আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-০৫

0
182

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
পর্ব-৫

সকাল সকাল কানিজের ফোন পেয়ে বেশ অবাক হলো শোভা। খুব জরুরি না হলে কানিজ তাকে বিরক্ত করে না। কিছু কি হয়েছে? কানিজের মুখ ভীষণ পাতলা। কোন বিষয় মনমতো না হলেই বিশ্রি ভাষায় কথা শোনায়। তাই পারতপক্ষে ওকে কেউ ঘাটায় না। শোভা ভয়ে ভয়ে ফোন তোলে-“হ্যালো কানিজ আপু, কেমন আছো?”
“তোর কি হয়েছে শোভা? ঠিক আছিস তো?”
“ঠিকই তো আছি আপু। আমার কি হবে?”
“সেদিন রিফাত আমাকে নক দিলো কেন? আমি তো মনে কর আসমান থেকে পড়ার অবস্থা। সামনা সামনি দেখা হলেও এই ছেলে আমার সাথে জীবনেও কথা বলে নাই। ইনফ্যাক্ট ওরা সবাই আমাকে খারাপ মেয়ে জানে। দূর থেকে আমাকে নিয়ে গসিপ করে। ওরা নিজেদের ইনটেলেকচুয়াল আর আমাকে কাপড় বেচনে ওয়ালি বলে। সেই ছেলেই কিনা নিজে থেকে আমাকে নক দিছে। ভাবতে পারিস?”
শোভা নিশ্চুপ হয়ে রইলো। ভেতরে ভেতরে ঘামছে সে। কানিজ গলা নিচু করলো-“তোর কথা জানতে চায়, শোভা। কি ঘটনা বল তো?”
“আমি জানি না আপা। সত্যিই জানি না। সেদিন অনুষ্ঠানে নিজে যেচে আলাপ করতে এলো, গাড়িতে লিফট দিলো। এই পর্যন্তই।”
ভার্সিটিতে দেখা হওয়ার ঘটনা চেপে গেলো শোভা। কেন চেপে গেলো নিজেও বুঝলোনা। কানিজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“শোন শোভা, রিফাতের বাপের বেশ টাকা পয়সা আছে। সামাজিক ভাবে অবস্থাপন্ন ওরা। এই ছেলে হয়তো শখের বশে ইউটিউবিং করে। এদের থেকে দূরে থাকিস বোন আমার। ওদের সাথে আমাদের যায় না।
এরা হয়তো দুই চারদিন তোর সাথে ঘুরবে বেড়াবে। সবার কাছে জাস্ট ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দেবে আর আড়ালে লুতুপুতু করতে চাইবে৷ কিন্তু সময় হলে ঠিকই বাপের পছন্দে বিয়ে করবে। কাজেই সাবধান। তোর জীবনে কেচ্ছা যা হওয়ার একবার হয়ে গেছে। আবার এমন কিছু হোক তা মোটেও চাই না। সেটা তোরা বা তোর পরিবার কারো জন্যই ভালো হবে না। এরপর কিছু হলে তোর বাবা সহ্য করতে পারবেনা শোভা।”
শোভার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখের কোনে জলের আভা। এবারও তাকেই শুনতে হচ্ছে অথচ কিছুই করেনি সে। শোভা অসহায় কন্ঠে আকুতি জানায়-
“আপু, আমি সত্যি জানি না সে কেন তোমাকে ফোন দিছে। বিশ্বাস করো? তার সাথে আমার যোগাযোগ নেই কোন।”
ইথারে কানিজের হাসির শব্দ ভেসে আসে-“দুর পাগলি, আমি কি তোকে অবিশ্বাস করছি? শুধু সাবধান করছি যাতে ভবিষ্যতে এমন কোন ঘটনা না ঘটে যাতে আবারও পস্তাতে হয়। বুঝতে পেরেছিস? রিফাতকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি। তুই ভাবিস না।”
“হুমম।”
“আচ্ছা রাখছি তবে। ভালো থাকিস।”
“আচ্ছা আপু।”
বলতে বলতে মাথা দুলায় শোভা। প্রচন্ড রাগ লাগছে তার। এই রিফাতটা কি শুরু করেছে? ওর পিছে লেগে আছে কেন এমন করে? তার প্রতি এত ইন্টারেস্ট কেন? কি চায় সে? আসুক এরপর, এমন অপমান করবে যে জীবনেও আর কোন মেয়ের দিকে তাকাবে না।

★★★

ভোর বেলা তৈরী হয়ে ডাইনিং আসতেই আদৃতাকে বসে খেতে দেখলো। ওর মাথায় গাট্টা মেরে নিজের চেয়ারে এসে বসলো রিফাত।
“আহহ ভাইয়া, এতো জোরে কেউ মাথায় মারে?”
আদৃতা মাথায় হাত বুলায়। রিফাত প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে চালান করে বলে-“তোর পড়ালেখার খবর কি? খালি প্রেম করছিস নাকি পড়ালেখার করছিস কিছু?”
আদৃতা একটু চমকায়। চেহারায় লজ্জার ছায়া-“মোটেও প্রেম করছি না ভাইয়া। শুধু শুধু মিছে কথা বলবে না।”
“মিথ্যে বলছি? তাহলে ওই সবুজ শার্ট পড়া ছেলেটা কে যে তোর ব্যাগ বহন করছিল?”
আদৃতা কাশলো। তোড়া চোখ বড় বড় করে আদৃতাকে দেখলো-“দিতি আপু, তুমি তো দেখি ছুপা রুস্তম। একই রুমে থেকে আমি কিছু টের পেলাম না কেন?”
রিফাত হাসলো-“তুই তো চোখেই দেখতে পাস না ওর প্রেম দেখবি কিভাবে?”
“কে বলেছে দেখতে পাই না? আমি তাহলে পড়ালেখা করছি কি করে?”
তোড়ার সহজসরল উত্তর শুনে আদৃতা আর রিফাত দু’জনেই হাসলো।
“সে তো চশমা দিয়ে পড়িস। চশমা ছাড়া কিছু দেখিস?”
“না তা দেখি না অবশ্য।”
রিফাত উঠে দাঁড়ায়-“আমার খাওয়া শেষ আমি উঠলাম। এই দিতি, ইউনি যাবি তো? চল আমিও যাবো।”
“হ্যা যাবো। কিন্তু তুমি আজ কেন যাবে?”
“কাজ আছে একটা। গেলে চল। আমি গাড়ি বের করছি।”
দিতি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে রিফাতের পেছনে ছুটলো।

