অসুখের নাম তুমি পর্ব-১৮

0
569

#অসুখের_নাম_তুমি
পর্ব নং–১৮
#লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

সৌহার্দের মাত্রাতিরিক্ত জ্বরের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে দুইদিন। কাঁদতে কাঁদতে কবরের উপর জ্ঞান হারানোর পর, তাকে ঘরে নিয়ে আসা হয়, এরপরেই শুরু হয় জ্বর। জ্বরের সাথে বেশ কয়েকবার বমি ও হয়েছে। কিছুই মুখে দিতে পারছে না, যা ই খাচ্ছে তা ই বমি করে ফেলে দিচ্ছে। জ্বর হয়েছে তার জ্বালিয়েছে রেশমিকে। আবোলতাবোল বকাবকি ছাড়া কিছুই করে নি। সুমির মৃত্যু তার পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ হচ্ছে না। জমিলা এক দন্ড সময় ও তার পাশ থেকে নড়ছেন না। এক নাতিন চলে গেছে,আরেক নাতিকে হারাতে চান না। নাতির পাশে বসে জমিলা স্নেহ ভরা হাতে সৌহার্দের মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছে। সৌহার্দ চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করছে। কিছুক্ষণ পর সৌহার্দ জ্বরের ঘোরে বলে,

‘দাদী,ও কীভাবে মারা গেছে?’

জমিলা কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললো,

‘পেটের বাচ্চা টা নষ্ট হয়ে গেছিলো। শোক সামলাতে না পেরে নাতিন টা চইলা গেছে।’

কথাটা অস্পষ্টভাবে বলেই ডুকরে কেঁদে দিলেন।সৌহার্দের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। দাদীর দিকে দ্বিতীয়বার প্রশ্নবান ছুড়লো,

‘ বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর চাচী ঝামেলা করছে না?’

‘হু। করছিলো, হাত কাইটা ফালাইছিলো। না,না এইটা এর আগে হইছিলো। ‘

‘চাচী হাত কেনো কাটছে?’

‘তোর বউ লিনার লগে বেয়াদবি করছিলো। তখন বিচার হইছে আর বিচারে সুমি তোর বউয়ের পক্ষে সাক্ষী দিছিলো। তাই লিনা হাত কেটে ফেলছিলো। ‘

সৌহার্দ অকপটে বলে ওঠলো,

‘ আর সাক্ষী দেওয়ার পর থেকেই বোনটারে শেষ কইরা দিছিলো, না?’

জমিলা নিরুত্তর রইলো। সৌহার্দ ও আর প্রশ্ন করলো না,যা বুঝার বুঝে গিয়েছে সে। মনের খোরাক মেটাতে কিছুক্ষণবাদে প্রশ্ন করলো,

‘তুমি তো আমার বউরে দেখতে পারো না, তাহলে ওরে নিয়া আলাদা ঘরে থাকতাছো কেন? বের কইরা দিছে?’

‘বের করবো ক্যান? আমি বাহির হইয়া আইছি।’

‘কেনো?’

জমিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,

‘সজীবরে আবার বিয়া করানোর সময় ঝগড়া করছিলাম।’

‘সজীব বিয়ে করেছে?’

‘হ। মাইয়ারা বিশাল বড়লোক। অনেক টাকা দিছে। জিনিসপত্র ও দিছে।’

দাদীর কথায় সৌহার্দের মনে কৌতুহল দেখা দিলো। চোখ মেলে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘এত বড়লোক,হইলে সজীবের কাছে বিয়ে দিছে কেনো?’

‘ মেয়ের আগে একবার বিয়া হইছে। বিয়ের কয়েকমাস পর মেয়েটারে কেনো জানি দিয়া গেছে। আর এজন্যই সজীবের কাছে বিয়া দিছে। ‘

সৌহার্দ জ্বরের ঘোরেই মৃদু হাসলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

‘ভালো তো।’

জমিলা বেগম খানিক গর্ভের সুরে বলতে লাগলেন,

‘আমিও ঝগড়া করছি, আমার নাতনিটার মরার এক বছর না হইতেই বিয়া করাইতেছে। এসব কোনো কথা? তখন বিশাল ঝগড়া কইরা তোর বউরে নিয়া আলাদা ঘরে আইসা পড়ছি।’

‘আলাদা ঘর কীভাবে করেছো?’

