#অসুখের_নাম_তুমি (পর্ব-১০)
#সোনালী_আহমেদ
জমিলা বেগম ক্ষেপে যান। আজ এই মেয়ের এক ব্যবস্থা না করে দম নিবেন না তিনি। মুখে খই ফুটেছে। বেশ কথা বলা,তাই না? আজ বের করছি কথা বলা। জমিলা বেগম ফুসে ওঠে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন।
রেশমি হাটতে হাটতে পেছনে জমিলার সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘুরে তাকায়। সে বেশ কৌতুহল নিয়ে জমিলার আগা গোড়া স্ক্যান করতে লাগলো। এ মহিলা এত শান্ত-শিষ্ট কীভাবে হলো? নিশ্চয়ই মনে মনে বুদ্ধি আঁটছে। দেখেছো, বয়স হয়েছে তবুও কাটনীতি যায় নি।
রেশমি রুমে ডুকতে দেখলো সত্যি সত্যি সূচনা বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে শরীর টা ভালো নেই।
সূচনার মাথায় হাত দিতেই, সূচনা উপরে মুখ তুলে তাকালো। সাথে সাথে ছিটকে সরিয়ে দিলো রেশমির হাত। সে ভেবেছিলো তার অসুখের কথা শুনে নিশ্চই সৌহার্দ আসবে। কিন্তু এখানে তো রেশমি। এই মেয়ে কেনো এসেছে? কি চায় সে?
রেশমি হতভম্ভ হয়ে সূচনার দিকে তাকালো। মেয়েটা এমন করলো কেনো? গায়ে তো বেশ জ্বর মনে হচ্ছে। হাসিমুখেই তো তাকিয়েছিলো আবার মুহূর্তেই মুখের রং বদলে ফেললো কেনো? মেয়ে টার কি তার উপস্থিতি পছন্দ হয় নি? তাকে কি সহ্য করতে পারে না?
তাছাড়া তার বিশেষ নজরে এসেছে, যতবার ই এ মেয়ের সাথে দেখা হয় তখন কেমন ক্ষোভের নজরে তাকায়। সে কথা বলতে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে স্থান ত্যাগ করে ফেলে। মেয়েটা কি কোনো কারণ বশত তাকে পছন্দ করে না?
—-” আপনি! আপনি এখানে কেনো এসেছেন?”
—” দাদী বললো,আপনার নাকি মাথা ব্যাথা করছে,তাই মাথা টিপে দিতে আসলাম।”
—” নানী বলেছেন এই কথা?”
—” জ্বি।”
রেশমির জবাব তার কানে পৌঁছাতেই, চেঁচিয়ে জমিলাকে ডাকতে লাগলো সে।
—” নানী, নানী, নানী????”
জমিলা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসলেন। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,
—-” হ্যা,হ্যা। কি রে এতবার ডাকছিস কেনো? এ মেয়ে কিছু করেছে নাকি? কি করেছে আমাকে বল।”
—” তুমি নাকি উনাকে আমার মাথা টিপে দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছো?”
—“হু।”
—-“কিন্তু কেনো? তোমাকে আমি কি বলেছি এই মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য?
—” আরে ওকে না বললে তো,,,”
—“কি হবে? মরে যাবো?”
