#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২০
রাতটা এভাবেই কেটে গেলো। সকালবেলা কড়া রোদের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকছিলো। রুহির চোখে সে আলো লাগতেই ধরফড়িয়ে উঠে বসলো। তাকিয়ে দেখলো ওর কোলে বিভোরের মাথা হলেও পা দুটো চিৎপটাং অবস্থায় এদিক-ওদিক রাখা।মনে হচ্ছে কোনো সঙ বুঝি সার্কাস দেখাচ্ছে। রুহি হাসি চাপাতে পারছিলোনা। বিভোরের মাথাটা ডিভানে রেখে অতি সাবধানে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ঠিক করে শুইয়ে দিলো। মনে হচ্ছে ড্রিংকসের প্রভাব এখনো কাটেনি। রুহি ওয়াশরুম খুঁজে ফ্রেশ হয়ে নিলো। পেটে ক্ষিধেয় ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। আশ্চর্য, কোনোদিন তো এতো ক্ষিধে পায়নি। কিন্তু এখন খাবেটা কী?
রান্নাঘর খুঁজতে খুঁজতে দেখলো করিডোরের ওপাশে ছোট্ট একটা রান্নাঘর আছে। ফ্রিজ খুলে দেখলো তাতে কয়েকটা ডিম, আলু, বেগুন মশলাপাতি পড়ে আছে। রুহি সেগুলো নামিয়ে নিলো। চা’য়ের পাতাও পেলো একটা বক্সে। তড়িঘড়ি করে চুলাতে আগুন দিয়ে চা বসালো। অন্য একটা কড়াইয়ে ডিম ভাজলো। কিন্তু ভাত? কোথায় পাবে চাল! রান্নাঘর যেহেতু কোথাও না কোথাও চাল তো পাওয়া যাবে ভেবে রুহি খুঁজাখুঁজি করে চালও পেয়ে গেলো। তারপর মনোযোগ দিয়ে ভাত রান্না করে, ডিম আর বেগুন ভাজা রেডি করে ডাইনিংয়ে নিয়ে রাখলো। বিভোরকে কীভাবে চমকানো যায় ভেবে একটা বুদ্ধি আঁটলো।
চা-নাস্তা নিয়ে রুহি বিভোরের রুমে ঢুকলো। ইতস্তত করে আস্তে করে ডাকলো,
‘শুনছেন?’
বিভোর ঘুমে মগ্ন। কপাল ঘেমে আছে। রুহি আলতো করে ওড়ানার কোণা দিয়ে মুছে দিয়ে আবারও ডাকল্প,
‘ডাক্তারবাবু, আহা উঠুন না। আর কত ঘুমাবেন? এবার তো একটু ক্ষান্ত হোন।’
ঘুমের মধ্যেই মেয়েলি গলার বকবক শুনে বিভোর চোখ খুলে তাকালো। ঘোলাটে দৃষ্টি গিয়ে আটকালো টকটকে লাল গালের অধিকারীনির চোখে। রক্তজবা! সে ডাকছিলো নাকি এতোক্ষণ? বিভোর ধীরে ধীরে উঠে বসলো। ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘ডাকছিলে?’
রুহি বিরস মুখে বলল,
‘হুম। নেশা করে যেভাবে ঘুমিয়েছেন, না ডাকলে বোধহয় আজ সারাদিন ঘুমিয়েই কাটাতেন।’
‘চুপ।’
‘আচ্ছা। চা-টা খেয়ে নিন।’
বিভোর অবাক হয়ে বলল,
‘তুমি বানিয়েছো?’
‘হ্যাঁ! অবাক হওয়ার কী আছে?’
