আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-১৫

0
880

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১৫।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁচের টুকরো বিঁধে গেছে ইজহানের ডান হাতে। শ্যামা থরথর করে কাঁপছে এখনো। থেকে থেকে চোখের পলব ভাড়ী হয়ে আসচ্ছে। গালের পরা চোখের জলের পানির দাগ শুকিয়ে গেছে। এতেও শ্যামার ন্যাচারাল বিউটিতে ছিটেফোঁটাও কমে নি। বরং এতেও মারাত্মিক সৌন্দর্য লাগছে। শ্যামা গুটিশুটি মেরে বিছানার এক কোনে হাটুতে দু হাত বেঁধে বসে৷ আড় চোখে বার কয়েক দেখে নিলো। কিছুক্ষণ আগে বয়ে যাওয়া, ঝড়ো হাওয়া ভেবেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শ্যামার।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,

ইজহান শ্যামাকে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে, মুহূর্তেই তার মুখোমুখি হয়ে যায়। অদ্ভুত হাড় কাঁপানো অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে শ্যামার লাল ঠোঁট। তপ্ত কন্ঠে বলে,

” এখানে, এখানে স্পর্শ করছিলো না.. রিদ?”

শ্যামা বিস্ময়ে বিমুঢ়। রিদ তাকে কখন ঠোঁটে স্পর্শ করলো? বুঝে উঠতে পারলো না শ্যামা। কাঁপা কন্ঠে শুধু বলল,

” আ… প.. নি ভুল ভাবছেন..”

শ্যামা চুপ বলতে বলতে চুপ হয়ে যায়। ইজহানের ঠোঁটে তখন অদ্ভুত অনুভূতিহীন হিংস্র হাসি। যেন অনেক বছরের পুরোনো কোন দৈত্য নিজের দুশমনদের তার৷ পায়ের নিচে চাপা দিতে স্বার্থক৷ শ্যামার চোখে জল গড়িয়ে পড়লো ভয়ে। ইজহান বলল,

” তোমার এই ঠোঁট জোড়া বড় টানতো আমায়, অথচ, অথচ এই ঠোঁট জোড়ায় আমি কখনো আমার ঠোঁটের স্পর্শ দেই না। জানো কেনো?”

শ্যামার কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। সে মনে করতে চাইলো, বিগত তারা যতবার ইন্টিমেট করেছে, ইজহান জোড় করেই করুক, কখনো তার ঠোঁট স্পর্শ করে নি। শ্যামা অবাক চোখে চাইলো। ইজহান ঘর ফাটানো হাসি দিয়ে বলল,

” জানো না তো? বলছি…!”

বলেই ইজহান আবার স্পর্শ করলো শ্যামার ঠোঁটে তবে এবার রুডলি ভাবে। শ্যামা ব্যথায় “আহ্ ” শব্দটি বেড়িয়ে এলো। ইজহান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,

” তোমার এই ঠোঁটে অন্য পরপুরুষ আমার আগে স্পর্শ করছে, যার জন্য… যার জন্য এই ঠোঁট আমি কখনো স্পর্শ করিনি। না করবো!”

বলেই উঠে গেলো ইজহান বিছনা থেকে। অস্বাভাবিক ভাবে হেলে দুলে কাচের টেবিলের সামনে এসে এক ঘুষি মারলো। সাথে সাথে ঝনঝন শব্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো কাচের টুকরো গুলো। কিছু টুকরো বিঁধে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে ফ্লোরে রক্তের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। তাতেও খ্যান্ত না সে, পর পর, আরো কয়েকটা ঘুষি বসালো ভাঙা কাঁচের উপরো। থতলে যেতে লাগলো হাত। শ্যামা এক চিৎকার দিয়ে নিজে নেমে এসে আটকাতে চাইলো ইজহানকে। ইজহান তখন আউট ওফ কান্ট্রোল। রাগে ফোঁসফোঁস করছে। শ্যামা তার বাহুতে ধরতেই হুংকার দিয়ে উঠলো ইজহান। শ্যামার থুতনিতে চেপে ধরলো তার রক্তাক্ত হাত দিয়ে। বেসে উঠে তখনি শ্যামার আর রিদের চুম্বন মুহূর্ত। ইজহান ছেড়ে দেয়, ক্লান্ত পায়ে পিছিয়ে যায় দু পা। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“তোমার মতো মেয়েদের মরে যাওয়া উচিত, তোমার মতো মেয়েদের থেকে প্রস্টিটিউটরা অনেক ভালো।”

