#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৫
একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। এখন আকাশ পরিষ্কার। কেমন ভিজে মাটির গন্ধ আসছে। কোথা থেকে দুটো ভিজে টুনটুনি এসে বসেছে বারান্দায়। একজন আরেকজনের গায়ে ঠুকাঠোকি করছে। বাগানবিলাস গাছটা নেতিয়ে আছে। রুহি এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। নাদিরার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। প্রেশার ফল করেছে। রুহি জোর করে একটু ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছে। এই মহিলাটিকে সে মায়ের মতো ভালোবাসে। কোনোভাবেই চায়না মায়ের মতো সেও হারিয়ে যাক। এই বাসায় চার বছর ধরে আছে রুহি। অথচ নাদিরা বা ইভা কেউ-ই ওকে বুঝতে দেয়নি সে পর। এতোটা ভালোবাসে ওরা রুহিকে। ইভাকে ফোন করেছে রুহি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে। মায়ের শরীর ভালো নেই শুনে চিন্তায় পড়ে গিয়েছে বেচারি। রাতুল আসলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। চায়ের কাপে চুমু দিতে দিতে রুহির মনে পড়ে বিষন্ন আর ভয়ানক অতীতের কথা। আজকাল জানেনা রুহি ওর সাথে কি হচ্ছে, আগের মতোই হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। সবকিছুতে হারানোর ভয়, উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা। মনে হয় ওর সাজানোর এই পৃথিবীটা কোনো একদিন আবারও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
চার বছর আগে। অনন্যা আর ইভা একই ভার্সিটিতে পড়তো। কীভাবে কীভাবে যেন ওরা হয়ে যায় প্রাণের বান্ধবী। সেই সুবাদেই মাঝেমাঝে অনন্যার ফ্ল্যাটে যেতো ইভা। সেখানেই রুহির সাথে ইভার পরিচয়। তিনজন মিলে ঘুরতো,এটা-সেটা করতো। এক্সিডেন্টের দিন ওরা তিনজন মিলেই শপিংয়ে গিয়েছিলো। ফেরার পথে রুহি ইভার সাথে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলো। সামনে থেকে আসা বাসটা ওর চোখে পড়েনি। পেছনে অনন্যা ছিলো। ইভা বাস দেখে রুহিকে টান দিতে যাবার আগেই অনন্যা পেছন থেকে ওদের দুজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। দুজন দুদিকে ছিঁটকে পড়ে। রুহি পড়ে রডের উপর। ইভা একটা রিকশার সাথে বারি খায়। হাত-পা ছিলে যায় কিন্তু খুব বেশি লাগেনি। জ্ঞান ফেরার পরে যখন রুহি অনন্যার মৃত্যুর খবরটা সহজভাবে নিতে পারেনি। যখন রুহির আর কোথাও যাওয়ার জায়গা রইলোনা তখন ইভা ওর পাশে দাঁড়ায়। ছোট একটা সার্জারির মাধ্যমে রুহির পায়ে আঙুল কেটে ফেলা হয়। এই পুরোটা সময় বড় বোনের মতো রুহিকে সামলিয়েছে ইভা আর ওর মা। নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। অনন্যার মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে অনেক সময় লেগেছে রুহির। পুরো একটা বছর শকে ছিলো। মাঝরাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠতো। রক্ত দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যেতো। রান্নাঘরে যেতে পারতোনা, আগুন দেখলেই মুখচোখ লাল হয়ে যেতো৷ পড়াশোনায় মনোযোগ ছিলোনা। শুধু দেখতো অনন্যা ওর পাশে বসে আছে, তাকিয়ে আছে আর খিলখিল করে হাসছে। মেয়েটা খুব সুন্দরী ছিলো। স্বপ্নে রুহির সাথে কথা বলতো। রুহি