‘না এমনিই।’
বিভোর চায়ের কাপে চুমুক দিলো। মাথা ভার হয়ে আছে, গা ম্যাজম্যাজ করছে। রুহি বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি রান্না করেছি। একসাথে খাবো।’
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রুহির আচরণগুলো অস্বাভাবিক। রাতের বেশিরভাগ কথাই বিভোরের মনে নেই। চিন্তিতমুখে চা খেয়ে বিভোর ডাইনিংয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো তার রক্তজবা থালাবাসন রেডি করছে। বিভোর মুচকি হাসলো। তারপর চুপচাপ ফ্রেশ হতে গেলো। রুহি কী ওকে আর মেনেই নিবেনা? অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে? বিভোরের ভালোবাসা বুঝবেনা! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। ভালোবাসা বোধহয় অসংখ্য উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসের সমন্বয়ে আবিষ্কৃত একটা ধোঁয়াশা।
খাবার টেবিলে বিভোর আবারও চমকিত হলো। কারণ রুহি নিজ হাতে ওকে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। এতো স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গি রুহির, যে বিভোরের মনে হচ্ছে দুজনে অনেক পুরোনো সংসারী। কিন্তু তা নয়। একপর্যায়ে বিভোরের হিঁচকি উঠে গেলো। রুহি তড়িঘড়ি করে পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এতো কী ভাবেন খাওয়ার সময়?’
‘কিছুনা।’
‘মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই। আপনার চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে আপনি চিন্তিত!’
বিভোর কিছু বললোনা। পরবর্তী লোকমা তুলে দিলো রুহি ওর মুখে। তারপর দেখতে লাগলো স্বামী নামক এই মানুষটাকে। তাঁর অল্প বয়সের আবেগ, প্রেম, ভালোবাসা সবকিছু ঘিরে আছে এই লোকটাকে ঘিরে। ভালোবাসা কী সেটা যখন বুঝতে শিখেছিলো তখন থেকেই এই মানুষটা ওর হৃদয়ের সমস্ত জায়গাটা দখল করে আছে। আজ পর্যন্ত কোনো নড়চড় হয়নি।
রুহিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিভোর থতমত খেয়ে বলল,
‘আমি কী দেখতে বেশি সুন্দর?’
ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে রুহি ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,
‘সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা।’
‘তুমিও সুন্দর।’
‘জানি। তবে আমি ছ্যাছড়া নই।’
‘যেমন?’
‘আপনি জান্নাহ নামক মহিলার প্রেমে পড়েছেন, যেটা আমি করিনি কোনো পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে!’
বিভোর গম্ভীর গলায় বলল,
‘এই টপিক বাদ দাও। আমার মাথা ধরে যায়।’
‘আচ্ছা। খেয়ে নিন।’
‘তুমি খেয়েছো?’
‘জ্বি।’
বিভোর প্রশ্ন করলো,
‘রক্তজবা তুমি জানো, তোমার বিয়ের কথাবার্তা কার সাথে চলছে।’
এমন প্রশ্ন শোনার জন্য রুহি প্রস্তুত ছিলোনা। অবাক হয়ে বলল,
‘না তো।’
‘নিরবের সাথে।’
রুহির মুখটা ”হা” হয়ে গেলো।
‘নিরব মানে? নিরব ভাই? ইভা আপুদের ফ্রেন্ড?’
‘হুম।’
রুহি ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। বলল,
‘ওনার কী খেয়েদেয়ে কাজ নেই? আমি তো ওনাকে বড় ভাইয়ের মতো দেখি।’
‘সে দেখেনা। এটা আমি প্রথম দেখেই বুঝেছি।’
‘ছাই বুঝেছেন।’
বিভোর গম্ভীর গলায় বলল,
‘এখন কী করবে?’
‘রিফিউজ।’
বিভোরের মনটা কেমন যেন নেচে উঠলো। ওকে আরও একদফা অবাক করে দিয়ে রুহি বলল,
‘আপনি ওনাকে জানিয়ে দিয়েন আমি আপনার বউ। তাহলে আর সামনে এগুবেনা। বউকে বাঁচাতে এই কাজটা তো করতেই পারেন। তাইনা?’
বিভোরের চোখজোড়া যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দুইগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো। রুহি আজ ওকে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করে ছাড়াবে। মেয়েটা এতো রহস্য করছে কেন? কাল রাতেই বলল নিজেকে বিভোরের বউ ভাবতে চায়না, লজ্জ্বা হয়৷ আর আজ হুট করেই নিজেকে ওর বউয়ের পরিচয় দিয়ে দিলো। মেয়েটার কী কোনো মানসিক সমস্যা আছে নাকি? এতো তাড়াতাড়ি একটা মানুষ পরিবর্তন হয়ে যায় নাকি! দেখো আবার কীভাবে হাসছে। আহা, মেয়েটা মনে হচ্ছে এবার ওকে সত্যিই হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মেরে ফেলবে। বিভোর বুকের বাঁ-পাশে হাত রেখে রুহির দিকে তাকালো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘সত্যি? এটাই বলবো?’
