আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব-১০+১১

0
201

#আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১০

মস্তিষ্কের নিউরন সেলে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের ফলে ব্রেইন টি*উ*মা*র হয়েছে রাশফিনের। আর একটু দেরি করলেই হয় তোবা তা রূপ নিতে পারত ক্যা*ন্সা*র নামক কঠিন ম*র*ণ ব্যাধি রোগে।

এ ছাড়াও রাশফিনের রক্তে এসজিপিটি এর পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এই এসজিপিটি টা মূলত মানুষের লিভার সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তা বুঝতে সাহায্য করে। যেখানে স্বাভাবিক মানুষের নরমাল রেঞ্জ ৪২-৫৭ থাকা উচিত সেখানে রাশফিনের কি না ২৩০৩, যা অস্বাভাবিক এর থেকেও অস্বাভাবিক। এমন হলে রোগী কে ইমিডিয়েটলি আইসিউ তে ভর্তি করতে হয়। ফলে ওকে আইসিউ তে ভর্তি করা হয়েছে।

রাশফিনের অবস্থা একদমই ভালো নয়। যে কোনো সময় যা কিছু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডক্টর।

এই তো কাল রাতে রাহেলা খাতুন ছেলে রাশফিনকে রাতের খাবার খেতে ডাকতে গিয়েছিলেন। পুরো রুম এ অসময়ে অন্ধকার দেখে তিনি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। লাইট অন করে রুমে কাওকে না দেখে বেলকনির দিকে পা বাড়ালেন তিনি। বেলকনিতে গিয়ে দেখলেন রাশফিন পড়ে আছে ফ্লোরে, নাক দিয়ে হালকা র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চি*ৎকার করে ছেলেকে ডাকলেন তিনি। ছেলের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে তিনি দ্রুত হসপিটালে নিয়ে এলেন।

রাশফিনের শরীরের এমন খারাপ অবস্থার কথা শুনে আমিও আর বাসায় থাকতে পারলাম না। দ্রুত ছুটে চলে এসেছি হসপিটালে।

একটু আগে মামনি আমায় ফোন দিয়ে উপরোক্ত খবরটা জানালো। আমার কর্নকুহরে কথাটা পৌছানো মাত্রই যেন আমার সর্বাঙ্গ ঝিনঝিনিয়ে উঠল। কিছু সময়ের জন্য আমি থমকে গিয়ে ছিলাম যেন। হুশ ফিরতেই সাত পাচ না ভেবে দৌড়ে ছুটে গেলাম হসপিটালে।

মামনি আমায় দেখতেই দৌড়ে এসে জাপটে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলেন। আমি তাকে কি বলে স্বান্তনা দিব তার কোনো ভাষা খুজে পেলাম না আমি। আমার নিজেরও তো কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এই মানুষটাকে ভালো বেসেছিলাম। আমি কখনোই ভাবতে পারিনি রাশফিনের এমন অবস্থা হবে।

কেবিনের দরজার ছোট কাচের জানালার দিকে তাকাতেই শুধু রাশফিনের মুখটা দেখতে পেলাম। মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগানো। শুধু এতো টুকু বুঝতে পারলাম, রাশফিনের মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে একদম। সেই আগের মতো সুন্দর চেহারাটাও আর নেই। ফর্সা মুখ খানা একদম কালসিটে হয়ে গেছে।

রাশফিনের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠল। চোখের অবাধ্য অশ্রু গুলো আমার গাল বেয়ে টপটপ করে পড়তে লাগল। আমি চাইলেও আমার কান্না থামাতে পারছি না কিছুতেই।

মামনি এবার কিছুটা কান্না থামিয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এতো কিছুর মাঝে এই মানুষটার খোজ খবর নেওয়ার কথা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। এজন্য আমার নিজের মাঝেই কেমন একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগল। রাশফিনের সাথে না হয় আমার যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মামনির সাথে তো ছিল।

আমার উচিত ছিল একবার হলেও খোজ নেওয়া এই মানুষ টার, এখানে তো আর মামনির কোনো দোষ ছিল না। মামনি কান্না থামিয়ে ধরা গলায় আমায় বললেন

-‘ কেমন আছিস রে মা? তোকে অনেক মিস করছি রে এতো দিন। এক বার তো খোজ নিতে পারতিস তুই? বাড়িতেও এক বারের জন্যে এলি না।