একপর্যায়ে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিনরাত নিজেকে আটকে রাখতো। কাঁদতো খুব। প্রচুর হ্যালুসিলেশন ওকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছিলো। অসংখ্য ফোবিয়ায় ভুগতো। এই ভয়ংকর সিচুয়েশন থেকে ইভা ওকে বের করে এনেছে। ডাক্তারদের নির্দেশনা মতো সবকিছু করেছে। যেখানে যাবার দরকার, যা দরকার সব করেছে। কতশত ডাক্তার দেখিয়েছে বলার বাইরে। কোনো আপনজনও বোধহয় এতোটা করেনা কারোর জন্য। দীর্ঘ একটা বছর পরে রুহি স্বাভাবিক হলো। পুরো জার্নিটাতে নাদিরা সবসময় ইভাকে সাপোর্ট করেছিলো। নাহলে আজ রুহি কোথায় থাকতো ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। হয় রাস্তায় নাহয় পাগলখানায়! ভাগ্যবতী বলেই সবসময় সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে রুহি। সবাই ওকে সাহায্য করে, জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো বিভোর, অনন্যা আর ইভাকে পাশে পেয়েছে। একেকটা জীবন-মরণ সমস্যা থেকে বের করে এনেছে এরা তিনজন, বিভিন্ন সময়ে। এদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা রুহির কোনোদিনও হবেনা। শহরের সব মানুষেরা খারাপ বা অকৃতজ্ঞ নয়। রুহি এখন সেটা বুঝতে পারে প্রবলভাবে।
অতীতের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুলো রুহির। ওর এমন এলোমেলো জীবনে সদ্য ফোঁটা পদ্মের মতো আবারও ঢু মেরেছে বিভোর নামক মানুষটি। এই কথাগুলো যখন বিভোরকে জানিয়েছিলো তখন অদ্ভুত এক আর্তনাদ ওর চোখে টের পেয়েছে রুহি। বাইরে কিছু প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে নিদারুণ পুড়েছে সেটা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। কতোটা ডেস্পারেট হয়ে আছে এখন বিভোর! এক বুক ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে নতুন একটা পৃথিবী গড়ে দিবে সে রুহিকে। অল্প হাসলো রুহি। বেচারা না জানি কতোটা অসহায় অবস্থায় আছে। বাবা-মাকে কীভাবে জানাবে এসব? আর ওনারা রুহিকে মানবে তো? ভাবনার প্রহর কাটিয়ে উঠতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। ইভারা এসেছে বোধহয়। পড়ন্ত বিকেলের রোদে চায়ের কাপটা রেখে উঠলো রুহি। চমৎকার শেষবিকেলের দৃশ্য। বাগানবিলাসীরা যেন হাওয়ার সাথে পাঞ্জা লড়ছে। চারপাশে কেমন নীরব-নিস্তব্ধ আর উৎফুল্ল। প্রাণের সঞ্চার করেছে বৃষ্টিরা প্রকৃতিতে। জল-ফড়িংয়ের দলেরা উড়ুউড়ি করছে। সোনাবরণ রোদ্দুরে ঝকমক করছে পুরো পৃথিবী! রুহির বারবার কেমন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ‘এতো সুন্দর হওয়ার কোনো দরকার ছিলো পৃথিবী?’
_____
এই নিয়ে চার গ্লাস পানি শেষ করলো বিভোর। নাসিমা চৌধুরী এবার বিরক্ত হয়ে ছেলেকে ধমক লাগালেন। তিনি বুঝতেই পারছেন না বিভোর এতোটা নার্ভাস হয়ে আছে কেন!
বিভোর নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই পারছেনা। কীভাবে বলবে যে সে বিবাহিত? বাবা তো নির্ঘাত ওকে কথা শুনাবে। মনে হচ্ছে এই কথাটা বাবাকে বলার চেয়ে ডাক্তারির পড়া করা ভীষণ সহজ। নাসিমা আর বাবর চৌধুরী পুত্রের মুখের দিকে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে। কি বলতে চায় বিভোর? এতো ইতস্তত করার মানে কী?
