#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১৯)
নুসরাত জাহান লিজা
ডায়েরিটা পড়ার পর থেকেই অবন্তীকে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা পেয়ে বসেছে। অয়নের জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু তার টিকিটারও দেখা নেই। ফোন করেছে কয়েকবার, শেষবার ধরে কেবল রুক্ষভাবে বলেছে,
“এত কল দিতেছিস কেন? ব্যস্ত আছি বুঝতে পারতেছিস না?”
বলেই কল কেটে দিয়েছে, অবন্তী ফুঁসে ওঠে নিজের মনে কয়েকবার আওড়েছে, “তুই খালি বাসায় আয়, তোর ব্যস্ততা আমি ছুটাইতেছি। ফাজিল।”
নিজের ঘরে বসেছিল, শাফিন ফোন করেছে। অবন্তী ভাবল শাফিনকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই বুঝবে। এই ভেবেই কল রিসিভ করল।
“কী করিস অন্তি?”
“এমনিতেই বসে আছি।”
“আমি যে কী পরিমাণ খুশি তোকে বলে বুঝাইতে পারব না রে। ফাইনালি তুই আমার জীবনে আসছিস। আচ্ছা, আমরা কী সবসময় তুই করেই কথা বলব? না মানে, আমাদের সমস্যা নাই, কিন্তু ধর বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে গেল। তাদের সামনে…”
“সেটা তখন দেখা যাবে। শোন শাফিন, বাসা ভর্তি মেহমান, এখন কথা না বললেই ভালো বোধহয়। পরে কথা হবে।”
অবন্তী যতটা সহজে শাফিনকে বলবে ভেবেছিল ততটা সহজ নেই বিষয়টা। ছেলেটা এত স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলেছে ওকে নিয়ে, সেটা ভেঙে দেবার অধিকার কি অবন্তীর আছে?
সেই রাতে অয়ন ফিরল না। পরেরদিন সকাল হতেই খুব তোরজোর শুরু হয়ে গেল। বেলা যত বাড়ে অবন্তীর উৎকণ্ঠা তত বাড়ে৷ একবার অন্তত অয়নের সাথে দেখা করতেই হবে, আজকেই যে শেষ সুযোগ। কিন্তু সে ছেলের তো দেখা নেই৷ কয়েকজন এসে দুই হাত ভর্তি করে মেহেদী দিয়ে গেছে।
অবন্তী বিকেল হতেই ঘরের ছিটকিনি আটকে বসেছে। মাকে বলেছে এখন ঘুমাবে, কেউ যেন বিরক্ত না করে।
শুয়ে শুয়ে অয়নের ডায়রি খুলল, বিশেষ বিশেষ জায়গা বের করে পড়তে লাগল আরেকবার।
“তোকে যেদিন শাড়ি পরার পরে ফাজলামো করে অনেককিছু বললাম, তুই সেদিন যদি সবসময়ের মতো তেড়েফুঁড়ে এসে কিছু মাইর দিতি তাহলেই ঝামেলা চুকেবুকে যেত। তুই তা না করে কেন কেঁদেকেটে অভিমান করে ফিরে গেলি? তোর ওই অভিমান ভরা কান্নাভেজা মুখে আমি সেদিন ডুবে গিয়েছিলাম। এক অদ্ভুত মায়ার টানে আমাকে তুই টানছিলি প্রতিনিয়ত। আমার চোখে সারাক্ষণ তোর ওইদিনের ছবিটা ভেসে উঠতে লাগল। এর আগেও তোকে কত কী বলেছি, তুই আমাকে পাল্টা আক্রমণ করেছিস, মেরেছিস, চেঁচামেচি করেছিস। কিন্তু সেদিন কিছুই করলি না, শুধু একরাশ অতল অভিমান করে বসে রইলি। যা এতটা শক্তিশালী যে আমাকেও তলিয়ে দিল। নতুন একটা উপলব্ধি হলো নিজের মধ্যে যার নাম ভালোবাসা।”