আমি চুপ করে রইলাম। কিছুটা সময় অতিবাহিত হলে আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললাম

-‘ আছি কোনো রকম। আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম তোমাদের কথা। সরি, মামনি। আর আসতাম কোন অধিকারে…

আমি থেমে গেলাম। মুখ ফোসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিছু কথা। এই মুহূর্তে এ কথা গুলো বলা ঠিক হবে না। মামনি কে পরেও বলা যাবে এ ব্যাপারে। তাই চুপ করে গেলাম আমি।

ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে মামনি বললেন

-‘ কি বলতে গিয়ে থেমে গেলি রে তুই?

-‘ ক কই কিছু না তো মামনি।

আমায় আমতা আমতা করতে দেখে মামনি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। যেন আমার কথা তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
তিনি বললেন

-‘ কিছু তো একটা হয়েছেই। না বললে আমি কিভাবে বুঝবো? সেদিন রা*গ করে চলে এলি। বাসায় একবারও গেলি না, ব্যাপার কি বল তো?

এই খারাপ সময়ে আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছিলাম না, তবে মামনির জোড়াজুড়ি করাতে কিছু না বলেও পারলাম না।

-‘ এক নিমিষেই যে সব শেষই হয়ে গেল আমার, মামনি। কোন মুখ নিয়ে আর কোন অধিকারে যেতাম আমি তোমাদের বাসায়?

-‘ মানেহ্, কি হয়েছে সবকিছু খুলে বল তো আমায়?

-‘ তোমার ছেলে আমায় ডিভোর্স দিয়েছে, মামনি।

কথাটা বলতে বলতে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম।

রাহেলা খাতুন চমকালেন। তার ছেলে খারাপ আচরণ করেছে এটা ঠিক কিন্তু তাই বলে ডিভোর্স দিবে, এটা কখনোই হতে পারেনা। অরনিশা চলে যাওয়ার পর তিনি ছেলেকে যতটা পেরেছেন চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেছেন, প্রতি মুহূর্তে নিজের ছেলেটাকে কাদতে দেখেছেন শুধুমাত্র অরনিশার জন্য।

এইতো সেদিনও রাশফিন তার মাকে জড়িয়ে ধরে কেদেছিল, অনেক কেদেছিল। নিজের করা কৃতকর্মের জন্য বড্ড অনুতপ্ত সে। কিন্তু এগুলো তো ও আর সজ্ঞানে করেনি। রাশফিন বুঝতে পারেনা ওর সাথে হচ্ছেটা কি।

তার পরই তো প্রচণ্ড মাথা ব্যাথায় অসুস্থ হয়ে পড়ল রাশফিন। আর আজ এই অবস্থা।

আমার কথায় ধ্যান ভাঙল মামনির। মামনি আমায় একে একে সব বলতে লাগলেন ঠিক যা যা রাশফিন বলেছিল রাহেলা খাতুনকে।

আমি সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লাম আমি। মামনি রাশফিনের ফোনটা বের করে ছবি গুলো দেখালেন আমায়। আমি আরও এক দফা অবাক হলাম। অবাক হয়ে বললাম

-‘ এটা তো আহনাফ, আর ওর পাশে এই মেয়েটা কে? আর এই ছবি গুলো রাশফিনের ফোনে এলো কিভাবে?

-‘ রাশফিনের ভাষ্য মতে এটা নাকি তুই ছিলি?

-‘ ইম্পসিবল, আমি এটা কখনোই হতে পারি না। আরে আমার সাথে তো আহনাফের বেশ কয়েক বছর ধরেই কোনো যোগাযোগ ছিল না। আর না আমি কখনো কোথাও এভাবে গিয়েছিলাম ওর সাথে। আর না আমার ফেস বুঝা যাচ্ছে। আমি যে গিয়েছিলাম সেটা আমি নিজেই জানি না।তাহলে আমি এটা হলাম কিভাবে?

সবার আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ছবিতে আমি না হলে এটা কে তাহলে? আমায় কেউ ফাসাতে চাইছে না তো? এসব ভাবতে ভাবেই আমি কিছুটা থেমে বললাম

-‘ আচ্ছা, মামনি এই ছবি গুলো রাশফিন কে দিয়েছে কে, বল তো?

