আঠারো বছর বয়স পর্ব-২২

0
4258

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২২

রুহির একটু অস্বস্তি লাগছিলো। বিভোর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় অবাকই হয়েছে। অফিস ফেলে এই ভরদুপুরে কেন এসেছে মেয়েটা? ওর এই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পাত্তা না দিয়ে রুহি বলল,

‘ভেতরে আসতে বলছেন না কেন? দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি?’

বিভোর থতমত খেয়ে বলল,

‘হ্যাঁ..হ্যাঁ আসো। ভেতরে আসো।’

রুহি একটা হাসি দিয়ে ভেতরে আসলো। বিভোর জিজ্ঞেস করলো,

‘কেন এসেছো?’

‘দরকারে।’

‘আমার কাছে কীসের দরকার?’

‘আপনি এতো প্রশ্ন কেন করুন বলুনতো। চুপ থাকন।’

হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এমন একটা ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্য করে বিভোর বলল,

‘সেদিন রাতে ফোনটা কেন কেটে দিলে?’

‘তাহলে কী করতাম? আপনার আজগুবি প্রশ্ন শুনতাম?’

‘তা নয়, তবুও ভদ্রতা দেখানো উচিৎ ছিলো।’

‘আমি ভদ্র নই৷ সেটা দেখাতেও পারিনা।’

‘আজব তো!’

‘আপনি কী এখন বিজি? কোনো কাজ বা ওটি আছে? এপয়েনমেন্ট আছে?’

‘না তো। কেন?’

‘এমনি।’

বিভোর হতাশ হয়ে বলল,

‘বাই দ্যা ওয়ে, কেন এসেছো?’

‘আপনার সাথে লাঞ্চ করতে।’

বিভোর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মতলব কী মেয়ের? সেদিনের পর থেকে অন্যরকম আচরণ করছে। অদ্ভুত!

রুহির মধ্যে আজ কোনো জড়তা নেই। সে খাবার বেড়ে দিলো। সময় নিয়ে দুজনে লাঞ্চ সারলো। সবকিছু গুছিয়ে ঘড়ির দিকে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। রুহির অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখান থেকে যেতে অনেকটা সময় লাগবে। ধুর এখানে আসাই উচিৎ হয়নি। ভালোবাসা দেখাতে গিয়েছিলো। এখন বুঝ ঠ্যালা। এজন্যই বলে, অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালোনা।

রুহি ক্ষোভ নিয়ে বিভোরের উদ্দেশ্য বলল,

‘সব আপনার জন্য।’

‘আমি কী বলেছি এখানে আসতে? নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে খুবই মজা লাগে, তাইনা?’

‘এখন আমার চাকরিটা যাবে।’

‘একদিনের জন্য কিছু হবেনা।’

রুহি তেজ নিয়ে বলল,

‘নিজে ডাক্তার বলেই এত বড়াই দেখাচ্ছে। আমিতো ডাক্তার না। অন্যের অফিসে কলুর বলদের মতো খাটি। আপনার বাবা ঠিকই বলে। আপনি গরুর ডাক্তার হওয়ারও যোগ্যতা রাখেন না।’

বিভোর আশ্চর্য হয়ে গেলো। নিজে সময়মতো যেতে পারেনি এখন ওর দোষ? এজন্যই সবাই বলে মেয়েমানুষ মানেই ঝামেলা। যেখানে যায় ঝামেলা বাঁধায়। সময়ের ব্যাপারে একদম পার্টিকুলার নয় তারা।
রুহিকে বলল,

‘এসব বাদ দাও। আরেকটু বসো।’

‘কেন?’

‘অনেকদিন বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি।’

‘তাই আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চান? তাইনা?’

‘ইন্টিলিজেন্ট গার্ল। খুব বড় হয়ে গিয়েছো দেখছি!’

রুহি আফসোসের মতো একটা ভঙ্গি করে বলল,

‘বড় তো হয়েছিই। সেই কবে বিয়ে হয়েছে আমার। ছোট তো আর থাকা যায়না।’

বিভোর মজা করে বলল,

‘ট্রেনে তোমাকে দেখে আমি “আপনি আপনি” করছিলাম তোমায়, মনে আছে?’

