#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪৫
সৃজার মা অনিতা রহমান ছিল ইহসান আর ইজহানের টিচার। সেবার ওদের কলেজে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ফিজিক্স পড়াতেন। প্রথমদিনই ব্রেক টাইমের পর ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে, সি’গারেট ফুঁকার অপরাধে ইজহানকে তিনি ক্লাসে শাস্তি দিয়েছিলেন। যেইসেই শাস্তি নয়। একপায়ে দাঁড়িয়ে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখানোর মতো শাস্তি৷ তবে শাস্তি মানবে না বলে ইজহান সেদিন অনিতা রহমানের সাথে বেশ দুর্ব্যবহারও করে। তাই তিনিও বেতের বারি দিয়ে হাতের তালুর বারোটা বাজিয়ে দেন ইজহানের। সেদিন কোনো এক কারণে কলেজে যাওয়া হয়নি ইহসানের। পরে সাঙ্গপাঙ্গদের থেকে জেনেছিল সে, নতুন এক ম্যাডাম এসে তার ভাইকে বেধড়ক মেরেছে। যদিও বনিবনা হতো না দু-ভাইয়ের মধ্যে, দা-কুমড়া সম্পর্ক ছিল, তবুও এ খবর শুনেই ক্ষুদ্ধ হয়ে গেছিল বেপরোয়া ইহসান৷ মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, সুযোগ পেলে এর শোধ সে নিয়ে নিবে।
তবে এর দু-তিনদিন টিচার্স রুমে ডাক পড়লে ইজহানের বদলে ভুলক্রমে ওকে ডেকে নিয়ে আসে পিয়ন। ইহসান যখন যায়, তখন দেখে শাড়ি আর চোখে চশমা পরা এক মহিলা মিষ্টি হেসে ওকে বলছে, “এসো বসো। আসলে তোমাকে ডেকে পাঠানোর একটা কারণ আছে—সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে আমি একটু ডিস্টার্ব আছি। আমার আরেকটু সহনশীল হওয়া উচিৎ ছিল। প্রথমদিন এসেই তোমাকে ওভাবে শাস্তি দেওয়াটা উচিৎ হয়নি। তুমি আমার ছেলের মতো, মা তোমাকে শাসন করেছে ভেবে ব্যাপারটা ভুলে যাও বাবা!”
ইহসান বিস্মিত হয়েছিল, “ভুলে যাব?”
“চেষ্টা করবে। তবে তাই বলে পড়াশোনা আর ক্লাসে ফাঁকিবাজি দিয়ে বটতলায় বসে সি’গারেট ফুঁকবে এটা কিন্তু মেনে নেব না৷”
“আবারও শাস্তি দিবেন তাহলে?’’
“অবশ্যই!”
ইহসান তক্ষণি হাত পেতে দিয়েছিল, “স্কেল মারুন
তো মিস।”
অনিতা রহমান বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেন?”
“আসলে আপনি যাকে ভাবছেন সে আমি নই, আমি তার ভাই। তবে সেদিনের ঘটনায় আমিও আপনার উপর একটু ক্ষুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, আমার ইনটেনশনও অতোটা ন্যায্য ছিল না!”
অনিতা রহমান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকা বুঝে ফেলেন তার সামনে বসা ছেলেটা কোন ইনটেনশনের ব্যাপারটা। কলেজ পড়ুয়া বেপরোয়া ছেলেপেলে এরকম হয় তা তিনি এক-আধটু জানেন। আর এ তো তার ভাইয়ের জন্য ম্যাডামের সাথে চতুরতা করতে চেয়েছিল। তিনি হেসে ফেলেন, “ইনটেনশন বুঝতে পারছি, তবে স্বীকার করেছ বলে শাস্তি থেকে রেহাই দিলাম!”
ইহসানের এতো মিষ্টি লাগল মিসকে, সে বলেই ফেলল, “আপনি কী আমার মাথায় একবার হাত রাখবেন মিস?”
অনিতা রহমান বড্ড অবাক হলেও ইহসানের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “আচ্ছা পাগল তো তুমি!”
“আসলে মাথায় হাত রাখার মতো আমার কাছে মা নেই।”
বলার সময় গলা কাঁপছি ইহসানের। অনিতা রহমান অবাক হয়েছিলেন! এই অদ্ভুত ছেলেটার প্রতি সেদিন তিনি মমত্ববোধ অনুভব করেছিলেন কি-না জানা নেই, তবে এরপর দু’জনের মধ্যে বেশ ভালো একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গেল। মা-ছেলের মতোই খুব সহজ একটা সম্পর্ক অথচ অনেককিছু পেয়ে যাওয়ার মতো। এরই সুবাদে মিসের বাসায় ও আসা-যাওয়া করতো মাঝেমধ্যে ইহসান। সৃজা তখন ছোট, এলিজা বাচ্চা একটা মেয়ে। ওদের সঙ্গেও বেশ ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল এই সুযোগে, নাইমুর সাহেবও প্রশংসা করে ভাসাতেন ওকে। বিকেলের খেলাধুলা আর ফাঁকিবাজি আড্ডাটা বাদ দিয়ে বইপত্র নিয়ে মিসের কাছে পড়তেও শুরু করল, সৃজা-এলিজাকে মাঝেমধ্যে ম্যাথ বুঝিয়ে দিতো। নিজের ভাঙাচোরা পরিবারের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এদের সাথে মিশে গিয়ে ইহসান উপলব্ধি করতে পেরেছিল, জীবনে একটা সুস্থ পরিবেশ কতটুকু দরকার! মা-বাবার ভালোবাসাটা কতটা দরকার! সন্তানের জন্য তাদের ভালোবাসাটা কেমন যেন নিঃস্বার্থ আর বড্ড মজবুত হয়। ওর কাছে তখন অনিতা মিস. নিজের মা না হলেও তার এমন একজন বড় মেন্টর, যার মধ্যে সে মা মা অনুভূতি খুঁজে পেতো। তবে ইজহান এ ব্যাপারটা মোটেও নিতে পারতো না। তাকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, শাস্তি দেয়া অনিতা মিসের সাথে নিজের ভাইয়ের এখন গদগদ সম্পর্ক তার গায়ে জ্বালা ধরাতো। ব্যাপারটাতে সে প্রচন্ড বিরক্ত ছিল! অনিতা মিস তাকেও স্নেহ করতেন, কিন্তু ইগোতে লাগতো ইজহানের। তার এক ফুফু, অনিকের মা। তার নামও অনিতা বেগম। বড্ড কুচুটে মহিলা। সবসময় মায়াকান্না আর নাটক করে স্বার্থ হাসিলে যিনি নিমগ্ন থাকেন। দু-চক্ষে দেখতে পারে না ইজহান তাকে, নামটাও শুনতে পারে না। তাই অনিতা রহমানকেও তার পছন্দ হলো না, অবশ্য ঠিক পছন্দ যে হয়নি তা নয়; তাকে শাস্তি দিয়েছে এবং এই মিসের নাম তার ফুফুর সাথে মিল! এটাই মূলত মিসের কাছে না ঘেঁষার অন্যতম কারণ। তাই সে একপ্রকার এড়িয়েই চলতো অনিত রহমানকে। আবার মাঝেমধ্যে হিংসায়ও জ্বলতো ভাইকে মিসের সাথে দেখে। তার তো ওমন একটা মা মা টাইপের কেউ নেই, মাথায় হাত রাখার মতো কেউ নেই। ইহসানটাই কেন এত সহজে সব পেয়ে যায়! হুহ! সে বেশ বিরক্ত ছিল এবং সেকশন পাল্টে ফেলেছিল। তবে সেই মায়ের মতো মিসের ছত্রছায়া দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারেনি ইহসান, হঠাৎ এক ঝাপটা ঘূর্ণিঝড়ে ইহসান হারিয়ে ফেলেছিল তার মিসকে, সেই সাথে জানতে পেরেছিল ভয়াবহ এক সত্যি! যে এক্সিডেন্টে, যে গাড়ির ধাক্কায় অনিতা মিসকে সে হারিয়েছে, সেই গাড়িটা আর কারো নয়, তারই বেপরোয়া, বখাটে, উচ্ছৃঙ্খল ছোটো ভাইয়ের!
এসব জানে না সৃজা! জানার মতো বয়স, অবস্থা, পরিস্থিতি তখন ছিল না। কিন্তু দিন বদলের সাথে সাথে যখন নিজের অনুভূতিও পরিবর্তন হচ্ছিলো সৃজার প্রতি ; অমানিশার ঘোর অন্ধকার ঘিরে ধরেছিল ইহসানের হৃদপিণ্ডটাকে। তাই ভালোবেসে ফেললেও সে কখনো ভাবেইনি, চায়ওনি তার
প্রেয়সী, তার গোপন চাওয়া অনিতা মিসের বড়ো
মেয়ে সৃজা রেহমানকে নিজের করে পেতে! তবে
পেয়ে যাওয়ার পর থেকেই সে সংশয়ে আছে, ইনজান দেশে ফেরার পর থেকে তো আরো অস্থিরতায় আছে, যদি কোনোভাবে সৃজা এসব সত্যি জেনে যায়, তাহলে? ওকে কী ভুল বুঝবে না, দূরে ঠেলে দেবে না? ইহসানের অস্থির লাগে খুব, ভার ঠেকে বুকের ভেতরটা। অমোঘ সত্যিগুলো সে চেপে রেখেছে এই বুকটাতে, কত আর লুকোবে সে? সৃজার ঘরের দরজার সামনে সে দাঁড়িয়ে থাকে আনমনা হয়ে। ভেতরে ঢুকে না। ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়েই থাকে, একবার ভেতরে ঢুকে, দেখে এলিজার পাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে সৃজা। ইহসান গিয়ে ওর পাশে একটু বসে, হাত বাড়িয়ে চুলগুলো ঠিক করে দেয়। চাদর টেনে দেয় গায়ে। মলিন মুখটার দিকে সে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে ওর মনে হয়, ঠকাচ্ছে সে এই মেয়েকে। যদিও ইচ্ছেকৃত নয়, তবুও ঠকানো হচ্ছে! ইহসান চোখ বুজে কপাল চেপে ধরে। কঠিন এক দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে সে। ইজহানটা কেন মনে করিয়ে দিলো ওকে তিক্ত স্মৃতিটা? ডেকে কি আরো দুটো ঘুষি বসিয়ে দেবে চোয়ালে? তাতে কি শান্তি পাবে? ইহসান সটান বেরিয়ে গিয়ে ডেকে বের করে আনে ওকে ঘর থেকে। ইজহান ঘুমঘুম চোখে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী সমস্যা?”
