#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২
একরাশ অস্বস্তি নিয়ে কেবিনের দরজায় নক করলো রুহি, কোনো সাড়াশব্দ নেই। অস্বচ্ছ কাচের দরজার ওপাশটাতে বিভোর আছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। রুহি দরজা ঠেলে ঢুকতেই শীতলতা গ্রাস করলো ওকে। সদ্য গরম আবহাওয়া থেকে আসা রুহি কেঁপে উঠলো। একী! এসির হাওয়ায় তো পুরো ঘর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। টেবিলের ওপাশের চেয়ারে ক্লান্ত ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ডাক্তারবাবু। শার্টের বোতাম বুকের ওপর পর্যন্ত খোলা। কি আয়েশের ঘুম!
রুহি কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। খাবারগুলো টেবিলের উপর রেখে আস্তে করে বিভোরকে ডাকলো। লোকটা নড়ছেও না।
‘ এই যে, শুনছেন?’
বিভোরের চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে গেলো নাকি! ব্যস্ত গলায় আবারও ডাকলো।
‘ এই যে ডাক্তারবাবু, শুনছেন? আহা, উঠুন না!’
মেয়েলি গলা শুনে হকচকিয়ে উঠলো বিভোর। মুখের উপর ঝুঁকে থাকা মেয়েলি অবয়ব দেখে দ্রুত সরে গেলো। ধাতস্থ হয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো রুহি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
‘ তুমি?’
‘ জি আমি।’
‘ সিরিয়াসলি তুমি আমার সামনে আছো? নাকি স্বপ্ন দেখছি?’
‘ আরে বাবা, আমিই আছি।’
বিভোর বলল,
‘ কোনো দরকারে?’
‘ জি।’
‘ কী?’
‘ আপনার মা আপনার জন্য খাবার পাঠিয়েছে।’
সকালের কথা মনে হতেই চোখমুখ কঠিন করে বলল,
‘ আমিতো খাবার পাঠাতে বলিনি।’
‘ কিন্তু আপনার মা পাঠিয়েছে তো!’
‘ নিয়ে যাও। আমি খাবো না।’
‘ দেখুন আন্টি অনেক কান্নাকাটি করেছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নিজেই আসতে চাচ্ছিলো, আমি বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে এসেছি। ওনি খুব করে বলে দিয়েছেন আপনি খেলে তবেই যেন আমি বাড়ি ফিরি। তাই প্লিজ এসব ড্রামা বন্ধ করে খেয়ে নিন।’
বিভোর চটে গেলো।
‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’
‘ আই মিন টু সে আপনি ড্রামাবাজ।’
রুহির গলায় কোনো অস্বস্তি নেই, খুব সাহস নিয়েই বলেছে বোঝা যাচ্ছে। বিভোর প্রথমে রাগ করলেও পরে ভাবলো বউয়েরা একটু রাগটাগ করতেই পারে। আর ইনি তো এখন রেগে ককটেল হয়ে আছেন। যেকোনো সময় শব্দ করে ফেটে পড়বে।
‘ তোমার এসব বাজে কথা বন্ধ করো।’
‘ জি করেছি। এখন খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।’
‘ বললাম তো খাবো না।’
‘ আপনার আম্মুকে আমি প্রমিজ করে এসেছি।’
‘ সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। আমিতো বলিনি প্রমিজ করতে, তাই এর দায়ও আমার নয়। গট ইট!’
রুহির কপালে ভাঁজ পড়লো। লোকটা ঘাড়ত্যাড়া। এখন কি করবে? বিভোর আড়চোখে ওকে দেখছে। দৈবাৎ একগুচ্ছ হাওয়া ভেসে আসলো জানালার ফাঁক দিয়ে। রুহি বিরক্ত ভঙ্গিতে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
‘ আপনার এসিটা প্লিজ বন্ধ করুন। বাইরে হাওয়া দিচ্ছে।’
বাধ্য ছেলের মতো বিভোর এসিটা বন্ধ করে জানালা খুলে দিলো। রুহি অনুরোধ করে বলল,
‘ খেয়ে নিন না প্লিজ!’
