আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-১৬

0
1217

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১৬।
সময় স্রোতের মতো বহমান। বয়ে চলে কিছু মনোমুগ্ধকর স্মৃতি দিয়ে আবার কিছু তিক্ত মুহূর্ত দিয়ে। একটা সময় থাকে, যখন সুখের সীমা থাকে না। চারিদিকে থাকে হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দের ফোড়োয়া। কিন্তু যখনি তাতে কারো নজর লাগে, সেই সুন্দর পরিস্থিতি হয়ে উঠে খা খা চৌচির মাঠের মতো।

পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা ঝাপিয়ে নেমে পড়লো। দূর কোথা থেকে ভেসে আসচ্ছে কাঠগোলাপের সুবাস। কাঠগোলাপ সানিয়ার খুব প্রিয় ছিলো। ইজহান যখন ছোট ছিলো সানিয়াকে প্রায় দেখতো বাগানের মাঝে দেশ, বিদেশ থেকে আনা গাছের চারা লাগাতে। তাদের এই পুরোনো বাড়িটিতে তার মা ঝাকে ঝাকে কাঠগোলাপ লাগাতো। মায়ের ঘরের বারান্দা থেকে বাগানে ফোঁটা ফুল গুলো দেখতে অপরূপ লাগতো।
ইজহান এখন তার মায়ের রুমে বারান্দায় বসে আছে, ঠিক সেখানে যেখানে তার মা অবসর সময় বসে থাকত, কখনো ইজহান, আরমান, আয়ানার মাথায় তেল দিয়ে দিতো। রাতে ঘুম না আসলে এখানেই কোলে করে এদিক ওদিক পায়চারি করে গুন গুন করে গান শুনাতো, গানটি ইজহানের কানে যে এখন-ও বাজছে,

” a leke chalun tujhko, Ek aise desh mein
Aa leke chalun tujhko, Ek aise desh mein
Milti hain jahan khushiyan
Pariyon ke bhes mein
Milti hain jahan khushiyan
Pariyon ke bhes mein
Pariyon ke bhes mein..
Aa leke chalun tujhko……

ইজহান হাসলো, এখনো মনে হচ্ছে তার মা পায়চারি করছে, কোলে আয়ানা কাঁধে আরমান, আর ইজহান ডিভানে শুয়ে, ছোট ছোট চোখে মাকে দেখছে আর হাসচ্ছে।

ঠিক তখনি সাদা জামা পরা আয়ানা আর সাদা পাঞ্জাবি পরা আরমান ভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। আরমান বলল,

“দাদা ভাইয়া তুমি এখনো মেডিসিন লাগাও নি?”

ইজহান আরমানের কথায় হাতটি হাওয়ায় তুললো, সেদিনের ক্ষতে আজ আবারো চাপ লাগায় ক্ষতটি তাজা হয়ে গেছে। ইজহান তাকিয়ে রইলো শুধু। আয়ানা মেডিসিন বক্স এনে ভাইয়ের সামনে রেখে হাতটি টেনে মেডিসিন লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,

” দাদা ভাইয়া নিজেকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছো?”

ইজহান তবুও চুপ। তার চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখে তারা কিছুই বুঝতে পারছে না। তখনি ইজহান ঠান্ডা গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“সব কাজ শেষ?”

আরমান মাথা নাড়ালো,

“হে দাদা ভাইয়া, গরীব মিসকিনদের কাপড় বিলিয়ে দেয়া শেষ!”

ইজহান মাথা নাড়ালো। তখনি আয়ানা বলল,

“আমরা এখনি বের হবো ভাইয়া!”

“ঠিক আছে তোরা যা আমি কিছুক্ষণ পর বের হবো!”

দুজনি সম্মতি জানিয়ে বেড়িয়ে গেলো। ইজহান আবারো তাকিয়ে রইলো বাগানের ফুল গুলোর দিকে।

আজ ইজহানের মা সানিয়া মেহরাবের মৃত্যু বার্ষিকি। এক যুগ পাড় হলো তার মা তাদের ছেড়ে পরকালে চলে গেছেন। ইজহান চোখ বুঝলো। চেয়ার পিছনে মাথা হেলিয়ে মনে করতে লাগলো ১২ বছর আগের দিন গুলো…..