পাতা উল্টে আরও বেশকিছুদিন পরের লেখায় চলে গেল, “তুই আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দে, আমি ছাই হয়ে উড়ে যাই। তারপর আবার তোর ভালোবাসাতেই নতুন করে ফিনিক্সের মতো মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠব, নতুন করে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাব। আমি তোর ভালোবাসায় বারবার জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হতে চাই। তোর ভালোবাসাতেই অনিবার বাঁচতে চাই, মরতেও চাই।”
“আমার খুব অদ্ভুত একটা স্বপ্ন আছে। তুই তো শুনবি না কখনো, তাই লিখেই রাখছি। আজ থেকে বহু বছর পরে যখন তোর আর আমার চুলে পাক ধরবে, দাঁত নড়বড়ে হয়ে যাবে সেইসময় অভ্যাসবশত অনেক রাতে তুই চা বানাতে গেলি রান্নাঘরে, আমি পিছু নিলাম। আমি স্বভাবসুলভ কথায় তোর গা জ্বালিয়ে দিলাম, কারণ প্রেম প্রেম কথা আমার কখনো ঠিক পোষাবে না। তুই উদগ্র রাগে পাশে রাখা খুন্তিটা আগুনে দিয়ে গরম করে আমার হাতে ছ্যাঁকা দিয়ে দিলি। জানি এটা তুই খুব করে করতে চাস। হা হা হা। এরপর তুই হুঁশ হলেই, চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে আমার হাতের ক্ষতের শুশ্রূষায় নেমে যেতি সেটা খুব ভালো মতো অনুমেয়। বিশ্বাস কর, তোর কান্নামাখা ভালোবাসা আমাকে নিমিষেই সুস্থ করে দিত। ওই বয়সেও তোকে আমি এভাবেই চাই। একইরকম স্ট্রং, দুর্বোধ্য, দৃঢ় খুন্তিকেই চাই। একসাথে জীবনের পথ হাঁটতে হাঁটতে বুড়ো হওয়াটা নিশ্চয়ই চমৎকার ব্যাপার হতো! কিন্তু চাইলেই কী আর সব হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়? আমার যা ফাটা কপাল! তোকে চাইতে ভীষণ ভয় হয়!”
“তোকে কখনো এসব বলার সাহস হয়নি, নিজের ভাঙা জীবনের সাথে তোকে জড়াতে চাইনি কোনোদিন। কিন্তু ভালোবাসা বলে কয়ে হয় না। না চাইতেও তোর প্রতি অনুভূতি এমন প্রগাঢ় হলো যে এখন মনে হয় নিজেকে ছাড়া বাঁচব কিন্তু তোকে ছাড়া সম্ভব নয় বোধহয়। মন কেন মস্তিষ্কের বারণ শোনে না?”