-‘ ফারিহা দিয়েছে এই ছবি গুলো। আমার তো মনে হচ্ছে সব কিছুর মুলে এই ফারিহা ই আছে। তোদের সম্পর্কে ফাটলটা এই ফারিহা ই ধরিয়েছে।

আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম। ফারিহার জন্যই তবে এতো কিছু হলো। এবার কিছুটা পরিষ্কার হলো। তবে সবটা না। এতো কষ্ট পেলাম আমি যার জন্য তার যেন জীবনেই ভালো না হয়। কঠিন শাস্তি পায় যেন ফারিহা। নিজের অজান্তেই ফারিহাকে অ*ভিশাপ দিয়ে বসলাম আমি।

আমাদের দুজনের মাঝেই পিন পতন নিরবতা বিরাজ করছে। হঠাৎ মামনির ফোন বেজে উঠায় ধ্যান ভাঙল আমার। ফোন বের করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই বিরক্তির ছাপ মুখে ফুটে উঠল মামনির। বেশ কয়েক বার ফোন বাজার পর বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলেন তিনি।

লাউড স্পিকারে দেওয়ার কারণে আমরা ফোনের অপর পাশ থেকে শুধু শুনতে পেলাম নাফিয়া রহমানের কান্না মিশ্রিত কণ্ঠের করুন আর্তনাদ..

#চলবে ~

#আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১১

কা’র এ*ক্সি*ডে*ন্টে শরীরের একটা পাশ একদম থে*ত*লে গিয়েছে ফারিহার। মাথাতেও বেশ গু’রু’ত’র ভাবে আ*ঘা*ত লেগেছে। একমাত্র মেয়ের এমন র*ক্তা*ক্ত, থে*ত*লা*নো শরীর আর এমন ক’রু’ণ অবস্থা যেন কিছুতেই স’হ্য করতে পারছেন না নাফিয়া রহমান। তিনি সেই তখন থেকেই চি*ৎকার করে কে’দেই চলেছেন।

এই তো, একটু আগেই, ফ্রেণ্ডরা মিলে ঘুরতে বেরিয়েছিল। ফিরে আসার সময় আড্ডা দিতে দিতেই গোধুলী লগ্নে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছিল ফারিহা আর ওর ফ্রেণ্ডরা। তখন কে জানত যে, কিছুক্ষণ বাদেই ওরা পতিত হতে চলেছে দূ’র্ঘ’ট’না’র কবলে। যা কিনা কে’ড়ে নিতে পারে ওদের সুন্দর ভবিষ্যত অথবা জী’ব’ন, এমনকি হতে পারে মৃ*ত্যু। ফারিহা এক হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছিল আর অন্য হাতে ফোন চালাচ্ছিল, সেই সাথে অন্য দিক ফিরে গল্প করছিল ফ্রেণ্ডদের সাথে।

এমন সময় হঠাৎ ওদের গাড়ির সামনে আরেক টি গাড়ি চলে আসাতে স’জো’রে ধা’ক্কা লাগে। ফলে দুটি গাড়ি সংঘর্ষের ফলে সামনের দিক থেকে দু’ম’রে মু’চ’রে যায়। এবং এক সাইডে কাত হয়ে পড়ে। যে সাইডটা কাত হয়ে পড়েছিল ঐ সাইডেই ফারিহা ছিল।

পরবর্তীতে ঘটনা স্থলে লোকজন জড় হয়ে গেলে গাড়ির ভিতরের সবাইকে টে’নে হি’চ’ড়ে বের করে আনা হয়। ঘটনা স্থলে দুই জন সাথে সাথেই মা*রা যায়। আর ফারিহাসহ আরও তিন চার জনকে হসপিটালে আনা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষ’তি’ গ্র’স্থ ফারিহা। আর বাকিরা তুলনামুলক কম ক্ষ’তি গ্রস্থ হয়েছে।

একটু আগে নাফিয়া রহমান মামনিকে ফোন দিয়ে এই খবরটিই দিলেন। খবরটা শুনে আমি আর মামনি দুজনেই ছুটে গেলাম। রাশফিন যে হসপিটালে সেই হসপিটালের থার্ড ফ্লোরে ফারিহা। তাই যেতে খুব বেশি সময় লাগলো না।