১২ বছর আগে,

মা, বাবা, ভাই, বোন আর তার দাদিকে নিয়ে ছিলো তাদের ছোট একটি পরিবার। দাদি তখনো তাদের কোম্পানি সি ই ও। যদিও তা নামেই, সম্পূর্ণ কোম্পানির দায়িত্ব ইজহানের বাবা মেহতাবের হাতেই। তখন তাদের পরিবারে না কষ্ট ছিলো টাকার, না ভালোবাসার। ইজহানের বাবা মা দিজনের মাঝেও ছিলো অফুরন্ত ভালোবাসা। কিন্তু ১২ বছর আগেই সেই সুখী পরিবারটিতে গ্রহণ লেগে গেলো কারো।যখন থেকে আজিজুল হক মেহতাবের সাথে যোগাযোগ করলো। সানিয়ার প্রতি মেহতাবের পরিবর্তন দেখা দিতে লাগলো। প্রতিরাতে সানিয়াকে মারতো মেহতাব। কিন্তু তার মা তার বাবাকে এতটাই ভালোবাসতো, যে মুখ বুঝে সব সহ্য করে ফেলতো। ইজহান তার মাকে অনেক রাত কাঁদতে পর্যন্ত দেখেছে, যখন তার বাবা বাসায় আসতো না। ধীরে ধীরে মানসিক রোগীর মতো হয়ে গেছিলো। আগের মতো ইজহান, আরমান, আয়ানার কেয়ার করতো না সানিয়া। সব সময় দরজা আটকে বসে থাকতো। কখনো ভেসে আসতো দরজা ভেদ করে আর্তনাদ। কিন্তু একদিন সব শেষ হয়ে গেলো। সেদিন ইজহান তাদের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিলো, তার শহরের সেই প্রথম স্থান করে। সেই খবরটি দিবে বলেই ইজহান দৌড়ে আসে, কিন্তু সেদিন যেন ইজহানের পুরো দুনিয়া উল্টে যায়। ভেঙ্গে যায় ইজহানের ছোট মন। মায়ের শুভ্রতায় ভরা মুখটি পুড়ে ছাই হয়ে আছে, শুয়ে আছে সাদা কাপড়ে মুড়ানো খাটিয়ার উপর। ইজহানের ভিতরটা সেদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও এক ফোঁটা চোখের জল বের হয়নি। ইজহান বরাবরই শান্ত চুপচাপ থাকলেও মা ছিলো তার বন্ধুর মতো, স্কুল কলেজে, যা হতো সব বলতো মাকে, এমনকি প্রথম ভালোবাসার কথাটি পর্যন্ত জানিয়েছিলো মাকে। কিন্তু আজ তার মাকে এভাবে দেখে ইজহান বুঝতেই পারছিলো না কি করা উচিত, মস্তিষ্ক যেন একে বারেই অচল হয়ে গেছে তার। ছোট দুটি ভাই বোন ইজহানের কোমড় জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে গেছে, এদের সান্ত্বনা দেয়ার মতো ভাষা ছিলোনা ইজহানের। ঠিক সেই মুহূর্তে তার দাদি হায় হায় করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন,

” এই সব কিছুর দায়ী আজিজুল হক, আর তার স্ত্রী আফিয়া। আল্লাহ কখনো তাদের ক্ষমা করবে না, সুন্দর একটি সংসারকে ধংস করে দিয়েছে এরা। আল্লাহ যেন এদের সঠিক বিচার করেন।”

দাদীর এইটুকুন কথা কানের মাঝে ঘন্টার মতো বেজে উঠলো ইজহানের।মায়ের মৃত্যুতে শ্যামার পরিবার আর নিজের বাবাকে দায়ী করে ইজহান। এই জন্যই তো তার বাবাকে তার মায়ের না মুখ দেখতে দিয়েছে, না খাটিয়া তুলতে দিয়েছে ইজহান। এখনো ইজহানের মনে আছে তার বাবার ব্যবহার তার মায়ের প্রতি। মায়ের শরীরের দাগ গুলোর কথা মনে পড়লে ইজহানের এখন গা শিউরে উঠে। একবার তো ইজহানের বাবা মেহতাব রাগে নিজের বউয়ের শরীরে গরম তেল ছুড়ে মেরেছিলো। দু হাতে মুখ ঢেকে নিয়াতে দু হাত পুড়ে ফোসকা পড়ে যায়। আর তখনি ইজহান দেখে ফেলে, রাগে সেদিন বাবাকে বাসা থেকে বের করে দেয় ইজহান। এর কিছুদিন পরেই তার মা নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়……

