধরেছে অদ্রিজার।কিন্তু অর্নবের সামনে আর বলা হয়ে ওঠেনি কিছু।

সকাল হয়ে গেলেও অর্নব এখনো ঘুমোচ্ছে।করুনা থার্মোমিটার দিয়ে জ্বরটা মাপলো।না গায়ে জ্বর নেই।বহ্নিকে তুলে বললো,বড়ো রাস্তায় বোসদের বাড়ি গিয়ে ব্লাউজ চারটে দিয়ে আসতে।আর বোস গিন্নীর দেওয়া টাকাতে অর্নবের ওষুধ গুলো কিনে আনতে।মায়ের কথায় অবাক হয়ে যায় বহ্নি।বলে,’কেন ওনার মানিব্যাগে তো অনেক টাকা,ওষুধ গুলো ওনার টাকাতেই কেন আনবোনা?’

একটু চুপ করে থেকে করুনা বললো,’আচ্ছা তাই আনিস।কিন্তু লক্ষ্মীমা আমার, ব্লাউজ দিয়ে টাকাটাও নিয়ে আসিস।কিছু তো রান্না করতে হবে।অসুস্থ লোকটাকে তো আর ভাতে ভাত সেদ্ধ খাওয়াতে পারিনা’।

বহ্নি কামিজটা বদলে ওর ঝোলানো সাইড ব্যাগে ব্লাউজ গুলো ভরে নেয়।প্রেসক্রিপশন টাও সামনের দিকের চেনে ঢুকিয়ে আটকে নেয়।

কলিংবেল বাজাতেই পল্লব এসে দরজা খুলে দিয়ে বহ্নিকে দেখে হা হয়ে যায়।

(চলবে)

#অশান্ত বসন্ত
(নবম পর্ব)
#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য
জয়া চক্রবর্তী
*********************
পল্লবের পলকহীন চোখের অপার মুদ্ধতা বহ্নিকে অপ্রস্তুত করে দিলো।’দরজাটা ছাড়লে আমি ভিতরে আসতে পারি’,বহ্নির কথায় কোনো ভাবে দরজাটা ছেড়ে দাঁড়ায় পল্লব।ভাগ্যিস ওর ফুলমানি কলিং বেল শুনে নিজেও বেরিয়ে এসেছিলো।

বহ্নিকে দেখে ঘরের ভিতরে আসতে বললো ফুলমানি।বহ্নি নিজের ঝোলানো ব্যাগ থেকে ব্লাউজ চারটি বের করে টেবিলের ওপর রাখলো।ফুলমানি নাড়িয়ে চাড়িয়ে ব্লাউজ গুলো দেখে প্রফুল্ল মনে, বহ্নিকে সোফাতে বসতে বলে ভিতরে গেলো টাকা আনতে।

ফুলমানি ভিতরে যেতেই একটু ধাতস্থ হয়ে পল্লব বললো,’আমাকে চিনতে পারলেন?সেই যে একদিন আপনার পিছনে গিয়েছিলাম কথা বলবার জন্য।আর আপনি বিনা কারনেই ভয় পেয়ে দৌঁড়োতে শুরু করেছিলেন’,বহ্নি এবার বিরক্ত মুখে পল্লবকে আপাদমস্তক দেখলো।

এমনিতেই গতকাল রাত থেকে বহ্নির মাথা কোনো কাজ করছেনা।বাবা যাওয়ার পর অনেক কষ্টে নিজেদের সামলে ছিলো।বহ্নি বুঝতে পারছেনা ওর বাবার ফিরে আসাটা ওদের জীবনে আবার কোনো ঝড় তুলবে কিনা!

বলতে গেলে এক রাতের মধ্যেই বহ্নি পালটে ফেলেছে নিজেকে।সেই ভীতু বহ্নি আজ মিসিং।বহ্নি ঠিক করেছে ওষুধ গুলো কিনে বাড়ি ফিরে মুখোমুখি বাবার সাথে কথা বলবে।ও কোনো ভাবেই আর চায়না ওই লোকটা ওদের জীবনে ফিরে আসুক।

বহ্নিকে চুপ থাকতে দেখে পল্লব বললো,’আপনার সাথে কথা বলবার জন্যই আজ কাঁথিতে আসা।ভাবিনি এতো সহজেই মুখোমুখি হতে পারবো।বহ্নি কপাল কুঁচকে পল্লবের দিকে তাকিয়ে বললো,’আমার সাথে আপনার কথা বলবার কি কারন থাকতে পারে সেটাই তো বুঝছিনা!আমি তো চিনিওনা আপনাকে’।

