আজও_তোমারই_অপেক্ষায় পর্ব-০১

0
240

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
১.

“ ছোট বেলায় মীর ভাইয়া কোলে না তুললে নাকি তুই ভাতই খেতিস না, কথাটা কি সত্যি হিমা?”
বয়ঃসন্ধিতে এসে ছোট বেলার রচনা বললে কি আর সবটা মনে থাকে? খালাতো বোন মারিয়ার অনর্থক কথা শুনে হিমার গা জ্বলে উঠলো। হাতের কাছে ভারী বস্তু থাকলে নিশ্চিত এতক্ষণে মাথা ফাটিয়ে ফেলতো সে! এটা কোন কথা বলার সময় হল! প্রশ্নটা ঠোঁটের আগায় এসেও গিলে ফেলল হিমা। এমনিতেও হিমার চালচলন পরিবারের সকলের চোখে কটু। অতিরিক্ত কথা পেঁচানো হিমার স্বভাব। কাছের মানুষেরা জানলেও দূরবর্তী আত্মীয়রা তো আর জানে না। বেড়াতে আসার আগে হিমার মা আশা পইপই করে নিষেধ করে দিয়েছেন অযথা কথা না বলতে। অথচ, তিনিই এখন পথ খুলে দিচ্ছেন হিমাকে কথা বলার জন্য। খালাতো মামাতো ফুফাতো বোনদের ধরে ধরে নিজের মেয়ের গুনগান গাইছেন। আর তারাও এসে হিমাকে ধরে বেঁধে এইসেই প্রশ্ন করে হিমার চঞ্চলতাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ইদের ছুটিতে হিমার পরিবার আনন্দ নগরে বেড়াতে এসেছে। সম্পর্কে হিমার নানা বাড়ি। এখানে হিমারা থাকবে আরো চার রজনী। আনন্দ নগরের উত্তর দশায় হিমাদের যাওয়া বারণ। কেননা সেখানে মঈনুদ্দিন মীর এবং তার শীর্ষরা থাকে। মারিয়ার কাছে বলতে শুনেছে, উত্তরের ভিটায় মীর নাকি ছেলেপেলেদের নিয়ে আড্ডা দেয়। আড্ডা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও হতো! বিদেশি মা’লও সেবন করে। কান কথাই মূল কথা, কথাটা হিমা মনে প্রাণে মানে। এজন্যই সে মীরকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। মঈনুদ্দিন মীর হিমার মামার প্রয়াত বন্ধুর ছেলে। বন্ধুর মৃত্যুর পর মামা নিজেই মীরের দায়িত্ব নেন এবং পড়াশোনা করান। বর্তমানে পুরান ঢাকায় বসবাস করলেও ছুটির সময়ে আনন্দনগরে বন্ধুদের নিয়ে চলে আসে। হিয়ার নানা বাড়িতে তার চেয়ে বেশি মীরের দাপট চলে। এ নিয়েও হিয়ার মনে কম হিংসা হয় না। তবে তা মুখে কখনো প্রকাশ করে না।

বাড়ির আঙিনায় সবাই মাদুর বিছিয়ে গল্প করছে। সেই সময়েই মীরের আগমন ঘটে। ধপাস করে এসে হিয়ার সামনে বসে বলে, “বুঝলি হিমালয়! আমাকে ভালবাসতে বুকের পাঠা লাগে পাঠা! যার তার সাথে এই মীর সম্পর্ক জড়াবে না। শুনেছি তোর বাড়ির আশেপাশে অনেক প্রজাপতিরা উড়ে বেড়ায়! তা তাদের এই মীরের ছবি দেখিয়েছিস তো! বলেছিস, তোর মীর ভাইয়ের মতো সুদর্শন পুরুষ পুরো আনন্দনগরে একটাও নাই!”

“ পাঠা তো কুচকুচে কালা, কিন্তু মীর ভাই তুমি তো ভেড়ার চামড়ার মতো সাদা। তোমার বুকের পশমও তো নাই। পাঠা আসলো কোথায় থেকে?”