কোথাও যেন ঠিস সেই মুহূর্তে বর্জপাতের শব্দ হলো। হ্যা, আর কোথাও না। শ্যামার মনের ভিতরে অাঁধারিয়া অম্বরে বর্জপাতের মতো ভয়ংকর শব্দে দু ভাগ করে দিতে লাগলো। শ্যামা ইজহানের ম্লান মুখের পানে চেয়ে রইলো। বড় বড় ফোঁটায় চোখের জল গুলো গড়িয়ে পড়তে লাগলো। শ্যামা স্তব্ধ হয়ে গেছে। কি শুনলো তার কান দুটো? নিজের স্বামীর কাছ থেকে কি এমন কথা… এমন কথা গ্রহনযোগ্য? শ্যামা ভেবেছিলো আজ দিনটি হয়তো তাদের জীবনের নতুন সূচনা হবে। কিন্তু… কিন্তু সব স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেলো।

শ্যামা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। নিস্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” আমাকে, আমাকে আপনার এতটাই খারাপ মনে হয়?”

ইজহান চোয়াল শক্ত করে বলল,

” এর থেকেও নিকৃষ্ট! ”

শ্যামা আর ভাষা খুঁজে পেলো না। অপলক দৃষ্টি চেয়ে রইলো শুধু৷ বুকের ভেতরটা ভাড়ি ভাড়ি মনে হচ্ছে তার। যেন কেউ পাথর চাপা দিয়েছে। ইজহান শ্যামার নিস্প্রভ দৃষ্টি আর সইতে পড়ালো না। তপ্ত রাগ, রি রি করে বাড়ছে। সে আরো এক বার চাইলো শ্যামা দিকে। তখনি শ্যামা ঠোঁট নাড়লো,

“এই জন্যই কি আমাকে রক্ষিতা করে রেখেছেন? বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধের নাম করে!”

ইজহান থমকালো। একপলক তাকিয়ে বেড়িয়ে গেলো তার লম্বা পা ফেলে।

শ্যামা তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিক।ঘরের ভিতরটা আবারো ঠান্ডা হয়ে গেলো। নিরব, নিস্তব্ধ এই পরিবেশে নিজের প্রতি আজ নিজেরি বড্ড করুনা হচ্ছে। আজ, আজ তার বাবা সুস্থ থাকলে, তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে পালিয়ে না বেড়ালে? এমন কি হতো? বার বার কি আহত করতো ইজহান তাকে। ম্যামা বিছানার উপর বসে পড়লো পা ফোল্ড করে। শরীর আজ খুব ক্লান্ত। এক সময় বিছানায় সেভাবেই শুয়ে পড়লো সে। ঠিক তখনি ভেসে আসলো গাড়ির শব্দ। শ্যামা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই সম্পর্কে আর কখনো আশার আলো সে খুঁজবে না। যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে যতদিন না সে মুক্ত পাচ্ছে। কিন্তু এবার সে মুক্তি চায় এই সম্পর্কে। কিন্তু কিভাবে পাবে সে মুক্ত হতে….

পরের দিন সকালে শ্যামার ফোন বেজে উঠলো। তীব্র মাথা ব্যথা নিয়ে শ্যামা ফোন তুলতেই, ওপাশ থেকে জাহিদের বিচলিত কন্ঠ ভেসে এলো। বলল,

“শ্যামা তুই কি করেছিস এইটা?”