মুখচোখ রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে বিভোরের। ও একটু বেশিই ফর্সা। যার দরুন লজ্জ্বা বা অতিরিক্ত টেনশনে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করে। নাসিমা চৌধুরী ওর এই অবস্থা দেখে উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে বাবা তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?’
মিনমিন করে বিভোর বলল,
‘না আম্মু।’
‘তাহলে চেহারার এই অবস্থা কেন? কিছু খাওনি নাকি দুপুরে?’
‘না না খেয়েছি। একচুয়েলি আজ খুব গরম তো, তাই এরকম লাগছে।’
বাবর চৌধুরী মা-ছেলের কথার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে বললেন,
‘শুনো, আমি তোমার বাবা। চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সিরিয়াস কোনো কথা বলতে চাও। তাই ঝটপট বলে ফেলো আর নিজেকে সামলাও।’
বিভোর নতমুখে বলল,
‘আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা শুনলে তুমি নিজেকেই সামলাতে পারবেনা আব্বু।’
‘তবুও শুনি কী বলতে চাও!’
বলতে গিয়ে আবার আটকালো বিভোর। কণ্ঠনালী যেন কেউ চেপে ধরে রেখেছে। আওয়াজই বেরুতে চাচ্ছেনা। বিভোর আরও একগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো। তারপর ধীরেসুস্থে বসলো। নাসিমা সন্দেহী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছেন। বিভোর শান্ত গলায় বাবর চৌধুরীর উদ্দেশ্য বলল,
‘কথাটা কিন্তু ভীষণ সিরিয়াস। তোমরা প্রচুর শকড হবে। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ!’
বাবর চৌধুরী তাচ্ছিল্য করে বললেন,
‘হুম। মানলাম ভীষণ সিরিয়াস।’
‘আমাকে কিন্তু ভুল বুঝবেনা।’
দাঁতে দাঁত চেপে বাবর চৌধুরী বলল,
‘বলো এবার।’
‘আব্বু তুমি আমাকে বিয়ে দিতে চাও, তাইনা?’
বাবর চৌধুরীর চোখদুটো চকচক করে ওঠলো। তিনি উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন,
‘অবশ্যই চাই। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করার কী আছে? প্রতিটা বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে স্যাটেল দেখতে চায়। তোমার তো অনেক বয়স হলো, সেই কবে থেকে বলছি বিয়ে কর, বিয়ে কর। আমার কোনো কথাকেই তো পাত্তা দাওনি!’
বিভোর অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকালো। বলল,
‘আমি এবার বিয়ে করতে চাই।’
নাসিমা অবাক হয়ে বললেন,
‘ভালো তো। কিন্তু ডিসিশনটা কী আমাদের জোড়াজুড়িতে নিয়েছো? নাকি নিজের ইচ্ছায়? শুনো, জোড় করে কিন্তু কিছু হয়না। বিয়ের পরে তুমি কিন্তু টালবাহানা করতে পারবেনা। তাই যা সিদ্ধান্ত নেবার তা ভেবেচিন্তে নাও।’
বাবর চৌধুরীও কঠিন চেহারায় নাসিমার কথায় সায় জানালেন। ওনি একটু হতভম্বই হয়েছেন। যে ছেলেকে বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিয়ে করানোর জন্য তিনি কলুর বলদের মতো ঘানি টানছে সেই বিভোর নিজ থেকে আজ বিয়ের কথা বলছে। স্ট্রেঞ্জ! নাসিমা ছোটছোট চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একঘেয়ে, বিরক্তকর এবং একইসাথে ভয়ংকর কয়েকটা মুহূর্ত পার হবার পরে নিস্তব্ধতা ভেঙে বিভোর মৃদু কাঁপা গলায় বলল,
‘আমার বিয়ে করে ফেলেছি আব্বু।’
নাসিমা এবং বাবর চৌধুরী দুজনেই চমকে উঠলো। প্রায় একসাথেই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘কী বলছো তুমি বিভোর?’