“ছাদে চল, কথা আছে।”
গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে ইজহান সন্দেহ নিয়ে তাকায়। সন্ধ্যার দিকেই তার পেটে-পিঠে ঘুষি বসিয়ে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এই ভেড়া। ব্যথায় রগে টান পড়েছে ওর। ইস্মি মালিশ করে দিচ্ছিল, তার মধ্যেই বাগড়া দেওয়া! কালপ্রিট এসে বলছে কি-না তার সঙ্গে ছাদে যেতে? আরো মারধর করার ধান্ধা কষছে নাকি সুযোগ পেয়ে? সে বাঁকা স্বরে বলে, “আমার সাথে কথা? সিরিয়াসলি? তোর সাথে আমার তো তেমন কোনো সম্পর্ক নেই যে, গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতে পারে। ধান্ধাবাজিটা খুলে বল তো!”
“ধান্ধাবাজি নয়।”
অবিশ্বাস নিয়ে বলে ইজহান, “তোকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না একটুও! তোর শ্বশুরবাড়িতে এসে ঘাঁটি গেড়েছি, বউ নিয়ে রাত কাটাচ্ছি, নিশ্চয় আমাকে দুর্বল ভাবছিস? ভাবছিস আমাকে মেরে গুম করে দিবি, সাবধান! আমার সৈন্য কিন্তু তক্কেতক্কে আছে। পাহা…”
সৈন্য বলতে মিজুকে বোঝাচ্ছে লুফারটা। ওকে আজ যেতে দেয়নি ইজহান। এখানেই থেকে যেতে বলেছে। ইহসানও না করেনি। রশিদ নেই, গেছে ইনজানের কাছে। রাতে যদি কোনো প্রয়োজন লাগে, তাহলে মিজু সাহায্য করতে পারে। এটাকেই রঙচঙ মিশিয়ে কত কী বলছে! ইহসান মেজাজ হারিয়ে ঘাড় চেপে ধরলো ভাইয়ের। ইজহান ছটফট করে উঠল। ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু ইহসান ওকে ছাদের দিকে নিয়ে যেতে যেতে শাসালো, “লাত্থি মেরে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেব।”
”খু-নি কোথাকার!”
“হ্যাঁ, তাই।”
“কবে থেকে নাম লেখালি?”
“যেদিন তুই বিয়ে করে বউ আনলি, সেদিন থেকে।”
ইজহান তাজ্জব চোখে চায়। ছাদে এসে ইহসান ওকে জোর করে চেপে ধরে বসিয়ে দিয়ে নিজে ওর উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। হাতগুলো টেনে নিয়ে নিজের মাথায় রেখে গমগমে স্বরে বলে, “নে, চুলগুলো টেনে দে, বড্ড যন্ত্রণা করছে ভেতরটা।”
আকস্মিক এ কান্ড দেখে ইজহানের স্ট্রোক করার মতো অবস্থা! একী দেখছে সে? এই ভেড়া, তার ভাই, তার শত্রু, যার সাথেই তার আজন্মের লাগালাগি! সে আজ, এই নিশীথে, এই নির্জন ছাদে নিয়ে এসে ওর কোলে শুয়েছে? ইজহানের কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে। বিস্ময়ে সে কিছু বলতেই পারে না। হাতদুটো ওভাবেই থাকে ইহসানের মাথায়, শক্ত হয়ে। ইহসান জিজ্ঞেস করে, “মরে গেছিস নাকি?”
বিস্মিত ইজহান কাঁপা গলায় বলে, “আগে বল, তুই বেঁচে আছিস নাকি শ্বশুরের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়েছিস? তুই ভেড়ার আত্মা?”
“জলজ্যান্ত মানুষ আমি।”
“তাহলে কি মাথা গেছে? মিজুকে বলব হসপিটালে নিয়ে যেতে?”
ইহসান বিরক্তিকর স্বরে বলল, “মাথাটা কিন্তু টগবগ করে ফুটছে, নাটক করলে লাত্থিতে চাপা খুলে ফেলব।”
ইজহান চুপ করে গেল। হলো কী এই ভেড়াটার? সে বিচলিত ভঙ্গিতেই নিজের হাতদুটো ভাইয়ের মাথায় চালনা করল। ইহসান আরামে চোখ বুজে দেখিয়ে দেখিয়ে দিতে লাগল কোথায় কোথায় বিলি কাটতে হবে। ইজহান একরাশ বিস্ময় নিয়ে আলো-আঁধারিতে সেভাবেই বিলি কেটে দিলো। ইহসান অনেকক্ষণ পর
মৃদুস্বরে বলল, “তুই কি আমার জীবনে মীরজাফর হবি?”
ইজহান আবারো অবাক হয়। তবে বলে, “তুই হলে আমি কেন নয়?”
“শুনি?”
“আমার বউকে সবসময় ফুঁসলাস, ছেড়ে যেতে বলিস আমাকে। মীরজাফরগিরি আমার পেছনে কম করিসনি তুই!”
“তো তুই অত্যাচার করিস, বলব না ওকে? আর তুই ভুলভাল মেয়েমানুষের প্রেমে পড়বি, মারা খাবি আর দোষ দিবি আমার?”
ইজহান মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। এই টপিকে সে কথা বলতে চায় না। ঐ হাবলির কথা মনে পড়লেই রাগে গা কিড়কিড় করে ওর, ছিহ! আবার চুমুও খেয়েছিল! সে গমগমে স্বরে ইহসানকে বলে, “তুই কখনো ইস্মিতাকে কালনাগিনীর কথা বলবি না।”
যদিও ইজহানের অতীত প্রেমের কথা জানে ইস্মি, বহু আগেই বলে দিয়েছিল ইহসান ওকে। তবুও সে ভাইকে সান্ত্বনাসূচক ভরসা দেয়, “চল একটা ডিল করে ফেলি।”
”কী ডিল?”
“আমি কখনো ইস্মিতাকে তোর কুকীর্তি বলব না, তুইও কখনো ইনজানের এক্সিডেন্টের সত্যিটা সৃজার সামনে তুলবি না।”
ইজহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবে, ভেবে এরপর ঠোঁট উল্টায়, “বললাম না টনা-মনার মাকে। কিন্তু আমি না বললেও কী, আরসালান যদি নিজেই নিজের কুকীর্তি স্বীকার করে? বলে দেয় যে, তোর শ্বাশুড়িকে ও নিজেই গাড়ির তলায় চাপা মেরেছিল? তুই পুরোটা জেনেও গোপন করেছিস! তখন?”
“তখন তুই আমার পক্ষ নিবি। এটাই ডিল।”
ফট করে কথাটুকু বলে ইহসান কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে। ইজহান পেছনে দু’হাতের উপর ভর রেখে চুপ করে ভাইকে দেখে। ইচ্ছে করে গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতে, কিন্তু বিবেকে বাঁধা দেয়! বেচারা আজকেই শ্বশুর হারিয়েছে, বহুৎ কাজও করেছে, মানসিকভাবে ভুগছে, এরমধ্যে ঠাটিয়ে চড় দেওয়াটা উচিৎ হবে না। তবে খোঁচা তো সে অবশ্যই দেবে৷ হঠাৎ মনে পড়তেই ইজহান তড়াক করে বলে, “একটা ছাগল তোর শালির হাত চেয়েছিল…”
“হাত চেয়েছিল মানে?”
“বিবাহের প্রস্তাব—”
ইহসান কান খাড়া করে শোনে, “কে দিয়েছিল?”
“নেভি ব্লু পাঞ্জাবি পরা ইতরটা, বাপটা যে চেয়ারম্যান। আমি অবশ্য রিজেক্ট করে দিয়েছি।”
“ভালো করেছিস।”
ভেড়ার মুখ থেকে প্রশংসা আদায় করে ইজহান বক্র হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ে ঊর্ধাকাশে তাকিয়ে। চারপাশের অন্ধকার ম্লান করে আকাশে উজ্জ্বল চন্দ্ররাজ তার কোটি কোটি নক্ষত্র সৈন্য নিয়ে মেলা বসিয়েছে। সেই আদুরে চন্দ্ররাজের মায়াবী আলো এসে পড়ছে ছাদের কার্নিশে, মেঝেতে, ফুলগাছের উপরে। ড্রামে লাগানো মাঝারি আকারের বাঁশগাছ আর নারকেল গাছের ফাঁক গলিয়ে আদুরে চাঁদ এসে পড়ছে তাদের দু’ভাইয়ের উপর! ইজহানের হঠাৎ মন খারাপ লাগে। উপলব্ধি হয়, অনেকগুলো বছর পর, তারা দু’ভাই একত্রে অন্ধকারের নিচে বসে চুপচাপ রাত কাটাচ্ছে! এমন হয়েছিল তাদের নিজের মায়ের মৃত্যুদিন, ছাদে বসে রাত কাটিয়ে দিয়েছিল তারা। মা-হীন পৃথিবীর নতুন ভোর হওয়া দেখেছিল, বড্ড অসুন্দর ছিল সেই ভোরটা!
…
বিষন্নতা নিয়ে তিনদিন কেটে গেছে। ইস্মি-ইজহান, শেফালি বুয়া রয়ে গেছে। আজ এতিম আর গরিব-দুঃখীদের দানখয়রাতের ব্যবস্থা ক করা হয়েছিল। বেশ ব্যস্ত ছিল সবাই আজকে। শুধু সৃজাই একমাত্র যে, সারাদিন ঘরে বসে চোখের জল ফেলেছে। বেরই হয়নি। রাত দশটা৷ মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া প্রকৃতি বা পরিবেশে শব্দটা কেমন নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে। খটমটে শব্দ তুলে চর্তুদিকে ঘূর্ণি তোলা ফ্যানের দিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থেকে সৃজা চোখদুটো বুজে ফেল। সে নিজ ঘরে শুয়ে আছে। আর ওর মাথার কাছে ম্লান চেহারা নিয়ে এলিজা বসা। ওর একটা হাত এলিজার মুঠোবন্দি। দুপুরের পর বোনকে এভাবে কাছেই পায়নি সৃজা। এতক্ষণে ডেকে আনা গেছে। ইস্মি ওদের দু বোনকে বসিয়ে দিয়ে গেছে, তবে কান্নাকাটি করতে মানা করে গেছে। মৃতব্যক্তির রুহের নাকি তাতে খুব কষ্ট হয়! তারা দুই বোন আব্বুর আত্মাকে আর কষ্ট দিতে চায় না। এলিজকে মলিন মুখে পাশে বসে থাকতে দেখে সৃজা উঠে বসতে চাইল, এলিজা তা দেখে হন্তদন্ত হয়ে কাঁধ জড়িয়ে ধরল ওর, “শুয়ে থাকো, উত্তেজিত হয়ো না আপু।”
সৃজা শুনলো না ওর কথা। পেট চেপে ধরে আস্তেধীরে উঠে বসল। এলিজাকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বসে রইল। এলিজা কোনো কথা বলল না। আড়ালে চোখ মুছে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “মন খারাপ করো না।”
সৃজা বোনের কথায় চাপা শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করে, “ফুপি কোথায়?”