“ আরে গাধীর নানি! লম্বাতে ঠিকই ফুফুকে ছাড়িয়ে নিয়েছিস। তোর বুদ্ধি আসলে হাঁটুর নিচেই। এই পাঠা সেই পাঠা নয়! এই পাঠা মানে হল সাহস!”

“ তা বুঝলাম, কিন্তু আমার হাঁটু তো ঢাকাই থাকে। বুদ্ধি অত নিচে নামলো কীভাবে!”

“ এই তোর ইন্জিনিয়ার বাপ কী যন্ত্রের সাথে তাঁর ব্লেন্ডার করে খাইয়ে তোকে মানুষ করেছে রে! কথা এত পেঁচাস ক্যান? এই ফুফু, ছোট বেলায় আমাকে দুধ ডিম খাওয়ার জন্য বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মারতে। তা তোমার মেয়েকে কি খাইয়েছো শুনি?”

আশা পানের খিলিটা মাত্রই মুখে পুরছিল। মীরের কথা শুনে ব্যাঙ্গ করে প্রত্ত্যুত্তর দেয়,“ তুই দুধ ডিম কীভাবে খেতিস। সবাইকে সেই গল্পটা শোনাবো?”

“ ক্ষ্যামা করো মা! ক্ষ্যামা করো আমায়। তোমার আর তোমার মেয়ের পিছনে আর কখনো লাগব না বলে দিলাম। এই আমি চল্লাম।”

“ কিন্তু আমি তো জানতে চাই মীর ভাই! মা সবসময় তোমার মত হতে বলে। তোমার পা ধুয়ে পানি খেতে বলে। সেটা তো আর খাওয়া যাবে না, তুমি বরং দুধ ডিম একসাথে খাওয়ার পদ্ধতিটা বলে দাও। যেন আমিও তোমার মত আক্কেলওয়ালা হতে পারি।”

হিমার বোকা কথায় আশা আশাহত দৃষ্টিতে মীরের দিকে তাকায়। দুজনেই তাৎক্ষণিক চোখে চোখে ইশারায় কিছু কথা বলে নেয়। যার মর্মার্থ হল এই, ‘ এই গাঁধী কি সত্যিই তোমার মেয়ে? জন্মের আগে কি খাইছিলা ফুফু যে এমন আক্কেল হীনা হয়েছে?’
‘ আমি তো বাদাম দুধ বেশি বেশিই খাইছিলাম। ছোট ছেলে তো ঠিকই আছে। বড়োটা বাবার মত হয়েছে।’

চোখের খেলা হিমা না বুঝলেও নীরবতায় কিছুটা বিরক্ত হয়। ঘরে যেতে যেতে মীরের উদ্দেশ্যে বলে যায়, “ বেশি কথা না বলে সাদা পাঠা খুঁজে নিয়ে আসো মীর ভাই! তোমার বুকের পশম গজাতে হবে তো!”

মেয়ের কথায় আশা খিলখিল করে হেসে পান মুখে দেয়। এদিকে মীর হতভম্ব হয়ে পশমহীনা বুকে নজর দিয়ে বলে, “ পশমহীনা বুক নিয়ে তোর এত চিন্তা কেন হিমা?”

____________________________

খোলা জানালা। দখিনা বাতাসে মন প্রাণ দোলা খাচ্ছে। সতেজ গাছপালা হিয়াকে ডেকে যেন বলছে, ‘ আয় তো একটিবার! ছুয়ে দিয়ে যা তোর পায়ের পরশ; সবুজের আস্তানায়!”

আনন্দ নগরে বেড়াতে আসলেও হিয়ার জন্য একটি কামরা বরাদ্দ থাকে এবং সে সেই কামরাকে নিজের মত সাজিয়ে রাখে। প্রবেশদ্বারে বড়ো বড়ো অক্ষরে সতর্কবাণী লেখা “ভেতরে প্রবেশ নিষেধ।” হিয়ার স্বভাবের জন্যই মূলত আশা নিজেই লিখে রেখেছে। পাড়া পড়শীর ভাইবোনেরা আসলে কথার ছন্দে যদি হিয়ার চাঞ্চল্যতা প্রকাশ পায়! এই ভয়ে।

“বাহার সে কেয়া বাত! আন্দার সে ইয়ে বাত!”

