আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব-৫+৬

0
250

#আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৫

মুখোমুখি বসে আছি আমি আর আহনাফ। দুজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করছে। বেশ কিছুটা সময় পর নিরবতা কাটিয়ে আহনাফ শান্ত কণ্ঠে আমায় বলল

-‘ অনেক তো কান্নাকাটি করলি। এবার বল কি হয়েছে তোর? তোকে এতো মনমরা কেন লাগছে? তোকে হাসিখুশিতেই মানায় রে, মন খারাপ এ নয়।

আমি তখনও হেচকি তুলেই যাচ্ছি। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে করুন কণ্ঠে বললাম

-‘ জানিস, গত কয়েক মাস আগেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

আমি এতোটুকু বলে থামলাম। আহনাফ চমকালো। আহনাফের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখটা কেমন যেনো শুকিয়ে গেছে। হয়তো ও মানতে পারছেনা বিষয়টা। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল

-‘ তোর বিয়েও হয়ে গেছে, বাহ্। ভালোই তো। একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধও করলি না। এতোটাই পর হয়ে গেলাম আমি তোর কাছে।

আমি চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বললাম

-‘ তুই কখনোই পর ছিলি না আমার কাছে। তোকে বলার সময় বা সুযোগ হয়ে উঠেনি আমার। এক প্রকার তাড়াহুড়ো করেই রাশফিনের সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যায়। আর তারপর..
একে একে সব কিছু বলতে শুরু করলাম।

সব শুনে আহনাফ অবাক হয়ে গেল। ওর মুখে কোনো কথা নেই। এবারও বেশ কিছুটা সময় নিরবতা বিরাজ করল। একটু থেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে করুন কণ্ঠে বললাম

-‘ আমি অনেক খারাপ তাই না? এই জন্যই তো আমার সাথে এমনটা হলো। এমনটা না হলেও পারত, তাই না বল?

-‘ কে বলেছে তুই খারাপ। আমার দেখা সবচেয়ে ভালো তুই। মন খারাপ করিস না। দেখবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

-‘ আর কি ঠিক হওয়ার আছে। সব তো শেষ। এখন আমি বেচে থেকেও বা কি হবে। তার থেকে বরং ভালো হবে ম*রে..

আর বলতে পারলাম না। আমার মুখ চেপে ধরে আহনাফ। রাগান্বিত স্বরে বলল

-‘ খবরদার বলে দিচ্ছি, একদম এইসব আজেবাজে কথা বলবি না, তাহলে কিন্তু ঠিক হবে না বলে দিলাম।

আমি অবাক হলাম। আহনাফকে এতোটা রে*গে যেতে এর আগে কখনোই দেখিনি আমি।

আড়াল হতে সবই শুনে ফেলেন রেহানা বেগম অর্থাৎ অরনিশার মা। শাড়ির আচলটা মুখে চেপে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন তিনি। মেয়ের এমন করুণ পরিনতি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। মেয়েটার সুখের কথা ভেবে কতো শখ করে বড় বাড়িতে নিজের একমাত্র মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাও কিনা আবার রাহেলা খাতুনের মতো এতো ভালো মানুষ যার সাথে অনেকে আগে থেকে খুব ভালো সম্পর্ক, তার-ই একমাত্র ছেলে রাশফিনের সাথে বিয়েটা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মেয়েটা হয়তো অনেক বেশি সুখী হবে। কিন্তু না, রাহেলা খাতুনের ছেলে হয়েও রাশফিন যে এতোটা অ*মানুষ হবে, তা জানতেন না তিনি। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালেও যে তার আসল চেহারা লুকিয়ে আছে তা তিনি বা অরনিশার বাবা, দুজনের কেউ-ই বুঝতে পারেননি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, কে জানত যে তাদের মেয়েটাই এতো বেশি দুঃখীনি হবে। মেয়েটার ভালো করতে গিয়ে উল্টে আরও ক্ষ*তি করে বসলেন তারা। নিজের ভেতরেই কেমন একটা অ*পরাধবোধ কাজ করছে। মেয়েটার সামনে মুখ দেখাবেন কিভাবে তারা। কতো করে মেয়েটা নিষেধ করেছিল, বিয়েটা করবে না, কিন্তু তারা মেয়েটার কথা কানেই তোলেনি। এক প্রকার জোড় করেই বিয়েটা দিল। যার শেষ পরিনতি এটা।

কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে উঠে গিয়ে দেখতে লাগলাম কোথা থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছে। আম্মুকে কাদতে দেখে ঘাবড়ে গেলাম। আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আম্মু আমায় জাপটে ধরে কাদতে লাগলেন। আম্মু কাদতে কাদতেই বললেন

-‘ আমাদের ভুল হয়ে গেছে রে মা, ক্ষমা করে দিস। বুঝতে পারিনি যে তোর ভালো করতে গিয়ে উল্টে ক্ষতি করে ফেলবো।

-‘ না, মা কিচ্ছু হয়নি। তুমি এভাবে কাদলে আমার খুব কষ্ট হয়। তোমাদের তো কোনো দোষ নেই এখানে। তোমরা তো আর জানতে না। দোষটা আসলে আমারই, আমার ভাগ্যটাই এমন।

-‘ শুধু শুধু কেন নিজের ঘাড়ে দোষ নিচ্ছিস।

-‘ থাক, বাদ দাও আম্মু। তোমার মেয়ে তোমার কাছেই সারা জীবনের মতো চলে এসেছে। ও বাড়িতে আর ফিরব না আমি।

-‘ হ্যাঁ, কোনো দরকারও নেই ও বাড়িতে যাওয়ার। আজ থেকে ওদের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ। কতো বড় সাহস আমার মেয়েকে কষ্ট দেয়।

-‘ আজ সারাদিন কিছু খাইনি আমি, বড্ড খিদে পেয়েছে আমার।

-‘ইস্ আমি তো ভুলেই গেছি রে। আয় মা খেতে চল।

শত কষ্টের মাঝেও আমার মুখে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি।

একপাশে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে মা মেয়ের কথা শুনছিল আহনাফ। ওরা চলে যেতেই কিছু একটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহনাফ। আজ আহনাফের মনটাও বেশ খারাপ। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুটা সময়।

অরনিশার ডাকে ধ্যান ভাঙে তার। সেও ওর সাথে খাবার খেতে চলে যায়।
.
.
.
রেস্টুরেন্টে বসে আছি আমি আর আহনাফ। গত দুদিন যাবত আমাকে মনমরা দেখে একদমই ভালো লাগছে না আহনাফের। তাই তো আমাকে নিয়ে আজ ঘুরতে বের হলো, আমার মন ভালো করার জন্য। ঘুরাঘুরি শেষে আমরা চলে এলাম রেস্টুরেন্টে। আমরা বসে বসে টুকটাক কথা বলছিলাম, গল্প করছিলাম আর খাচ্ছিলাম।

এমন সময় হঠাৎ কোনো কিছু ভা*ঙার শব্দে আমরা দুজনই সেদিকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম রাশফিন আমার দিকে অ*গ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আজ ফারিহা এটা সেটা বাহানা করতে করতে জ্বা*লিয়ে মা*রছিল রাশফিনকে। তাইতো বি*রক্ত হয়ে ওকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো। আর এসেই ঘটল এই বি*পত্তি। এমনিতেই গত দুদিন ধরে রাশফিনের মন মেজাজ একদমই ঠিক নেই। তার উপরে আবার অরনিশাকে এসময় অন্য একটা ছেলের সাথে দেখে মাথায় ধ*প আ*গুন জ্ব*লে উঠল। মনে পড়ে গেল সেদিন রাতের কথা। তার মানে ছবিতে যাকে দেখেছিল সেটা সত্যি সত্যিই অরনিশা ছিল। রা*গে হাতের কাছে থাকা গ্লাসটা তুলে আ*ছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিল।

আমার দিকে রাশফিন তে*ড়ে এসে আমাকে টেনে উঠিয়ে দাতে দাত চেপে বলল

-‘ খুব তো আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছিলি। তো এখন কি হচ্ছে এখানে।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ফলে আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছিল না। আমায় চুপ থাকতে দেখে যেন আরও বেশি রে*গে গেল রাশফিন। আমার গালে ঠা*স করে চ*ড় মারতে গেলে আমি ভ*য়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম কিন্তু না আমার গালে কোনো চ*ড় পড়েনি। চোখ খুলতেই দেখলাম আহনাফ হাত ধরে আছে রাশফিনের। রাশফিন দাত কিড়মিড় করে বলল

-‘ হাও ডেয়ার ইউ? তুমি আমার হাত ধরো কোনো সাহসে, তুমি জানো আমি কে?