‘হুম। আপনি কী এখনো সবার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে যান?’

বিভোর শক্ত গলায় বলল,

‘না। মজার ব্যাপার কি জানো, ওই ঘটনার পর আমি আর কখনো টেনে চড়িনি। বলতে গেলে সেই সুযোগ হয়নি।’

‘তাই নাকি। বেশ তো!’

এরকম টুকটাক আরও কথা হলো ওদের। তারপর বিভোরের অফিস আওয়ার আবার শুরু হলো,এবার রাউন্ডে যেতে হবে। রুহিকে কেবিনে বসতে বললো। ওকে রেখে পেশেন্টদের দেখতে গেলো, প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আধঘন্টা পরই আবার ফিরে এলো। দেখলো রুহি থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছে?’

‘কিছুনা।’

‘আচ্ছা বসো। আমাকে একটা কাজ সারতে হবে।’

বলেই ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। রুহি ওকে আর ডিস্টার্ব করলোনা। অফিসটা মিস হওয়ায় খারাপই লাগছে। ম্যানেজারের কাছ থেকে কথা শুনতে হবে। বেশি পাকনামির এ-ই উপযুক্ত শাস্তি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুহি বাইরে দৃষ্টি মেললো। তখন চারদিকে কমলা রঙের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। মিষ্টি রোদে আকাশখানি তার বুকে ঢেলে দিয়েছে বিশাল বিশাল মেঘকুঞ্জ। ওখানে একটা মেঘবাড়ি থাকলে কেমন হতো? সবকিছু খুব চমৎকার লাগছে। আচ্ছা, বিভোর কোথায় যাবে রুহিকে নিয়ে!

থমথমে নীরবতা চারদিকে। শুভ্র সাদা মেঘেরা দুলছে, উড়ছে আসমানে। কোথা থেকে যেন দল বেঁধে উড়ে আসে সাদা বকের দল। হসপিটালের বিশাল বড় কাচের জানালার ওপাশটাতে আবাসিক এলাকা। সেখানে বিশাল একটা বাগান আর মাঝারি আকারের জঙ্গল আছে। দুপুরের শেষভাগ আর বিকেলের শুরুতে হাজার হাজার পাখিরা দল বেঁধে এখানে আসে। কিচিরমিচির শব্দে ভরিয়ে দেয় পুরো এলাকাটা। নিরব-নিরিবিলি পরিবেশটাতে এলেই মন ভালো হয়ে যায়।

শুভ্র সাদা মেঘ, সাদা বকের দল, পাখিদের হুল্লোড়, বাতাসে কেমন শরৎ শরৎ গন্ধ। রুহি বিভোরকে জিজ্ঞেস করলো,

‘এখন কী শরৎকাল?’

‘তাইতো মনে হচ্ছে!’

‘আপনি ওই কবিতাটা জানেন?’

‘কোনটা?’

রুহি কবিতার প্রথম লাইনটা বলতেই বিভোর মাথা নাড়িয়ে বললো আমি জানি। অনেকবার পড়া হয়েছে।

তারপর নিজেই কবিতাটা আওড়ালো,
‘শুভ্রতার প্রতীক ভাদ্র ও আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল,
নেই বর্ষার বিষন্নতা শুধু স্নিগ্ধতা প্রকৃতি শান্ত নির্মল।
সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে শুভ্র কাশের আঁচল উড়িয়ে,
শরৎ আসে প্রকৃতি হাসে শেফালিফুলের মালা দুলিয়ে।’

পরের পঙক্তি ধরলো রুহি,

‘নীল আকাশে চলছে ভেসে সাদা মেঘের ভেলা,
আপন মনে মেঘের সনে করছে লুকচুরি খেলা।
এমন পরিবেশে ঝিরঝির বাতাসে দোলে কাশবন,
প্রকৃতির ছন্দে শিউলি ফুলের গন্ধে ভরে যায় মন।’

এবার বিভোর বললো,

‘ঝিলমিলি রোদ শান্ত শরৎ স্নিগ্ধ রূপে প্রশান্তি আনে,
মন মাতোয়ারা ধবধবে রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার টানে।
সাদা কাশফুল শিউলি বকুল জ্যোৎস্না আলোছায়ায়,
নদীর তীরে বনের প্রান্ত জুড়ে অপরূপ শোভা ছড়ায়।’

