আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-১১

0
965

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি

১১।

আচ্ছা শ্যামাকি তাকে উইশ করবে? করলে হয়তো এতক্ষণে করে ফেলতো নাকি? তবুও আশায় বাঁধে বাসা। সেটা ভেবেই নামতে লাগলো নিচে। আর তখনি…ফুস করে কারেন্ট উড়ে গেলো। সিঁড়ির মাঝ পথে এসেই থেমে গেলো ইজহান। আর ঠিক তখনি রান্নাঘর থেকে ঝনঝনানি শব্দ হলো থালাবাসনের। ইজহানের বুক ধক করে উঠলো। ঠিক আছেতো শ্যামা? সে তার গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“শ্যামা…! কি হয়েছে?”

রান্নাঘরে থালাবাসন ধুছিলো। ধোয়া শেষে যেই না বাসন কাসন সেলফে রাখতে নিলো, ওমনি কারেন্ট চলে গেলো। শ্যামা হতাশ হলো, এই এলাকার এই এক সমস্যা যখস তখন কারেন্ট চলে যায়। সে অন্ধকারে বাসন,কোসন রাখবে তখন ধুমধাম করে বাদ্যবাজনা বাজিয়ে পড়ে গেলো নিচে। এরি মাঝে যখনি ইজহানের গলা শুন্তে পেলো, তখনি আরো চমকে উঠলো। বলল,

“না.. না.. কি.. ছু হয়নি..! সব ঠি..ক আছে..!”

ওদিক থেকে আর কোনো আওয়াজ পাওয়া গেলো না। শ্যামা হাতরে মোমবাতি বের করে জ্বালিয়ে নিয়ে খাবার টেবিলের সামনে আসতেই দেখতে পেল একটি কাঠিন্যে ভরপুর গম্ভীর মুখ। খাবার টেবিলে বসে আছে, হাতে মুঠোফোনের আলোয় জ্বলজ্বল করছে তার মসৃণ মুখ, ঘন কালো কুচকুচে চোখ জোড়া দিয়ে ডুবে আছে ফোনের ভিতরে। শ্যামা ভাবলো, ছোট বেলায় যতবার এই লোকটিকে সে দেখেছে, তার সাথে এখনের এই মানুষটি বড্ড অপরিচিত। তবে একটা জিনিস এখনো মিল, দাম্ভিক, গম্ভীর, চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। মাঝে মাঝে একে বোবা ভেবে বসলে অবশ্যই ভুল হবে না…!

শ্যামার নাক দিয়ে ছোট শ্বাস ছাড়লো। এক হাতে খাবারের প্লেট আর অন্য হাতে মোমবাতি নিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলো। ঘন কালো কুচকুচে গভীর চোখ জোড়ায় তাকালো ইজহান শ্যামার দিকে, হলদে আলোয়
শ্যামার মসৃণ মুখ বড্ড মায়াবী লাগছে। ইজহান এক দৃষ্টি তাকিয়ে রইলো শুধু। এদিকে শ্যামা ইজহানের এমন চাহনি কাঁপিয়ে তুলছে তার দেহ। শ্যামা কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না.. এই দৃষ্টি। সে ভেবেই পাচ্ছে না.. এমন করে কেন তাকিয়ে ইজহান? আচ্ছা তার মুখে কিছু লেগে নেই তো? শ্যামা নিজের মুখে হাত ছোয়ালো। টিমটিম করে জ্বলা মমের আলোতেই একটি স্টিলের থালা তুলে নিয়ে, তাতে নিজের মুখ দেখের বৃথা চেষ্টা করলো। আর তখনি শ্যামার অজানতে ফটফট করে ছবি তুলে নিলো কটা ইজহান।

অনেকক্ষণ নিরবতার পর শ্যামা খাবার নিয়ে আসে, এবং খিচুড়ির প্লেট এগিয়ে দেয়, ইজহান তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো, পলকহীন চেয়ে থেকে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠলো। খিচুড়ির প্লেটে আচার দিয়ে খুব সুন্দর করে লিখা… H B D…পাশেই একটি ডিম অমলেট করে সেটাতেও খুব সুন্দর ডেকোরেশন করেছে। ইজহান তার গম্ভীর কন্ঠে হালকা হেসে বলল,

“তুমি এসব আমার জন্য করেছো?”