-‘ আপনি কে তা আমার জানার কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। তবে এতোটুকু জানি, আপনি অরনিশার হাসবেন্ড যে কিনা ওকে প্রতিনিয়ত অত্যাচার করে।

-‘ কিহ্, কি বললে তুমি? আমি ওকে অত্যাচার করি? ও তার মানে জল এতো দূর গড়িয়ে গেছে। তা তোমার ল*জ্জা করে না, অন্যের বউকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে বসে বসে কথা বলতে?

-‘ অভিয়েসলি না, কারণ আমরা কোনো প্রেমালাপ করছিলাম না, জাস্ট কথা বলছিলাম। আর না আপনার মতো কোলে নিয়ে বসেছিলাম না যে ল*জ্জা করবে আমার।

আহনাফের কাটকাট জবাবে রে*গে আ*গুন হয়ে গেল রাশফিন। এতোটা অ*পমানিত সে, এর আগে কখনোই হয়নি। আহনাফের উপর রা*গ ঝা*ড়তে না পেরে আমার দিকে তে*ড়ে এসে শ*ক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল রাশফিন। আর চি*ৎকার করে বলল

-‘ আজ তুই শুধু বাড়ি চল আমার সাথে। তোর একদিন কি আমার একদিন। আজ আমি তোকে মে*রেই ফেলব।

আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম আহনাফের দিকে। ততক্ষণে আহনাফও রে*গে একদম লাল বর্ণ ধারণ গিয়েছে। যে মানুষটাকে সবসময় যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে দেখেছি, সেই মানুষটাও আজ রে*গে গিয়েছে।

আহনাফও চি*ৎকার করে বলল

-‘ খবরদার, অরনিশার যদি আজকে কিছু হয়ে যায় আর ওর গায়ে যদি একটা ফুলের টোকাও লাগে। তাহলে কিন্তু আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।

রাশফিন আচমকাই আমার হাত ছেড়ে দিল। বাধন আলগা হতেই আমি দৌড়ে আহনাফের কাছে ছুটে গিয়ে ভ*য়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়ালাম।

রাশফিন সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল আমাদের দিকে। জোড়ে হেসে আমায় উদ্দেশ্য করে বলল

-‘ ওহ্ আমি তো ভুলিয়ে গিয়েছিলাম। তুই তো আরেকটা জুটিয়েছিস। যাহ্ তোকে তালা*ক দিয়ে দিলাম। কালই ভি*ভোর্স পেপার পেয়ে যাবি। তোর মতো মেয়ের সাথে সংসারও করবো না। চরিত্র*হীন মেয়ে কোথাকার।

এবার রাশফিন আহনাফের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল

-‘ যাহ্ তোর মা*ল, তোকে ভি*ক্ষা দিয়ে দিলাম। তবে ভাবিস না, তোর কথায় আমি ভ*য় পেয়ে এমমটা করেছি। কারো ইউজ করা প্রোডাক্ট আমি নিই না।

বলে রা*গে গটগট করে ফারিহার হাত ধরে নিয়ে বেরিয়ে চলে যায়।

রাশফিনের বলা এসব বি*শ্রী বাক্য শুনে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না, মাথা ঘুরে উঠল। চারিদিকে কেমন যেন অন্ধকার দেখতে লাগলাম। জ্ঞান হারাবার আগে শুধু শুনতে পেলাম আহনাফের চিৎকার।

#চলবে ~

#আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৬

অবশেষে ডি*ভোর্সি, এই অ*ভিশপ্ত তকমাটা লেগেই গেল আমার গায়ে। রেস্টুরেন্টে যেদিন গিয়েছিলাম তার ঠিক পরের দিনই ডি*ভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছিল রাশফিন। সত্যিই রাশফিন কথা দিয়ে কথা রাখতে জানে। আমিও মা বাবার কাছ থেকে পরামর্শ নিই সাইন করবো কি করবো না। তাদের উত্তরটা হ্যাঁ ই ছিল।