ফারিহা মানুষ হিসেবে হয়তো অনেক বেশি খা’রা’প’, আমার আর রাশফিনের অনেক ক্ষ’তি করেছে, কিন্তু তার বি’প’দে’র সময় এসব মনে রাখা উচিত না বলে আমি মনে করি। আর তাছাড়াও এসময় নাফিয়া রহমানের মেন্টালি সাপোর্ট দরকার। তিনিও বা একা একা কিভাবে সামলাবেন সবটা।

নাফিয়া রহমান আমাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি যে আমায় স’হ্য করতে পারেন না, সেটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি আমি। মামনিকে জড়িয়ে ধরে কেদেই চলেছেন সেই তখন থেকে তিনি।

কেবিন থেকে ডক্টর গম্ভীর মুখে বের হতেই তার ছুটে যান নাফিয়া রহমান। কাদতে কাদতে তিনি বলেন

-‘ ডক্টর, আমার মেয়ে, কি অবস্থা ওর এখন? ওকে কি দেখা যাবে একবার?

ডক্টর গম্ভীর মুখে চুপ করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এদিকে আমরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ডক্টরের দিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন

-‘ আমরা তো আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছিই তবে রোগীর কন্ডিশন তেমন একটা ভালো নয়।

কিছু একটা ভেবে ডক্টর বললেন

-‘ হ্যা, আপনারা রোগীকে দেখতে যেতে পারেন।

এতো টুকু বলে চলে গেলেন ডক্টর। ডক্টরের এমন কথা শুনে দৌড়ে কেবিনের ভিতরে চলে গেলেন নাফিয়া রহমান, পিছু পিছু আমরাও গেলাম। ভিতরে গিয়ে মেয়েকে দেখেই হু হু করে কেদে দিলেন নাফিয়া রহমান। তাকে কি বলে স্বান্তনা দিব তার ভাষা নেই আমাদের কাছে।

বেশ কিছুটা সময় পর ফারিহার জ্ঞান ফিরে এলো। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো ফারিহা। আশপাশ ঘুরে দেখতে লাগল সে এখন। আমার দিকে চোখ পড়তেই যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল ফারিহা। হাত দিয়ে ইশারায় কিছু যেন বোঝাতে চাইছে আমায়। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। ওর একটু কাছে গিয়ে বোঝার বৃথা চেষ্টা করছি মাত্র।

আমাকে দেখে মেয়েকে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়তে দেখে নাফিয়া রহমান ধমকের সুরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন

-‘ এই মেয়ে বেরিয়ে যাও এখান থেকে। দেখতে পাচ্ছ না, আমার মেয়ে কেমন করছে তোমায় দেখে। এখন যদি ওর কিছু হয়ে যায়, তবে তোমায় আমি মে*রেই ফেলবো।

নাফিয়া রহমানের এমন কথা শুনে আমি যখনই বেরিয়ে আসতে যাব কেবিন থেকে ওমনি আমার হাতটা খপ করে ধরে বসে ফারিহা।

ফারিহার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তবুও অক্সিজেন মাক্সটা সরিয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে হাপাতে হাপাতে আমায় বলল

-‘ আমাকে মাফ করে দাও অরনিশা। আমি তোমার সাথে অনেক অ’ন্যা’য় করেছি।

আমি ফারিহার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালাম। মেয়েটার এমন করুন অবস্থা দেখে আজ বড্ড মায়া হচ্ছে আমার। এই পৃথিবীতে আমরা আজ আছি, তো কাল নেই। কি দরকার ছিল দুই দিনের দুনিয়াতে, মানুষের ক্ষ’তি করা। কথায় আছে না, পা’প বাপকেও ছাড়ে না। মানুষের ক্ষ’তি করলে, কেউ নিজে কখনোই ভালো থাকতে পারেনা।

ফারিহা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল

-‘ মাম্মি আর মামি, তোমরা একটু বাইরে যাবে, আমি একটু অরনিশার সাথে একা কথা বলতে চাই।

নাফিয়া রহমান কিছুতেই মেয়েকে একা ফেলে যাবেন না। তবে ফারিহা বলাতে তিনি বাধ্য হলেন যেতে। এদিকে মামনি আমায় কিছুতেই ফারিহার সাথে একা ফেলে যাবেন না। অবশেষে মামনিকে এমন করতে দেখে ফারিহা বলল