“আমি যে তোর অযোগ্য সেটা বহু আগে থেকেই জানতাম, কিন্তু আজ ছোটচাচী সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। অবশ্য ভালোই হলো, তোকে এতদিন নিজে নিজে ভুলতে চেষ্টা করে করে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম, এখন চাচীর কথায় নতুন করে তোকে ভুলতে চাইবার সাহস পেলাম। তুই যখন আমাকে তোর ভালোবাসার কথা জানালি, বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল সব ভেসে যাক, আমি আরাধ্য ভালাবাসাটুকু আঁকড়ে ধরি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো খাঁটি হীরের পাশে অন্তত স্বর্ণ হলেও মানা যায়, কিন্তু আমার মতো তামা বা সীসা বড্ড বেমানান। তুইও যে আমাকে তোর জীবনে ভালোবেসে চাস, এইটুকু সুখ আর প্রাপ্তি নিয়ে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারব রে। কিন্তু আমার ছন্নছাড়া জীবনের সাথে তোর জীবন জুড়ে দিয়ে সেটাকে নষ্ট করতে পারব না। তোকে দেখতে আসবে শুনে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম কয়েকদিনের জন্য।”
“তুই বিয়ে কেন ভেঙে দিলি? আমাকে আবার আশায় বসতি গড়ার সাহস কেন দিলি? বারবার ভেঙে যাবার সাহস আমার নেই। তাই তোর সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু তোকে মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে আর পারলাম কই। দূরে থেকেও তো ঠিকই পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে গেলাম। তোর ভালোবাসায় এত উত্তাপ কেন রে? না চাইতেও দগ্ধ করে দেয়। আলোকবর্ষ দূরত্বেও ভীষণভাবে পুড়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।”
“যেখানে তোর স্মৃতি পুরো বাড়ি জুড়ে সেখানে থাকাটা আমার দ্বারা আর হবে না। তাই বহু দূরে চলে যাওয়ার চেষ্টা, বলতে পারিস পালিয়ে যাওয়া। তোকে কখনো এভাবে চাইব জানলে নিজেকে কোনোদিন ভেসে যেতে দিতাম না রে, যত কষ্টই হোক, বাবার সাথে হারজিতের খেলায় নিজের জীবনকে বাজি হিসেবে ধরতাম না। এখন ফেরার পথ নেই, তাই পালিয়ে যাওয়া। চোরাবালিতে আটকে গেছি। তুই খুব সুখী হবি দেখিস। মুখে যাই বলি মন থেকে তোর খারাপ চাওয়ার স্পর্ধা কোনোদিন হয়নি রে! তোর ভালোবাসায় আমি নিজে সহস্রবার মরতে পারব, কিন্তু তোর কোনো ক্ষতি আমি হতে দেব না!”
অবন্তীর চোখ আবার ভিজে এলো, এই গোঁয়ার গোবিন্দ, ঘাড়ত্যাড়া, একগুঁয়ে ছেলেটা কবে মনে মনে ওকে এতটা ভালোবেসে ফেলল, আর সে কিনা কিছু বুঝতেই পারল না। অগোচরে ওর জন্য ভালোবাসার হিমালয় জমে আছে জানলে কী অবন্তী এমন ভুল করত? কী এক দোটানায় জীবনকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটুও কেন আভাস পেল না, বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল আরেকবার।
***
অয়ন বাসায় ফিরেছে দশটার পরে, মা খাবার দিয়েছে, সে কোনোমতে খেয়ে ছাদে চলে এসেছে। বাড়িতে আজ উৎসবমুখর পরিবেশ। এখন বারোটা ছুঁই ছুঁই বলে ছাদে যারা ছিল তারা নেমে গেছে। চারপাশের এত আলো অয়নের মনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠকে যেন কটাক্ষ করছে চরমভাবে। ওর ক্ষতকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করছে। কিন্তু আজ কোথাও পালানোর জায়গা নেই। বাবা বলে দিয়েছে বিয়েতে থাকতেই হবে। ক’দিন পরে তো চলেই যাচ্ছে, শেষবার তার কথা শোনাই যায়।
নিজের ভাবনায় যখন বুঁদ হয়ে ছিল, তখন হঠাৎ পেছন থেকে টান অনুভব করল, আর গালে প্রচণ্ড শক্তিতে কারোর হাতের চড় অনুভব করল। ভালো করে তাকিয়ে দেখল অবন্তী। অয়নের মাথাটা বোঁ বোঁ করছে, সর্বশক্তিতে মেরেছে পাগল মেয়েটা। তবুও মুহূর্তেই নিজেকে খোলসে ঢুকিয়ে রুক্ষ গলায় বলল,
“এসব কী খুন্তি? বিয়ের কণের এত রাতে এভাবে বাইরে থাকা মানায় না!”
“তুই একটা মিথ্যেবাদী, তোর কাছ থেকে আমি শিখব আমার কী করা উচিত?”