কয়েক মাসের ব্যবধানেই সব শেষ। বিয়েটা তো কোনো ছেলে খেলা নয়। মেয়েদের জীবনে বিয়েটা একবারই আসে, এটা কি জানতো না রাশফিন। আর আমিও ভেতরে ভেতরে ক্ষ*ত বিক্ষ*ত হয়ে ভে*ঙে চুর*মার হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।

সেদিনের পর থেকে আর বের হয়নি নিজের রুম থেকে। নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছি।মা রোজ এসে চেচায় কিছু খাবার জন্য। কিন্তু আমার গলা দিয়ে যে আর কিছুই নামবে না। তাও জোর করে আম্মু খাইয়ে দিয়েছিল কয়েক লোকমা।

বেলকনিতে বসে তাকিয়ে থাকি ঐ দূর অন্তরীক্ষের পানে। নিজের জীবনের হিসেব মিলানোর বৃথা চেষ্টা করি। রাশফিন কিভাবে পারল আমায় এতো বা*জে কথা বলতে সেদিন।কিভাবে পারল রেস্টুরেন্টে ওতোগুলো মানুষের সামনে অ*পমান করতে। আমি বুঝতে পারিনা, আমার উপর কেন এতো ক্ষী*প্ত রাশফিন। কি এমন করেছিলাম। আমাদের বিয়ের দিন তো সবই ঠিক ছিল, তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে আমার সাথে এমন আচরণ করতে শুরু করল।

সেদিনের পর থেকে আহনাফের সাথেও আর কোনো যোগাযোগ করিনি আমি। ইচ্ছাও নেই কোনো।

মানুষ এতোটা নি*চ হয় কিভাবে, রাশফিন ভালো করেই জানতো আহনাফ আমার বেস্টফ্রেণ্ড, তাহলে ওর সাথে আমাকে জড়িয়ে এভাবে না বললেও পারত। তার উপর আমাকে ডি*ভোর্স দিয়ে ঐদিনই ফারিহাকে বিয়ে করে ফেলল। ইভেন ফারিহা আমাকে ওদের কিছু ছবি পাঠিয়েছে, যাতে ফারিহা হাসি মুখে বিয়ের বেনারসি পরে বসে আছে, তারপর আমাকে ফারিহা ফোন করেও বলে দিয়েছে ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ওদের বিয়েটা কি সত্যিই হয়েছে? আচ্ছা রাশফিন কি আদৌ মন থেকে করেছে বিয়েটা?

পরক্ষণেই ভাবলাম আমার আর জেনে কি লাভ, সব তো শেষ-ই। এসব ভেবে আমি ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে কান্নাই ভেঙে পড়ি। কোনো দোষ না করেও কেন এমন শা*স্তি পাচ্ছি আমি। কি সুন্দর করে পরিকল্পিত ভাবে একটা ইস্যু ক্রিয়েট করে আমার জীবনটাকে একেবারে ত*ছন*ছ করে দিল। একটুও কি বুক কাপল না রাশফিনের। কেন এমন করল আমার সাথে।
.
.
.
বেলকনিতে বসে সি*গারেট খাচ্ছে রাশফিন। কালকের রা*গটা এখনও মেটেনি ওর। রা*গ আর জে*দের বসেই অরনিশাকে সেদিন ওতো গুলো কথা শুনিয়েছিল। রা*গের মাথায় কি বলেছে, কি না করেছে তা ওর মাথায় নেই এখন। আর ফারিহাও তখন আ*গুনে ঘি ঢালার মতোই উ*ষ্কে দিয়েছিল রাশফিনকে যার কারণেই সাত পাচ না ভেবে অরনিশার সাথে ওমন আচরণ করে। এখন নিজের ভেতরেই কেমন যেনো অ*পরাধবোধ কাজ করছে। ফাকা ফাকা লাগছে সব। নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে রাশফিনের। গত এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে নেই অরনিশা। প্রতিটা মুহূর্তে ভীষণ ভাবে মিস করছে। ও যদি এমন না করত তাহলে কখনোই হয়তো খা*রাপ আচরণ করত না অরনিশার সাথে রাশফিন। এখন নিজের উপরেই রা*গ হচ্ছে রাশফিনের, কেন এমন বা*জে আচরণ করতে গেল অরনিশার সাথে।