-‘ আচ্ছা, মামি, তুমিও থাকো অরনিশার সাথে। সমস্যা নেই।

ফারিহার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবুও শ্বাস শ্বাস টেনে টেনে বলল

-‘ জানো, অরনিশা, আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে খুব। আমার করা কৃতকর্মের ফল হয়তো আমি দুনিয়া থেকেই পেয়ে যাচ্ছি। তবে তোমায় আমি সব সত্যিটা বলে আমার পাপের বোঝা কিছুটা হলেও হালকা করতে চাই। আমার কথা গুলো একটু মনোযোগ দিয়ে শোনো।

আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ফারিহার দিকে। ফারিহা আবার বলতে শুরু করল

-‘ অরনিশা, তোমার আর রাশফিনের ডিভোর্স হয়নি। রাশফিন তোমায় সেদিন ডিভোর্স পেপার পাঠায়নি আর না আমাদের বিয়ে হয়ছিল। আমিই পাঠিয়ে ছিলাম ডিভোর্স পেপার, আর বিয়ের ছবি গুলোও আমিই পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু ওগুলো আসল ছিল না। ওর ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে ছবি তুলেছিলাম সাথে এডিটও করেছিলাম যাতে বোঝা না যায় ছবি গুলো দেখলে। আর তুমিও যেন ভুল বুঝে রাশফিনের থেকে দূরে চলে যাও।

আমি চমকালাম ফারিহার কথা শুনে। তার মানে আমার আর রাশফিনের ডিভোর্স হয়নি। আমি আর মামনি একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলাম।

এবার আমি রাশফিনের ফোনটা বের করে ঐ ছবি গুলো ফারিহাকে দেখাই যেই ছবি গুলোর কারণে রাশফিন সন্দেহ করেছিল আমায়। ছবি গুলো দেখে ফারিহা করুণ কণ্ঠে বলল

-‘ আমিই তোমাদের বিয়ের রাতে রাশফিনকে এই ছবি গুলো দিয়ে ছিলাম সাথে উস্কানিমূলক কথা বলে ওকে একদম রা*গিয়ে দিয়েছিলাম। আমি ভালো করেই জানতাম, একটুর থেকে একটু কিছু হলেই রাশফিন প্রচণ্ড রেগে যায় তাই ওকে তোমার নামে যা নয় তাই বলে রা*গিয়ে দেই। আর তাছাড়াও রাশফিন আমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করতো, কারণ আমি যা বলতাম তা সবসময় সত্যিই বলতাম কিন্তু হঠাৎ করে যে ওকে আমি এমন ভাবে মিথ্যা বলবো এটা ও ভাবতেও পারেনি। নিশ্চয়ই ছোট থেকেই যাকে বিশ্বাস করে আসছে, তাকেই বিশ্বাস করবে, দুদিনের একটা অপরিচিত মেয়েকে নয়। আর তাই তো ওর এই বিশ্বাসেরই সুযোগটা নিয়েছিলাম আমি। আর এটাকেই আমার হাতিয়ার বানিয়েছিলাম।

ফারিহার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম কয়েক মুহূর্ত। মামনি তে*ড়ে যেতে লাগলেন ফারিহাকে মা’রার জন্য। আমি তাকে ঠেকালাম। এটা দেখে ফারিহা মলিন হাসল। আমি কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বললাম

-‘ আমার মনে পড়ে না, তোমার কোনো দিন ক্ষ’তি করেছিলাম কিনা? তবে তুমি কেন করলে আমার সাথে এমন?