“আমি মিথ্যেবাদী, খারাপ, সব। তাতে তোর কী? তুই যা ভাগ এখান থেকে।”
অবন্তীর চোখে যেন আজ আশ্চর্য দৃঢ়তা এসে ভর করেছে, আগুন ঝরিয়ে বলল, “তুই কী কোনো থিয়েটার থেকে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিছিস? এমন নিখুঁত অভিনয় কীভাবে করিস? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না এখনকার বা সবসময়কার তুই সত্যি নাকি এটা?”
অবন্তীর হাতের দিকে লক্ষ্য করল এতক্ষণে, অয়নের ডায়েরিটা ওর হাতে দেখে অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। মনে মনে দু’বার বলল, “এটা ঠিক হয়নি। এটা একদম ঠিক হয়নি।”
গলার রুক্ষতা অব্যাহত রেখে মুখে বলল, “খুন্তি, তুই আমার ডায়েরি কেন পড়ছিস? তোর সাহস হলো কী করে?”
“আমার সাহস সম্পর্কে তুই খুব ভালো মতো জানিস। এত নাটক করলি কেন? আমার অনুভূতি খাটো করলি কেন?”
অয়ন মুহূর্তেই মিইয়ে গেল, এতদিনের যত তর্জন গর্জন ধরা পড়ার সাথে সাথেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নিজেকে, অবন্তীকে কীভাবে সামলে নেবে তার কোনো উপায় খুঁজে পেল না। অসহায়বোধ করল। এতটা অসহায় কোনোদিন লাগেনি নিজেকে।
“কী হলো বল?”
“পড়েই তো ফেলেছিস। আর কী বলব?”
“কিচ্ছু বলার নেই তোর?”
“কাল থেকে তোর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। শাফিন তোকে খুব ভালোবাসে। তুই অনেক সুখী হবি।”
“তোর এসব ঢং দেখতে এত রাতে ছাদে আসি নাই আমি। যা লিখছিস সেটা নিয়ে বল!”
“সেসব নিয়ে কিছু বলার নেই বললাম তো। আমি বাবাকে হারাতে গিয়ে নিজেই গো হারা হেরে বসে আছি। আমার সব স্বপ্ন হারিয়ে না গেলে আমি এই খেলায় নামতাম না, আর নিজেও ভেসে যেতাম না। বাবা ঠিকই বলে, আমি একটা অপদার্থ, নিষ্কর্মা ছেলে। আমার তোকে ভালোবাসার অধিকার নেই রে অন্তি, সবার ভালোবাসতে নেই।”
অয়নের গলাটা ভেঙে এলো, নিজের সংযম ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অবন্তী মরিয়া হয়ে বলল,
“আমি এত কিছু বুঝি না। এখনো সময় আছে। আমি আজই এই বিয়ে ভেঙে দেব। তারপর তোকে বিয়ে করব। আমি যাচ্ছি।”
চমকে উঠে অবন্তীর হাতটা টেনে ধরল অয়ন, “অন্তি, দেখ এটা করিস না। এভাবে কিছু হয় না। সব শেষ হয়ে যাবে।”
“কেন হয় না?”
“আমার মতো উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের সাথে কোনো মেয়ের পরিবার তার মেয়েকে দেবে না। তোর বাবা-মা, চাচা-চাচী কেউ রাজি হবে না। তাছাড়া তাদের এত ভালো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। পরিবারটা ভেঙে যাবে। এমনিতেই অনেক অশান্তি করেছি, আমার জন্য তাদের সম্পর্ক নষ্ট হোক এটা কোনোভাবেই চাই না। শাফিন এতদিনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, ওর স্বপ্নটা ভাঙতে পারবি?”