বলেই এক চামচ মুখে পুরে নিলো। এত সুস্বাদু খাবার যেন সে আর আগে খাইনি।শ্যামা সাইডেই কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইজহানের কথা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে মাথা নেড়ে বলল,

” ইয়ে, মানে.. অধিরাজ দা বললেন…!”

হাসি মুখ খানা মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো ইজহানের মুখ। মাথায় বার বার বাজতে লাগলো, অধিরাজদা বললেন? মানে? এসব তার জন্য না? অধিরাজ বলেছে বলে করেছে সে? ইজহানের অভিব্যক্তি আবারো চেঞ্জ হতে দেখে শ্যামা ঢুক গিললো। ইজহান ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেলো। খাবার প্লেট ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে।ইজহানের রাগান্বিত দৃষ্টিতে মাথা নত করে ফেললো শ্যামা। ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠে ওর পুরো দেহ। সে তো তাই করেছে, অধিরাজ দা তখন ফোন দিয়ে বলল,

” শ্যামা শোনো না বোন, স্যারের মন টন ভালো নেই, তুমি বরং তার বার্থ ডের জন্য কিছু একটা করে খুশি করে দিও।”

শ্যামা বলল,

“আ..আ..মি কি করবো?”

“যা খুশি! যা আমাদের স্যারের মন ভালো করে দেয়!”

শ্যামা চুপ করে থাকে। কিছু ভেবে সেই ভাবে কাজ করে। তাহলে? তাহলে কেন ইজহান এমন করলো?? শ্যামার ভানার মাঝেই ইজহান দু কদম এগিয়ে আসতেই শ্যামা পিছিয়ে পড়ে। এ দেখে আরো রেগে যায় ইজহান।ঠিক তখনি কারেন্ট চলে আসে। আর হাত মুঠ করে ইজহান বেড়িয়ে যায় সদর দরজা দিয়ে। ম্যামা সেখানেই বসে পরে, মুখের মাঝে হাত চেপে হু হু করে কেঁদে উঠে, কেন? কেন? ইজহান তার সাথে এমন করে? কেন তাকে এত টর্চার করে? কি দোষ ছিলো তার??

——–

খুব সকালে দরজার মাঝে খটখট করে শব্দ শোনা যাচ্ছে। শ্যামা তাদের হল ঘরের সোফার উপরেই শুয়ে পড়েছিলো। বাহিরে এমন সরগরম আর দরজায় কড়া ঘাত উঠে বসলো। বাহিরে কি হচ্ছে? কারাই বা এভাবে দরজা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে? শ্যামা ওরনা টেনে নিলো। চোখ ঢলতে ঢলতে বাহিরে এসে দেখলো, এলাকার মানুষ ঝর হয়েছে তার দোরগোড়ায়। শ্যামা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে ভ্রু কুচকে বলল,

“আপনারা? এত সকালে এখানে কি করছেন? ”

তখনি পিছন থেকে একটি পরিচিত গলা শোনা গেলো,

“আমি বলছি?”

শ্যামা সেদিকে তাকালো। তার আগেই পাশ থেকে এক মধ্য বয়সি মহিলা খেঁকিয়ে উঠলো,

“কিসের বলা বলি? এরে টেনে বের করে দু ঘা বসা আগে রাত বিরাতের ফস্টি নষ্টি বেড়িয়ে যাবে।”

তাকে তাল দিয়ে আরেকজন বলল,

“বাপ হসপিটাল কি গেলো? মেয়েতো নষ্টামিতে নেমে পড়লো!”

তার সাথে আরেকজন তেড়ে এসে বলল,

“বের কর, বের কর, তোর নাগড়কেউ বের কর, দুজনের মুখে এক সাথে চুনকালি মেরে, জুতার মালা পড়িয়ে বের পুরো মহল্লা নাকে খত দিয়াবে!”

শ্যামা এদের কথা কোনো কিছুই বুঝতে পাড়লো না,

“কি সব বলে যাচ্ছেন আবোল তাবোল? মুখ সামলে কথা বলুন!”

এবার শিফন বাঁকা হেসে, শ্যামার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

“আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ঘরে তুলবে, তা তো হয় না? রিভেঞ্জ ইজ রিভেঞ্জ…!”

