আমার আকাশে তারা নেই ২ পর্ব-১২

0
236

#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি

১২.
বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা করে চৌধুরী বাড়ির সামনে নামলো ইচ্ছে। হাতব্যাগ থেকে ভাড়ার টাকা বের করতে যেয়ে খেয়াল হলো তার কাছে খুচরা টাকা নেই। এখানে ভাড়া বিশ টাকা। রিকশাওয়ালা একশত টাকা খুচরা দিতে পারবেন না। অগত্যা পুরো টাকাটাই দিয়ে দিল সে। এমাসের হাতখরচের আর কয়েকটা টাকাই অবশিষ্ট আছে মাত্র। তপ্ত শ্বাস ফেলে ছোট্ট ট্রলিটা টেনে বাড়ির ভেতরে পা রাখলো। দারোয়ানকে দেখতে পেল না কোথাও। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে গেলো বাড়ির দরজার সামনে। বেল চাপতে যেয়ে কেমন অস্বস্তি বোধ হলো। কেমন একটা আড়ষ্ঠ ভাব তাকে জেকে ধরেছে। এ বাড়িতে দ্বিতীয়বার পা রাখার ইচ্ছা তার ছিলনা। কিন্তু তাকে কিছুদিন এখানে থেকেই নিজের পরবর্তি পরিকল্পনা গুছিয়ে নিতে হবে। এসব নানাবিধ ভাবতে ভাবতেই সে ডোরবেল চাপলো। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও যখন কেউ দরজা খুলল না তখন আবার ডোরবেল চাপতে যেতেই কেউ দরজা খুলে দিল। হঠাৎ এভাবে দরজা খুলে যাওয়ায় ইচ্ছে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে নিজেকে সামলে সামনে তাকাতেই দেখলো রুশা দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছেকে দেখে সে খুশি বা রাগ করলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে ইচ্ছে খুশি হতে পারলো না রুশাকে দেখে। এমন একটা মানুষ যে তার থেকে তার প্রাণটাই কেড়ে নিয়েছে তাকে দেখলে খুশি কিভাবে হতে পারে? ইচ্ছে কোন প্রকার কথা ছাড়াই পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।

________________

ইচ্ছে ফিরে আসায় শারমিন বেগম বেশ খুশি হয়। এতদিন বাদে নাজমুল সাহেব ও হাসি মুখে কারো সাথে কথা বললেন। শারমিন বেগম রান্নার জন্য তরকারি কাটছিলেন তখনই রুশার বাচ্চা কেঁদে উঠে। তা শুনে শারমিন বেগম ইচ্ছেকে তরকারি কাটতে বলে নিজে এগিয়ে যান বাচ্চাকে সামলাতে। তা দেখে ইচ্ছে কষ্ট লুকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। রুশাকে পছন্দ না করলেও বাচ্চার প্রতি যে শারমিন বেগম বেশ পজেসিভ তা বুঝতে বাকি রইল না। অবশ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার একমাত্র ছেলের একমাত্র সন্তান বলে কথা!

এরপরের দিনগুলো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার জন্য। কারণ অবশ্যই ইহান। ইহান বারবার তার সাথে কথা বলার জন্য আগে পিছে লেগে ছিল। ইচ্ছেও খুব কৌশলে তাকে এড়িয়ে গেছে। যদিও এক বাড়িতে থেকে ইহানের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখাটা সহজ ছিল না। ইহান অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে সেই সুযোগে ইচ্ছে তার প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র রেডি করার জন্য বেরিয়ে পড়তো। ইহানকে এ ব্যাপারে কিছু বুঝতে দিলে চলতো না। ইচ্ছের এটা ভাবতেই হাসি পায় যে একসময় যে মানুষটার সাথে থাকার জন্য হাজার বায়না বানাতো আজ তার থেকে নিজেকে লুকাতে হাজার প্রচেষ্টা!
ইচ্ছে রোজ সকালে বারান্দায় লুকিয়ে ইহানকে দেখে। ইহান যখন পাঞ্জাবি গায়ে মাথায় টুপি পড়ে মসজিদ থেকে ফেরে তখন তাকে ভিষণ পবিত্র লাগে। মুখের দাড়ি গুলো একটু বড় হওয়ায় চেহারায় অন্যরকম জৌলুস এসেছে। অল্পদিনেই বয়সটা কেমন বেড়ে গেছে বোধহয়। কিন্তু তবুও সৌন্দর্যে বিন্দুমাত্র কমতি নেই। বরং আগের থেকেও বেশ আকর্ষণীয় লাগে। ইচ্ছের খুব ইচ্ছা হয় আলতো হাতে মুখ ভরা দাড়ি গুলো একটু ছুঁয়ে আদর করে দিতে। বুকে মাথা রেখে রাত জেগে নিকষ কালো আঁধারে ঘেরা আকাশের বুকে জ্বলতে থাকা তারা দেখতে। হাজার রঙিন স্বপ্ন দেখতে। কিন্তু এগুলো কেবল ইচ্ছা পর্যন্তই সিমাবদ্ধ। বাস্তবায়ন যে আর সম্ভব নয়।