“চল পালিয়ে যাই অয়ন? তাইলে আর কারোর মুখাপেক্ষী হতে হবে না। অনেক দূরে চলে যাব। আমাদের খুব সুন্দর একটা সংসার হবে। তুই আর আমি একসাথে থাকব, একসাথে বুড়ো হব। চল না।”
অয়ন অবন্তীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, ঝাপসা হয়ে আসছে সামনে দাঁড়ানো অবন্তী।
“আমার চেনা খুন্তি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তুই এমন করিস না রে। এটা করলে আমরা কোনোদিন সুখে থাকতে পারব না। তোকে পরিবারের সবাই কতটা বিশ্বাস করে তুই জানিস? তোকে নিয়ে তাদের কত স্বপ্ন। আমার মতো তুইও একই ভুল করলে তারা বাঁচবে কী নিয়ে? তাছাড়া সবার স্বপ্ন ভাঙার দায় নিয়ে কখনো সুখ আসে না রে। তুই তো কত বুদ্ধিমতী, এমন ভুল করিস না, আমাকেও প্রলুব্ধ করিস না।”
অবন্তীর কান্না যেন আজ বাঁধনহারা, অয়নের হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে মরিয়া হয়ে বলল, “তুই সবার কথা ভাবছিস, অথচ তোর নিজের কথা, আমার কথা কেন এতটুকু ভাবছিস না? আমাকে তুই ভালোবাসিস না একটুও।”
“তোকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা বলে বোঝাতে পারব না। বেশি ভালোবাসি বলেই ফিরিয়ে দিতে পারছি। একটু কম ভালোবাসলে হয়তো স্বার্থপর হতে পারতাম। কিন্তু আমি চোরাবালিতে তলিয়ে গেছি, তুই জানিস না আমি কোথায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। দেশে থাকলে সেই গ্যাঁড়াকল থেকে টেনে বের করতে পারব না নিজেকে। হয়তো কারো হাতে খুন হব, নয়তো কাউকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলব, আর নয়তো নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে হবে। এটাই আমার নিয়তিতে নির্ধারিত হয়ে গেছে। এখনো কিছুটা সময় ছিল বেরুনোর, তাতেই বাইরে চলে যাবার সব গুছানো শেষ। শেষ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে চলে যাচ্ছি দূরে, তোর কাছ থেকে, সামনের নিয়তির কাছ থেকে। আমাকে পিছুটানে বাঁধিস না আর।”
কিছুটা থেমে অয়ন আবার বলল, “আমাকে এতটা ভালোবাসলি কেন? আমি তো এসবের যোগ্য নই। কেন আমার মতো একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলেকে ভালোবাসলি?”
“কে বলেছে তুই নষ্ট হয়ে গেছিস?” অবন্তী অয়নের ঠিক হৃদপিণ্ডের উপরে হাত দিয়ে বলল, “তোর এখানে অদ্ভুত সুন্দর নিরেট একটা হৃদয় আছে। যাতে পচন ধরা সম্ভবই না। যে নিজেকে বাদ দিয়ে অন্যের জন্য এভাবে ভাবতে পারে, সবার ভালো চাইতে পারে সে কীভাবে নিজেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষ বলে? আর কখনো এটা বলবি না।”
অবন্তীর হাত ভর্তি মেহেদীর দিকে নজর পড়ল অয়নের, টকটকে লাল হয়ে আছে। অয়ন ওর হাত দুটো সামনে নিয়ে এলো, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বলল, “তোর মনে আছে অন্তি, ছোটবেলায় তুই বলতি, যার হাতের মেহেদীর রঙ গাঢ় হয় তার বর তাকে খুব ভালোবাসে? তোর বর শাফিন তোকে খুব ভালোবাসবে, দেখ কতটা লাল হয়েছে।”
অয়নের চোখে পানির সাথে মুখে মৃদু হাসি, অবন্তী বলে উঠল, “এখন বড় হয়ে গেছি, এসব কুসংস্কার আর মাথায় আসে না। ছেলেভোলানো কথা বলে আমায় ভুলানোর চেষ্টা একদম করবি না।”
কিছুটা সময় নীরবেই কেটে গেল। আজ চাঁদের আলো এই বাড়ির আলোকসজ্জায় চাপা পড়ে গেছে। তবুও দুজন দু-জনের কাছে দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। এতদিন প্রাণপণে লুকানো অনুভূতি আজ প্রকাশিত বলেই যেন বড্ড বেশি বাঁধ ভেঙেছে।
“তুই সত্যিই সব শেষ করে দিচ্ছিস অয়ন?”
