#আমার_আছে_জল
#মাহিমা_রেহমান
#পর্ব_১৫
বিকেল চারটা বেজে বিশ মিনিট।আজকে সন্ধ্যায় পার্টি উপলক্ষে দুঘন্টা আগেই অফিস শেষ হয়েছে।এই দুঘন্টা কেবল নিজেদের তৈরি করে সঠিক সময়ে পার্টি এরিয়ায় উপস্থিত থাকার জন্য দেওয়া হয়েছে। শিথি যখন চুপিচুপি অফিস থেকে বের হতে যাচ্ছিল,,সহসা তাকে পাকড়াও করে ফেলে নুসাইব।প্রতিদিনকার মত আজকেও নিজে ড্রাইভ করে পৌঁছে দিয়ে যায় শিথিকে।আজকাল নুসাইবের এহেন পাগলামো’তে আর বিরক্ত হয় না শিথি। অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে ব্যাপারগুলো।তাই বিরতক্ত প্রকাশ না করে বেশ কিছুটা এনজয় করে সে।
শিথি এবার বসে পড়ল অফিস থেকে দেয়া পার্সেল ওপেন করতে।পার্সেল খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো হাফ সিল্কের একটা কালো রঙের শাড়ি, চুড়ি,কিছু অর্নামেন্টস আর বেশ কিছু মেকআপ আইটেম।মাথায় হাত পড়ল শিথির।এগুলো যে নুসাইব চৌধুরীর কারসাজি তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার।লেগে পড়ল নিজেকে তৈরি করার উদ্দেশ্যে।
ঘড়িতে সময় দেখে দিন শিথি।সন্ধ্যা ছয়টা চল্লিশ।পুনরায় নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিল।খারাপ না! বেশ ভালোই লাগছে।আকস্মাৎ গাড়ির হর্ন শুনতে পেল শিথি।মৃদু হাসল সে।নিশ্চয়ই নুসাইব এসেছে।পার্স নিয়ে ছুটল শিথি নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।রাস্তার মোড়ে দেখতে পেল চিরচেনা সেই গাড়িটি।এগিয়ে গেল সেদিক।গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো মধ্যবয়স্ক একলোক। গায়ে তার ড্রাইভারের পোশাক।বুঝতে পারল ইনি ড্রাইভার। অন্তঃকরণে বিষন্নের মেঘেরা এসে হানা দিল।সে আশা করেছিল নুসাইবকে।কিন্তু তার পরিবর্তে ড্রাইভারকে দেখে বেশ খারাপই হলো শিথির চিত্ত।যেতেই ইচ্ছে করছে না তার এখন। শিথির উদেশ্যে ড্রাইভার বলে উঠল,
-“ম্যাডাম গাড়িতে উঠে বসুন।স্যার প্রচুর ব্যস্ত।তাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
নুসাইব কি এতটাই ব্যস্ত যে তাকে পিকআপ করার সময়টুকু নেই?।বিষন্ন মনে পিছনের সিটে গিয়ে বসে পড়ল শিথি।
_
গাড়ি এসে থামল হোটেল সেরাটনের সামনে।আলগোছে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল শিথি। মৃদু কদমে এগুতে লাগল সামনের দিকে।হোটেলে প্রবেশ করল সে।গিয়ে লিফটে উঠল।লিফট এসে থামল চার নম্বর ফ্লোরে। চারপাশে বেশ শোরগোল তার সাথে জোরে মিউজিকের শব্দতো আছেই।চোখমুখ কুঁচকে সেদিক পা বাড়াল শিথি।
নিজের কিছু পুরনো ক্লাইন্টদের সহিত ব্যস্ত নুসাইব।হাতে হাত ওয়াইনের গ্লাস। ফাঁকে ফাঁকে ওষ্ঠ স্পর্শ করছে তাতে।আকস্মিক নুসাইবের চোখ গেল প্রবেশ পথের দিকে।সত্বর বক্ষঃস্থলে ধক করে উঠল তার।হৃদযন্ত্রটা তরান্বিত বাড়িয়ে তুলল নিজের স্পন্দন।কালো শাড়ি পরিহিতা নারীকে দেখে থমকালো তার শ্বাসনালী।উষ্ণ হয়ে উঠল নিঃশ্বাস।পাল্লা দিয়ে ভারী হয়ে উঠল নিঃশ্বাসের গতিবেগ।নেশাক্ত হলো তার নয়ন জোড়া।প্রিয় দর্শনীর উপর থেকে আজ যেন চোখ ফেরানো দায় নুসাইবের।
কেবল নুসাইব না পার্টির প্রায় বেশিরভাগ ছেলে হা করে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলছে শিথিকে। শিথি নামের শান্তশিষ্ট মেয়েটা যে এতটা সুন্দরী হবে তা হয়তো কারোরই ধারণায় ছিল না।সব সময়ের সাদামাটা মেয়েটাকে সামান্য শাড়ি আর হালকা মেকআপে যে এতটা আকর্ষণীয় লাগতে পারে,, তাই বা কে জানতো?