“নামাজে বসা।”
“কাঁদে খুব?”
“হু।”
“সেদিন আব্বুকে বিদায় দিতে গেছিলি?”
তিনদিনে এ নিয়ে একটা প্রশ্নও করেনি সৃজা, এখন করেছে। এলিজা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “সাময়িক বিদায়, দেওয়ার কিছু নেই। আমাদের আবার দেখা হবে, একসঙ্গে থাকব আমরা। ততদিন পর্যন্ত মনে আর মস্তিষ্কে আব্বু চিরঞ্জীব থেকে যাবে। তাই ওসব লোকদেখানো বিদায়, গেইট অবধি পার করে দেওয়ার রীতি অযৌক্তিক বৈ কিছু না। আমি যাইনি ওসবে।”
এ পর্যায়ে আবারো সৃজা ডুকরে কেঁদে উঠল, “আব্বুর এখন খেয়ে, ঔষধ নেওয়ার কথা! একটু পর ঘুমানোর সময়!”
এলিজা জবাব দিলো না। বোনকে ছেড়ে বসলো। এরপর শূন্য, আহত চোখে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল, “এখনও ঘুমাচ্ছে, তবে পার্থক্য এটাই যে, আব্বু আমাদের কাছে শান্তির ঘুমে ছিল না, এখন তিনি চিরশান্তির ঘুমে আছেন।”
কেমন যেন ক্ষোভ মেশানো শোনাল কথাটা। অদ্ভুত! এলিজা এভাবে বলে না। সৃজা বিস্ময় নিয়ে তাকাল কথাটা শুনে, “নির্মম না?”
এলিজার কণ্ঠস্বর অত্যাধিক শান্ত, “সত্য তো এটাই যে, আব্বুর এত দ্রুত চলে যাওয়ার কথা ছিল না। তবুও সে গেছে। আমাদের এতিম করে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। আর কখনোই আমরা তাঁকে পাব না। যেভাবে পাইনি আম্মুকে। আচ্ছা, আর ক’দিন পর যখন ইউনিভার্সিটি যাব, আব্বু দেখবে না? সেখানে আমি টপ করব, আব্বু হেসে বলবে না আজ বাসায় ভালোমন্দ রান্না হোক? রাতে আমরা আব্বুর ঘরের মেঝেতে বসে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া, গল্প করব না আর? মাথায় অসাড় হাতটা রেখে দোয়া করবে না আর তাঁর দোয়াকে? আচ্ছা, ভালোই তো ছিলাম আমরা, হোক না অসুস্থ দু’দিন পরপর! আমরা তো কোনোদিনও অভিযোগ করিনি। তাহলে? আমাদের এত দ্রুত শান্তি দেওয়ার তাড়া ছিল কেন আব্বুর? আপু, আমার কী ঐ মানুষটার প্রতি অভিমান করা উচিৎ? নাকি রাগ করা উচিৎ?”
সৃজা চোখ ভরা পানি নিয়ে, থরথর করে কেঁপে উঠল। এই মুহূর্তে এলিজাকে থামানো উচিৎ, ওর সহ্য হচ্ছে না এ কথাগুলো। এলিজা ছোট, ও কেন এত কথা বলবে? এভাবে বলব? ও এলিজার মুখ চেপে ধরে বলল, “চুপ কর।”
“আমি একটু কাঁদি আপু? তোমার জন্য কাঁদতেও পারিনি। আব্বুর জন্য শেষবার কাঁদব!”
সৃজা দু’হাতে আগলে নিলো এলিজার মুখখানি, “তুই কাঁদিস না এলিজ!”
“ভাইয়াও বলে গেল কান্না চোখে আমাকে নাকি
মানায় না! বোকা বোকা লাগে! আমি কী খুব বুদ্ধিমান? তাহলে কেন আগে থেকে টের পেলাম না আব্বুর চলে যাওয়ার খবর?”
এলিজা বিদ্রুপাত্মক হাসলো। সৃজা নিরুত্তর। ব্যথিত নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। এলিজা উঠে বারান্দায় চলে গেল। ডাকলো না সৃজা ওকে। তীব্র অবসাদে ওর শরীর ভেঙ্গে আসছে। পুরো পৃথিবীটা মনে হচ্ছে ঘুরছে। আচ্ছা আব্বু কী সত্যিই চলে গেছে? সৃজার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ওর মস্তিষ্ক কাজ করছে না। হুট করে এত দুর্বল হয়ে গেল ও, এমন তো আগে লাগেনি। এইযে বমি পাচ্ছে, মাথা ঘুরছে, এক পৃথিবী ঘুমে অক্ষিকোটর জড়িয়ে আসছে! কই! এতদিন তো কিছু অনুভব করেনি সে! সৃজার তখনি সম্পূর্ণভাবে মাথা কাজ করা শুরু করল। বাচ্চাদের কথা মনে পড়ল৷ আশ্চর্য! সে দুটো দিন একটা দানাও পেটে দেয়নি, তরল যা খেয়েছে বমিতে সেটুকুও বেরিয়ে গেছে। স্যালাইন আর ঔষধের উপর রয়েছে সে। বাচ্চাদের উপর তাহলে কম ধকল যায়নি। ওয়েট, ওয়েট! সেডেটিভও নেওয়া হয়েছে এরমধ্যে, ভীষণ রিস্কি! সৃজা অস্থির হয়ে উঠল, ভয়ে ঘাম ছাড়ল। মাথার ভেতরের নার্ভগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে যেন। পেটে হাত চেপে কেঁদে ফেলল। ওরা ঠিক আছে তো? নাকি, কিছু হয়ে যায়নি তো…
এলিজা বারান্দায়ই ছিল, শূন্যতা নিয়ে। তাঁকে দোয়া বলে ডাকা আব্বুর জন্য সে অবশ্যই কাঁদবে, কিন্তু সেই কান্নাটুকু কাউকে দেখানোর জন্য না। শুধু নিজেকে একটু হালকা করার জন্য। সব কান্না জমিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না। সবকিছু ভারী ভারী ঠেকছে। এত ভার বইবার মতো শক্তি-সামর্থ্য এলিজের নেই৷ অথচ সবাই তাকে কতকিছু ভাবে! চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই ঘর থেকে সৃজার কান্নার শব্দ শোনা গেল। এলিজা কোনোমতে চোখ মুছে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছুটে এলো। অভিযোগের স্বরে বলল, “তুমি আমাকে কাঁদতে দিবেই না আপু, বলো তো আবার, কী হয়েছে?”
সৃজা করুণ চোখে তাকাল। ভগ্ন গলায় ঢোক গিলল, “আমার বাচ্চারা! ওরা…ওরা কেমন আছে? আমি তো খেয়ালই রাখতে পারছি না এদের…”
এলিজা ওর পাশে বসলো। বোনকে শান্ত হতে বলে ভরসা দিলো, “অল ওকে।”
“তোর ভাইয়া কোথায়?”
“বসার ঘরে। ডাকব?”
“খুব ধকল যাচ্ছে না? ব্যস্ততা শেষ হলে বলিস আসতে।”
ভাঙা কণ্ঠে বলল সৃজা। তবে এলিজা গিয়ে বলতেই ইহসান প্রায় ছুটেই এলো ঘরে। বিছানায় সৃজাকে চুপচাপ বস থাকতে দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে দরজা আটকে ওর কাছে এলো। টেনে সৃজাকে বুকে নিয়ে বসে রইল৷ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কাঁদ, আজকেই কেঁদে চোখের পানি শেষ কর। আর কখনো এভাবে কাঁদতে পারবি না।”
সৃজা ওর বুকে মিশে গেল। ভার গলায় অস্ফুটস্বরে বলল, “আব্বু চলে গেল, আমাদের আর কেউ নেই। ফুপিকে, এলিজটাকে কে দেখবে?”
“আমি তো আছি, মরে যাইনি।”
সৃজার বুক কেঁপে উঠল। ভয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল, বুক খামচে একাকার করল৷ এলোমেলো স্বরে বলল, “আমার হারানোর মতো কিছু নেই, এলিজ আর তুমি ছাড়া…”
বলতে বলতে মেয়েটা আবার চুপ হয়ে গেল৷ ইহসানের বুকে জলোচ্ছ্বাসের মতো উদ্দাম সৃষ্টি হয়, অদ্ভুত এক যন্ত্রণা হয়। কেন, সে জানে না! রুক্ষ হাতদুটো বাড়িয়ে সৃজাকে আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে ধীর স্বরে বলে, “ভরসা করিস তো আমাকে? একদম ভাববি না তোর কেউ নেই, আর কেউ না থাকুক আমি আছি। এইযে দেখ, আমারও কেউ নেই তোরা ছাড়া… আমারও মা চলে গেছে সেই কবে, একবুক অভিমান নিয়ে! এতিম হওয়ার যন্ত্রণা, জানি তো এই যন্ত্রণা কেমন…”
মুখ ফসকে মায়ের কথাটা বলে দিয়েই থেমে গেল ইহসান। কী থেকে কী বলে ফেলেছে সে! শিট, শিট, শিট…ইহসান আড়ষ্টতায় জমে গিয়ে সৃজার মুখের দিকে তাকালো। কিন্তু তারপরই চমকে উঠল। আশ্চর্য! জ্ঞান হারিয়ে বসে আছে এই মেয়ে, আবারো!
“সৃজা! সৃজা! শুনছিস?”
কোনো সাড়া নেই। মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে ওর বাহুর মধ্যে পড়ে আছে। ইহসান দ্রুত ওর কপালে হাত
রাখল—একদম আগুন! সে তড়াক করে ওকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে বেডসাইড থেকে পানির ছিঁটা দিতে দিতে অন্যহাতে ফোন নিয়ে ডাক্তারকে কল করতে উদ্যত হলো।
একটু একটু জ্ঞান ফিরলে সৃজা টের পেল হাতে
সূক্ষ্ম কিছু একটা বিঁধছে। সৃজা নড়েচড়ে উঠে বসতে চাইল, কিন্তু ইহসান জোর করে ওকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিচলিত মুখে ভরসা দিলো, “কিচ্ছু হবে না তোর, একটু ঘুমা!”