_______________

ঘড়িতে সময় রাত দুইটা। নিশ্চুপ পরিবেশকে এক গুনগুন শব্দ ভারী করে তুলছে। চাপা কান্নায় বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে ইচ্ছের শরীর। কান্নাগুলো শব্দ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। নিজেকে আটকে রাখতে চাইলেও পরমুহূর্তেই ভেঙে পড়লো ইচ্ছে। শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে। এতদিন জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলো অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়তে লাগলো। সেও তো রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ। কিভাবে সহ্য করবে এত আঘাত? কষ্ট তো তারও হয়। সে যত ই নিজেকে শক্ত করে রাখতে চায় ততটাই ভেঙে পড়ে। রাতের এই অন্ধকার তার শক্ত ব্যক্তিত্বের মাঝে লুকিয়ে থাকা এই কোমল ইচ্ছেকে বের করে আনে। হাতের কাঁটা স্থান থেকে এখনো রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় বেরিয়ে আসছে। এর থেকেও অনেক বড়ো আঘাত সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার আছে। তবে আজ এই অল্প আঘাতে কেন এত কান্না? ইচ্ছে নিজেও বুঝলো এই হাত কাঁটাতো কেবল অজুহাত মাত্র কান্নার কারণতো অন্যকিছু।
দরজার বাইরে থেকে তার এই কান্নার শব্দ অন্য একজন নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিলো। তার কি করা উচিত এই মুহূর্তে সেটা সে জানে না। ভেতরে যেতে চেয়েও পারলোনা সে। কোন একটা অদৃশ্য দেয়াল বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের মাঝে। রমনীর এত দুঃখের কারণ তো সে নিজেই। এক সময় নিজের জন্য যার মুখে আনন্দের জোয়ার ছিল আজ তারই জন্যে সেই মানুষটার চোখে অশ্রু ঝরে। দগ্ধ হৃদয় নিয়ে রুমে ফিরে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল ইহান। যেন তার সকল রাগ দরজার ওপর থেকেই কাটাতে চাইছে। হতাশ হয়ে বারান্দায় ফ্লোরে বসে দূর আকাশ পানে তাকালো। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো,”আমি কি ক্ষমার যোগ্য?”

________________

বিগত এক সপ্তাহ ধরে ইচ্ছের একটা চুলের দেখাও মিলছে না ইহানের। তার অনেক কিছুই বলার আছে মেয়েটাকে কিন্তু মেয়েটা যে তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা বারের জন্যও কি মেয়েটা তার উপর করুণা করতে পারেনা? সে যতটা অনুতপ্ত হয়ে আকুতি করছে ইচ্ছের কাছে এই আকুতিটা কোনো পাহাড়ের সামনে বসে করলে হয়তো পাহার গলে নদীতে পরিণত হতো। ইহানের আজকাল কিছুই ভালো লাগেনা। মেজাজ আগের তুলনায় অধিক খিটখিটে হয়ে গেছে। ইচ্ছের প্রতি অভিমান গুলো রাগে পরিণত হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেয়েটাকে সামনে পেলে কষিয়ে একটা থাপ্পর দিবে এমন অভদ্রতার জন্য। শাসনের অভাবে এমন অবাধ্য হয়ে উঠেছে।

রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিয়ে শান্তিতে চোখ বুজে শ্বাস নিলো ইচ্ছে। আজ সকল কিছু থেকে মুক্তি নেওয়ার দিন। সকল খারাপ স্মৃতি থেকে মুক্তি নিয়ে এক নতুন অধ্যায় শুরু করার সময় চলে এসেছে। বারান্দায় থাকা লাল গোলাপের গাছটায় আলতো করে হাত ছোয়ালো ইচ্ছে। কাঁটা বিধলো। সামান্য রক্ত ও বের হলো। ইচ্ছে সেদিকে নজর দিল না। তার মনে পড়লো এই গোলাপ গাছটা ইহান তাকে বার্থদে গিফট দিয়েছিল। তখন গাছটা বেশ ছোট ছিল। কোনো ফুল ছিল না তাতে। ইচ্ছে ইহানের এমন গিফ্টে খুশি হলো না। সে ইহানের থেকে একতোড়া গোলাপ আশা করেছিল রোমান্টিক কাপলদের মতো। ইহান বুঝতে পেরে ইচ্ছেকে একটা সফট হাগ করে বলেছিল,

–’একতোড়া গোলাপ তো আজ বাদে কাল ই নষ্ট হতে শুরু করবে কিন্তু এই গাছটার যত্ন নিলে সে বছর পর বছর তোমায় ফুল দিবে। আমি তোমায় এক তোড়া না এক জীবন পরিমাণ গোলাপ উপহার দিলাম। খুশি নও তুমি?’

ইচ্ছের মোন খারাপ তখনই শেষ। এরপর থেকে বিশেষ যত্ন নিয়ে আগলে রেখেছে এই গাছটা ইচ্ছে। যখন ফুল ফোটে তখন একরাশ ভালোলাগা তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু তার সাথে সাথে এখন এ গাছটাও মরে গেছে। ভালোবাসা নেই বলেই হয়তো!

চলবে…..