তারপর জোরে চেচিয়ে বলল,

“আমি আমি সত্যি বলছি, কাল রাতের বেলায় দেখলাম এক লম্বা লোককে সে ঘরে ঢুকিয়েছে, আপনার তালাসি নিন।”

শ্যামার চোখ কঁপালে। সে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল,

” খবরদার যদি কেউ এক পা নর, তাহলো খারাপ কিছু হয়ে যাবে। আর এই শিফনকে বিশ্বাস করছো তোমরা? যে দিন রাতে রাস্তা-ঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করে? তার কথা বিশ্বাস করছো?? আমার গরে কোনো ছেলে নেই। শিফন মিথ্যা বলেছে তোমাদের”

শিফন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। কারণ শ্যামার বলা কথায় সবাই কানাঘুঁষা শুরু করে। তখনি এক দাদি বলল,

“ঠিক আছে তোমার কথা মানলাম, আমরা না হয় একবার চেক করে দেখি?”

শ্যামার চোখের কোনে জল টলমল করে উঠলো। বলল,

“আজ বাবা-মা থাকলে হয়তো আপনাদের এমন কথা শুন্তে হতো না? এক শয়তান লোকের জন্য আপনারা আমাকে এত নিচে টেনে ধরলেন? আচ্ছা যান করে নিন চেক!”

সকলের মাথা নত হয়ে গেলো। এরি মাঝে জান্নাত নব নিচে এসে বোনকে কাঁদতে দেখে তার কাছে ছুটে এসে বলে উঠে,

“বড়পু কাঁদছো কেন? বলো? এরা.. এরা কিছু বলেছে? একবার বলো, আগুন লাগিয়ে দিবো।”

শ্যামা নিচের ভাগ্যর উপর কখনো দোষরোপ করেনি। কিন্তু আজ আজ বড্ড দোষ দিতে ইচ্ছে করছে। যবে থেকে তার মা মারা গিয়েছে , জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে যেন। জান্নাত বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে। আর পাড়াপ্রতিবেশিরা অনুতপ্ত হচ্ছে কিছুটা। কিন্তু শিফন তার শিকার ছেঁগে দেয় কিভাবে? কাল রাতে তার নিম্নাঙ্গে শ্যামার দিয়া আঘাতের জন্য দাঁড়াতে পারছে না। এত সহজে সে ছাড়বে না এই মেয়েকে। সে জানতো, শ্যামার কথায় সবাই পলটি মারতেই পারে? তাই সে ভারা করে এনেছিলো চর থেকে কতগুলো মহিলাকে। তাদের ইশরা করতেই এক মহিলা ডিম ছুঁড়ে মারলো শ্যামার দিকে। বলল,

“ছোকরি, আমি নিজেও তোহাকে দেখেছি, এক ছোকরার সঙ্গে লটকে লটকে ঘরে ঢুকতে, এখন বল, আমি মিথ্যে বলচি!”

শ্যামা ডিম মাখা গায়ে বিস্ময় নিয়ে মুখ দিয়ে কিছু বলতে নিলো তার আগেই ধাপে ধাপে ডিম ছুঁড়লো আরো কজন, পঁচা ডিমের বিশ্রী গন্ধ গা গুলিয়ে আসার উপক্রম। তাদের সাথে আবারো তাল মিলিয়ে পাড়াপড়শিরা কম করলো না। এক পর্যায় জান্নাত ঘর এক রডের লাঠি এনে তাদের দিকে তাক করলো। বোনকে হেফাজত করার জন্য। বলল,

“আর এক বার যে ডিম ছুঁড়বে তার মাথা ফাটিয়ে দিবো।”

কিন্তু তাতে তেমন লাভ হলো না। কথা থেকে একদল মহিলা এসে ধরে ফেললো জান্নাতকে। চেচিয়ে বলল,

“চোরের মার বড় গলা। রাত বিরাতে করবা দেহ ব্যবসা করবা, আমরা বললেই দোস, এইটা ভদ্র লোকের এলাকা। তোমাদের শিক্ষা দিবোই দিবো!”

বলেই শ্যামাকে আরো কজন নিয়ে এলো মাঠের মাঝে। এবং সবাই লাঠি নিয়ে পিটাতে শুরু করলো। অচমকা আসা আঘাত সামলে উঠতে পারলো না।প্রতিটি বাড়ি মরণযন্ত্রনা দেখিয়ে দিচ্ছে শ্যামাকে। মারার এক পর্যায় যখন শ্যামার মাথায় আঘাত করতে নিলো, তার আগেই বন্দুকের আওয়াজ ভেসে উঠলো পিছনে ঘুরতেই দেখতে পেলো, এক জোরা জলন্ত চোখ……

চলবে,

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।