আজও_তোমারই_অপেক্ষায় পর্ব-০৪

0
129

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
৪.

অল্প বয়সী মেয়েদের জন্য মধ্যরাতের শেয়াল পেঁচার ডাকের মতো ভয়ানক ডাক আর কোথাও নেই। আর সন্ধ্যায় যদি পথে শেয়াল দেখতে পান তো বুঝে নিবেন সেই রাতে আপনার ঘুম হারাম। গ্রামের মানুষের আবার এসব শেয়াল পেঁচার ভয় নেই। তাদের বাড়ির আঙিনায় শেয়ালরা নাইট পার্টি করলেও আরামে ঘুমাতে পারবে। আমাদের আশেপাশে এমন কিছু শেয়াল নামক প্রাণী আছে যারা রাত বিরাতে মানুষদের জ্বলাতন করে। হিমার কাছে রিপ্তীকে তাই মনে হচ্ছে। মধ্যরাতে তাকে জ্বালাতন করার কোনো মানেই হয় না। তবুও সে জ্বালাচ্ছে, এমন একজনের নাম নিয়ে যার জন্য হিমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে।
হিমা জন্মদিনের উপহারগুলোর মধ্যে একটি উপহার বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সে। সে কোন ক্রমেই এই উপহার রিপ্তীকে দেখাবে না বলে পন করেছে। এদিকে রিপ্তী উঠে পড়ে লেগেছে, এই প্যাকেটে কি আছে তা দেখার জন্য। সে হিমার সাথে জোর জবরদস্তি করে এক প্রকার হাঁপাচ্ছে। সে যখন থেকে দেখেছে প্যাকের উপর উপহার দাতার নামের পাশে মীর ভাই লেখা তখন থেকেই ভেতরে কি আছে তা দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে।
“ হিমা, তুই না আমার প্রাণের সখী! একটিবার দেখতে দে না! প্রমিজ করছি দূর থেকে দেখেই ঘুমিয়ে যাব।”

হিমা মাথা না বোধক ইশারা করে। রিপ্তীর থেকে কিছুটা দূরে সরে উত্তর দেয়, “ একদম না, রাক্ষসী মেয়ে একটা; আমার গিফটের দিকে সারাজীবন নজর দেয়।”

“ আজই তো দেখতে চাইলাম। তাও মীর ভাইয়া গিফটটা। কি সুন্দর লাল রেপিংয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে দেখ, দেখেই লোভ জাগছে।”
“ শেষে কি না ঐ গু’ণ্ডা’র উপর তোর লোভ জাগছে,রিপ্তী? তুই এতো লুচ্চি কবে থেকে হলি রে?”

হিমার স্বভাবের কথা রিপ্তীর অজানা নয়। সেও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, “ তোর হাতের গিফটটা আমাকে দেখা হিমা, নয়তো তোর মীর ভাইকে বলে দিব যে তুই তাকে গু’ণ্ডা ডেকেছিস।”

বিপদে পড়লে ভূতও মানুষকে ভয় পেয়ে যায়। হিমার ইচ্ছে করছে আকাশে উড়াল দিয়ে চলে যেতে যেখানে রিপ্তী নামক লোভী নারী থাকবে না। মুখটাকে বাংলার পাঁচ করে সে রেপিং খুলতে বসে। রিপ্তীর উৎসুক দৃষ্টি হিমার কাছে অসহ্য লাগছে। সে মনের দুঃখে রেপিং খুলে অবাক হয়ে যায়। লাল পাড়যুক্ত সাদা কাতান শাড়ি তার সাথে দুই মুঠো রেশমী কাঁচের চুড়ি, একটি লাল টিপের পাতা ও একটি আলতা। রিপ্তী হা করে দেখছে। সে ভেবেছিল, হয়তো দামী কোন জুয়েলারি হবে অথবা দামী কোন ফোন। এমন সাধারণ উপহার দেখে কিছুটা আশাহত হলো। কিন্তু হিমার সামনে প্রকাশ করলো না বরং হিমার উদ্দেশ্যে বলল, “ শুনেছি লাল রং ভালোবাসার রং। প্রমিক প্রেমিকারা এই রংয়েই নিজেদের রাঙিয়ে তুলতে পছন্দ করে। এসব কি রে হিমা? মীর ভাই কী তোকে ভালোবাসে?”