বিভোর কথাটা বলে একটা প্রশান্তির হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। আসল কথাটা বলেছে, এবার সেকেন্ড টপিক অর্থাৎ রক্তজবার কথাটা বলতে পারলেই ওর বুক থেকে একটা পাথর নেমে যাবে। বলল,
‘হুম আব্বু। পিওর সত্য কথা বলছি আমি।’
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৬
বিভোরের কাছ থেকে এই কথা শুনতে হবে তা কখনো ভাবেনি বাবর চৌধুরী। তার একটাই ছেলে। কত স্বপ্ন ছিলো ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দেবে, কিন্তু কিছু হলোনা। ওনার বিশ্বাস আর ভরসার মর্যাদা দিলোনা? ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে এতোটাই পর হয়ে যায় নাকি বাবা-মা? তাদের মতামতের কোনোই কি মূল্য নেই? মাথা ধরে আসছে নাসিমা চৌধুরীর। জিজ্ঞেস করলেন,
‘কবে করেছো বিয়ে?’
বিভোর ইতস্তত করে বলল,
‘অনেক বছর হয়ে গিয়েছে।’
বাবর চৌধুরী গলা উঁচিয়ে বললেন,
‘কয় বছর? বাচ্চাকাচ্চাও নিয়ে নিয়েছো নাকি? ভালোই তো।’
‘ছয় বছর। বাচ্চাকাচ্চা নিইনি।’
নাসিমা ভেবেছিলো কয়েক মাস হবে বোধহয়। কিন্তু ছয় বছর কথাটা শুনে ওনি অবাক হয়ে গেলেন। বাবর চৌধুরী প্রচুর শকড হলেন। এতো বছরে তার ছেলে একবারও কথাটা বলতে পারলোনা? তার ছেলে কি মেয়েদের ধোঁকা দেয় নাকি! এখন কি মেয়েটা ওকে চেপে ধরেছে সবাইকে কথাটা জানানোর জন্য, সচরাচর যেমন হয়!
বিভোর ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
‘আমি আসলে বিয়ের কথাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। দেশে ফেরার পরে ওর সাথে যখন আমার আবার দেখা হলো তখন আমি বুঝতে পারলাম ওকে ছাড়া আমার
চলবেনা। ওকে আমার চাই-ই চাই।’
‘দেশে ফিরেছো দুই বছরেরও বেশি সময় হয়ে গিয়েছে। আর তুমি এসব কি বলছো? আমরা কিছু বুঝতে পারছিনা।’
নাসিমা চাঁছাছোলা প্রশ্ন করলেন। বিভোর মাকে বলল,
‘আসলে আমি বিয়ে করতে চাইনি। পরিস্থিতি বাধ্য করেছিলো তখন আমাদের।’
‘পরিস্থিতি? কী এমন হলো যে তোমরা বিয়ে করতে বাধ্য হয়ে গেলে?’
বিভোর বলল,
‘সেইবার আমি ফ্রেন্ডের বাসা থেকে ফিরছিলাম। ট্রেনেই ওর সাথে প্রথম দেখা, কয়েকটা ছেলে মিলে আমাদেরকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়।’
পুরো ঘটনাটা বাবা-মাকে খুলে বললো বিভোর। মাহিমের অত্যাচার, ট্রেনে দেখা আর পরিস্থিতির চাপে বিয়ে করা! এমনকি রুহিকে একা শহরে ছেড়ে দেওয়া, স্বামীর দায়িত্ব পালন না করা, ওর খোঁজ না নেওয়া এভরিথিং। বিদেশে গিয়ে কলিগের সাথে রিলেশন এবং ব্রেকআপ করা সবকিছু ওরা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কিন্তু কিছু বললোনা। রাগে থমথম করছে বাবর চৌধুরীর চেহারা। নিজের ছেলেকে ঠকবাজ মনে হচ্ছে তার। এতো লেখাপড়া শিখিয়ে, ডাক্তার বানিয়েছিলো কী একটা মেয়ের সাথে এইরকম করার জন্য? এই শিক্ষা কোথায় পেয়েছে সে?