‘অফকোর্স।’
______
রুহি অসময়ে বাসায় ফেরায় নাদিরা একটু অবাকই হলেন। রুহি মাঝেমাঝেই তার অফিস মেয়ে কলিগ বা ফ্রেন্ডদের বাসায় রাত কাটায়। এই নিয়ে প্রশ্ন করাটা নাদিরা পছন্দ করেন না। কিন্তু বেলা বারোটায় রুহি অফিসেই থাকে। আজ বাসায় চলে এসেছে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে রে মা? শরীর খারাপ?’
রুহি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘নাহ।’
‘অফিস নেই?’
‘আছে। যাইনি।’
‘ওহহ।’
রুহি বলল,
‘নিরব ভাই নাকি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?’
নাদিরা বললেন,
‘হ্যাঁ। কাল এসেছিলো ওদের ফ্যামিলির লোকজন। তুই না করে দিলি তাই আমি আর কথা বাড়াইনি। তাও খুব করে অনুরোধ করে গিয়েছে যেন তোর সাথে একটু কথা বলি।’
‘কীসের কথা?’
‘তুই আরেকবার ভেবে দেখ।’
রুহি সরাসরি নাদিরাকে জানিয়ে দিলো এখানে ভাবার কিছু নেই। নিরবকে ও বড় ভাইয়ের মতো দেখে। একটু ফ্রেন্ডলি কথাবার্তা বললেই যে কাউকে বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। নাদিরা আর কথা বাড়ালোনা। রুহিকে নিজের মেয়ের চেয়ে কম কিছু ভাবেনা। তাহলে কেন নিজের সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিবে! যদিও নাদিরা চেয়েছিলো রুহি এ বিয়েতে রাজি হোক। নিরব ছেলেটা দেখতে-শুনতে ভালোই। চাকরিটাও ভালো। রুহিকে নিজে থেকে পছন্দ করেছে। তবে যা হয় সেটা ভালোর জন্যই হয়।
সারাদিন এভাবেই কেটে গেলো। রাতেরবেলা ঘুমুতে যাওয়ার সময় রুহির ফোন বেজে উঠলো। বিরক্ত হয়ে রুহি ফোনটা রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে বলছেন?’
‘আমি।’
‘কে আমি?’
‘শিট ম্যান। আমি বিভোর।’
রুহি ধমক শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। পরমুহূর্তেই রেগে বলল,
‘পাগল নাকি। এভাবে কেউ ধমকি দেয়?’
বিভোর বলল,
‘তুমি আমাকে চিনতে পারলেনা কেন?’
‘আমিতো কখনো আপনার সাথে ফোনে কথা বলিনি। তাহলে বুঝবো কীভাবে এটা আপনি? আর আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’
বিভোর ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
‘এ যুগে এটা কোনো ব্যাপারই নয়।’
রুহি প্রশ্ন করলো,
‘কীজন্যে ফোন দিয়েছেন?’
‘কী করছো?’
‘এতোরাতে এটা জানার জন্য ফোন দিয়েছেন? রাখুন তো! যত্তসব বিরক্তিকর।’
রুহি ফোন কেটে দিলো। মানে কী এসবের! বিভোর চটে গেলো। মেয়েটা তো আচ্ছা ত্যাড়া। রেগেমেগে বিভোর ফোন দিতেই থাকলো। বারবার ফোন বেজে উঠায় বিরক্ত হয়ে রুহি ফোনটাই অফ করে দিলো। ভালো করে কথা না বলে এসব ন্যাকামি কথাবার্তা আর ফোনে বকবক করাটা রুহির মোটেও পছন্দ নয়। তারপর শুয়ে পড়লো কাথামুড়ি দিয়ে। রুহি ঠিক করেছে বিভোরের সাথে এবার চুটিয়ে প্রেম করবে। ওকে তাক লাগিয়ে দেবে। তবে ফোনে কোনো প্রেমালাপ করা যাবেনা। হুট করে, যখন-তখন বিভোরের হসপিটালে গিয়ে চমকে দেবে। বিয়ে? সেটা না হয় পরে দেখা যাবে!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!