ঘটনার কয়েকদিন পরেই ইজহানকে তার দাদি অফিসে বসিয়ে দিয়ে, এবং ইজহান চলচ্চিত্র জগতেও কাজ করতে শুরু করে। তার সাথে তার এইম হয়ে যায় শ্যামার পরিবারের ধংস করে দেয়ার।কিন্তু তার আগেই শ্যামার পরিবার শহর ছেড়ে কোথাও চলে যায়। এবং তারপরই আবার দেখা হয় শ্যামার সাথে, তখন সে জানতে পারে, ইজহানের ভালোবাসার সেই এক ফালি চাঁদ শ্যামা নিজেই। সেদিন যতটা না খুশি হয়েছিলো? তার থেকে রাগ বেশি হয়েছিলো। তাই তো সেদিন দেখা করিনি। তবে শ্যামার পরিবারের খবর ঠিকি নিয়েছে সে, তখনি জানতে পারে শ্যামার বাবা সব হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাই ইজহান তাদের ছেড়ে দেয়। এর কয়েক বছর যখন স্বয়ং স্বীকার শিকারীর কাছে ধরা দেয়? ইজহান সেই সুযোগ আর হাত ছাড়া করে না। লুফে নেয়।………

ইজহান ভাড়ী নিশ্বাস ছাড়লো। চেয়ার ছেড়ে উঠে বেড়িয়ে গেলো তাদের পুরোনো বাড়িটি থেকে….
একরাশ মন ভার নিয়ে চলে আসে বাসায়। হলে ঢুকতেই কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করে ইজহান,

“তোমার ম্যাম কই!”

কাজের মেয়েটি আমতা আমতা করে বলে উঠে,

“স্যার ম্যাম তিন দিন যাবত বাসায় আসে না। ”

ইজহানের কঁপালে চিন্তার ভাজ পরে। পকেট থেকে ফোনটি বের করে, সেদিন শ্যামার সাথে ফোনে কথা বলেই ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলো ইজহান। এবং সবাই চলে গেছিলো তাদের পুরোনো বাড়ি। ইজহান ফোনটি অন করেই অধিরাজকে ফোন করলো ইজহান। ওপাশ থেকে ভেসে এলো অধিরাজের কন্ঠ,

“স্যার আপনি কোথায় ছিলেন এত দিন?”

ইজহান উত্তর দিলো না। উল্লটো জিজ্ঞেস করলো,

” তোমার মেডাম কোথায় খোঁজ নাও তো!”

ওপাশ থেকে সব নিরব। ইজহান বলল,

“অধিরাজ,?”

অধিরাজ গলা পরিস্কার করে বলল,

“স্যার শ্যামা বাবা মারা গেছে।”

ইজহান চুপ করে গেলো। তার এই মুহূর্তে আনন্দ লাগছে, আবার কষ্ট, সে চেয়েছিলো নিজ হাতে লোকটিকে মেরে ফেলতে, কিন্তু তার আগেই….

ইজহান বলল,

“আচ্ছা! ”

বলেই ফোন কেঁটে বেড়িয়ে পড়লো শ্যামাদের বাড়িতে। কিছুক্ষণের মাঝেই পৌঁছে গেলো সে। দরজায় নক করতেই জান্নাত দরজা খুলে দিলো। ইজহানকে দেখে অবাক হলো জান্নাত। ইজহান তার গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“শ্যামা?”

জান্নাত বলল,

“আপু তার রুমে আছে ভাইয়া!”

ইজহান বিনা বাক্য ব্যয় করে শ্যামার রুমের দিকে গেলো। এত দিন পরে শ্যামাকে দেখবে, কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ইজহানের। সে রুমে পা রাখতেই দেখলো শ্যামা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। কারো পায়ের শব্দে শ্যামা তাকালো। ইজহানকে দেখে হেসে বলল,

“মি. ইজহান? আপনার অপেক্ষা ছিলাম। এক মিনিট দাঁড়ান!”

বলেই টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি চেক বের করে ইজহানের হাত দিলো শ্যামা। তার সাথে দিলো একটি পেপার। ইজহান ভ্রু কুচকে ফেললো শ্যামার কাজে। বলল,

“এসব?”

“আপনার দেয়া টাকা, আর ডিভোর্স পেপার। আমি মুক্তি চাই , রক্ষিতা নামটি মুছে ফেলতে চাই, আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স। ”

এমন একটি কথা শুনে ইজহানের পায়ের নিচ থেকে মাটি স্বরে গেলো যেনো। কাগজ দুটি মুঠ করে ধরলো শক্ত করে। মাথার মাঝে বার বার বাজতে লাগলো,

“আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স! ”

চলবে,