রিপ্তীর মতো হিমাও অবাক। আলতা হতে নিয়ে তার মনে পড়ে যায় সন্ধ্যায় মীরের বলা কথা। তার মীর ভাই কেন তাকে এসব দিল? মীর তো তাকে সদা জ্বালাতেই থাকে। এটাও তার জ্বালাতন করার একটি অংশ নয়তো! প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলাতে না মিলাতেই রিপ্তী হিমার হাত থেকে আলতা নিয়ে নেয়। টিস্যু কটন হাতে প্রস্তুতি নেয় আলতা দেওয়ার। তা দেখে হিমা ভীষণ রেগে যায়। রিপ্তীর হাত থেকে আলতা কেড়ে নিয়ে বলে, “ খবরদার রিপ্তী, আমার মীর ভাইয়ের দেওয়া একটা জিনিসও তুই ছুঁয়ার সাহস করবি না।”

রিপ্তী ভেঙচি কাটে। কাঁথা বালিশ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। হিমা সেভাবেই কিছু সময় বসে রয়। চুরি গুলো হাতে পরে ঝুনঝুন আওয়াজ করে আপনমনে হেসে বলে, “ এগুলো আমি সবসময় আমার কাছে রাখবো,কখনোই হারাবো না।”

______________________

প্লাটফর্মের পৌঁছাতে পৌঁছাতে কখনোও কি ট্রেন মিস করেছেন? হিমারা অনেকবার করেছে। হিমার গাঢ় ঘুমের কারণে ট্রেন বাস নিজ বাড়িতে কতবার ফিরে গিয়েছে গননা করা যাবে না৷ আশা আরো একঘণ্টা পূর্বে হিমাকে ডেকে গিয়েছে। তাদের ট্রেন সকাল সাতটায়। এখন বাজে ছয়টা পনেরো। আজ তারা ঢাকায় ফিরে যাবে। রাতে শোবার আগে বার বার আশা বলে গিয়েছিল যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। আশা জানে তিন মেয়ে তার কথা শুনেনি। সকালে সাত সকালে উঠে পড়লেও হিমা উঠতে পারেনি। আশা রেগে হিমাকে ডাকে। এক পর্যায়ে ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘুম ভাঙে। আবছা চোখে মাকে রেডি হয়ে দাঁড়াতে দেখেই তার চোখোর ঘুম উড়ে যায়। মুঠোফোন বের করে সময় দেখে বাথরুমে চলে যায়।

হোসনেআরার মন ভীষণ খারাপ। আশা চলে যাবে বলে নয় বরং তার মেয়ে অল্প বয়সে টাক হয়ে যাবে এই চিন্তা করে। সে আশার হাতে জোর করে কিছু টাকা গুঁজে দিয়েছে যেন ঢাকা থেকে ভালো মানের কোন তেল কিনে পাঠায়। আশা টাকা নিতে চায়নি কিন্তু হোসনেআরা নিজের কসম দিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। হোসনেআরা আশার থেকে চার বছরের ছোট কিন্তু বর্তমানে তাকে দেখে আশার বুড়ো মনে হয়। হঠাৎ স্বামী মারা যাওয়ার পর হোসনেআরা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। কয়েকমাস হাসপাতালে ভর্তিও ছিল। তখন থেকেই মাথায় সমস্যা দেখা দেয়।

আজমল হোসেন ছোট বোনকে বিদায় দিতে প্লাটফর্মে আসেন। চোখের পানি মুছে প্রিয় ভাগনির মাথায় হাত রাখেন, “ মায়ের কথা শুনবে, মামা। মা যদি বকা দেয় তাহলে এই মামাকে একটা কল দিবে; তোমার মামা এসে মাকে ইচ্ছামত বকে দিবে।”
“ তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো, মামা? আম্মুর জন্য তুমি কাঁদছো অথচ এখন আমার পক্ষে কথা বলছো? তুমি তো একটা মীর জাফর বের হলে, মামা।”