রাগে ফুলে ওঠছে সূচনা। এই মেয়েকে দেখলেই তার রাগ লাগে। তারপরেও দাদী কী বুঝে তাকে নিয়ে এসেছে? সে বুঝতে পারছে না।
তিনি কি বুঝেন না রেশমিকে দেখলে তার খারাপ লাগে। সাথে কষ্ট ও লাগে। বারবার মন বলে ওঠে, এ জায়গা তো তার প্রাপ্য,রেশমির নয়। মনের অজান্তেই হিংসা করে বসে।
জমিলা বেগমের চোখেমুখে বিরক্তির রেশ। এ বোকা মেয়েটা কিচ্ছু বুঝে না। সে তো ওদের আলাদা রাখতেই রেশমিকে নিয়ে এসেছে। অথচ তাকে দেখে কি সুন্দর ওকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে।
তিনি ইশারায় তাকে বারবার বুঝাতে লাগলো। সূচনা অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে বুঝতে সক্ষম হয়েছে। সাথে সাথে চেহারার রং বদলিয়ে সে রেশমিকে বলে,
—” আহ্, যন্ত্রণা বেড়ে গিয়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আ্ আপু একটু মাথা টিপে দেন না।”
রেশমি অবাক হয়ে যায় সূচনার হঠাৎ করে ফেলা আচরণে। এদিকে সূচনা আরো চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। তাই সে আর কোনোকিছু না ভেবে মলম নিয়ে কপালে খানিকক্ষণ ঘষিয়ে হাত দিয়ে টিপতে লাগলো।
রেশমির স্পর্শ সূচনার গায়ে কাটা দিলেও মষ্তিষ্কে এক চরম সুখ দিচ্ছে। রেশমির সাথে যদি দ্বন্দ্ব না থাকতো নিশ্চিত এতক্ষণে তার হাতের জাদুর গুনগান করে ফেলতো। এত আরাম লাগছে যে মুহূর্তেই ব্যাথ্যা ভ্যানিস হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। জমিলা বেগম আয়েশ করে বসে পান খাচ্ছেন। আজ কোনো মতেই এ মেয়ে কে যেতে দেওয়া যাবে না।
ঘন্টা খানেকের মতো সূচনার মাথা টিপে দেওয়ার পরেও সূচনা বলছে না যে আর লাগবে না। এদিকে রেশমির হাত ব্যাথায় কাত হয়ে যাচ্ছিলো। সে কয়েকবার জিজ্ঞেস ও করে নিয়েছিলো যে ‘হয়েছে,হয়েছে?’ সে একটা মানুষ, কোনো যন্ত্র নয় যে ঘন্টার পর ঘন্টা টিপে যাবে।
জবাবে, সূচনা এদিকে ওদিক দেখিয়ে বলেছে,’এখানে দাও- ওখানে দাও।’
হাত আর চলছিলো না বলে রেশমি ওঠে বলে,
—” আপু,আমার হাত ব্যাথ্যা করছে,ঘুম ও আসছে তাই আমি চলে যাচ্ছি। ”
ঠিক তখন ই জমিলা বেগমের পায়ের ব্যাথা দেখা দেয়। তিনি সোজা হয়ে হাত পা পালঙ্গে ছুঁড়তে ছুঁড়তে ‘ব্যাথ্যা ব্যাথ্যা’ বলে আওয়াজ করতে লাগলেন। রেশমি চলেই যাচ্ছিলো কিন্তু বুড়ি তখন ক্রমাগত চেঁচাতে চেঁচাতে বলতে লাগলো,
—‘ ও সজীব,ও সৌহার্দ তোরা কই রে? দাদী পায়ের ব্যাথ্যায় মরে যাচ্ছি রে।’
রেশমির আর যাওয়া হলো না। তৎক্ষণাৎ ফিরে এসে জমিলার পায়ের পাশে বসলো। পায়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে ওঠে, ‘ ঝামেলা বুড়ি,বুড়ো বয়সে ভিমরতি! দাড়াও ছুটাচ্ছি তোমার ব্যাথা।’
রেশমি, জমিলার পায়ে হাত দিতেই একসাথে উপস্থিত হয়, ‘ সজীব আর সৌহার্দ।’
দাদীর চিল্লানোর আওয়াজ কানে যেতেই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। পিছন পিছন সুমিও এসে উপস্থিত হয়। সুমি আর সৌহার্দের চোখে ঘুম আর ঘুম। দুজনে চোখে কানে কিছুই দেখছে না। তবুও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে দাদীর রুমের দিকে উঁকি দিলো সবাই।
জমিলা বেগম তখন পায়ের ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন। কেঁদে কেঁদে পা ব্যাথা বলে চিল্লাচ্ছেন।
—” কি হয়েছে দাদী? চিল্লাইতেছো কি জন্যে?”