-‘ তোমার সাথে কখনোই আমার কোনো শত্রুতা পূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। তবে যদিন থেকে তুমি রাশফিনের বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছো, সেদিন থেকে আমি তোমায় স’হ্য করতে পারিনা, জাস্ট।আর তা-ই তো এতো কিছু করলাম যাতে তোমাকে হ’টি’য়ে আমি রাশফিনের বউ হতে পারি।

এতো টুকু বলে থামল ফারিহা। ওর নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। এখন নিশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে ফারিহার। তবুও কষ্ট করে বলল

-‘ আর জানো? রেস্টুরেন্টে তোমার সাথে সেদিন যে ব্যবহারটা রাশফিন করেছিল, ওটা ও মোটেও সজ্ঞানে করেনি। আমি ওর শরীরের ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ পুষ করেছিলাম। ফলে ও তখন কি বলেছিল বা কি করেছিল, সে বিষয়ে ওর কোনো ধারণাই নেই।

এটা শুনে চমকে উঠলাম আমি। মনে হচ্ছিল এখনই গিয়ে ফারিহাকে গ’লা টি’পে মে*রেই ফেলি। কাটকাট কণ্ঠে জবাব দিলাম

-‘ তোমার জন্যই এতো কিছু হয়েছে। তুমি-ই মেইন কার্লপ্রিট। আমরা ভালো ভাবেই সংসারটা করতে পারতাম কিন্তু তোমার মতো কা*ল*না*গি*নে’র জন্যই আজ এই অবস্থা আমাদের। আর তোমার জন্য শুধু মাত্র তোমার জন্যই আজ রাশফিনের এই অবস্থা।

এতোটুকু বলে আমি কান্নায় ভে’ঙে পড়ি। ফারিহা আমার কথা শুনে বেশ উ’ত্তে’জি’ত হয়ে বলল

-‘ ক কি হয়েছে রাশফিনের?

-‘ রাশফিনের ব্রে’ই’ন টি*উ*মা*র হয়েছে। ওকে আইসিউ তে রাখা হয়েছে। ডক্টর জানিয়েছে রাশফিনের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। যে কোনো সময় যা কিছু…

আর বলতে পারলাম না এতোটুকু বলে থামলাম আমি। আমার কথাটা শুনে এবার নি’স্তে’জ হয়েছে পড়ে ফারিহা। ওর চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ে কয়েক ফোটা নোনা জল।

অনেক ক’ষ্ট করে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে শ্বাস টেনে ফারিহা বলল

-‘ আমায় মাফ করে দিও অরনিশা। যদিও আমি আসলেই ক্ষমার অযোগ্য। তুমি রাশফিনকে কখনো ভুল বুঝো না, ও সত্যিই অনেক ভালো। আর হ্যাঁ আমার মায়ের থেকে সাবধানে থেকো তুমি, কারণ আমি মা*রা গেলে আমার মা তোমার অনেক ক্ষ’তি করার চেষ্টা করবে, কখনোই তোমায় ছাড়বেনা আমার মা। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু একা দোষী নই আমার সাথে তোমার বেস্টফ্রেণ্ড আহনাফও ছিল।

ফারিহার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমি যেন থমকে গেলাম। মানেহ্ আহনাফও ফারিহার সাথে জড়িত তার মানে। আমার বিশ্বাস নিয়ে এতোটা ছিনিমিনি খেলতে পারল কি করে আহনাফ। যাকে কিনা নিজের বেস্টফ্রেণ্ড, নিজের ভাইয়ের মতো দেখতাম। সে-ই এমন কি করে করতে পারল আমার সাথে?

ফারিহা ঘন ঘন শ্বাস টেনে টেন বলল

-‘ অ অর অরনিশা, ভালো থেকো বোন, তুমি অনেক সুখী হও। আমার হাতে যে আর খুব বেশি সময় নেই। আর শোনো, রাশফিনকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিও না। ও তোমায় অনেক ভালোবাসে। আর ঐ আহনাফ থেকে দূরে থেকো। রাশফিনকে ড্রাগ দেওয়া, এটা ওরই প্ল্যান ছিল। রেস্টুরেন্টে তো ওই…

আর কিছু বলতে পারল না ফারিহা। ওর প্রচণ্ড রকম শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। আমি চি*ৎকার করে ডক্টরকে ডাকি। ততক্ষণে সব শে’ষ। ফারিহা মৃ*ত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে। ফারিহা ততক্ষণে পাড়ি দিয়েছে প’র’পা’রে।

আমার চোখের সামনে খুব দ্রুতই যেন ঘটে গেল সবকিছু। সবটা যেন দুষ্স্বপ্ন মনে হচ্ছে আমার। আজ সবটা ক্লিয়ার হলো তবে আহনাফ এমন বি*শ্বা*স*ঘা*ত*ক*তা করলে কিভাবে আমার সাথে?

#চলবে ~