অযুক্তিযুক্ত প্রশ্ন করাই আমাদের হিমার কাজ। রিপ্তী সহ হিমার পরিবার সকলেই স্তব্ধ। আশা কপাল চাপড়াচ্ছে। হিমার বাবা হিমেল সাহেব টিকিট দেখার বাহানায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই সবকিছু রাদিফ মুঠোফোনে বন্দী করে রাখছে। হিমার কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলে, “ কোন জায়গায় কি বলতে হয়, কবে শিখবি হিমা?”

রাদিফের কথার জবাব না দিয়েই সে রাদিফের ফোনের উপর হামলে পড়ে। গ্যালারিতে ঢুকে নিজের ছবিগুলো দেখে খুব খুশি হয় সে। এক একটা ছবিতে হিমাকে পরী লাগছে। ছবি দেখতে দেখতে সে বলে, “ আমি সব জানি। তুমি এতো সুন্দর ছবি তুলতে জানো, রাদিফ ভাইয়া! আমি দোয়া করে দিলাম, তুমি একদিন মস্ত বড়ো ফটোগ্রাফার হবে।”
হিমার কথায় রাদিফ কিছুটা লজ্জা পায়। সে মাথা চুলকে উত্তর দেয়, “ আবার কবে আসবি, হিমা? তোর ছবি হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দিব?”
“ দিয়ে দিও। আর তুমি এই শুক্রবারের পরের শুক্রবারে ঢাকায় আসবে হ্যাঁ! আমি তোমার ফোনে ছবি তুলবো।”

হিমার সহজ কথায় সরল রাদিফ মাথা নাড়ায়। আফজাল হোসেন ছেলেমেয়েদের মাঝে না থেকে কাউকে ফোন করে। আশা অনেকক্ষণ যাবত তা খেয়াল করে। সে ভাইয়ের কাছে এসে প্রশ্ন করে, “ কি হয়েছে ভাইজান? সব ঠিক আছে? ”

“ মীরকে দুই ঘণ্টা যাবত কল করছি। রিসিভ করছে না। তোদের সাথে ঢাকায় ফিরার কথা। অসভ্য ছেলেটা আজ নিশ্চয়ই ট্রেন মিস করবে।”

মীরের জন্য ভাইয়ের মনে অগাধ ভালবাসা দেখে আশা খুশি হয় সে ভাইকে আশ্বস্ত করে বলে,“ ও ছেলে মানুষ, ট্রেনে না আসলেও বাসে চড়ে আসতে পারবে। তুমি চিন্তা করো না।”

আফজাল হোসেন বোনের কথায় সায় দেয়। আশাদের ট্রেনে চড়িয়ে ঝাপসা চোখে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায়।

———–

ট্রেনের ইঞ্জিন ঝকঝক করে চলছে। ট্রেন ছেড়েছে বিশ মিনিট হয়েছে। হিমাদের সিট খুঁজে পেতে দেরী হয়। কাঙ্খিত সিটে এসে তারা মীরকে বসে থাকতে দেখতে পায়। কানে হেডফোন লাগিয়ে মনের সুখে গান শুনছে সাথে গাইছেও। আশা মীরকে দেখামাত্রই কান মলে দেয়। আকস্মিক আক্রমণের জন্য মীর প্রস্তুত ছিল না। কান থেকে হেডফোন খুলে আর্তনাদ করে ওঠে, “ আহ ফুফু, লাগছে। এত কষ্ট করে তোমাদের জন্য সিট রাখলাম তার এই প্রতিদান দিচ্ছো?”

আশা কাকে রাগ দেখাবে? মীরের কথা শোনামাত্রই রাগ পানি হয়ে যায়। মীর হয়তো যাদু মন্ত্র জানে। আশার মনও পড়তে জানে। মীরের কথায় আশা রাগ দেখিয়ে উত্তর দেয়, “ ভাইজান কতোগুলো কল দিয়েছে দেখেছিস?”