—” ওরে,তোরা এসেছিস! আমি মনে হয় আর বাঁচুম না রে। তোরা আমারে মাফ করে দিস, আমি মরলে আমার জন্য মিলাদ পড়াইস।”
সজীব বিরক্তি নিয়ে বলে,
—“আহা,দাদী এসব কি বলছো?”
—-” আমি কি আর এমনি এমনি বলছি? দেখে যা আমার পায়ের অবস্থা। ব্যাথায় টনটন করতেছে, মনে হচ্ছে সাপের কামড়ের দিছে। ও আল্লাহ,তুমি কই! আমারে বাঁচাও। কেউ একটু পা টাও টিপে দেয় না গো। এরা আমাকে মেরে ফেলবে গো!”
রেশমি মুখের করুণ অবস্থা করে ফেললো। হাত নাড়াতে না পারার মতো করে বলে ওঠে,
—” দাদী, আর কোথায় ব্যাথা করছে?এখানে তো দু ঘন্টার মতো দিলাম। অন্য কোথাও কি ব্যাথা করছে?”
জমিলা বেগম টাসকি খেয়ে রেশমির দিকে তাকায়। এ মেয়ে তো একবারো এখন ঠিকমতো হাত দেয় নি আর বলছে দুঘন্টার মতো টিপেছে।
ওদিকে সৌহার্দ বকার সুরে বলে,
—-” উফফ দাদী, রেশমি তো পা টিপেই দিচ্ছে।”
—“মিথ্যা, মিথ্যা! এ মেয়ে একবারও দেয় নাই। ও ভং ধরছে। বিশ্বাস কর,আমি সত্য কইতাছি।”
সুমি তখন এগুতে এগুতে বলে,
—” দাও,দাদী আমি টিপে দেয়।”
সজীবের মাথা বিগড়ে গেলো। সে তখন ধমক দিয়ে বলে ওঠে,
—” এক চড় দিবো যে চোখে কানে কিছু দেখবি না। তোকে কেউ বলেছে টিপে দিতে? আমাদেরকে কি কাজ দেখাতে চাস? আবার বলে ‘দাও,আমি টিপে দেই।’ যাও রুমে যাও। আমি এসে যেনো ঘুমে দেখি নাহলে অবস্থা খারাপ করে ফেলবো। বেয়াদপ,কোথাকার। ”
সুমি দাত চেপে কান্না আটকায়। ভাইয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে রুমের দিকে চলে যায়।
—“আর দাদী, উনি মিথ্যা বলছে না সত্য সেটা উনার দিকে তাকালেই বুঝা যায়।”
—” আরে,তুই বিশ্বাস কর, আমি….!!”
–“আমার বিশ্বাস করা লাগবো না, ভাবী আপনি সরুন তো। আমি টিপে দিবো। যান,আপনি যেয়ে ঘুমান।”
রেশমিও পেয়েছে সুযোগ, সে ‘আচ্ছা ভাই’ বলে ওঠে যায়। ওর দিকে তাকালে যে কেউ বলবে,ওর হয়তো বল-শক্তি সব শেষ।
সৌহার্দ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দরজায় দাড়িয়ে আছে। বোনের ছলছল দৃষ্টি দেখে সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে সজীবকে এখন ই মাটিতে পুঁতে ফেলতে।
সে গর্জে ওঠে বলে,
—” আমার বোনকে এভাবে বলার দুঃসাহস আপনার কোথা থেকে এলো?”