অবন্তীর এই কাতরতা, ব্যাকুলতা অয়নকে টুকরো টুকরো করে দিলেও সে যে অপারগ।
“বললাম না, বেশি ভালোবাসি বলেই ফিরিয়ে দিতে পারছি। কম ভালোবাসলে ফেরাতে পারতাম না। তোর জীবন নষ্ট করার অধিকার আমার নেই।”
“একবার আমাকে জড়িয়ে ধরবি অয়ন? শুধু একবার? এই এক মুহূর্তের জন্য তোকে পেলেও এক মুহূর্তের পূর্ণতা নিয়ে বেঁচে থাকব। তোকেও একটা মুহূর্ত দিতে চাই, একফোঁটা পূর্ণতা! ধরবি অয়ন?”
“তুই আজকে আমাকে বড্ড দুর্বল করে দিচ্ছিস অন্তি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি। নিজের সংযম যদি ভেঙে পড়ে?”
“তোর ভালোবাসার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জন্মেছে। আমি জানি তুই ভাঙলেও মচকাবি না। অবশ্য আমি চাই তুই ভেঙে পড়ে আমাকে আঁকড়ে ধর। আমি তোকে ছেড়ে যেতে চাই না।”
অয়ন কিছু বলল না, এই মেয়েটা ওকে এত ভালোবাসল কেন? অয়ন ভেবেছিল অনুভূতিটা তার একান্তই একার। কিন্তু অবন্তী বলার পরে আরও ভয় পেল।
“তুই আমাকে ভালোবাসিস, আমি তোকে ভালোবাসি। এর চাইতে বড় পূর্ণতা আর কীসে আছে? শুধু বাহ্যিকভাবে পাওয়াটাই কি সব? দুজনের মন তো একটা মোহনায় মিশে আছে। সবার ভালোর জন্য আমরা মনে মনেই নিজেদের হলাম নাহয়।”
অয়ন মনে মনে বিশ্বাস করে শাফিনের সাথে থাকতে থাকতে একসময় অবন্তী ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলবে। তখন অয়ন নামের একজন শুধু এক টুকরো বিষণ্ণতা হয়েই অবন্তীর মনে মিশে থাকবে।
“একটা গান শোনাবি অন্তি? তোর প্রিয় গান? আনন্দধারা বহিছে ভুবনে গানটার শেষের অংশটুকু?”
“তুই আমাকে খুন্তিই ডাকিস। এটা ছাড়া কেমন অপূর্ণ লাগে, তোকে দূরের মানুষ মনে হয়।
‘বসিয়া আছো কেন আপন মনে,
স্বার্থ নিমগন কী কারণে,
চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয়ও প্রসারি,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি।
প্রেমও ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে,
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,
দিন-রজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্তগগণে।
আনন্দধারা বহিছে…”
গান শেষ করে অবন্তী অয়নকে জড়িয়ে ধরল, নিজের হৃদয়ে এতদিনের জমা সমস্ত ভালোবাসা মিশে থাকল সেই প্রগাঢ় আলিঙ্গনে। অয়ন তাতে সিক্ত হতে থাকল। এবার অয়নের চোখের জলও গড়িয়ে পড়তে লাগলো অবন্তীর কাঁধে। ভীষণ লোভ হলো অয়নের, এই আলিঙ্গনে আবব্ধ সময়টা সহস্র বছর এভাবেই থেমে থাকুক না। খুব বেশি কী ক্ষতি হতো। কেন সে অবন্তীকে ওর জীবনে পেলো না? এত ব্যথা কেন করছে ভেতরটায়, অবন্তীকে বিদায়ের শেষবেলায় এসে কেন এভাবে নিজেকে শক্ত রাখতে পারল না? তবে এই শেষ মুহূর্তের প্রাপ্তিটুকুই ওর বাকি জীবনের রসদ। আজকের এই রাতের স্মৃতিটুকু সারাজীবন জিইয়ে রাখবে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখবে। এটাই বা কম কীসে!