“ আমি রাদিফকে তো বলেই এসেছি। সে তোমাকে কিছু বলেনি? দেখেছো ফুফু! রাদিফ ছেলেটা কতো বেয়াদব?”

আশা হেসে ফেলে। সিটে বসতে বসতে উত্তর দেয়, “ কে বেয়াদব আর কে আদব তা আমি জানি। এখন বল, কেথায় যাবি? আমার সাথে চল, কয়েকদিন থেকে তারপর না হয় বাসায় চলে আসিস।”

হিমাদের সিট একটু পিছনে পড়েছে। মেয়েদের সঙ্গ দিতে হিমেল তাদের সাথে গিয়ে বসতে যাচ্ছে। হিমা মীরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মীরের চেখে চোখ পড়ে। মীরের চোখ হিমাকে যেন কিছু বলছে। হিমা সেই চাহনির উপেক্ষা করে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ে। সে রিপ্তীর কারণে মীরের সাথে রাগ করেছে। নিশ্চয়ই মীর রিপ্তীর সাথে ফুসুরফুসুর করে নয়তো রিপ্তীর মুখে কেন শুধু মীরের নাম থাকবে?

“ তোমার মেয়েটা অনেক হিংসুটে ফুফু। আমাকে তোমার পাশে সহ্য তার হচ্ছে না।”

আশা মীরের কথা উপেক্ষা করে বলে, “ তার আগে বল, তুই আমার মেয়ের পিছনে এত লাগছিস কেন? বিয়ে করবি?”

মীর আাশা একে অপরের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ নীরবে থেকে চোখে চোখে কিছু কথা বলে নেয়। এরপর উচ্চ স্বরে দুজনই হেসে উঠে।
________________

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছাতে আরো এক ঘণ্টা বাকী। সাধারণত লোকাল ট্রেনের বাথরুম ব্যবহার যোগ্য নয়। কিন্তু ভি আই পি ট্রেনে কিছুটা আরামে যাতায়াত করা যায়। প্রাকৃতিক প্রয়োজন সম্পন্ন করে হিমা সিটে আসতেই মীর ও রিপ্তীকে দেখতে পায়। দুজন কি যেন বলাবলি করে হাসছে। রিপ্তী তো পারছে না মীরের কোলে চড়ে বসে যেতে। হিমার এসব দৃশ্য দেখে গা জ্বলে ওঠে। সে মীরের সে একদম সামনের সিটে বসে বলতে শুরু করে, “ বাবা কোথায়?”
“ প্রেম করতে গেছে।”
“ মাকে ছাড়া অন্য মেয়ের দিকে তো তাকায়ই না। তুমি কি বাবাকে অন্য নারীর কাছে পাঠিয়েছো, মীর ভাই?”

মীর আহত দৃষ্টিতে হিমার দিকে তাকায়। সে এসেছিল হিমাকে জ্বালাতে এখন দেখছে সেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। নিজেকে সংযত করে উত্তর দেয়, “ তুই বললেই তো পারিস, নিজেদের বাবা মা কীভাবে রোমান্স করতে জানতে চাস! এতো প্যাচানোর কি আছে রে হিমালয়! ”

হিমার উৎসাহী চোখের মাঝখানে ভাজ পড়ে। সেখানে রাগের আভাস পাওয়া যায়। সে রেগে বলে, “ তোমাকে ভালো বলাই আমার দোষ হয়েছে। তুমি আস্ত একটা নষ্ট লোক।”
মীর হিমার কথায় হাসে। পুনরায় রিপ্তীর দিকে নজর রেখে বলে, “ মন চুরি করেছে কোনো এক রূপকন্যা। যার অভিমান, অভিযোগ সব আমার জন্যই বরাদ্দ থাকে। সেই আমার অভিমানিনী, আমি তার মনের কথা জানতে আজও তারই অপেক্ষায় আছি।”

চলবে ইনশাআল্লাহ………..