‘তোর বিদেশের পাঠানো টাকা দিয়ে। সজীবরে বিয়া করানোর পর ওগুলার একটা টাকাও আমি তাদের দেই নাই। মারামারি কইরা সব নিয়া গেছি। এসব কিন্তু তোর বউয়ের বদৌলতে সম্ভব হইছিলো। জানিস, মেয়েটা বেশ ভালো রে। আমি তার সাথে কত কি করছি তারপরেও লিনার সাথে আমার জন্য ঝগড়া করছে। আমার এক কথায় ওই ঘর থেকে বের হয়ে আমার সাথে চলে আসছে। তুই খুব ভাগ্যবান রে, এত লক্ষী বউ পাইছোস। রেশমি লাখে একটা। তোর উপরে আমার কোনো রাগ,দুঃখ নাই। একদম ভালো করেছিস সেদিন বিয়ে করে।’

সৌহার্দ কিছু বললো না। গা টা আবার গুলাচ্ছে, মনে হচ্ছে বমি আসবে। চোখ বন্ধ করতেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। কল্পনায় চোখের সামনে সুমির বিভীষিকাময় জীবন ভেসে উঠেছিলো। অনুমান করছে,কে কি করেছে সুমির সাথে। বুকটা তীব্র হাহাকার করছে। মৃত্যুর আগের সকল ঘটনা সে অনুমান করতে পারছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলো, বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে। তীব্র ক্রোধের সহিত অসুস্থ শরীর নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সে বোনের মৃত্যুর জন্য বিচার বসালো। রেশমি এসব দেখেই সৌহার্দকে বারণ করছে। সে বলছে ‘শুধু শুধু ঝামেলা হবে। প্রকৃতপক্ষে কিছুই হবে না।’ কিন্তু সৌহার্দ শুনলো না।

বিচারে বেশ নামিদামী লোকজন বসেছেন। তারা আসতে চায় নি,তখন সৌহার্দ কিছু টাকা গুজো দিয়েছিলো। মোটকথা সৌহার্দ উন্মাদ হয়ে আছে। চাচীদের একটা শেষ দেখে ছাড়বে সে। বিচারসভায় বেশ হট্টগোল চলছে। লিনার ঘর থেকে কেউ আসতে চাইছে না। কিসের বিচার?তারা কি করেছে? সজীবের শশুড়বাড়ীর লোক বড়লোক হওয়ায় লিনার ঘর আজকাল বেশ চলছে। তাদের টাকা দিয়েই এত দাপট দেখাচ্ছে। তাই বিচারকদের তারাও টাকা খাওয়াতে পেরেছে। দুই পক্ষের টাকা খেয়ে বিচারকরা নিরপেক্ষ রইলো। আলোচনায় লিনা বলে ওঠে,

‘কিসের জন্য বিচার বসেছে জানতে চাই।’

এক বিচারক বললো,

‘সৌহার্দের বোনের জন্য। তাকে আপনারা অত্যাচার করে মেরে ফেলেছেন।’

লিনা ফুসে ওঠে বলে,

‘সুমি আমার ছেলের বউ। ওকে কেনো আমি অত্যাচার করবো? মেরে ফেলার হলে ছোট থেকে এত বড় করতাম না। হায়,হায়! এত বড় অপবাদ দেওয়ার আগে আমার কিছু হয়ে গেলো না কেনো? যে মেয়েকে আমি নিজ হাতে বড় করেছি তাকেই নাকি আমি মেরে ফেলেছি। ওহ,আল্লাহ গো,কই তুমি!’