বসার ঘরে সুনশান নীরবতা বিরাজমান। গুমোট পরিস্থিতি সবসময়ই অস্বস্তিজনক ও বিরক্তিকর। মা-বাবার মুখের রঙ পাল্টাচ্ছে। দীপ্তিমান চেহারায় ভর করছে বর্ষার কালো মেঘেরা। প্রশান্তির বাতাসের ছিঁটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছেনা। বিভোর থমকালো, বাব-মা কী তবে ওর বিয়ের কথাটা হজম করতে পারছেন না? ওরা কী বিভোরকে বুঝবেনা? কয়েক সেকেন্ড নীরবতায় কাটলো। ওর বুকের বাঁ পাশে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কোনোমতে বলল,
‘কিছু বলছোনা কেন তোমরা?’
বাবর চৌধুরী বললেন,
‘কী বলবো? বলার মতো মুখ রেখেছো আমাদের?’
‘তোমরা আমার পুরো কথাটা শুনো..’
গর্জন করে উঠলেন বাবর চৌধুরী।
‘থামো। তোমার মতো কুলাঙ্গার ছেলের মুখ থেকে আর একটা কথাও শুনতে চাইনা।’
বিভোর আহত হলো। ওরা মানতে পারছেনা এটা। তবুও বলার চেষ্টা করলো,
‘আব্বু তুমি আমার কথা..’
‘স্টপ ইট। আমাকে একদম আব্বু বলে ডাকবেনা।’
‘আমাকে ভুল বুঝছো তোমরা। আমার সিচুয়েশনটা একটু বুঝো প্লিজ?’
‘আরকিছুই আমরা বুঝতে চাচ্ছিনা। তুমি এবার চাইছো যে সামাজিকভাবে তোমাদের বিয়েটা আবার দিতে, তাই তো? ওকে ফাইন। এটা আমি করবো। আফটার অল তুমি আমাদের একমাত্র পুত্র। কিন্তু তোমার বিহেভিয়ার অনুযায়ী তুমি একটা কাপুরুষ। এরকম সন্তান বাবা-মায়ের জন্য লজ্জ্বার। আমার ভীষণ লজ্জ্বা করছে, মাথা নিচু করে দিয়েছো তুমি আমার। এতোটাও ইররেস্পন্সিবল কী করে হলে তুমি। আমি এখন সেই মেয়ের কাছে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? আন্সার মি!’
বিভোর ঝটপট করে বলে ফেললো ,
‘মেয়েটা কে জানো তোমরা? রুহানি।’
নাসিমা অবাক হয়ে বললেন,
‘কোন রুহানি?’
অপরাধীর মতো মুখ বিভোরের। অসহায় গলায় বলল,
‘নাদিরা আন্টির বাসায় যে থাকে, রুহি। আমার স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী সে। তাঁর সাথে আমি প্রচুর অন্যায় করে ফেলেছি তার শাস্তিও পাচ্ছি৷ আমাকে প্লিজ নিজের ভুল শুধরানোর সুযোগ দাও তোমরা!’