সাদা কুর্তির সাথে সিলভার রঙের গহনা পরিধান করে চোখে মোটা করে কাজল দিচ্ছিল হিমা। মীরের কথায় হাত ফসকে কাজল নিচে পড়ে যায়। এদিকে মীর জানালার প্রান্তে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে।

“ আন্দার বাহারের ব্যপারটা বুঝলাম না মীর ভাই। তুমি কি হিন্দির উপরে মাস্টার্স করতে চাইছো নাকি?”

“ হিন্দি আবার শিখতে হয় নাকি হিমালয়! স্টার প্লাস এবং কালারসের রেগুলার দর্শকরা এমনিতেই হিন্দি ভাষায় পটু হয়ে যায়।”

“ কিন্তু আমি তো স্টার ওয়ান দেখে শিখেছি। তুমি কোন সিরিয়ালের কথা বলছো?”

“ দরজায় হুমকি ওয়ালা ধমক আর ভিতরে করা হচ্ছিলো রঙ্গলীলা চমক। আমি এই সিরিয়ালের কথা বলছি। যাইহোক একজন ছেলের সামনে এভাবে থাকতে লজ্জা করছে না? তুই ওড়না বিহীন কি করছিস হিমা?”

কথার ছলে হিমা নিজের অবস্থার কথা ভুলে গিয়েছিল। ঝটপট ওড়না গায়ে দিয়ে নতজানু হয়ে বলে,“ আমি কি জানতাম তুমি দুষ্ট লোকেদের মত জানালায় উঁকি দিবে?”

হিমার কথায় মীরের কাশি উঠে গেল। পিচ্ছি বাচ্চা মেয়েটা এভাবে যে মীরকে সামনাসামনি লজ্জা দিয়ে ফেলবে ভাবতে পারেনি। নিজেকে কিছুটা সংযত করে সে বলে, “ ছোট হয়ে বড়োদের মুখের উপর কথা বলছিস? ফুপি তোকে এই শিক্ষা দিয়েছে?”
“ শিক্ষা তো অনেক কিছুই দিয়েছে। তোমার সামনে কোনটা পেশ করব!”

মীর চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে নেয়। হিমার স্বাভাবের ব্যাপারটা সে ভুলেই গিয়েছিল।
“ বলছিলাম কি! তোর হাতে পায়ে তো পশমে ভরপুর। বুকেও কি! এজন্যই কি বিপরীত মানুষের বুকের পশম চাইছিস?”

হিমা নির্বাক। পিটপিট চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মীরের কথার মর্মার্থ বুঝার চেষ্টা করেছে। পরিশেষে বুঝতে পেরে জানালার কাছে এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠে সে, “ মীর ভাই! তুমি এই কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছো? তোমার লজ্জা শরম কিছুই কি নাই? নাকি বোতলওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিয়েছো! যাও এখান থেকে। আমি আম্মুকে সব বলে দিব।”

শক্ত জমিনে পড়ে মীর ভালোই ব্যাথা পেয়েছে। হাতের কনুইয়ে ঘসতে ঘষতে উত্তর দেয়,“ তুই তো আমায় গোলকধাঁধায় রেখে এসেছিলি! এখন আমি জানতে চাইলেই দোষ!”

মীরের কোন কথা না শুনেই হিমা জানালা আটকে দেয়।
আাধাঘণ্টা পর হিমা দ্বর খুলে বাহিরে বের হতেই দেখতে পায় তার মামা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। পাড়া প্রতিবেশীর কিছু ছেলেপেলেরা কাউকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হিমা সামনে এগিয়ে মানুষটাকে দেখামাত্রই চিৎকার করে বলে,“ ইয়া আল্লাহ! আমি বলেছি বলে, হাত পায়ের চামড়া ছিলে ভেড়ার পশম লাগিয়েছ মীর ভাই?”

চলবে……….