ঘুমিয়ে পড়তে সময় লাগল না সৃজার। ইহসান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওর হাত ধরে বসে রইল। মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে, চোখের পাতায় এখনো কিছু শুকনো অশ্রু জমে আছে। ছোট্ট শিশুর মতো দেখাচ্ছে ওকে।
ইহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গত দু’দিনে আজ, এক্ষণ
সে একটুখানি ফুরসত পেয়েছে, সব কাজ ফেলে, সৃজাটার পাশে একটা রাত বসে কাটানোর। সে ক্লান্ত চিত্তে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে তার সন্তান ধারণ করা মানবীটির দিকে, বাবা হবার মতো নিদারুণ একটা সুখ চেয়ে এসেছে আসঙ্গের প্রথম দিন থেকেই। মন থেকে চেয়েছে তার অপবিত্র রক্ত পায়ে মাড়িয়ে পবিত্র রক্ত ধারণ করে পৃথিবীতে আসবে তার ভবিষ্যত প্রজন্ম। তারা আসছে…অথচ, সে এই সুখটুকু উপভোগ করতে পারছে না। চারপাশ থেকে দায়িত্ব-কর্তব্য আর সৃজার সাথে করা খামখেয়ালিপনার বেড়াজালে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়তে দেখছে সে! ক্লান্ত লাগে খুব ইহসানের। দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে সে ধীরস্থিরে সরে আসে, মুখ নামিয়ে আনে সৃজার পেটের কাছে। আলতো হাতে কাপড় সরিয়ে ধবধবে ফর্সা উদরখানিতে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে পলকহীন চোখে। উঁচু হয়ে উঠার প্রক্রিয়াধীন থাকা উদরে ঠোঁটদুটো ঠেসে সে চুমু খায় গভীরভাবে, বলে, “খুব রাগ, খুব অভিমান, খুব আক্রোশ জন্মেছে আব্বার প্রতি? ভাবছ, এতদিন পর কেন এসেছি তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে, তোমাদের অনুভব করতে, আদর করতে? সোনারা, আব্বা জানতো না তোমরা আসছ, সে খেয়ালই করেনি, ভাবেওনি তোমরা আসতে পার! তোমাদের আম্মাও বলেনি, অবশ্য তার দোষ দেওয়া বে-ইনসাফি হবে। সে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিল—অবশ্য আমি যোগ্যই! তার গায়ে হাত তুলেছি, শাস্তি বিহীন সব পেয়ে যাব কেন? এরকম অধম পিতা তোমরা আসলে ডিজার্ভ করো না! তবুও আমি এক লোভী, স্বার্থপর পিতা, তোমাদের মায়ের মতো তোমাদেরও চাই, তোমাদের থেকেও চাই—ক্ষমা পাব কি আব্বারা? প্রথমবার এবং শেষবার আব্বার ভুলগুলোকে ফুল ভেবে মাফ দিবে তো তোমরা? নাকি মায়ের মতোই কঠোর হবে? আচ্ছা, হও তোমরা মায়ের মতো, মাফ না দিলেও আব্বাকে একটু ভালোবাসা দিও, কাঙাল ভেবে হলেও দিও।”
[যারা মন্তব্য করেন না, তারাও মন্তব্য জানাবেন।]
_______
[কী লিখেছি, না লিখেছি রি-চেইক দেওয়া হয়ে উঠেনি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪৬
সকাল থেকেই সূর্যের দেখা নেই। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া বইছে। আকাশের আজ মন ভালো নেই। রুক্ষ, শুকনো পাতাগুলো হাওয়ার তালে শুকনো মাটিতে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির সাথে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ছে। সৃজাদের শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িটাতে বসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে ইস্মি। তার খুব মন খারাপ। ইজহানের সাথে বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি তার। বাপের বাড়ি গেলে শান্তিতে দু’টো দিনও থাকতে পারেনি। সকালে গেলে বিকেল বা সন্ধ্যায় গিয়ে নিয়ে আসতো ইজহান। থাকার অনুমতি সে কখনোই দেয়নি। দিবে কীভাবে! বিয়ের পর থেকে বউ ছাড়া রাতে নাকি সে একা ঘরে থাকতে পারে না। যেখানে বউয়ের হাতের রান্না না খেলে, মুখে তুলে খাইয়ে না দিলে, বউ পাশে না বসলে তার গলা দিয়ে খাবারই নামতে চায় না সেখানে গোটা একটা রাত বউকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে সে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে পারবে না। সেইবার যখন অনাগত বাচ্চাটা কোলে না এসেই চলে গেল, ইস্মি সেই বার বাড়িতে থেকেছিল একটানা অনেকদিন। সেটাও সাড়ে তিনবছর আগের কথা! এরপর আর তেমন যাওয়া হয়নি, গেলেও সকাল-সন্ধ্যা থেকে চলে এসেছে। বহুদিন পর শেখ বাড়ির বাইরে কোথাও দিনরাত কাটিয়েছে ইস্মি। যদিও নাইমুর সাহেবের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে আসা হয়েছে, তবে এ ক’টা দিন সেই শোকের মাঝেই কেটে গেছে; এখনো বিষন্নতার রেশ কাটেনি। তবুও নীলু বেগম ইজহানকে জোর করলেন ইস্মিকে নিয়ে সে যাতে কয়েকটা দিন বেড়িয়ে যায়। কিন্তু ইজহান রাজি হলো না৷ নীলু বেগম তাও বললেন, ইস্মিকেই নাহয় রেখে যেতে, কয়েকটা দিন থাকুক। কিন্তু তাতেও আপত্তি ইজহানের৷ অফিসে তার প্রচুর কাজ। কাজ সেরে ঘরে ফিরে বউকে না দেখলে হার্ট-অ্যাটাক নিশ্চিত। নীলু ফুপি, এলিজা সবাই কত ভালোবাসছে, কত আপন করে নিয়েছে ইস্মিকে! ঐ বদ্ধ বাড়িতে থাকার চেয়ে এখানে ক’টা দিন থাকার সুপ্ত ইচ্ছে ছিল ওর মনে। ভয়ে ভয়ে প্রকাশও করেছিল, কিন্তু ইজহান ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়বার আর কথা বাড়ায়নি। বিষন্ন মনেই গোছগাছ করছিল চলে যাওয়ার জন্য।
কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি সংক্রান্ত কার্যকলাপ সেরে বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে দুপুরনাগাদ বাড়ি এসে এলিজা যখন দেখল ওরা চলে যাওয়ার জন্য একপ্রকার তৈরিই হয়ে আছে, বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে ভেবে এলিজার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। ইস্মিকে থাকার জন্য জোর শুরু করল। কিন্তু মালিক যদি থাকার অনুমতি না দেয়, তাহলে ভৃত্য কীভাবে থাকবে? ইস্মি মনমরা হয়ে সেটাই বলল। এলিজা টুকটাক শুনেছে ইজহানের ব্যবহার সম্বন্ধে, ওর পজেসিভনেস সম্পর্কে! ইস্মিই গল্পে গল্পে বলেছে ওকে। আন্দাজ করতে তাই অসুবিধা হলো না ওর। ইস্মিকে বলে কয়ে ও ইজহানকে রাজি করাতে গেল। ইজহান তৈরি হয়ে তখন মিজুর সাথে ফোনে কথা বলছে, এমন সময়ই ঘরের দরজায় টোকা পড়ল।
“ভাইয়া আসব?”
রিনরিনে কণ্ঠস্বরে কেউ অনুমতি চাইলো। ইজহান অত খেয়াল করল না, অনুমতি দিলো। তবে এলিজাকে দেখেই খানিকটা অবাক হয়ে গেল সে। ফোনটা কেটে পকেটে রেখে বলল, “তুমি?”
“জি আমি। আসলে একটা কথা বলতে এসেছি, অনুমতি দিলে বলব।”
এত ফর্মালিটি করে কথা বলে হাঁটুর বয়েসী মেয়েটা, যেন মুরুব্বি! এ পর্যন্ত যতবার কথা হয়েছে, ততবার বেশ গোছগাছ করে কথা বলেছে এলিজা ওর সাথে। ইজহান কেন যেন ওর সামনে অপ্রস্তুতবোধ করে খুব৷ কথা না বাড়িয়ে মাথা নেড়ে অনুমতি দিয়ে বসতে বলল সে এলিজাকে। সোফার একপাশে বসে এলিজা প্রসন্ন কণ্ঠে বলল, “আমাদের বাসাটা আপনাদের বাড়ির মতো এতো বড় নয় জানি, কিন্তু এমনও নয় যে, খুব খারাপ। বরং থাকার মতো যথেষ্ট জায়গা আছে। তবুও জিজ্ঞেস করছি, আমাদের এই ছোট্ট বাসাটা কি ভালো লাগছে না আপনার?”
ইজহান রীতিমতো এ কথা শুনে ভড়কে গেল, “মানে? না, ভালো লাগছে। কিন্তু হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
“তাহলে আপনি ইস্মিতা ভাবিকে নিয়ে চলে যেতে চাইছেন কেন? থেকে যান না কয়েকটা দিন।”
আবদার শুনে ইজহানের চোখ কপালে, “এতদিন অফিস কামাই হয়েছে, প্রচুর কাজ জমেছে, থাকা পসিবল না।”
“ইস্মিতা ভাবিও কী অফিস করে?”