সজীব নির্বিকারে বলে,
—” সে আমার বউ। আর আমার বউকে মারার-কাটার সব কিছুর দুঃসাহস আমার আছে।”
সৌহার্দ ফুসে ওঠে। রেশমি অবস্থা বেগতিক দেখে সৌহার্দকে টেনে নিয়ে আসলো।
সৌহার্দ ভীষণ রেগে আছে। ঘরের নির্জীব বস্তুদ্বয়ের উপর নিজের রাগ মেটানোর পূর্ণ চেষ্টায় আছে। রেশমি ভয় পেয়ে যায়। সে এর আগে সৌহার্দকে এমন রাগতে দেখে নি। সৌহার্দের মেজাজ ঠিক ই হচ্ছে না। সব কিছু ধ্বংস করতে পারলেই বোধ হয় তার কলিজায় শান্তি মিলতো।
নিজেকে তার নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে, চোখের সামনে বোনকে কষ্ট পেতে দেখেও কিচ্ছু করতে পারলো না সে। তার মতো হতভাগী কেউ আছে?
সে রেগে গিয়ে মাথার চুল খামছে ধরলো। বসে বসেই সে ফোঁপাচ্ছে।
—“আপনি এমন করছেন কেনো,উনি ভুল কিছু করেন নাই। আপনি বুঝার চেষ্টা করুন।”
সৌহার্দের চোখদুটো লাল হয়ে ওঠে, আচমকা ওঠে রেশমির বাহুদ্বয় ধরে বলে,
—” আমার চোখের সামনে সব ঘটেছে আর তুমি বলছো, আমার বুঝার ভুল? ”
—“হু,ভুল। কারণ যদি এমন হতো,তাহলে উনি নিজে দাদীর পা টিপতে যেতেন না। আপুর সাথে উনিও চলে যেতেন। আপুকে পাঠিয়ে দিয়ে,আপুর বদলে উনি টিপতে বসেছেন। কারন উনি চাইছিলেন না যে আপু কাজ টা করুক।”
—“তাই নাকি?তাহলে সেটা ভালোভাবেও বলা যেতো। ”
—“ভালোভাবে বললে আপু কি শুনতো বা আপনার দাদী কি মানতেন? দেখা যেতো, দাদী এটা নিয়ে খিল্লি উড়াতেন। আপুকে ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছিলো, উনি যদি এখন রাত জেগে দাদীর পা টিপতেন তাহলে নিশ্চই আপুর শরীর খারাপ করতো। আপনিই বলুন,উনার কি দোষ ছিলো? ”
সৌহার্দের মুখে কথা নেই। রেশমি যা বলছে তা কি ঠিক? নাকি এসব রেশমির মনগড়া কাহিনী?
—” জানেন, উনি এতক্ষণ জেগে ছিলেন, হয়তো আপুর মাথায় হাত ও বুলাচ্ছিলেন।”
সৌহার্দ ভ্রু কুচকে বলে,
—” তুমি কীভাবে জানো?”
—“উনার মুখ থেকে বিড়ির গন্ধ করছিলো আর যখন দাদীর পায়ে হাত দিচ্ছিলেন তখন হাতে লম্বা চুল দেখেছিলাম।”
সৌহার্দ রেশমিকে ছেড়ে দিলো। প্রাণহীনের মতো হেটে বিছানায় বসলো। তার মাথা কাজ করছে না। রেশমি যা বলছে তা সত্য নাকি সে যা দেখেছে সেটাই সত্য! দ্বিধায় ভুগতে লাগলো সৌহার্দ। তার ভেতর কেমন অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো। এ কেমন ধাঁধায় আটকে গেলো সে! দক্ষিণের জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস এসে সৌহার্দের গা ছুঁতেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসলো। রেশমি এসে তার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলো। এতক্ষণের তেজ আর রাগ দুটোই বরফের মতো গলে পানি হয়ে গেলো। বাহিরে প্রবল বেগে বাতাস বইছে। টিপ টিপ ফোঁটা পড়ে বৃষ্টি নামার আভাস দিতে লাগলো আকাশ।
চলবে!