রুহির কথা শুনে ওনারা আকাশ থেকে পড়লেন। তার মানে ওনাদের ছেলের জন্যই মেয়েটার আজ এই অবস্থা? কীভাবে পারলো এটা করতে বিভোর? মেয়েটার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, অন্যের বাড়িতে আশ্রিতার মতো থাকে যদিও নাদিরা নিজের মেয়ের মতোই রাখে। ওরা আশ্রয় না দিলে মেয়েটা সত্যিই পাগলখানায় থাকতো আজ, নয়তো রাস্তায়। রুহির খুঁটিনাটি সবকিছুই জানে ওরা, বিয়ের কথাটা তো কাউকে বলেনি। কতোটা ভালো হলে একটা মেয়ে নিজের স্বামীর পরিচয় লুকিয়ে রাখতে পারে, একবার নিজের অধিকারটুকুও চাইতে আসলোনা। অথচ আজকাল ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার ছেলের পিছনে মেয়েরা লাইন লেগে থাকে। রাগ হচ্ছে বাবর চৌধুরীর। সেই মুহূর্তে বাবর চৌধুরী একটা আশ্চর্যজনক কাজ করে বসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন ছেলেকে। বললেন,
‘তুমি এটারই যোগ্য। নাও গো টু হেল।’
চৌধুরী বাড়ির লনটা বেশ বড়সড়। সেখানে বিভিন্ন ফুলের গাছ আছে। দেশী-বিদেশী নানরকম ফুল সারাবছরই বাগানটাকে মাতিয়ে রাখে। রোদে পোড়া শান্ত বিকেলে স্নিগ্ধতার পরশ ছড়িয়ে দেয় বাহারি ফুলেরা। ম ম করে উঠে আদুরে সুবাসে। সবচেয়ে বেশি আছে রেইন লিলি। ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে তাদের কলিগুলো দেখা যায়। পায়ের নিচে চাপা পড়ে যায় বলে সেদিকটায় মালি ছাড়া আর কেউ যায়না। বাগানের প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়েই রেইন লিলিদের বিস্তার। সাদা-গোলাপী রঙের ফুলগুলোতে রোজ সকালে হাত বুলিয়ে দেন বাবর চৌধুরী। প্রকৃতিপ্রেমী একজন মানুষ। কিন্তু ছেলে বিভোরকে শত চেষ্টা করেও প্রকৃতিপ্রেমী বানাতে পারেননি, তবে প্রকৃতির ক্ষতি সে করেনা। যাইহোক, সকালবেলা মর্নিং ওয়াক করার জন্য লনে নামতেই দেখলেন সদ্য নতুন গোলাপ গাছটিতে ফোঁটা কালোগোলাপ ফুলটা কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে। বাবর চৌধুরীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। রাগ উঠলো এবং একপর্যায়ে লাল চেহারা নিয়ে তিনি মালি রতনকে ডেকে পাঠালেন। মালি হাঁকডাক শুনেই দ্রুত দৌড়ে এলো, নতমুখী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কী করতে পারি স্যার?’
বাবর চৌধুরী কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘গোলাপগুলো কে তুলেছে?’
রতন আস্তে করে বলল,
‘জানিনা স্যার।’
‘আশ্চর্য! তুমি বাগানের মালি আর তুমিই জানোনা গাছ থেকে কে ফুল ছিঁড়েছে?’
মালি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। বাবর চৌধুরী রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,
‘লাল, গোলাপি গুলো ছিঁড়ে নিলে তাও মানা যেতো, কালো গোলাপটা ছিঁড়ে নিলো কোন সাহসে? কার এতো বুকের পাটা আমার গাছে হাত দেয়? কে সে?’
মালি রতনের মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে। বাবর চৌধুরী খুব ভালো একটা মানুষ। সবার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেন , হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু তাঁর বাগানের গাছ থেকে কারোর ফুল ছিঁড়ার পারমিশন নেই। এমন হলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়েন তিনি। ওনার মতে হাতে নয়, ফুলেদের মানায় ফুলগাছেই। সবটাই রতন জানে। তবে আজ এই দুঃসাহস কে দেখালো? রতন মনে মনে মজা পাচ্ছে আবার ভয়ও হচ্ছে। চাকরিটা না আবার চলে যায়। যদিও এই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ শহরে আজকাল মালি পাওয়া দুষ্কর হয়ে গিয়েছে। রতনকে তো অনেক খুঁজে তারপর পেয়েছেন বাবর চৌধুরী। রতন বলল,
‘স্যার। একটাই তো ছিঁড়ছে। হয়তো বাতাসে নিচে পইড়া গেছে।’
তেতে উঠলেন বাবর চৌধুরী।
‘বাতাসে যদি ফুলটা পড়েই যেতো, তাহলে নিচে থাকতো। কোথায়? আছে ফুলের কোনো চিহ্ন?’