অয়নের শূন্য জীবনে এই ভালোবাসাটুকুও যে অর্ঘ্যসম। শূন্য জীবন যেন আজ কিছুটা হলেও পূর্ণ, কানায় কানায় ভালোবাসায়।
অবন্তী আলিঙ্গণাবদ্ধ থেকেই বলল, “হৃদয় প্রসারিত করে শূন্য জীবনে কিছুটা প্রেম হলেও ভরে নে। গানের এটুকু তো তুই শুনতে চাইলি। আমার একটা শেষ চাওয়া আছে তোর কাছে। বল রাখবি?”
“আমার সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই রাখব। বল?”
“রাত পোহালেই আমাদের বাঁধন কেটে যাবে। শেষবার আমার সাথে সকালে বাইরে যাবি? আমি জানি তুই আর দেশে ফিরবি না। তোর সাথে এই বুঝি আমার শেষ দেখা। সেটাকে কিছুটা হলেও স্মরণীয় করে রাখতে চাই। যাবি? শাফিনকে নিয়ে ভাবিস না। ওকে আমি কখনো ঠকাব না। আজকের কথা সব বলব ওকে।”
অবন্তীর কথার মধ্যে যে আকুলতা ছিল সেটাকে এড়ানোর সাধ্য অয়নের মধ্যে আর নেই।
“হ্যাঁ যাব। তোর সাথে ঘুরতে। এখন তুই তোর ঘরে যা। এত রাতে ছাদে দেখলে যা হয়নি তেমন কিছু কথাও শুনতে হবে। সেটা আমি সইতে পারব না।”
অবন্তী অয়নকে ছেড়ে কিছুটা সরে এসে বলল, “তুই কবে এভাবে ভাবতে শিখলি অয়ন? তোকে নিয়ে আমার অনেক আক্ষেপ আছে, কিন্তু তোর আজকের ভাবনায় আমার ভালোবাসা আরও অনেকটা বেড়ে গেল রে। তোকে ভালোবেসে আমি কোনো ভুল করিনি। তুই মোটেও অযোগ্য নোস। তোকে হাজারবার ভালোবাসা যায়। তোর মনটা অদ্ভুত সুন্দর। এত সুন্দর মনটাকে সবসময় লুকিয়ে রাখলি কেন? আমার জন্য আর বড়চাচার জন্য?”
“খুন্তি, যা প্লিজ। বাসায় অনেক মানুষ। কে, কখন চলে আসবে? সকালে তো দেখা হচ্ছেই। বাকি কথা তখন বলি?”
অবন্তী আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরল অয়নকে, এরপর দৌড়ে বেরিয়ে গেল। নিজের ভালোবাসার মানুষের উপরে সব অধিকার ছেড়ে দিয়ে।
অবন্তী যাবার পরে অয়ন পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। কার্নিশে হেলান দিয়ে দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে পড়ল। এতটা দুঃখ সইবার মতো এতটা বড় মন কি ওর তৈরি হয়েছে আদৌ! আজ সে চিরতরে নিঃস্ব হয়ে গেল, নিজের কৈশোরের স্বপ্ন তো কবেই পেরেক ঠুকে বন্ধ করে দিয়েছে। আজ একমাত্র ভালোবাসাটাও সমাধিস্থ করে বসে আছে। এতটুকু জীবনে এতটা সইতে হলো কেন? কীসের দোষে!
অয়ন তখনো জানে না, ওর জীবনের সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হওয়া তখনও বাকি, ভালোবাসার মানুষের শেষ চাওয়া পূরণ করতে চাওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সেটা।
……..
(ক্রমশ)