শ্যামা ভাঙা কন্ঠে বলল,

“কি করেছি?”

“নিউজ পেপার দেখিস নি?”

“নাহ্, আমি মাত্র উঠেছি ঘুম থেকে!”

“নিউজ পেপার টা দেখ!”

“তুই বল!”

“নাহ্ আপনি দেখেন মেডাম!”

শ্যামার কঁপালে চিন্তার ভাজ পরলো। জলদি লিভিং রুমে এসে আজকের পেপারটা হাতে নিতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। শ্যামা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এসব কি? ঠিক তখনি ইজহানের দাদিজান আর আয়ানা এসে হাজির। শ্যামা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। কিছু বলবে, তার আগেই ঠাস করে চর বসিয়ে দিলো শ্যামার গালে। সাথে সাথে ঠোঁটের কোনা কেঁটে রক্ত বেড়িয়ে গেছে। শ্যামা গালে হাত দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তাদের দিকে। দাদিজান তখনি চেচিয়ে বলল,

“আমার নাতি তোমাকে এত এত সাহায্য করেছে, এই দিন দেখবার জন্য? তার রেপুটেশন নষ্ট করতে এতটুকু গায়ে বাজলো না!”

শ্যামা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

” মেডাম বিশ্বাস করুন এই.. এই নিউজ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। ”

আয়ানা হাত তালি দিয়ে বলল,

“বাহ্, আমার মা তোমার মাকে সাহায্য করেছিলো, আর সেই মহিলা, আমার মাকে ধোকা দিলো। আর একই কাজ তুমি করলে? সেইম ওন ইউ। আমি ভাইয়াকে আগেই বলেছিলাম, খাল কেঁটে কুমির এনো না!”

শ্যামা বলল,

” আয়ানা প্লিজ বিশ্বাস করো আমি কিছু করিনি। আর না আমার মা কিছু করেছে। বার বার আমার মাকে ব্লেম করা বন্ধ করো, যে নেই এই পৃথিবীতে তাকে নিয়ে মিথ্যা গুজব ছড়িও না।”

আয়ানা রাগে শ্যামাকে বলল,

“তোমার মার জন্য, একমাত্র তোমার মার জন্য আজ আমার মা নেই, নিজের চোখের সামনে মায়ের গায়ে আগুন লাগাদে দেখেছি, মায়ের দেহ পুড়ে ছাই হতে দেখেছি। কত রাত মাকে চোখের জল ফালতে দেখেছি, তার পরেও বলবে তোমার মা ধোঁয়া তুলসি পাতা! তুমি কিভাবে বুঝবে? যেই সন্তান তার মাকে নিজের চোখের সামনে পুড়ে ছাই হতে থাকে!”

বলেই আয়ানা কেঁদে দিলো। শ্যামার কষ্ট লাগছে এই কথা শুনে, যদিও সে কখনোই জানতো না, এসব বিষয়ে। শ্যামার চোখেও পানি চলে এসেছে। ম্যামা বলল,

“আন্টির কি হয়েছে আমি জানি না। তবে আমার মা কখনোই তোমার মায়ের মৃত্যুর কারণ হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি না।”

তখনি দাদিজান শ্যামাকে তার দিকে ঘুরিয়ে বলল,

“তোমার বিশ্বাসে কখনোই সত্যি বদলাবে না। আর আজকের এই ঘটনার পর তোমাকে আমি জাহান্নাম না দেখিয়েছি তাহলে আমি আলিয়া নই!”