‘না স্যার।’
‘তাহলে বোকার মতো কথা বলো কেন? তুমি জানো আমি কত বিচক্ষণ ব্যক্তি? সেনাবাহিনীর বড় অফিসার ছিলাম আমি, আর তুমি আমাকে লজিক ছাড়া কথা শোনাও? ড্যাম ইট!’
‘ছাইড়া দেন স্যার। আর লজিক ছাড়া কথা কমুনা।’
‘পলিটিক্স শিখেছো ভালোই।’
‘এর লগে পলিটিক্সের কী সম্পর্ক স্যার?’
-‘তোমার মাথা। যাও কাজ করো। ভালো করে ডালগুলো ছেঁটে দিও। সার দিয়েছো?’
‘একটু পরে দিমু। রোদটা পশ্চিমমুখী হইয়া নেক।’
‘আচ্ছা৷ আর শুনো, ক’দিন পর বাসায় বিয়েটিয়ে লাগবে। তুমি বাগানটা ভালো করে পরিষ্কার করে, শুকনোপাতা ফেলে দিও। কয়েকটা গাঁদা আর বেলিফুলের চারা এনে গেইটের কাছে লাগিয়ে দিও। কৃষ্ণচূড়া নেই বাসায়, একটা গাছ এনে পেছনের দিকে লাগিও। বুঝেছ?’
রতন মনোযোগ দিয়ে সব শুনে খাতায় নোট করে রাখলো। ভেবেচিন্তে বলল,
‘দাদাভাইয়ের বিয়ে নাকি স্যার?’
‘হুম।’
‘বিয়া করতে রাজি হইছে নাকি?’
‘হুম।’
রতন কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা মনে হতেই উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
‘ওনার তো তাহলে লাল টকটকে জবাফুল পছন্দ। আমাদের বাগানে সাদা আর গোলাপি জবা আছে, লাল নাই। একটা রক্তজবার চারা নিয়া আসুম স্যার?’
বাবর চৌধুরী বললেন,
‘বিভোর তোমাকে বলেছে ওর রক্তজবা পছন্দ?’
‘তেমনভাবে বলে নাই। সকালে বাগানে এসে জিজ্ঞেস করলো লাল টকটকে জবা আছে কিনা। আমি বললাম নাই!’
বাবর চৌধুরী গম্ভীরকন্ঠে বললেন,
‘তাহলে নিয়ে এসো। ছেলে তো নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা আমাদের বলেই না। এতো গোপনীয়তা কীভাবে শিখলো বুঝতে পারছিনা। তুমি জানো বিভোর আরও ছয় বছর আগেই বিয়ে করে ফেলেছে। আমাদেরকে একবারের জন্য বলেওনি। ভাবতে পারছো আমার গুণধর ডাক্তার ছেলে কতোটা ডেঞ্জারাস!’
বলেই বাবর চৌধুরী হেঁটে চলে গেলেন। রতন এই কথাটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বিভোর বিয়ে করতে এতোদিন রাজি হয়নি দেখে সেও মনে মনে বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেছিলো। কারণ মেয়ে মানেই ঝামেলা আর বউ মানে আরও বেশি ঝামেলা। ওরা ‘ক’ বললে ‘কলকাতা’ বুঝবেই। কিন্তু বিভোর আরো আগেই বিয়ে করে রেখেছে শুনে রতনের বুকটা দুমড়েমুচড়ে গেলো। এবার ওকেও বিয়ে করতে হবে আর বউয়ের কথায় উঠবস করতে হবে। কারণ বিভোরকে অনুসরণ করতে সে ভালোবাসে। ও যা করে রতনও তা-ই করে। বিভোর এখন জিম করা শুরু করেছে, রতনও করছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো ওর। কাঁচি আর বালতিটা হাতে তুলে নিয়ে ধীরপায়ে কাজে লেগে পড়লো।
চলবে…ইনশাআল্লাহ! ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।