“না তো, ও বাড়িতেই থাকে।”
“তাহলে তো ভাবি একা একাই বাড়িতে বসে থাকবে, আপুও তো এখন ও বাড়ি যাবে না। আরো কয়েকটা দিন থাকবে। একা বাড়িতে বসে বোর হওয়ার চেয়ে আমাদের এখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাক, ভালো না? কথা দিচ্ছি, ফুপি, আমি আপুর মতো ভাবিকেও দেখে রাখব। আপনিও না-হয় অফিস সেরে এখানে চলে আসবেন! আমাদের বাসাটা সবসময় খালিই পড়ে থাকে, আম্মু থাকাকালীন মেহমান আসতো, আব্বুর কলিগরাও আসতো।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিজা, “বহুবছর ধরে আমাদের বাসায় কেউ আসে না, মেহমান, আত্মীয়স্বজন কেউই না। তেমন কেউ নেইও। এখন যেহেতু আপনারা আছেন, এসেছেন, তাহলে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যান ভাইয়া। আমাদের ভালো লাগবে। প্লিজজ! আপনি না চাইলে আমি জোর করতে পারব না, তবে ছোটো বোন আবদার করেছে বলে যদি ভেবে থাকেন, তাহলে অবশ্যই আপনার এই আবদারটা রক্ষা করা উচিৎ।”
কঠিন স্বরে ইমোশনাল ড্যামেজ! ইজহান কী বলবে ভেবে পেল না। বিষণ্ণ গলায় বলল, “রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল…”
“কাইন্ড আ…”
“তোমার মধ্যে টিচার টিচার ভাব আছে।”
“আম্মুও তো টিচার ছিল, খবরদারি তার কাছ থেকেই শিখেছিলাম। এখন অবশ্য অতো খবরদারি করি না, দেখাইও না…”
“তখন তুমি খুব ছোট।”
“হ্যাঁ, বেশিদিন পাইনি আম্মুকে।”
“আমরাও পাইনি মা’কে…”
মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো ইজহানের। মায়া লাগলো হঠাৎ। আহারে! এতো মিষ্টি একটা মেয়ে, মাকে কাছে পায়নি। সে নিজেও পায়নি। দুঃখগুলো কী এক! তারা ভাইয়েরা যেমন মাকে পায়নি, তেমনি এই বোনেরাও। অবশ্য এই বোনেরা আরো দুঃখী। বাবাও নেই ওদের। তাদের অবশ্য বাবা আছে। ভালো, খারাপ যেটাই হোক না কেন! এখনো আছে, দাপটেই আছে। আচ্ছা, এই দুঃখী মেয়েটার আবদারটা কি রাখা উচিৎ? ভাবনার মাঝেই এলিজার গলা ভেসে এলো,
“কী?”
প্রশ্ন শুনেই সম্বিৎ ফিরলো ইজহানের। এলিজাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখেই মনে পড়লো কী বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে সে। ইজহান দ্রুত কথা কাটানোর চেষ্টা করল, “থাকব, থাকব।”
“কে বলে ভাইয়া আর আপনি আলাদা, দু’জনেই এক। কী আশ্চর্য!”
বলে এলিজা মিষ্টি করে হাসলো, এরপর বিদায় নিয়ে চলে গেল। ভেড়ার এই ইঁচড়েপাকা শালি কোন প্রেক্ষিতে বলল এ কথাটা? ইজহান বোকার মতো তাকিয়ে থেকে মানে খুঁজে না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে ইস্মিকে ডেকে সে যখন থেকে যাওয়ার কথাটা বলল, মেয়েটা বড়োই আশ্চর্য হয়ে গেল। চোখদুটোতে খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল। ইজহান মুগ্ধ হয়ে বিড়বিড় করে বলল, “তোমার চোখদুটো খুব সুন্দর, একদম মাছের বউ মীনাক্ষীর মতো!”
মীনাক্ষীর সাথে তুলনা দিয়েছে ঠিক আছে, মাঝখানে মাছের বউ বলার কী মানে? ডিকশিনারিতে কি মীনাক্ষীর ব্যাখা এভাবেই দেওয়া? আর এই ভুলভাল ডিকশনারি কী এই লোকের কপালেই জুটেছে? প্রশংসার কী ছিঁড়ি! ইস্মি ছোট ছোট চোখ করে চাইল ইজহানের দিকে, “আপনি দিনদিন অতো ভালো হয়ে যাচ্ছেন কেন বলুন তো, আমার কিন্তু অন্যরকম ব্যাপার আছে বলে মনে হচ্ছে।”
“আছেই তো! ছানাপোনা আসছে, না পটালে যদি তুমি দূরছাই করে ছানাপোনা নিয়েই বসে থাকো, আমার দিকে তো নজর দিবে না জানা কথা।”
এই একটা অভিযোগ! শুরু থেকেই আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে ওর পেছনে। শুনতে শুনতে ক্লান্ত! অবান্তর এই অভিযোগের মেয়াদ কবে ফুরোবে কে জানে! ইস্মি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে এরপর আস্তেধীরে ওর বুকে মাথা রাখল, ‘খুব বেশি নজর দিলে আমার সুদর্শন স্বামীর বদনজর লেগে যায়? তাই বেশিবেশি দিই না।’ ইজহানের কী যে ভালো লাগলো প্রশংসা শুনে! সে গদগদ কণ্ঠে আবদার জুড়ল, “একটা চুমু খাই তোমার ঠোঁটে?”
“না।”
“কেন?”
অসন্তোষ নিয়ে জিজ্ঞেস করল ইজহান। সে খুশি নয় ‘না’ শুনে। তখনি বুক থেকে মাথাটা হালকা উঁচু করে ইস্মি ওর চোখে চোখ রাখল, কিছুটা বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল, “আপনি কোনদিন থেকে অনুমতির ধার ধারছেন, আমি বুঝতেই পারছি না। যাইহোক, কপালে দিন, ওটা বেশি ভালো।”
“কিন্তু আমার তো ঠোঁটে খাওয়ার বাসনা জেগেছে।”
ভাবলেশহীন ভাবে কথাটা বলে কপালে গভীরভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে এরপর ইস্মিতার ঠোঁটদুটো দখল করে নিলো আগ্রাসীভাবে।
.
একেই তো কয়েকদিন যাবৎ শরীর দুর্বল, তার উপর দুনিয়ার সব প্রেগ্ন্যাসি উপসর্গ, যেগুলো এতমাস যাবৎও প্রকাশ পায়নি। সেসবের যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কোনোকিছু গন্ধ নিতে পারছে না, খাবার খেতে পারছে না। বমি করে অবস্থা কাহিল সৃজার। তারমধ্যে সন্ধ্যা নাগাদ বাথরুমে গিয়ে বেখেয়ালে পিছলে পড়ে হাতে-পায়ে বেশ চোট লেগেছে। পেটেও বেশ ব্যথা করছে। হসপিটালে চেকআপ করে সব ঠিকঠাক আছে জেনে আসার পরেও ওর মন থেকে ভয় দূর হয়নি। কান্নাকাটি করে অবস্থা খারাপ করে ফেলছে। ইহসানের এতো অসহায়বোধ আর কখনো হয়নি। একের পর এক বিপদ লেগেই আছে। কোথায় মেয়েটা একটু স্থির করেছিল মনটাকে, চেয়েছিল আজ ডিনারে একটু ভালোমন্দ রান্না করবে ইস্মিদের জন্য; তারমধ্যে এই বিপদ। তার নিজেরও যে অস্থির লাগছে না তা নয়, এখনো বুক কাঁপছে। যদি কিছু হয়ে যেতো? সে কী করতো? বোধহয় পাগল হয়ে যেতো। ইহসান সৃজাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। চুলে ঠোঁট ছোঁয়ায়। অস্থিরতা গোপন করে সে সান্ত্বনা দেয়, “কিচ্ছু হয়নি সৃজা, ইলিয়ানা ম্যাম বলেছে সব ঠিক আছে। ওরা ঠিক আছে। তবুও কাঁদিস কেন!”
“কেন এমন হচ্ছে বলো তো? কী দোষ করেছি আমি, আমার বাচ্চারা? আচ্ছা, তোমার থেকে লুকিয়েছিলাম এজন্য এমন হচ্ছে? তুমি কি মাফ করোনি আমায়?”
সৃজা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ওর৷ ইহসান ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। দু’হাতে চোখ মুছিয়ে দিয়ে অপরাধে জর্জরিত কণ্ঠে বলে, “ওসব কথা অন্যায্য। অন্যায়, ভুল যা সব আমি করেছি! তোর গায়ে হাত উঠিয়েছি। এসবের শাস্তিই পাচ্ছি। আমাকে মাফ কর সৃজা, আমি দোষী, নিকৃষ্ট লোক…”
“না তবুও! আমার উচিৎই ছিল না এমনটা করার। কিন্তু তখন তোমার উপর এতো রাগ হচ্ছিলো আমি কিছু ভাবিনি। জেদের বশে…”
মাঝপথে ইহসান ওকে থামিয়ে দেয়। হাতদুটো একত্র করে মাফ চাওয়ার জন্য তুলে ধরে, “তোর রাগ ন্যায্য এতটুকুই আমি বলব, আরকিছু না। বলার মুখ আমি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু একটু কৃপা কর আমায়!”
চোখেমুখে অস্বাভাবিক অসহায়তা। কণ্ঠ দুর্বল। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসে চোখদুটো ইহসানকে এমন করতে দেখে। সৃজা ওর হাতদুটো ধরে ফেলে মাথা ঠেকায়, “এমন করো না। প্লিজ…”
ইহসান শোনে ওর কথা। হাতদুটো সরিয়ে নেয় ওর মাথায় রাখে। আলতো করে হাসে, স্বস্তি ঠিক নেই তবুও দেখানোর চেষ্টা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য দুঃখগুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখে বলে, “আচ্ছা, ওসব বাদ৷ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া সব ঠিক আছে। কিন্তু রিপোর্টে কী উঠেছে সৃজা? আমার মণ্ডামিঠাই দু’জন এতমাস যাবৎ ঘাপটি মেরে বসে আছে! অথচ টের পেলাম না, এটা কী জাদু?”