অসস্তিতে পড়ে গেল শিথি।কেমন করে তাকিয়ে আছে সকলে।সামনের দিক এগিয়ে গেল সে।করো ডাকে ঘোর কাটলো নুসাইবের।শিথিকে চোখের সমীপে দেখে মৃদু হাসল নুসাইব।”নারী” নামক এই প্রাণী বেশ অদ্ভুত।কেমন করে তারা পারে একজন পুরুষের সর্বত্র নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে।এই যেমন নুসাইবের হৃদযন্ত্রটা নিয়ে শিথি কেমন তবলা বাজাচ্ছে!
_
কেক কাটার পর্ব চুকে যেতেই কেউ একজন পার্টিকে আরো রমরমা করতে কাপল ড্যান্সের অফার করল।সত্বর হইহই করে উঠল সকলে।শুরু হলো কপোল ড্যান্স।সহসা শিথিকে একপ্রকার টেনে ডান্স ফ্লোরে নিয়ে গেল নুসাইব।কেবল মাত্র পার্টিতে অ্যাটেন্ড করেছে তাহসিন।একটা কাজে আটকা পড়া বাহুল্য এখানে আসতে বেশ লেট হয়ে গেছে।যদি সে আসতো ও না।কিন্তু কেবল মাত্র একপলক শিথিকে দর্শনের লোভে এসেছে।আজকাল শিথিকে দেখার তৃষ্ণা তার কেবল বেড়েই চলছে।যতই দেখুন না কেনো? মন ভয়ে না।মায়ের কথাটাই বুঝি সত্য হলো,,সে হীরে ফেলে জেনে শুনে কাঁচে গিয়ে হাত দিয়েছে।এখন হারে হারে টের পাচ্ছে বেশ।বেশ বড় এক দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করে চোখ ঘুরিয়ে মনোযোগ দিল ড্যান্স ফ্লোরে। টকর নড়ল তাহসিনের।ড্যান্স ফ্লোরে ওটা শিথি না?কার সাথে নাচছে ও।কেমন ছ্যাত করে উঠল বক্ষঃস্থলে।তখনই নজরে এসে ধরা দিল শিথির সাথে থাকা ছেলেটির মুখ।হাত জোড়া মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়াস চালাল তাহসিন।দেখতে পেলো শিথিকে জোর করে,, তার সহিত ড্যান্স করাচ্ছে নুসাইব।আকস্মিক শিথিকে পাঁজাকোল তুলে নিল নুসাইব। সহ্য হলো না আর তাহসিনের।চোখ বুঝে নিল সে।না!এই নুসাইবকে আর কোনো প্রকার সুযোগ দেওয়া যাবে না শিথির আশে পাশে ঘেরার।আজকেই সে নিজের মনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সকল কথা তুলে ধরবে শিথির কাছে।দরকার পড়লে ডিভোর্স দিবে রিমিকে সে।তাও তার যে করেই হোক শিথিকে চাই চাই। শিথিকে ছাড়া মোটেও ভালো লাগে না তার।কেমন বেচেঁ ও মৃত লাশের মত আছে সে।যে ভুল সে করেছে! পুনরায় সেই ভুল আর নয়।এতদিনে সে বেশ বুঝতে পেরেছে,,,সে ভালোবাসলে কেবল শিথিকেই বসেছে।তার মানসিক শান্তি কেবল শিথি।কি খেয়ে যে সেদিন সে বলেছিল শিথিকে,,তার সব সুখ নাকি রিমি?