‘ খুব তাড়া আছে দেখছি।’
‘ জি আছে। আমার তো আপনার মতো চাকরি নেই, ঘুরাঘুরি করবো।’
বিভোর আগ্রহ বোধ করলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘ একা একাই? আমি কী সঙ্গে যেতে পারি?’
‘ না। আমি আমার ফ্রেন্ডদের নিয়ে যাবো।’
‘ কেমন ফ্রেন্ড?’
‘ আপনার সঙ্গে শেয়ার করার ইচ্ছে নেই। তাই চুপ থাকুন আর খেয়ে নিন।’
বিভোর রেগে গেলো। মেয়েটার ইগনোর আর নিতে পারছেনা৷ এর জন্য ওকে শাস্তি পেতে হবে। বিভোর মনে মনে ফন্দি আঁটলো। গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
‘ আমি খাবো, কজ একটা শর্ত আছে।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘ কী?’
‘ আগে বলো রাজি?’
‘ আগে শুনি। তারপর ভাববো।’
‘ আমাকে খাইয়ে দিতে হবে।’
রুহি আকাশ থেকে পড়লো। মানে কী এসবের? ও কেন এতো বড় দামড়া ছেলেকে খাইয়ে দেবে? বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরেছে। রুহিকে একা পেয়ে এখন নাটক শুরু করেছে, আজব! দেখো শয়তানটা আবার মিটমিটিয়ে হাসছে। বিভোরের বাবা ঠিকই বলে, চাপকিয়ে ডাক্তারের পিঠের ছাল তুলে নেওয়া উচিৎ। বিভোর ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ সম্পূর্ণ ব্যাপারটা তোমার ওপর নির্ভর করছে। তুমি যদি খাইয়ে দিতে চাও ভালো, রাজি না থাকলে আম্মুকে গিয়ে বলে দেবে আমি খাইনি, সঙ্গে এটাও বলবে যে তোমার কারণে আমি খালি পেটে আছি। তুমি আমাকে খাইয়ে দিতে রাজি হওনি তাই আমি খাইনি। ওকে?’
‘ দেখুন এসব কিন্তু ঠিক নয়।’
বিভোর অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘ কীসব?’
রুহি রাগী স্বরে বলল,
‘ এই যে আপনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন।’
‘ লাইক সিরিয়াসলি, আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করছি রক্তজবা? কীভাবে এটা বলতে পারছো তুমি?’
‘ আপনি জোর করে আমাকে খাইয়ে দিতে বলছেন।’
‘ মোটেও না। আমিতো অপশন দিয়েছি তোমাকে। তোমার যেটা খুশি করো।’
‘ আমি কিছুই করবো না।’
বিভোর চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
‘ ওকে। তুমি এখন যাও। আমাকে এখন পুরো হসপিটালে চক্কর দিতে হবে, মেডিক্যালে যেতে হবে। বাই চান্স আমি যদি মাথা ঘুরে পড়ে যাই, তার দায় একমাত্র তোমার।’
রুহি প্যাঁচার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। জানালার ধারে বসে আছে কুচকুচে কালো রঙের একটা কোকিল। মাঝেমধ্যে শব্দ করে ডেকে উঠছে। গলার স্বর ভারী মিষ্টি। কালো কোকিলটা ড্যাবড্যাব করে বর-বউয়ের কান্ডকারখানা দেখায় ব্যস্ত। যেন বোঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে এখানে! বিভোর রুহির মুখ দেখে বুঝতে পারছে মেয়েটা ভারী বিপদে পড়েছে। ভেতরে ভেতরে হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে ও। কিন্তু চেহারায় কাঠিন্য বজায় রেখে বলল,
‘ যাচ্ছি আমি।’
‘ দাঁড়ান!’
পিছন থেকে ডেকে উঠলো রুহি। ওর দিকে না তাকিয়েই বিভোরের মুখে হাসি এসে গেলো। খুব কষ্টে সেটাকে গোপন করে গম্ভীর ভাব নিয়ে রুহির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কী?’