এ পর্যায়ে কান্নাভেজা স্বরেও সৃজা হেসে ফেলে, “আমি নিজেও তো টের পাইনি। প্রথমবার টেস্ট করার পরই তো জানলাম ইস্মি ভাবির চেয়েও দু-সপ্তাহ এগিয়ে ওরা। ভাবি তো খুব হাসছিলো তখন, যদিও জানতো না এরা টুইন…”
ইহসানের বুকটা কেমন দ্রিমদ্রিম করে বাজতে থাকে। বাবা হবার মতো আনন্দটা এমন অসহ্যকর সুন্দর কেন? এই সুখটা অসুখের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ওর সর্ব দেহে! অথচ মরতে একটুও দ্বিধাবোধ, ভয় কাজ করছে না তার। ইহসান সৃজার চোখের পাতায় সময় নিয়ে চুমু খায়, নিচু কণ্ঠে কানে কানে বলে, “এতবড় উপহারের বিনিময়ে কী চাস? যা চাইবি তাই দেব। শুধু একবার মুখফুটে বলবি, সব তোর পায়ের কাছে এনে রেখে দেব। চাইলে আমার মুণ্ডুটাও। বল তো, বলে ফেল আমার মণ্ডামিঠাইয়ের আম্মা।”
“মণ্ডামিঠাইয়ের আব্বার ভালোবাসা।”
বলতে মোটেও সময় নেয় না সৃজা। ইহসান জবাব শুনে হেসে ফেলে। নাকে নাক ঠেকিয়ে বলে, “চাইতে হবে না, ওটা অলিখিতভাবে তোমার। সেই কবে থেকেই প্রতিই দায়বদ্ধ। অবশ্য দায়বদ্ধ বললেও ভুল হবে। ওটা এমনিই তোমার। ইহসান শেখ পুরোটাই তোমার জান। এবার তার সাথে কী হবে, না হবে সবটাই তোমার ইচ্ছে মোতাবেক।”
নির্মলা এক ঠান্ডা বাতাস, মেঘ ভিজে যাওয়া প্রকৃতির আকাশে শুক্লা দ্বাদশী চাঁদ আর চুকেবুকে যাওয়া অভিমান, সবটাই কেমন অদ্ভুত সুন্দর! সৃজা নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখে তার মানুষটাকে, প্রেমানুভূতিতে মরে যায় সে কেমন করে যেন! ইহসান হাসে, হাসিতেও তার মরতে ইচ্ছে করে! ইহসান ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে, “এভাবে কী
দেখছেন মণ্ডামিঠাইয়ের আম্মা?”
সৃজা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে, “দেখছি একটা লোক, যাকে কয়মাস আগেও বড়ভাইয়ের নজরে দেখতাম। সে কীভাবে আমার এতো আপন হয়ে গেল!”
“আসলেই তো! বড় ভাইয়ের নজরে দেখা এই ইহসান শেখ কীভাবে এতো আপন হয়ে গেল যে, আপনার পেটে দু দুটো বাচ্চা দিয়ে দিলো!”
বিস্মিত হবার ভান করে ইহসান, ঠোঁটে অভদ্র হাসি, চোখে দুষ্টু ইঙ্গিত। ঘোর কাটতেই লজ্জায় সৃজার গা শিউরে উঠে। পেটের ভেতর হাজারো প্রজাপতি উড়ে। রক্তিম মুখে হুট করে চলে আসা হাসি লুকিয়ে নাকমুখ কুঁচকে অন্যদিকে তাকায়, “ছিহ।”
“আমি একটা ফুটবল টিম বানাব ভেবেছিলাম, কিন্তু আপনার যা কন্ডিশন দেখছি জান…আর কখনো বাপ হওয়ার নাম নেব না। এই ক’টা মাস ধৈর্য ধরে শুধু আপনার পেটে আমার বাচ্চাদের একটু বড় হওয়ার জায়গা দিন, ওদের লাথিগুলো সহ্য করুন আর নিজের খেয়াল রাখুন। বিনিময়ে ওদের আব্বা আপনার দাস হয়ে থাকবে।”
ফিসফিস করে নরম, ঠান্ডা এবং বিগলিত স্বরে বলে উঠে ইহসান৷ সৃজা ওর বুকে আছড়ে পড়ে লজ্জিত মুখটা লুকায়। ওর আরক্ত অবস্থা দেখে ইহসান হেসে ফেলে। হৃদয়ে তার প্রশান্তির শীতকাল শুরু হয়। তুষার ঝড়ে তোলপাড় চালায় তার ভেতরে। কেঁপে উঠে বুকটা। সৃজা টের পায় তা, সে বুকের বা পাশে হাত রাখে খুব যতনে। ইহসানের মরে যেতে ইচ্ছে হয়! কেন হবে না? যার পানে তাকিয়ে একটা গোটা একটা পৃথিবীর ভার হালকা মনে হয়, যার স্পর্শ গোটা শরীর-মনকে আন্দোলিত করে দেয়, যার নিষ্পাপ মুখখানির অসহায়ত্ব বুকে লাগে, খুব গোপনে মায়া তো তার জন্যই চলে আসে। যদিও লোকে বলে মায়া খুব তুচ্ছ জিনিস, খুব বেশিদিন টেকে না। উল্টেপাল্টে ভালোবাসা নামক এক বিধ্বংসী অনুভূতিতে রুপান্তর করে ফেলে। তবুও ইহসানের আজকাল মনে হয়, মায়া আর ভালোবাসা দুটো আলাদা অনুভূতি। সে সৃজাকে যতোটা ভালোবাসে, ঠিক ততোটাই মায়া করে। আর ভালোবাসা কেটে গেলেও এই মায়া সে কোনোদিন কাটাতে পারবে না, কোনোদিন না। সে শুধু বলে,
“ভালোবাসি আপনাকে।”
সৃজা হঠাৎ বলে উঠে, “আপনি আজ্ঞে করছ কেন?”
“করব না?”
“না।”
“যথাআজ্ঞা মহারাণী।”
“ইশ! বাচ্চার বাপ হয়ে যাচ্ছে অথচ দেখো কী আচরণ! নাটকে ওস্তাদ আর কোনোদিকে নজর নেই।”
“নজর তো দিয়েই যাচ্ছি, বড্ড লোভ হচ্ছে। মহারাণীকে কি আদরই করব এ অবস্থায়ও? বহুদিন তো আদর-ভালোবাসা হয়নি! আসব কাছে? একটু স্ল্যাং শোনার পিপাসা পাচ্ছে!”
ফিসফিস করে বলে ইহসান। লজ্জায় হতভম্ব সৃজা পরপরই কানচাপা দেয়। বিড়বিড় করে বলে, “একটা বেহায়া লোকের ঘর করছি আমি!”
[মন্তব্য জানাবেন সবাই।]
______
[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪৭
সৃজাদের চারতলা বাড়িটার বয়স দেড় যুগের কাছাকাছি। সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক, কিন্তু বাইরের দেয়ালে ঘষা সাদা রঙটা চটে মলিন হলুদাভ বর্ণের হয়ে গেছে। সেইসাথে৷ কিছু কিছু জায়গায় পলেস্তারাও খসে গেছে। শ্যাওলাপড়া পিচ্ছিল অংশগুলোতে জন্মেছে আগাছা আর ফার্ন। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ, বর্ষার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ বা শীতের রুক্ষ দিন! অথচ বিবর্ণ এই বাড়িটা ছিলো বলেই মাথার উপর কখনো ছাদের অভাববোধ করেনি কখনো নাইমুর সাহেবের মেয়েরা। বাবা-মায়ের জমানো সম্বলে তৈরি এই বাড়িটা তাই ওদের খুব আপন। তবে বাড়িটা রাস্তার পাশে হওয়ায় বসার ঘরের বড় বারান্দাটা থেকে নিচ দিয়ে মানুষের চলাচল দেখা যায়। ওপাশে একটা বালুর বড় মাঠ, বিকাল হলে সেখানে ছেলেপুলেরা খেলাধুলা করে, সেটাও দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ সময় যখন কেউ থাকে না, পরিবেশ নীরব থাকে, বিকেল বা সন্ধ্যায় এখানে বসে চা খায় সৃজা-এলিজা। এগুলো সবই গল্পে গল্পে এলিজার কাছ থেকে শুনেছে ইস্মি।
সে এখন বসে আছে বারান্দায়। বাজে সকাল দশটা। ইজহান একটু পর অফিসে বেরুবে, ফর্মাল পোশাক পরে তৈরি সে। এখন এসেছে চুপিচুপি বউ থেকে একটু আদর নিতে। কিন্তু ইস্মির নজর তার দিকে নেই। সে তাকিয়ে আছে আকাশে-বাতাসে, রাস্তায়, ফুলের টবে। কয়টা গোলাপ এসেছে, গাঁদার কয়টা কলি ফুটেছে, ক্যাকটাস কতটুকু লম্বা হয়েছে তার দৈর্ঘ্য মাপা নিয়ে। বেশ উৎসুক দেখাচ্ছে ওকে এসবে। ইজহানের যদিও ভেতরে ভেতরে রাগ লাগছে তবুও সে কাতর চোখে চুপচাপ বসে কাহিনী দেখছে। বাড়ি হলে এতক্ষণে এক লাথিতে সবগুলো টব ভেঙ্গে দিতো, ফুলগাছগুলো মেরে দিতো। কিন্তু ভেড়ার শ্বশুরবাড়িতে এসে এমন সিন ক্রিয়েট করলে সেটা নিশ্চয় ভালো দেখাবে না, ভেবে সে চুপ আছে। কিন্তু কতক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারবে নিশ্চয়তা নেই। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সে হাত মুচড়াল কয়েকবার। পায়ে পা ঘষলো। টাই ঢিলে করলো একটানে। গোছানো চুলগুলো একহাতে ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিলো। অগোছালো চুল, লালচে মুখ আর মুখ অন্ধকার করে রাগ সামলাতে থাকা ইজহান ইস্মিকে ডাকলো ছোট্ট স্বরে, “ঔষধ খেয়েছ এখন একটু বিশ্রাম নিলে চলে না? এখানে বসে না থেকে ঘরে চলো।”
ইস্মি হেসে অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিলো, “যাব। এখানে একটু বসি। হাওয়াটা ভালো লাগছে। আর এই ফুলগুলো দেখুন, কী সুন্দর! আমাদের বারান্দায়ও এমন গাছ লাগাব।”
“প্রশ্নই উঠে না।”
বিড়বিড় করে বলল ইজহান। ইস্মি বুঝতে না পেরে ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সে কী বলেছে, কিন্তু ইজহান আলগা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বুঝালো সে কিছু বলেনি। ইস্মি মাথা নেড়ে আবারো গাঁদা ফুল ডাল কেটে লাগালেই বা পাপড়ি থেকেই কীভাবে গাছ বা কলম তৈরি করা যায় সেসব নিয়ে কথা বলতে লাগলো। মাঝখানে এলিজা এসে ওকে একমগ গরম দুধ দিয়ে গেল। ইস্মির খেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু পাগল সামনে বসে আছে তাই সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে চুমুক বসালো মগে।
তারমধ্যেই হাঁক ছাড়তে ছাড়তে এক ফেরিওয়ালা আচার বিক্রি করছে, বরাবর নিচে রাস্তার বৈদ্যুতিক খুঁটির ওখানে দাঁড়িয়ে। তরুণ থেকে বাচ্চা, সবাই এসে ভিড় জমিয়েছে ওখানে আচার কিনতে। ইস্মি হাতের মগটা একপাশে রেখে চমকিত চোখে তাকাল। ছোটবেলায় কত খেয়েছে ফেরিওয়ালা থেকে আচার কিনে! পাঁচ টাকা, দশ টাকার আচার অথচ কী অমৃত স্বাদ! এখনো মুখে লেগে আছে। ইস্মির জিভে একপ্রকার জলই চলে এলো। কিন্তু ইজহানকে বললে কী সে এনে দেবে? যা নাক সিঁটকানো স্বভাব!