লিনার কুমিরের কান্নায় গলে গেলো সকলে। বিচারকরা তার কথায় যুক্তি পেয়ে সৌহার্দকে বলে,

‘উনি ঠিক বলেছেন। তোমার বোনকে মারার হলে তো আগেই মেরে ফেলতেন। আসলে তোমার বোন বাচ্চা নষ্ট হওয়ার শোকেই মরে গিয়েছে। তুমি তো বিদেশে ছিলে, তাই আসল ঘটনা জানোই না। উনার কথাই ঠিক।’

কারো আর সৌহার্দের আর কথা শুনা হলো না। বিচার সেখানেই শেষ হয়েছে। রাগ আর ক্ষোভ সৌহার্দের মনে দ্বিগুন বেড়ে গেলো। বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে না পেরে রেগে চেয়ার-টেয়ারে লাথি দিয়ে ঘরে চলে আসলো। তার এত কষ্ট লাগছে যে, সে কি করবে বুঝতে পারছে না। মাথায় আগুন জ্বলছে। বোনের মৃত্যু কি এভাবেই বিফলে যাবে? সে কি কিছুই করতে পারবে না।

রেশমি গুটিগুটি পায়ে ভেতরে আসলো। এসেই সৌহার্দের পাশে দাড়ালো। সে বুঝতে পারছে সৌহার্দের মনে কি ঝড় চলছে। সে তার কাঁধে হাত রাখলো। সৌহার্দ টকটক লাল চোখে পেছনে ঘুরলো। রেশমি দেখতেই শান্ত হয়ে গেলো। কান্না পাচ্ছে তার,ভাষণ অসহায় লাগছে। সে টলমল চোখে রেশমিকে বলে,

‘আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমার বোনের মৃত্যুর কোনো বিচার হলো না।’

বলতে বলতে সৌহার্দ বসে পড়লো। রেশমি তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। তার কোলের উপর মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো সৌহার্দ। রেশমি ভীষণভাবে অনুভব করছে সৌহার্দের কষ্ট। তার ও তো কষ্ট হচ্ছে সুমির জন্য। কিন্তু সৌহার্দ এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো হবে না,তাই রেশমি সান্তনা দিয়ে বললো,

‘ এই পৃথিবীতে কোনো মানুষ চিরস্থায়ী নয়। সময় ফুরিয়ে গেলে সবাইকে একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমনকি আমি, আপনি আমরা কেউই নয়। আপুর সময় শেষ হয়ে গিয়েছে তাই উনাকে চলে যেতে হয়েছে। আপুর সাথে যা হয়েছে তার জন্য উপরওয়ালা আছেন। তিনি সব দেখেছেন। উনারা একদিন তাদের প্রাপ্যটুকু ঠিকই পাবেন। এর জন্য আপনি নিজেকে দোষ দিতে পারেন না। আপনার তো কোনো দোষ নেই।’

এবারে সৌহার্দ খানিকটা সামলে নিলো নিজেকে। রেশমির কথায় মনোবল খুঁজে পেলো সে। সেদিন আবার জ্বর দেখা দেয় তার। সারাদিন বিছানায় শুয়ে রইলো। রাতের দিকে শুরু হলো ঝড়। টিনের ঘরের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার সাথে ছমছম আওয়াজ হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঘরেও শীতল হাওয়া প্রবেশ করেছে। সৌহার্দ জ্বর নিয়ে শুয়ে আছে। বেশ দূরত্ব রেখেই বসে আছে রেশমি। কিছুক্ষণবাদে সৌহার্দ চোখ মেলে রেশমির দিকে তাকালো। তার চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তীব্র আকুতি। সৌহার্দ হাত বাড়িয়ে রেশমির আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে দিলো। রেশমি খানিকটা কেঁপে উঠলো। সৌহার্দ বললো,

‘তুমি আমার কাছে আসো। এত দূরে কেনো?বাহিরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে,ঠান্ডা বাতাস বইছে।তোমার কি অন্যায় কিছু করতে ইচ্ছে করছে না?’

#চলবে……..
®সোনালী আহমেদ