সি*গারেট খেতে খেতেই জ্ব*লন্ত সি*গারেটের আ*গুনটা নিজ হাতেই চেপে ধরে রাশফিন। হঠাৎ পেছন থেকে এসে কেউ একজন জড়িয়ে ধরে রাশফিনকে। রাশফিনের হাত থেকে পড়ে যায় সি*গারেটটা। ও ভাবে অরনিশা হয়তো জড়িয়ে ধরেছে ওকে। কিন্তু পেছন ফিরতেই ফারিহাকে দেখে মাথা গ*রম হয়ে যায় রাশফিনের। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাটকাট গলায় বলল

-‘ তুই কাজিন, কাজিনের মতোই থাকবি। এর চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার চেষ্টাও করবি না। সেদিন আমার কোলে বসার কারণে তোকে কি শা*স্তি দিয়েছিলাম যদি মনে থাকে তাহলে আর আমার কাছে ঘেষার চেষ্টাও করবি। আর যদি মনে না থাকে তাহলে আবার যেন তোকে ফেলে দেওয়া না লাগে। আগের বার তো কোমরে ব্যথা পেয়েছিলি এবার যেন হাড় ভাঙা না লাগে। মাইন্ড ইট।

ফারিহা ন্যা*কা কান্না জুড়ে দিল।

-‘ তুমি আমার সাথে এমন কেন করছো? ঐ থার্ড ক্লাস মেয়েটার জন্য এমন করতে…

-‘ শোন, তুই অরনিশাকে সেদিন অ*পমান করেছিলি, আমি কিছু বলিনি বলে এই না যে কিছু বলবো না। সেদিন তো ওকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারো সাথে দেখলে ঠিক কেমন লাগে। তাই আমি কোনো প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারিনি আমি।

ফারিহার গা জ্ব*লে যায় এসব শুনে। অরনিশার নাম টা শুনলেই গা জ্বলে ফারিহার। আবার শুরু করল রাশফিন। তাই ওকে যে করে হোক থামাতে হবে এখন।

হঠাৎ রাশফিনের হাতের কিছু পু*ড়ে যাওয়া অংশে নজর পড়তেই ফারিহা উত্তেজিত কণ্ঠে দ্রুত বলে উঠল

-‘ এটা কি করেছো কি রাশফিন ? এই সামন্য থার্ড ক্লাস, চরিত্র*হীন মেয়েটার জন্য তুমি এমন করছো? কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো শুধু শুধু?

রাশফিন ফিরে তাকায় ফারিহার দিকে। রাশফিনের ক*ষ্টটা যেন দ্বিগুন বেড়ে যায়।মলিন হেসে বলল

-‘ বল তো কেন হলো আমার সাথে এমন? অরনিশা কেন করল আমার সাথে এমন? আমি যে অরনিশাকে কত্তো ভালোবাসি, এটা কি ও জানেনা? ও আমায় ঠ*কিয়েছে। কিন্তু কেন করল এমন?

রা*গটা কোনোমতে দমিয়ে দাতে দাত পিষে ফারিহা বলল

-‘ এখন ভালোবাসেও কোনো লাভ নেই রাশফিন। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। তুমি এখন মুক্ত। আমি এখন তোমার সব। অরনিশা কেউ নয় তোমার।

বলার সাথে সাথে ফারিহা কিছু একটা পুষ করে রাশফিনের শরীরে। ফলে মৃদু চি*ৎকার করে উঠল রাশফিন। কিছুটা, কেমন একটা ঘোরের মাঝে থাকার পর রাশফিন বলে উঠল

-‘ হ্যাঁ, আমি তো এখন মুক্ত। ওর মতো চরিত্র*হীনের ছায়া আমার জীবন থেকে চলে গেছে। তাহলে আমি কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি শুধু শুধু। লাইফ ইস্ ফুল ওফ ইন্জয়এবেল।