কিন্তু তারপরও বলে দেখা যাক! সে অসহায় চোখে ইজহানের দিকে তাকাল, “আচার খেতে ইচ্ছে করছে, শুনছেন?”
বউয়ের অবহেলা পেয়ে ততক্ষণ ফোনে মন দিয়েছিল ইজহান। এবারে সে চোখ তুলে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কী! ইস্মি আগের মতোই ভীতি লুকিয়ে বলল, তার আচার খেতে ইচ্ছে করছে! ইজহানের চোখ কপালে উঠল।এখন আচার কোথা থেকে এনে দেবে সে? এ বাড়িতে কী আচার আছে? অবশ্য থাকতেই পারে। এলিজা বসার ঘরের অ্যাকুরিয়াম পরিষ্কার করছিল, ইজহান ওকে জিজ্ঞেস করল। বাসায় হাতে বানানো আচার ছিল, এলিজা সেটা এনে দিলো। কিন্তু ইস্মি সেটা একটু খেয়ে এরপর আমতা-আমতা করে জানাল সে বাইরের আচার খাবে। নিচে ঐ ফেরিঅলা দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে এনে দিলেই হবে। ওর কথা শুনে ইজহান ভ্রু কুঁচকে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই দেখল মাঝবয়েসী কালো মতোন এক লোক। লুঙ্গি পরণে, গায়ে ময়লা ফতুয়া, মাথায় গামছা বাঁধা। কন্টেইনারে করে কীসব হাবিজাবি যেন বিক্রি করছে। উপর দিয়ে মশা-মাছি উড়ছে। কতগুলো বাচ্চা সেসব কিনছে। দেখেই গা গুলিয়ে উঠল ইজহানের। ছিহ! এসব নোংরা, দেখতে কদাকার কালচে ফলের পেস্টকে ইস্মি নাম দিয়েছে ‘আচার?’ আবার খেতেও চাইছে? মানে খাওয়ার মতো আরকিছু পেল না তার বউ? অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে বাইরে মাথায় করে বিক্রি করা ভংচং খেতে? সে তেঁতিয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। ইস্মি ভড়কে গেল। ইজহান নাকমুখ কুঁচকে বারণ করে দিলো সে এসব এনে দিতে পারবে না, আর ইস্মিকেও খেতে দেবে না। দরকার পড়লে মিজুকে দিয়ে বাড়ি থেকে বানানো আচারের বয়াম নিয়ে আসবে, তাও এসব সে খেতে দেবে না, কভু না! ইস্মি তবুও গো ধরে আবদার করে বসলো, কিন্তু ইজহান ‘না’ তো ‘না’ তেই অটল রয়ে গেল। তার ভাষ্যমতে, এই গরিব-ফকিন্নি গোছের নোংরা লোকটার হাত দেখেই তার এতদূর থেকে বমি আসছে, আর তার হাতে বানানো আচার সে ইস্মিকে খাওয়াবে? মরে গেলেও না। সে কতক্ষণ নিজেই বমি বমি ভাব করে রাগে গজগজ করতে লাগলো। দু’বার লোকটাকে উপর থেকে ডেকে বললও এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে, দূরে গিয়ে বিক্রি করতে। কিন্তু লোকটা তো ওর কথায় পাত্তা দিলোই না, ভান ধরে ওখানে দাঁড়িয়েই বিক্রি করতে লাগল।
এবং কাস্টোমার বিদায় করার পরও লোকটা খুঁটির ওখানে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইস্মিও গো ধরে ওকে রাজি করাতেই চাইছিল, কিন্তু কিছুতেই টলাতে পারছিল না বলে এবং ইজহানকে বারবার নাক সিঁটকাতে দেখে সে রাগে-ক্ষোভে দুটো কথা শুনিয়ে অহংকারী লোক বলেছিল, ব্যস! বারান্দায় রাখা এলিজার শখের সাদা গোলাপ গাছের টবটা তুলে নিচে আচার বিক্রি করা ফেরিঅলা লোকটাকে লক্ষ্য করে নিচে ছুঁড়ে মারলো ইজহান। কারণ সেই অনেকক্ষণ যাবৎ সে লক্ষ্য করছিল—ফেরিঅলার বেশ ধরে থাকা লোকটার উদ্দেশ্য ভালো না। হাঁক ছাড়ার বাহানায় একটু পরপরই সে এদিকে তাকাচ্ছিল আর চুল ঠিক করছিল, জিভ দিয়ে ঠোঁটও ভিজিয়েছে কয়েকবার। ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি, নোংরা চাহনি। বউয়ের জ্বালাতন সহ্য করতে করতে ইজহান সবই লক্ষ্য করছিল আর তড়তড় করে মাথায় রক্ত উঠছিল এতক্ষণ।
তবে টব পড়ার পর একটুর জন্য সরে গিয়ে লোকটা বেঁচে গিয়ে দ্রুত কেটে পড়লেও ইস্মি তার পরম, পতিমেশ্বর স্বামীর এই রুপ হজম করতে পারল না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে এরপর কঠোর স্বরে প্রশ্ন করল, “এটা কেন করলেন?”
ফিরে তাকাল ইজহান৷ দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলো, “ইচ্ছে হয়েছে তাই।”
“আমি খেতে চেয়েছি, জোর করেছি। দেননি, তবুও মেনে নিতাম। কিন্তু এতে লোকটার কী দোষ? বেচারা গরিব মানুষ, কর্ম করে খায়। মাথায় পড়লে বাঁচতো?”
এবারে ইজহানের নজর তীক্ষ্ণ হলো। ঐ বদমাইশটার পক্ষ নিচ্ছে তার বউ? যে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিল এতক্ষণ ওকে! অথচ সে কখন থেকে এখানে বসে আছে এলোমেলো হয়ে, রাগ নিয়ে। ইস্মিতা দেখল তো না-ই, বরং ঐ চোখ দিয়ে মেয়েমানুষ গিলে ফেলা লুচ্চার জন্য মায়া দেখাচ্ছে! মাথাটা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট! সে রাগান্বিত গলায় বলল,
“খুব দরদ না?”
কথার ধরণটা বড্ড আপত্তিকর, ইস্মির ঘৃণা হলো, “ছিহ, আপনি একটুও বদলাননি।”
“বদলাব না। বদলালে কি হবে, তোর জন্য সুবিধা হবে, পরপুরুষের সামনে যেতে পারবি ইচ্ছেমতো, লোকে তাকিয়ে থাকবে তোর সুন্দর চেহারার দিকে, শরীরের দিকে। আর আমি তো বোকা, বলদ স্বামী! তোর আঁচল ধরে ধরে ঘুরব আর অন্যদের সামনে উপস্থাপন করব, এসবই তো চাস তুই! এসবই তো তোর মতে নারী স্বাধীনতা! বেয়াদব!”
ইস্মি কঠিন গলায় বলল, “আমি আপনার স্ত্রী, আপনার বাচ্চার মা।”
“সেটাই, ভুলে যাবি না। আমি থাকতে অন্যদের জন্য দরদ দেখাবি না।”
“আমি কাকে দরদ দেখিয়েছি?”
“এক্ষুনি দেখালি, ঐ বদমাশ ফকিন্নির পুত মোটেও বেচারা নয়, এতক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তোকে…নোংরা চোখে। মেয়েরা নাকি দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝে কে তার দিলে তাকিয়ে আছে, নজর দিয়েছে! অথচ বুঝিসনি তুই? কি দেখেও না দেখার ভান করছিস…”
ঝাঁঝালো, উচ্চস্বর ওর। নোংরা চোখে ওকে দেখছিল লোকটা সেটা ও কী-বা জানবে যে ইজহান ওকে এভাবে বলছে? ইস্মি হতভম্ব হয়ে গেল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিচু স্বরে বলল, “এটা আপনার বাড়ি নয়,
তাই বুঝেশুনে কথা বলুন।”
“বলব না আমি বুঝেশুনে কথা…”
বেপরায়া হয়ে উঠল রাগের বশে ইজহান। কণ্ঠস্বর বাঁধনহারা হলো। এদিকে চেঁচামেচি শুনে এলিজা-নীলু বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো, কিন্তু তারা ইজহানের এই রুপ দেখে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে! কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। আর এভাবে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না করে অসভ্য ব্যবহার করায় অপমানে ইস্মির গা জ্বলছিলো, কোনো ভাবেই আটকাতে পারছিল না চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে আসা জল। রাগ-বিস্ময় আর ক্ষোভে কান্নারা গলাটাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছিল বারবার। এলিজা আর নীলু ফুপিকে দেখে লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে যেয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল একসময়। এলিজা ইতস্তত করলেও এবারে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, ইজহানকে পেরিয়েই বারান্দায় গেল এবং ইস্মিকে গিয়ে হাত ধরে ভেতরর ঘরে নিয়ে গেল। আর নীলু বেগম ভয়ে ভয়ে একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এলো ইজহানের জন্য, গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “পানিটা খাও বাবা।”
ইজহান পানির গ্লাস নিলো ঠিক, কিন্তু হাতে নিয়ে বসেই রইল। রাগে এখনো তার গা কাঁপছে, হাতদুটোও!
.
