আঠারো বছর বয়স পর্ব-১০

0
3955

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০

বিভোরকে সবার আগে দেখতে পেলো নিরব। চেয়ার ছেড়ে ওঠে এসে হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনি বিভোর? রাইট?’

খুশি হবার ভান করে বলল,

‘ জ্বি। কিন্তু আপনি?’

‘ আমি রাতুলের বন্ধু।’

‘ ওহহ। আমাকে চিনলেন কী করে?’

‘ ছবিতে দেখেছি, ইভা আপনার অনেক গল্পও শেয়ার করেছে। তাই চিনতে অসুবিধে হয়নি।’

‘ ওহহ! আপনি ওকে চিনেন?’

বিভোর রুহির দিকে ইশারা করলো। নিরব বলল,

‘ নাহ, পরিচিত হলাম এখুনি। ইভার বোন।’

বিভোর মনে মনে ভাবে দু’মিনিটের দেখায় কেউ কারো সাথে কীভাবে হাসাহাসি করতে পারে। যেন কতোদিনের পরিচয়। রুহিও ওদেরকে দেখছে। বিভোরকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। অতি দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এলো। আসার সময় শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে যেতে নিয়েছিলো, সেসময় নিরব এসে রুহিকে ধরলো। সাহায্যের বদৌলতে ধন্যবাদ জানিয়ে রুহি চলে গেলো, নিরবও। বিভোরের ছাদে একা আর ভালো লাগছেনা, তাই নিচে নেমে এলো।

কাজি এলো সাড়ে পাঁচটায়। দেখতে দেখতে ইভার বিয়েও শেষ হয়ে গেলো। মেয়েটা খুব খুশি। বিদায়ের সময় কেঁদে দিলো একদম। রুহি হেসে বললো,

‘ কাঁদছো কেন? তোমার শ্বশুরবাড়ি এখান থেকে পাঁচ মিনিটের পথ!’

‘ কাঁদবো না? তোদের ছেড়ে থাকতে হবে!’

‘ না কাঁদবে না। আমরা তো আছিই। তোমাকে দেখে আসবো প্রতিদিন।’

‘ আম্মুর খেয়াল রাখিস বোন।’

‘ অবশ্যই। সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা কর‍তে হবেনা।’

‘ নিজের খেয়াল রাখিস।’

‘ তুমিও।’

নাদিরা ইসলাম কাঁদছেন, বিভোরের মা, ইভা এমনকি রুহিও কাঁদছে। কান্নাকাটির শব্দে বিরক্ত হয়ে গেলো বিভোর। এখানে কান্নার কি আছে? মেয়েদের সবকিছুতে কান্না জিনিসটা না থাকলে যেনো ষোলোকলা পূর্ণ হয়না। এতো এতো মানুষের ভিড়ে একদম চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে ডাক্তারবাবু।

ইভাকে বিদায় করে মেহমানরাও একে একে চলে গেলো। কাল বাদে পরশু রিসেপশন। নাদিরা ইসলাম পইপই করে সবাইকে আসতে বলে দিলেন। নাসিমা চৌধুরী বোনের বাসায় ক’দিন কাটাবেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একেবারে একা হয়ে গেছেন নাদিরা। রুহি ছাড়া আর কেউ রইলো না। অবশ্য রুহির বিয়ে হয়ে গেলে কিভাবে থাকবে সেটাও একটা চিন্তার বিষয়।

বিভোর এতোক্ষণে একটা ফাঁকা রুম পেলো। ঘরে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো মাথা চেপে। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গায়ে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। এর কারণ, ওই নিরব ছেলেটা যাবার সময় রুহির সাথে কিসব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিলো, আবার ওর সেলফোনের নাম্বারও নিয়েছে। ওরা দুজন কি প্রেম করবে? ভাবতেই রাগে ফেটে পড়লো ওর শরীর। দরজায় টোকা পড়েছে। বিরক্ত হয়ে দরজা খুললো বিভোর। রুহি হাতে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ আপনার জন্য খাবার নিয়ে এলাম।’

‘ আমিতো খাবার চাইনি।’

‘ আপনার আম্মু পাঠিয়েছে।’

গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করলো,

‘ তুমি নিয়ে এলে কেন?’

‘ আপনার আম্মুর কথা ফেলতে পারিনি। ছেলে না খেয়ে আছে তাই পাঠিয়েছে।’

‘ আমি খাবো না।’

‘ সেটা আপনার ব্যাপার। পৌঁছে দেওয়া দায়িত্ব ছিলো, দিয়ে গেলাম।’

‘ তুমি খুব বড় হয়ে গেছো তাইনা?’