ইতিমধ্যে পিউ এসে দাঁড়িয়েছে পল্লবের পাশে।সেটা খেয়াল করে পল্লব বললো,’আপনি তো এখনই বের হবেন,আপনার সাথে যেতে যেতেই না হয় কারনটা বলবো’,পল্লবের কথা শেষ হতে না হতেই বহ্নি বললো,দুঃখিত আমি আজ ব্যস্ত, এছাড়া আপনাকে চিনিনা তাই কথা বলবারও কোনো প্রয়োজন দেখছিনা’।

পল্লবের ফুলমানি ঘরে ঢুকতে গিয়ে শান্ত মেয়েটাকে ওরকম রাগি গলায় কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে গেলো।তবে সেটা বুঝতে না দিয়েই ব্লাউজের টাকাটা বুঝিয়ে দিয়ে আরো দুটো শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বললো,’এগুলোর ব্লাউজ পিস কাটা হয়নি,মাকে বলিস শাড়ি দুটো ফলস-পিকো করে ব্লাউজ বানিয়ে দিতে’।বহ্নি মাথা নাড়িয়ে শাড়ি দুটো ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

‘বিশ্বাস করুন শুধুমাত্র আপনার সাথে কথা বলবার জন্যই আমার কাঁথিতে আসা’,পল্লবের কথায় বিরক্ত মুখে বহ্নি বললো,’দেখুন আমি এই মুহূর্তে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, কোনো কথা শোনবার অবস্থাতে নেই’।

পল্লব বললো,’আমরা কি কাল দেখা করতে পারি?’,না পারিনা,আমরা কোনোদিনই দেখা করতে পারিনা’,কথাটা বলেই বহ্নি হাঁটা লাগালো।পল্লব বুঝতে পারছেনা এই মুহুর্তে ওর কি করা উচিত! ওর কাঙ্ক্ষিত নারী ওর সামনে দিয়ে এভাবে চলে যাচ্ছে, এটা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলোনা পল্লব।একবার শেষ চেষ্টা করলো।

স্থান কাল পাত্র ভুলে বহ্নির হাত ধরে টানলো।বহ্নি প্রচন্ড রেগে পল্লবের গালে চড় বসিয়ে দিলো।তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো।

দাদাভাই মেয়েটার সাথে কি কথা বলতে চায় সেটা জানার কৌতূহলে পিউ ও চুপিচুপি বেরিয়ে এসেছিলো বাড়ির থেকে।দাদাভাইকে ওই ভাবে মার খেতে দেখে নিজেই কেমন হতভম্ব হয়ে গেলো।

পিউ দেখলো,দাদাভাই দাঁড়িয়ে মেয়েটির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। দাদাভাই এর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ভুমিকম্প হচ্ছে মনের ভিতর।পিউ চাইলোনা দাদাভাই জানুক যে সে দাদাভাইকে মার খেতে দেখেছে।তাই যেভাবে চুপিচুপি বেরিয়ে এসেছিলো সেভাবেই ঘরের ভিতরে চলে গেলো।

বহ্নি এতো বাজে ব্যবহার এর আগে কারো সাথে করেছে বলে ওর মনে পরছেনা।কেন যে ছেলেটা আজকেই ওর সামনে আসলো।অন্যের রাগ ছেলেটার ওপরেই ঝাড়লো।
আসলে কাল রাতে বাবাকে চাতালে পরে থাকতে দেখে এক মুহুর্তে বহ্নির মনে হয়েছিলো,বাবা আর নেই,মনে মনে খুশিও হয়েছিলো।

এই লোকটা চলে যাওয়ার পর থেকে যে অপমানের বোঝা তাদের পুরো ফ্যামিলিকে বইতে হচ্ছে,সেটার কোনো ক্ষমা হয়না।রাস্তায় বের হলেই লোকজন কারনে অকারনে বাবার কথা তোলে।কেউ কেউ বলে,তোদের নতুন মা তোর দিদির বয়েসীই হবে।লজ্জা অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করে বহ্নির।অথচ তার প্রতিমার মতো সুন্দরী মা এই বাবার ভালোবাসার ভরসাতেই ঘর ছেড়েছিলো।
ভালোবাসা!এই শব্দটায় ঘেন্না ধরে গেছে বহ্নির।

যে বাবাকে ও সবচেয়ে বেশি সম্মান করতো, ভালোবাসতো,আজ সেই বাবার নামটা পর্যন্ত শুনতে চায়না। হয়তো মনের অজান্তে ঘৃণাও করে।তাছাড়া যে নিজের সুন্দরী স্ত্রী আর মেয়েদের ফেলে অন্য মহিলায় আশক্ত হয় তাকে ঘৃণা ছাড়া আর কিইবা দেওয়া যায়!এই একটা লোকের জন্য রাস্তার লোকজন তাদের দিকে আঙুল তোলবার সাহস পায়।