নির্ঘুম রাত কেটেছে সৃজা আর ইহসানের। একফোঁটা ঘুমও হয়নি ওদের। কারণটা অবশ্য সৃজা। এই মেয়ে প্রেগ্ন্যাসির মতো কঠিন সময় পার করছে, রাতে ঘুম না আসাও এরই একটা যন্ত্রণাময় লক্ষ্মণ। রাতে কেঁদেছেও সৃজা এরজন্য। ইহসান যদিও সান্ত্বনা দিয়েছে, তাতে কী? চোখে ঘুম নিয়েও ঘুমাতে না পারা যে কতটা অস্বস্তিকর সেটা কী এসব নিষ্ঠুর পুরুষজাত বুঝবে? অভিযোগে অভিযোগে ইহসানের আত্মা জর্জরিত করে সকাল হওয়ার পর ঘুমিয়েছে সৃজা, ওকে ঘুম পাড়িয়ে হাফ ছেড়ে বালিশে মাথা ছুঁইয়েছে ইহসানও। কিন্তু বসার ঘর থেকে চেঁচামেচি শুনে সেই ঘুমও ভেঙেছে দু’জনেরই। ঘুমঘুম চোখে উদোম গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জিটা কোনোমতে চাপিয়ে বেরিয়ে এসে দেখল তার ভাই এটাকে নিজের বাড়ি মনে করে তার নিরীহ বউয়ের উপর চোটপাট করছে! ব্যস! সকাল সকাল আরো একপ্রস্ত ঝগড়া-মারপিট হয়ে গেল দু’জনের, মুখ দেখাদেখিও হলো বন্ধ! ইজহান সিদ্ধান্ত নিলো আর এক মুহূর্ত ভেড়ার শ্বশুরবাড়ি থাকবে না, এক্ষুনি বাড়ি চলে যাবে। স্বামীর এমন অ-আকাঙ্খিত আচরণে ক্রন্দনরত ইস্মিকে গিয়ে আদেশের সুরে বলল তৈরি হতে। কিন্তু বাঁধ সাধলো ইহসান। সে কিছুতেই যেতে দিতে রাজি হলো না ইস্মিকে। তেমনি সৃজাও বলল, রাগারাগি আর ঝগড়া করে ইস্মিকে নিয়ে যেতে দিবে না ও। ইস্মিও গোঁ ধরে বসে রইল এই অবুঝ, অভদ্র লোকের সাথে সে কোথাও যাবে না। ফলে, বউয়ের কাণ্ডে হতবিহ্বল ইজহান অগোছালো চুল, এলোমেলো, টপ বোতাম ছেঁড়া শার্ট গায়ে চাপিয়ে সেভাবেই বেরিয়ে গেল। বলে গেল, এখানে সে আর কখনো আসবে না। ইহসানও বলল ওকে দেখলে ঠ্যাং ভেঙ্গে রেখে দেবে। দু-ভাইয়ের কাণ্ডে তখন এলিজা-নীলু ফুপি চরম বিস্মিত, বিব্রত! এদিকে
সৃজা ইহসানকে ঘরে নিয়ে গিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, “তুমি ভাইয়াকে আসতে বারণ করে দিলে কেন? এভাবে বেরিয়ে গেল, কী ভাববে!”
“যা খুশি তাই ভাবুক। আর ভাববেই বা কী? ভাববার মতো ঘিলু আছে নাকি! কুত্তাটার স্বভাব আমার ভালোই জানা আছে।”
“এই তুমি মুখ সামলে কথা বলো, কুত্তা কাকে বলো? তোমার ভাই হয় সে। আরেকবার যদি ওসব বলতে শুনি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
“তুই এমন করছিস কেন?”
“কেন করব না? মেহমান আমাদের, খারাপ লাগছে আমার, মানুষটা এভাবে রাগ করে বেরিয়ে গেল!”
“হয়েছে! আর মেহমান বলে সম্মান দেখাতে হবে না। ও পরিবেশ বুঝে? বুঝলে এমন করতো?”
একথা শুনে সৃজা মেজাজ খারাপ করে বলল,
“ভাইয়ার মাথা গরম জানি, একটু ওভার পজেসিভ! লোকটা ওভাবে ভাবির দিকে তাকিয়ে ছিলো বলেই তো রেগে গেল। তুমি হলে রাগতে না?”
এ পর্যায়ে ইহসান আমতাআমতা করে উঠল, “তুই বেশিই ভাবছিস…”
“তুমি কথা বলবে না আমার সাথে।”
সৃজা রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে ইস্মির ঘরে চলে গেল। ইহসান মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল সোফায়। এমনিতেই রাতে ঘুমাতে পারেনি, মেজাজ চরমে, তার উপর দুনিয়ার নাটক! ভেবেছিল সৃজাটাকে নিয়ে একটা গাঢ় ঘুম দেবে, কিন্তু হলো কী? এই মেয়ে ওর উপরই চোটপাট করে বেরিয়ে গেল। ইচ্ছে করছে কপাল ঠুকতে দেয়ালে। রাগে-বিরক্তিতে গা ম্যাজমেজ করছে ওর। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা একটানে খুলে সে উপুড় হয়ে পড়ে রইল বিছানায়। কিছুক্ষণ পর উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকলো সৃজাকে। পাত্তা দিলো না ওর ডাকে মেয়েটা। ধৈর্য হারিয়ে ডাকতে থাকলোই সে। অনেকবার ডাকার পর বিরক্ত হয়ে ঘরে এলো সৃজা। ঢুকতেই ইহসান ওকে টেনে এনে দরজা আটকে উদোম গায়েই চেপে ধরল সৃজাকে। কোলে তুলতেই চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা, “পাগল হয়েছ তুমি? এমন করছ কেন? ছাড়ো…তোমার সাথে আমার কথা নেই।”
“আমার আছে।”
“শুনতে ইচ্ছুক নই।”
ইহসান ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখলো জোর করে, “কিন্তু আমি বলতে ইচ্ছুক।”
“শুনব না।”
“শুনবে।”
“নাটক কম করো।”
“সিনেমা করব তাহলে? রোমান্টিক?”
“কিছুই করতে হবে না। ঘাসে মুখ দিয়ে থাকো।”
“ঘাসে মুখ দিয়ে আছি বলেই তো সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে ঘরজামাই হয়ে থাকছি, বউয়ের কাছাকাছি থাকতে চাইছি।”
সৃজা ওর চুল টেনে দিলো দু’হাতে। বুকে কিল-ঘুষি দিলো অনেকগুলো। বড় বড় নখ বসিয়ে দিলো পিঠে। ইহসান প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে যেন কিছুই হয়নি ওমন ভান ধরে বলল, “যা খুশি তাই করো জান। আটঘন্টা মাস্ট ঘুমাতে হবে তোমার। ছাড়াছাড়ি নেই, কোনো কথা শুনব না।”
সৃজা ওর সাথে গায়ের জোরে না পেরে বলল, “আগে ভাইয়াকে ফিরিয়ে আনো। তারপর বাকিসব।”
ইহসান হাই তুলতে তুলতে বলল, “ফিরিয়ে আনতে হবে না। নিজেই ফিরবে।”
সৃজা ওর ভাবলেশহীন অবস্থা দেখে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। ইহসান ভ্রুক্ষেপহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রসঙ্গ বদলাল, “আব্বারা পেটে খেলাধুলা করেছে
তো ভালোভাবে? কষ্ট হয়নি তো আপনার?”
“কষ্ট হলেই কী? তুমি ভাগ নেবে?”
“ওদের আম্মাজান দিতে চাইলে অবশ্যই নেবে। কিন্তু সে তো ভাগ দিতেই রাজি না। কিছুই বলে না আমাকে।”
সৃজা রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইল। ইহসান বেশি কথা বাড়াল না, চুপচাপ ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
.
রাত আটটার দিকে দো-তলার ভাড়াটিয়া এসে জানাল, শুকনো কাপড় আনতে গিয়ে তার ছোট মেয়ে ছাদে কাকে একটা দেখেছে, লম্বাচওড়া, শক্ত-সামর্থ্য! স্যুট-টাই পরে অন্ধকারে বসে আছে। জিজ্ঞেস করেছিল তাদের ছোট মেয়েটা, কিন্তু লোকটা কিছুই নাকি বলেনি। ভয় পেয়ে তাই মেয়েটা চলে এসেছে বাইরে দিয়ে গেইট আটকে দিয়ে! এখন মালিকপক্ষ গিয়ে দেখে আসুক ওটা কে, চোর-ডাকাত কিনা!
ইহসান তখন বাসায় নেই, কাকে পাঠাবে নীলু বেগম? এলিজা বলল সে যাবে, দোতলার আন্টি আর তার ছেলেটাকে নিয়েই গেল সে টর্চ আর লাঠি নিয়ে। উদ্দেশ্য চোর হলে এটা দিয়ে মেরে তক্তা বানাবে। সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে, শব্দ না করে গেইট খুলে ছাদে প্রবেশ করে একপাশে খুঁজে কাউকে না পেয়ে অন্যপাশে যেতেই লোকটাকে চোখে পড়ল তাদের! ভয়ে আঁৎকে উঠল দোতলার আন্টি আর তার ছেলে। এলিজা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল৷ আন্টিকে ভরসা দিয়ে অবয়বটার উপর টর্চ ফেলতেই দেখল ওটা আর কেউ নয়, ইজহান! হতভম্ব এলিজা! ফ্ল্যাটে না গিয়ে এখানে এসে বসে আছে কেন ভাইয়া? কখন থেকে? ও বিস্ময় নিয়ে ছুটে গেল আলুথালু বেশে বসে থাকা ইজহানের কাছে। জিজ্ঞেসও করল কারণ—ইজহান শুধু একবার ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। এলিজা অনেক অনুরোধ করল ওকে বাসায় যেতে, কিন্তু ইজহান বলল সে যাবে না। ইস্মিকেই শুধু নিতে এসেছে সে। নিয়ে চলে যাবে।
এলিজা নিচে এসে এই কাহিনী বলল সবাইকে, সৃজা হেসে ফেলল। ইস্মি বহুদিন পর জেদ দেখাল, থাকুক ওখানে বসে। সে কোথাও যাবে না। বাধ্য হয়ে নীলু বেগম গেলেন ইজহানকে নিয়ে আসতে। বুঝিয়েশুনিয়ে নিয়েও এলেন। ইস্মি গিয়ে দরজা আটকে বসে রইল ঘরে। আর ইজহান শক্ত মুখ করে বসে রইল বসার ঘরে, এলিজা ওকে শরবত এনে দিলো। ইজহান কাঁচুমাচু করল, “ইস্মিতা দুপুরে খেয়েছে?”
এলিজা মাথা নাড়ল, “খেয়েছে।”
ইস্মিতা নিজেও জানে, রাগ করে থাকলে ইজহান
খায় না। কিন্তু এখানে এসে ডানা গজিয়েছে, মুখে খই ফুটেছে। তাই দরজা আটকে বসে আছে। বুকে চিনচিনে ব্যথা হলো ইজহানের। বউ খেয়েছে সে খুশি, দুশ্চিন্তামুক্ত! কিন্তু তারপরও তার বুক জ্বলছে। কারণ সে খায়নি!
[আজকের নিরামিষ পর্ব, তবে সামনের পর্বে একটা ছোটোখাটো টুইস্ট আসবে। সবাই মন্তব্য জানাবেন।]
_______
[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…