বলেই তারা চলে গেলেন। শ্যামা সেখানেই বসে পড়লো। হাতে নিউজ পেপারটিতে একটি ছবি জ্বল জ্বল করতে লাগলো। তার উপর বড় একটি হেড লাইন,

” ইজহান মেহরাব মাদকাসক্ত। তার সাথে গোপনে আছে মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক।”

এবং একটি ছবি, যেখানে মেয়েটির পিছন দেখা যাচ্ছে। কাকতালীয় ভাবে, মেয়েটি আর কেউ না… শ্যামা নিজেই।

শ্যামা হু হু করে কেঁদে উঠলো। জীবনের এটি কেমন সময় চলছে? পরীক্ষার উপর পরীক্ষা চলছে। এক সমস্যার সমাধান না পেতেই আরেকটি এসে হাজির হচ্ছে। কি করবে শ্যামা? কি করবে এবার??

ঘড়ির কাঁটায় ১১.২০। টিক টিক শব্দ হচ্ছে। পিনপতন নিরবতা এই অফিস ঘরটিতে। দুটো মানবের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যেন।খবরের কাগজের হেডলাইন আর ছবি দেখে ইজহানের মাথায় সুক্ষ ভাজ পড়লো। অধিরাজ নিজেও এই নিউজ দেখে অবাক। সত্যি কি শ্যামা এমন একটি কাজ করতে পারে? অধিরাজ বলল,

“স্যার এর ফিডব্যাক কি হবে? অনেক চাপ দিচ্ছে সবাই, আপনার স্টেটমেন্ট জানার জন্য!”

ইজহান কঁপালে আঙুল ঘসে বলল,

“খোঁজ লাগাও অরিজিনাল কালপ্রিট কে?”

অধিরাজ অবাক হয়ে বলল,

“শ্যামা মেম!”

ইজহান চাইলো তার ঠান্ডা দৃষ্টিতে। তাতেই অধিরাজ বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,

“আমি খবর নিচ্ছি! ”

অধিরাজ বেড়িয়ে যেতেই অফিসের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। কখন থেকে ফোনটি বেজে যাচ্ছে ইজহানের৷ সে ফোনের স্ক্রিনের নাম্বার দেখে ফিকে হাসলো। তারপর কল কেঁটে দিয়ে পকটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো। বাহির তখন অনেক রাত। ঘনিয়ে আছে আচ্ছন্ন অন্ধকারে। তবে অদুর দূরে এক ফালি চান্নি পসরের ছোঁয়া গায়ে লাগছে । সে বিড়বিড় করে বলল,

” অন্ধকার আকাশের এক মাত্র আলোকিত চাঁদ তুমি….আর আমিই তোমার #আধাঁরিয়া_অম্বর!”

আবারো স্ব শব্দ ফোনটি বেজে উঠলো। এবার সাথে সাথে ধরলো ফোনটি, ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটি চিকন মিষ্টি মেয়েলি কন্ঠ। যে কন্ঠ শুন্তে ইজহান কত রাত জেগে থাকতো। ইজহান এই প্রান্তে চুপ। ও প্রান্তে শ্যামা বলল,

“মি: ইজহান, বিশ্বাস করুন আমি কিছু করিনি!”

ইজহান শান্ত। অভিব্যক্তহীন। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূরে। শ্যামা বার বার একই কথা বলে যাচ্ছে। ইজহান সপ্তপর্ণে শ্বাস টুকু লুকিয়ে বলল,

“আমি জানি!”

ও প্রান্ত শ্যামা শান্তির শ্বাস ছাড়লো। তখনি ইজহান আবার বলল,

“আমাকে আর ডিস্টার্ব করবে না!”

বলেই কল কেঁটে গেলো। শ্যামা অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। ইজহান বার বার তাকে কেন ভুল বুঝে যাচ্ছে? সে কি করবে? এত এত অপরাধ বোধ নিয়ে সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। এই জীবন সে আর রাখতে চায় না। চায় না… কিন্তু সে নির্দোষ এইটুকু প্রমান সে করেই ছাড়বে। তার সাথে ইজহানের টাকা পরিশোধ করে নিজেকে মুক্ত করে নিবে সে। চলে যাবে, সবার জীবন থেকে, অনেক… অনেক দূরে….

চলবে,