‘ সবসময় তো আর ছোট থাকা যায়না। সময়, পরিস্থিতি বড় বানিয়ে দিতে বাধ্য করেছে।’

বিভোর চুপ করে রইলো। মেয়েটা চটাং চটাং কথা বলা শিখেছে। রুহি ট্রে’টা টেবিলে রেখে পুরো ঘরটা ঝেড়েমুছে দিলো। জানালা খুলে দিলো। ফরফর করে উত্তুরে হাওয়ারা ঢুকে পড়লো ঘরে। বিভোর মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে অনেক মায়াবী লাগছে।

‘ রুহি।’

‘ বলুন।’

‘ তুমি কি আমাকে এড়িয়ে চলছো?’

‘ জানিনা।’

বলেই রুহি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বিয়েবাড়িতে অনেক কাজ, সবকিছু শেষ করলো নাদিরা ইসলাম, নাসিমা চৌধুরী আর রুহি। বাড়তি খাবারগুলো আত্মীয়দের বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। কাজ করতে করতে প্রায় দশটা বেজে গেলো। রুহি গোসল করে বারান্দায় গিয়ে বসলো। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত, রাতে খাবার খেতেও ইচ্ছে করেনি। এদিকে পুরো সন্ধ্যাটা বিভোর ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, ফ্রেশ ঘুম।

ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এলেই দেখতে পায় বিপরীত দিকের বারান্দায় রুহি বসে আছে। বারবার চোখ মুছছে। কাঁদছে নাকি রুহি? কেন? কান্নার মতো কি হলো? বিভোর কি হলো জানেনা, হঠাৎ করেই রুহিকে জোরে ডাক দিলো। হকচকিয়ে উঠলো রুহি।

‘ হেই রক্তজবা, তুমি কি কাঁদছো?’

বিভোরের গলা শুনেই পায়ের রক্ত মাথায় চড়লো রুহির। শান্তিতে বসে কাঁদতেও দেবেনা। ঘরে ঢুকে শব্দ করে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলো। বিভোর ব্যক্কল বনে গেলো।

প্রথম দেখায় বিভোরকে যেমন মনে হয়েছিলো লোকটা আসলে তেমন নয়। অদ্ভুত, মেয়েদের মন বোঝার ক্ষমতা কম। সবসময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে। নিজের জীবন নিয়ে সিরিয়াস নয়। সংক্ষেপে এটাই বিভোর। এর বেশিকিছু ভাবতে পারছেনা রুহি। কিন্তু তাই বলে তো বিয়েটা ছেলেখেলা নয়,রুহি যখন মানতে পেরেছে তখন ওর মানতে সমস্যা কোথায়? একবার তো রুহির ইচ্ছের কথাটা জানতে চাইলো না, নিজের দিকটাই দেখলো। তাহলে রুহি কেন কাঁদবে পাষাণ লোকটার জন্য?

ফোন অন করতেই দেখলো ম্যাসেঞ্জারে কেউ নক করেছে। অপরিচিত আইডি। রুহি ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো এটা ওই রাতুলের বন্ধু নিরব। রুহি রিপ্লাই করতেই সেকেন্ডের মাঝে নিরবের ম্যাসেজ আসলো।

‘ হ্যালো রুহি?’

‘ জি ভাইয়া।’

‘ কি করো?’

‘ কিছুনা। আপনি?’

‘ এইতো তোমার সাথে চ্যাট করছি।’

‘ ওহহ! আপনি আমার আইডি পেলেন কোথায়?’

‘ রাতুলের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি।’

রুহি কিছু লিখলো না। মানেটা কি? যে সে এসে ওর আইডি চাইবে আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করে দিয়ে দেবে। মানে কমনসেন্সের অভাব আছে নাকি। এই নিরবটাকে যে কিভাবে সহ্য করছে তা শুধু রুহিই জানে। দেখতে অভদ্র নয়, কিন্তু হাবভাবে বোঝা যায় রুহির প্রতি ইন্টারেস্টেড। কিছু বলতেও পারেনা রুহি। ইভা আর রাতুল দুজনেরই খুব ক্লোজ নিরব। খারাপ ব্যবহার করতে চেয়েও পারছেনা। এমন সময়ই নিরব লিখলো,

‘ তোমাকে আজকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো।’