ফারিহার মুখে ফুটে উঠল মুচকি হাসি। এটাই তো চাচ্ছিল ফারিহা। এতোদিনের শখ পূরণ হতে চলেছে। খুশি হয়ে ফারিহা জরিয়ে ধরতে গেলো রাশফিনকে, ততক্ষণে ও জ্ঞান হারিয়ে ফারিহার উপর ঢলে পড়ল রাশফিন।
.
.
.
জানালার গ্রিলের ধারে রকিং চেয়ারে বসে আছে আহনাফ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে আছে, অরনিশার ফোনের আশায়, কিন্তু না অরনিশা ওকে একবারের জন্য ফোন দেয়নি। তবে কি আবারও হারিয়ে ফেলল অরনিশাকে। মেয়েটাকে যে ছোটবেলা থেকেই বড্ড বেশি ভালোবাসত সে। তবে সাহস করে আর বলাটা হয়ে উঠেনি। ফোনের গ্যালারীতে গিয়ে একটা হাস্যজ্জ্বল মেয়ের ছবি বের করল আহনাফ। মেয়েটা আর কেউ নয়, এটা অরনিশা। আহনাফের সেই পুরনো স্মৃতি গুলো মনে পড়তে লাগল। ওর এখনো মনে আছে একদিন মজার ছলে আহনাফ অরনিশাকে বলেছিল

-‘ অরনিশা, তোকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি রে।

অরনিশা সেদিন মজার ছলে উড়িয়ে দিয়েছিল ব্যাপারটা। বেস্টফ্রেণ্ড তো এমন বলতেই পারে। তেমন একটা পাত্তাও অরনিশা দিয়েছিল না সেদিন। তবে মজার ছলে সেদিন আহনাফ বললেও কথাটা সত্যিই ছিল। সাহস করে বলেই ফেলেছিল নিজের মনের কথাটা। তবে অরনিশা তা বুঝতে পারেনি। আহনাফ সেদিন চোখ দিয়ে অনেক কিছুই বোঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি কোনো। সেদিনই আহনাফ বুঝে গিয়েছিল যদি সত্যিটা অরনিশা জানতে পারে তাহলে হয়তো আর কোনোদিনও আরহনাফের সাথে কথা বলবে না। তাই ও আর সাহস করে কখনোই বলেনি। আর কখনো এই দুস্সাহস করেনি। তাইতো ভালোবাসাকে ভুলতে অরনিশা থেকে অনেক দূরে চলে যায় আহনাফ।

এতো কিছু ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আহনাফের। ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল

-‘ ভালোবাসার মানুষটা যখন কষ্ট পায়, তাকে যে ভালোবাসে সে-ও ভীষণ কষ্ট পায়। কারণ সে কখনোই চায় না, তার ভালোবাসার মানুষটা কষ্ট পাক। আমি যে তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি, অরনিশা। কিন্তু তুমি বুঝলেও না, আর বুঝবেই বা কি করে আমি তো তোমাকে কখনোই বুঝতে দিইনি আর দিবোও না। তুমি তো এখন অন্যের বউ। তোমাকে পাওয়ার আশা করাটাও যে নিষিদ্ধ আমার কাছে। খুব ভালো থেকে প্রিয়। আহনাফ গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে।

” দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাধিব।”

মুচকি হেসে নিজেকেই আবার সান্ত্বনা দিল।

-‘ সবার কপালে সবকিছু থাকেও না। আমি না হয় দূর হতেই ভালোবেসে যাব তোমায়। কিছু কথা না হয় না বলাই থাক। থাক না, কিছু কিছু ভালোবাসাটা একপাক্ষিক ই হোক। আমার ভালোবাসাটা আড়ালেই থাকুক না হয়। #আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়, প্রেয়সী। সারাজীবন না হয় তোমায় আড়ালেই ভালোবেসে যাব আমি, সমস্যা কি তাতে।

হঠাৎ ফোনের রিং টোনে চমকে তাকালো আহনাফ। ফোনটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই মুখে ফুটে উঠল তার রহস্য ময় হাসি।

#চলবে ~