‘ আপনি বসুন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি!’
মেয়েটাকে আচ্ছামতো জব্দ করা গিয়েছে। কি ইগো দেখাচ্ছিলো বিভোরের সাথে, সব ল্যাটা চুকেবুকে গেলো এক নিমিষেই। এতো সুন্দর, মায়াবী, অসাধারণ মনের অধিকারিণীকে নিজের বউ ভাবতে সত্যিই ভালো লাগছে বিভোরের। খাবার খাওয়ার সময় রুহির অস্বস্তি খুব করে টের পাচ্ছিলো বিভোর। ওর দিকে তাকাচ্ছিলোই না। সুযোগ বুঝে হঠাৎ করে রুহির আঙ্গুলে কামড় দিয়ে বসলো বিভোর। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো রুহি। আর্তনাদ করে বলল,
‘ এটা আপনি কী করলেন?’
‘ ডাক্তাররা খুব স্পাইসি হয়-তো, তাই এক-আধটু কামড় দিয়ে ফেলে মাঝেমাঝে।’
‘ আপনি কী কুকুর?’
‘ নো নেভার!’
‘ নিজেকে কী মনে করেন আপনি? সবাই আপনার কথা মতোই চলবে। অসহ্য!’
‘ চলতেই হবে। কেউ আমার মনমতো না চললে তাকে কামড়িয়ে খেয়ে ফেলবো!’
‘ এটা আপনার ব্যাড হেবিট।’
বিভোর ভ্রু-কুটি করে জোর গলায় বলল,
‘ কথা না বলে খাইয়ে দাও তো। বলা যায় না, কখন আবার মাথা ঘুরে পড়ে যাই।’
রুহি এক লোকমা পোলাও মুখে তুলে দিলো। ইচ্ছে করেই বিভোর রুহির আঙ্গুলে ঠোঁট ছোঁয়ালো। দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো রুহি। ডাক্তার শয়তানটা আজ এরকম করছে কেন, আজব! খেতে খেতেই বিভোর বলল,
‘ আজকের খাবারটা দারুণ সুস্বাদু। অবশ্য তোমার হাতে খাচ্ছি বলেই বোধহয় বেশি স্বাদ লাগছে। এক কাহ করো, এখন থেকে তুমি আমাকে খাইয়ে দেবে। ওকে?’
দাঁত কিড়মিড় করে রুহি বলল,
‘ কখনোই না।’
বিভোর আর কিছু বললো না। প্রথম দিন ছিলো তাই ডোজটা কম দিয়েছে। পরবর্তীতে বাড়ানো যাবে। রুহি রাগে ফুঁসছে। মেয়েটা চিরকালই নিরীহ প্রকৃতির। নিরীহ মেয়েরা রাগলে দেখতে খুব কিউট লাগে। এই যেমন, রুহির গালগুলো জবা ফুলের ন্যায় লাল হয়ে আছে। বিভোরের ইচ্ছে করছে গাল দুটো টেনে দিতে। রুহিকে নিয়ে একসাথে বাড়ি ফিরলো বিভোর। কোথাও যেতে দিলোনা। ব্ল্যাকমেইল করেছে একপ্রকার। লোকটার নতুন নতুন রুপ দেখে রুহির অবাক হওয়া ছাড়া আর কোনোকিছু করার থাকলো না। কাউকে কিছু বলতেও পারলোনা। আর কী-ই বা বলতো!
রাতের খাবার শেষে সবাই যখন টিভিতে মগ্ন ছিলো তখন পাশাপাশি সোফায় বসে থাকা বিভোর রুহির হাত চেপে ধরে বসে রইলো। সারা শরীর কেঁপে উঠলো রুহির। এটার রেশ না কাটতেই বিভোর রুহির কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ আজ রাতে আমরা এক ঘরে ঘুমাবো, কেমন?’
চলবে…ইনশাআল্লাহ!