ব্যস। পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো রুহির। সাথে সাথে ফোন বন্ধ করে রেখে দিলো। এই বিভোরটাকে দেখার পর থেকেই রুহি কেমন খিটখিটে মেজাজের হয়ে গিয়েছে। তার উপর আবার এই নিরব উল্লুক যুক্ত হয়েছে। ওদিকে ইশতিয়াকের কি হলো কে জানে, সামনে পেলে এবার উচিৎ শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে।একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো রুহি।

সকালবেলা ডাইনিং টেবিলে ওই ডাক্তার শয়তানটার মুখোমুখি পড়তে হলো রুহির। কি সুন্দর আয়েশ করে কফি খাচ্ছে দেখো। মগের ভেতর চুবিয়ে মারতে ইচ্ছে হচ্ছে। নাদিরা ইসলাম রুহিকে খাবারের প্রতি উদাসীন দেখে বললেন,

‘ তুই খাচ্ছিস না কেন?’

‘ খাই।’

নাদিরা ইসলাম ধমক দিয়ে বললেন,

‘ দিনদিন কি হাল করছিস চেহারার?’

‘ খাচ্ছি তো।’

‘ এদিকওদিক তাকিয়ে কি দেখছিস? খাবারের প্রতি মনোযোগ নেই তোর।’

‘ তা না! আসলে পেট ভরে গিয়েছে।’

নাদিরা আকাশ থেকে পড়ে যাওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল,

‘ কি বলছিস রুহি? দু’ চামচ খেয়ে তোর পেট ভরেছে। আমাকে বোকা ভাবিস তুই? এক্ষুনি খা, পুরো সব্জিটা শেষ না করলে তোর কি হাল করি দেখিস।’

নাসিমা চৌধুরীও খাওয়ার জন্য রুহিকে জোড়াজুড়ি করলো। বাধ্য হয়ে খাচ্ছে রুহি, মুখে অসহায় ভঙ্গি। দৃষ্টি এড়ালো না বিভোরের।

বাবর খান পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিতে দিতে রুহিকে বললেন,

‘ জানো মা, খাবার হলো দুনিয়ার সবকিছু। খেলে লাভ, না খেলে লস। যতো পারো খেয়ে মোটাতাজা হও। যা সামনে পাবে গপগপিয়ে খাবে।’

বিভোর বাবার এসব কথায় প্রচন্ড বিরক্ত হয়। বলল,

‘ খাবার পরিমিত খেতে হয় বুঝলে আব্বু। অবশ্য তোমাকে বলে কি লাভ? দিনে এক হাঁড়ি মিষ্টি আর কষা মাংস ছাড়া তোমার পেট তো চলেই না।’

খোঁটা খেয়ে বাবর চৌধুরী রেগে গেলেন। বললেন,

‘ তোর সংসারে আমি হয়েছি নাকি আমার সংসারে তুই? বাপের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাই জানিস না আবার ডাক্তারগিরি ফলাতে আসছিস। বেয়াদব, এক থাপ্পড়ে তোর দাঁত ফালিয়ে গরুর খাদ্য বানাবো। অসভ্য!’

বিভোর রুহির দিকে তাকিয়ে দেখলো মিটিমিটি হাসছে। মানসম্মানের চৌদ্দটা বাজাতে এক্সপার্ট বাবর চৌধুরী। জোর গলায় বলল,

‘ পরিশেষে এই ডাক্তারের কাছেই তো আসতে হয়। পেটব্যথা, হাই প্রেসার সব নিয়েই তো আসো।’

‘ জানি জানি। গরুর ডাক্তারও তোর থেকে ভালো চিকিৎসা করাতে পারে। ইডিয়ট। তোর মতো চামচিকা আমার পুত্র আমি ভাবতেও পারিনা। কই বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করবি, আমরা নাতিপুতির সাথে খেলবো তা না, গরুগিরি ফলাতে আসে।’

মুখচোখ লাল হয়ে গেলো বিভোরের। নাদিরা, নাসিমা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন। রুহিও মুখ টিপে হাসছে। রাগ করে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো বিভোর। পেটে ক্ষিধে নিয়েই হসপিটালে রওয়ানা হলো। নাসিমা চৌধুরী অনেক করে বুঝালেন, ডাকলেন তাও খেলো না। সবার মুখ কালো হয়ে গেলো। বাবর চৌধুরী বললেন,

‘ যেতে দাও। খাবার না খেয়ে থাকতে পারে নাকি, ঠিকই আসবে।’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!