_
মিউজিক অফ হতেই,,রাগে গজগজ করতে করতে একপাশে গিয়ে দাড়িয়ে পড়ল শিথি।ক্ষণকাল বাদ নুসাইব এসে পাশে দাঁড়াল।গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল।শিথিরাগান্বিত মুখশ্রী নিয়ে ফিরে তাকাল নুসাইবের দিকে।কিছু বলতে নেবে সহসা ফোন কল বেজে উঠল শিথির।
_
ফ্লাওয়ার শপের সন্মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাহসিন। হাতে তার একগুচ্ছ কালো গোলাপ।যা শিথির বেশ পছন্দ।আজকে সে এই কলো গোলাপ দিয়েই শিথিকে প্রপোজ করবে পূনরায়।গোলাপ গুলো হাতে নিতে খুশি মনে হোটেলের উদ্দেশ্যে ফিরে এলো তাহসিন।
_
অকস্মাৎ শিথির হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পড়ে গেল।ভ্রু কুঁচকে শিথির মুখপানে তাকাল নুসাইব।কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে তার পূর্বেই পাগলের মত ছুট লাগল শিথি।ঘাবড়ে গেল নুসাইব। শিথির পিছন পিছন ছুটতে লাগল সেও।
চোখের জল মুছতে মুছতে দৌঁড়াতে লাগল শিথি।যে করেই হোক আজ রাতেই তাকে চট্টগ্রাম ফিরতে হবে।এই এক বাবা ছাড়া এই পৃথিবীতে তার তো আর কেউ নেই।হতে পারে পালক বাবা! কিন্তু সম্পর্কটা তো রক্তের সম্পর্কের উপরে।ঢাকার আশার পরেও প্রায়ই কথা হতো ইকবাল সাহেবের সহিত শিথির।ফোন দিয়ে তিনি প্রায় কাঁদতেন মেয়ের এমন জীবন নিয়ে।তিনি চেয়েও কিছু করতে পারলেন না,,সেই আফসোসই তিনি করে যেতেন সর্বদা।বাবার সেই কান্না শুনে কেঁদে ফেলত শিথি ও।আর আজ সেই বাবা মৃত্যুর পথযাত্রী।বুকটা কেঁপে উঠল শিথির।আর ভাবতে পারছে না সে।মেইন রোডের মোড়ে এসে কোনদিক বিচার-বিবেচনা না করেই পাগলের মত ছুটতে লাগল শিথি।আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিক তার কোনো খেয়াল নেই।
পিছন থেকে শিথিকে পাগলের মত ডেকে চলছে নুসাইব।কিন্তু শিথির সেদিক কোনো খেয়াল নেই।সে দিক-বেদিক বিচার না করেই রাস্তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলছে।আকস্মিক শিথির নাম ধরে এক ভয়ঙ্কর চিৎকার দিয়ে উঠল নুসাইব।
একটা ট্রাক এসে হঠাৎ ধাক্কা দিল শিথিকে।ছিটকে প্রায় অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ল শিথি।পুনরায় শিথির নাম ধরে এক গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল নুসাইব।
___
কেটে গেছে প্রায় পাঁচটি বছর।আজ ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ।আজকেই এই দিনে সকলকে ছেড়ে পরলোক গমন করেছে শিথি।রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত নুসাইব।সহসা তার চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।যায় আভাস ও পেল না নুসাইব।প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে আজকেরই দিনে শিথিকে নিজের মনের গহীনে লুকিয়ে রাখা অনুভূতি সম্পর্কে অবগত করতে চেয়েছিল সে।কিন্তু তার পূর্বেই….।এক গভীর দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করল নুসাইব।আজও অব্যক্ত রয়ে গেল তার অনুভূতি গুলো।
হঠাৎ দুর থেকে একটা মিউজিক টন তার কর্ণকুহরে এসে ধরা দিল।
– বাতোকো তেরি হাম ভুলানা সাকে
হোকে যুদা হাম না যুদা হো সাকে
দিলমে হে জিন্দা হার ঘাড়ি তু কাহি
হোকে যুদা হাম না যুদা হো সাকে~
টোনটা হঠাৎই আবার মিলিয়ে গেল কোথাও একটা।চোখ বুঝে নিল নুসাইব।প্রতিনিয়ত নিজের অনুভূতি গুলোর সহিত যুদ্ধ করে চলছে সে।আর পারছে না।তার এই অব্যক্ত প্রণয় তাকে চিরকাল কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে।
~ সমাপ্ত ~