বারবার অপমানে বিদ্ধ হলেও কাউকে কিছু বলতে পারেনা বহ্নি।গতকাল লোকটা ফিরে আসাতে সেই সব না-বলা পুঞ্জীভূত রাগ যেন দাবানলের মতো ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
পাড়ার দোকানে ওষুধ গুলো কিনে ঘরে ঢুকতেই দেখে,তার দিদিয়া ভয় ভয় মুখে দরজার কোনে দাঁড়িয়ে, মায়ের হাতে চা জলখাবার। বহ্নি ওষুধের প্যাকেট খাটের ওপর ছুঁড়ে দিলো।

মুখে বললো,’এর মধ্যেই আপনার প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ।নিয়ম করে খেলে আশা করি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন’,বহ্নিকে দেখে অর্নবের মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে।কিন্তু বহ্নি এই ভাবে কেন কথা বলছে!আর অর্নবকে আপনি সম্মোধনই বা কেন করছে!

অর্নব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বহ্নির দিকে।এই কি তার সেই ডল!এতো পরিবর্তন! অর্নবকে আরো অবাক করে দিয়ে বহ্নি বলে উঠলো,’দেখুন আমরা জানি বাড়িটা আপনার,চাইলে ছেড়ে দিতে বাধ্য আমরা।তবু কয়েকটা বছর যদি দিতে পারেন,আশা করছি নিজেরাই ছেড়ে দিতে পারবো’,বহ্নির কথায় অর্নবের চোখে জল চলে আসে।তার ছোট্ট ডলের সাথে কোনোভাবেই মেলাতে পারেনা ওকে।

কিছু সময় চুপ করে থেকে একটু গুছিয়ে নেয় নিজেকে।তারপর বলে,’কানাডা অফিসে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাচ্ছি আগামী সপ্তাহে। হয়তো আর কখনোই এদেশের মাটিতে পা দেবোনা।তোদের ওপর অনেক অন্যায় করেছি,জানি এর ক্ষমা হয়না।তবু যদি ক্ষমা করতে পারিস এই নাম্বারে ফোন করিস’,কথাটা বলে বুকপকেট থেকে একটা কার্ড বিছানার ওপরে রাখলো অর্নব।

অর্নবের কথায় ঝরঝর করে কেঁদে চলেছে করুনা।শুধু বহ্নির এসব কথায় যায় আসেনা।’যাওয়ার সময় প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ গুলো নিয়ে যাবেন।আপনার টাকাতেই ডাক্তার দেখানো হয়েছে আর ওষুধ কেনা হয়েছে।না বলে আপনার মানিব্যাগ ধরার জন্য দুঃখিত’,অর্নবের সাথে কথাটা শেষ করে বহ্নি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,’টিউশনি যাচ্ছি,ফিরতে দেরি হবে’।

বহ্নির চলে যাওয়ার দিকে ব্যথিত চোখে তাকিয়ে থাকে অর্নব।আজ অর্নবের চোখে মুখে হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা।

উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে ঘুরে বেলা শেষে পল্লব ফুলমানির বাড়িতে আসলো।পিউয়ের কাছে ইতিমধ্যেই ফুলমানি শুনে নিয়েছিলো পল্লবের এবার কাঁথি আসার সেই বিশেষ উদ্দেশ্যের কথা,বহ্নিকেই যে পল্লব ভালোবেসে ফেলেছিলো সেটাও বুঝে গেছে।আর সেই বহ্নির হাতে চড় খাওয়ার কথা শুনে ফুলমানি নিজেও অপ্রস্তুত।

পল্লব আসতেই বললো,’খাওয়ার বাড়ছি,খেয়ে নে’,পল্লব বললো,’ফুলমানি আমি খেয়ে এসেছি। আর আজ সন্ধ্যেতেই ফিরছি আমরা।অফিস থেকে ফোন করেছিলো আমায়’।

ফুলমানি সবটাই বুঝলো,কিন্তু পল্লবকে আর ঘাটালোনা।
পিউ আসার সময় ঠিক করেছিলো,দাদাভাইকে বলবে ফেরার পথে মন্দারমনি নিয়ে যেতে ।কিন্তু দাদাভাইকে দেখে আর কথা বাড়ালোনা। এক বেলার মধ্যে পিউ নিজেও যেন বড়ো হয়ে গেছে।

(চলবে)