রুহি বিমোহিত হয়ে শেষ পঙক্তিটা আবৃত্তি করলো,

সোনালী আলোয় মেঘের জড়াজড়ি মৃদুমন্দ বাতাসে,
চিরসবুজ মাঠে প্রকৃতি হেসে ওঠে মুকুল ধানের শীষে।
চারপাশের শুভ্রতা বৃষ্টির ফোঁটায় ভেজায় ফুলের রেণু,
দিগন্তজুড়ে আঁকা সাতরঙা হাসিমাখা ফুটে ওঠে রংধনু।

কবিতা আবৃত্তি শেষ হতেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। বিভোর অনুমতি দিলো ভেতরে আসার জন্য। সিস্টার কিয়ারা এসেছে। রুহির দিকে তাকিয়ে ওনি মিষ্টি করে হাসলো। প্রতুত্তরে রুহিও হাসলো। বিভোরের সাথে পেসক্রিপশন আর কিছু ফাইল নিয়ে কথাবার্তা বলে চলে গেলেন। রুহি মনোযোগ দিয়ে কিয়ারাকে লক্ষ্য করলো। কি সুন্দর করে শাড়ি পরেছে ওনি। মধ্যবয়সী মহিলা, কিন্তু রুপে অনন্য। গুণেও কম নয়। পেশেন্টদেরকে নিজের বাড়ির লোক মনে করে। আনন্দের সহিত সেবা প্রদান করে। আশ্চর্যের ব্যাপার এত বয়স হবার পরেও বিয়ে করেননি। ওনি খৃষ্টধর্মের অনুসারী। বিভোর ওনাকে খুব সম্মানের চোখে দেখে।

ল্যাপটপের কাজ শেষ করে বিভোর রুহির দিকে তাকালো। টকটকে কমলা বিকেলে রক্তজবাকে হলদে পরী মনে হচ্ছে। মেয়েটা আশ্চর্য মায়াবতী। আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখছে ও? বিভোর কবি কালিদাসের বিখ্যাত পঙক্তি আওড়ালো।

‘প্রিয়তমা আমার, ঐ চেয়ে দেখ
নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’

সব কাজ শেষ করে রুহিকে নিয়ে বেরুতে বেরুতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো। ওরা একটা পার্কে এসেছে। নরম ঘাসের ওপর বসতেই কোথা থেকে মিষ্টি এক সুগন্ধ ভেসে এলো। এক-আধটু কথা হলো ওদের। হঠাৎই রুহি চুপ করে গেলো। তারপর দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। লেকের পানিতে অস্তমান সূর্যের শেষ আলোর ছটা হাজারো কিরণমালা সৃষ্টি করছিলো। সেদিকে তাকিয়ে বিভোরের জানতে ইচ্ছে হলো রুহি ওকে ভালোবাসে কিনা?

রুহির হাতে হাত রাখলো বিভোর। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। রুহি ওকে যদি না করে দেয়, তাহলে? কিন্তু এতকিছুই বা করছে কেন? কাউকে না ভালোবাসলে এতকিছু করার মানে হয়না। কিন্তু বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া উচিৎ। রুহির উত্তর যদি না হয়, তাহলে আর কখনোই ওর সামনে আসবেনা বিভোর। অনেকটা কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘Can’t you love me?’

বিভোরের কথায় খুব বেশি অবাক হলোনা রুহি। আস্তে করে হাসলো। রুহির হাতটা ছেড়ে দিলো বিভোর। ভাবলো, রক্তজবা ওকে ক্ষমা করেনি এখনো। নাহ, আর বোধহয় ওদের এক হওয়া হলোনা। কিন্তু তারপরই! গোধূলির লালচে আকাশের উদাসী রঙের খেলা দেখতে দেখতে যখন নীরবতা জেঁকে ধরলো, শরৎের মেঘেরা স্বপ্নলোক তৈরি করেছিলো দূর আকাশে তখনই রুহির মনে হলো আজ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিৎ। শরৎ মানেই প্রেম, শরৎ মানেই মুগ্ধতা। রুহি বিভোরের পানে মুগ্ধতা নিয়ে তাকালো। তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

‘Of course love goes.’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!