প্রায় দিন রিফাতকে চোখে পড়ে শোভার। এসে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। ক্যামেরা নিয়ে ভিডিও করার ভাব ধরে। মাঝে মাঝে ক্যামেরার সামনে কথা বলে। শোভা জানে এসবই রিফাতের বাহানা তাই ওকে দেখলেই শোভা দ্রুত হেঁটে প্রস্থান করে। কথা বলার সুযোগ দেয় না কোন। কিন্তু আজ দেখেই এগিয়ে এলো। রিফাত বেশ অবাক হলো ওকে আসতে দেখে। শোভা সোজা এসে রিফাতের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ চোখ রেখে জানতে চাইলো-“কি সমস্যা আপনার?”
রিফাত ভ্যাবাচ্যাকা খায়-“আমি আবার কি করলাম?”
“কি করেছেন জানেন না? আমাকে কি বোকা মনেহয়?”
রিফাত দাঁত বের করে হাসলো-“নাহ, খুব চালাক আপনি।”
শোভা রেগে গেল-“ফাজলামো করবেন না একদমই। আপনি কানিজ আপুকে ফোন করেছেন কেন? আপনার জন্য কানিজ আপু কতোগুলো কথা শোনালো আমাকে।”
রিফাত চুপ করে যায়। শোভা আশপাশ তাকিয়ে দেখে নিল একবার। তার হলে যাওয়ার এই রাস্তাটা এখনো নীরব। সে সাপের মতো ফনা তুলে হিসহিসিয়ে বলে-“এখন চুপ কেন? কথা বলতে পারছেন না? কেন ফোন করেছেন কানিজ আপুকে? কতবার বলছি আমার পিছু ছেড়ে দিন। কথা কানেই তুলছেন না। বখাটে ছেলেদের মতো পিছে পড়ে আছেন। কত মানুষ চেনে আপনাকে। কেউ না কেউ দেখে ফেলবে না? কয়দিন পরে ক্যাম্পাসে কানাকানি শুরু হবে। হয়তো কেউ ভিডিও করে ছেড়ে দিবে। আর আমার অতীত যদি কেউ জানে তাহলে আরেকবার নতুন করে আলোচনা শুরু হবে। তারপর কি হবে ভেবেছেন?”
রিফাত উ্ত্তর দেয় না। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। শোভা হাল ছাড়া গলায় বললো-“কি চাইছেন বলুন তো? আপনি কি চান আমি পড়ালেখা বাদ দেই?”
রিফাতের চোখ অনবরত ঘুরছে চারপাশে। তাকে অসহায় দেখালো। আসলে সে নিজেও বুঝতে পারছে না কেন শোভার পেছনে পড়ে আছে। কারণে অকারণে জাবির ক্যাম্পাসে চলে আসছে। এমনকি ঝোঁকের বসে কানিজকে ফোন করে ফেলেছে। পরক্ষণেই মনে হয়েছে ভুল করেছে সে। এখন শোভার মারমুখী আচরণ দেখে লজ্জা লাগছে তার। যত যাই হোক তার একটা ইমেজ আছে। শোভা যা বলছে তা মোটেও ভুল নয়। তাছাড়া বন্ধুরা জানলেও ভীষণ বিব্রত হতে হবে।
“তুমি আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলো না বলেই আমি বারবার আসছি। সেদিন তো ঠিকই কথা বললে আমার সাথে। অথচ এখন দেখা হলেই না চেনার ভান করছো। কেউ আমাকে এভোয়েড করলে আমি নিতে পারিনা। আমার কি দোষ?”
“দেখুন আমি এই মুহূর্তে এমন কোন কাজ করতে চাই না যাতে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হই। মন দিয়ে পড়ালেখা করতে চাই অন্য কিছু নয়। বুঝতে পেরেছেন? এখানে আসা বন্ধ করুন। আপনার আমার দু’জনার জন্যই ভালো হবে। আপনি বুঝদার মানুষ। আশাকরি আজকের পর এ নিয়ে আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না।”
রিফাত মাথা দুলায়। মন খারাপ করে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শোভার দিকে তাকালো-“আমি তোমার ফোন নাম্বার পেতে পারি? খুব প্রয়োজন হলে ফোন দিলাম?”
শোভা আর দাঁড়ালো না। হনহন করে হেঁটে চলে গেলো। রিফাত সেদিকে চেয়ে থেকে গাড়ি ছাড়লো। মেয়েটা এতো কঠোর কেন? এই বয়সে এতো কঠোরতা মানায় না মেয়েদের।

চলবে—
©Farhana_Yesmin