আমার বাহুডোরে আবদ্ধ তুমি পর্ব-০২

0
191

#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২

বধু বেশে নিষ্প্রাণ চাহনিতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দৃষ্টি নিবদ্ধ। প্রাণবন্ত মেয়েটা আজ কেমন নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। চোখে না আছে কোনো জল, না আছে কোনো অনুভূতি। কেমন যেন পাথর মানবীতে পরিণত হয়েছে মাত্র একদিনের ব্যাবধানে। মুখে কোনো ভারী মেকাপের আস্তরণ নেই। গালে মায়ের দেওয়া উপহারসরূপ থাপ্পরের লাল দাগটা মেলায়নি এখনো। ডাগর চক্ষুদ্বয় ফুলে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ইতোমধ্যে।

তবে মেরুন কালারের শাড়িতে যেন বেশ মানিয়েছে মেহরুনকে। অথচ এই শাড়িটা সে শখ করে কিনেছিল, তার ভাইয়ের বিয়েতে পরবে সেজন্য। কিন্তু কে জানত, এই শাড়িটাই তার জীবনের কাল হবে। হঠাৎ যেন কোনো এক দমকা হাওয়া এসে তার সুন্দর, সাজানো গোছানো জীবনটাকে এক মুহুর্তে তছনছ করে দিয়েছে। তার জীবন যেন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।

এইতো কিছুক্ষণ আগেও মেহরুন ও বাড়ির মেয়ে ছিল কিন্তু এখন তার সাথে আরও একটা পরিচয় যুক্ত হয়েছে। সে এখন খান বংশের একমাত্র পুত্রবধু। সনামধন্য বিশিষ্ট হার্ট সার্জন আব্রিশাম খান আদ্রিশের বিয়ে করা বউ। এটাই এখন মেহরুনের জীবনের চরম সত্য। মেহরুন তো অর্থবিত্ত, বাড়ি গাড়ি চায়নি। চেয়েছিল একটু শান্তিতে বাঁচতে, কিন্তু তা আর হতে দিল কই আদ্রিশ। তার ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকারটাও তো কেড়ে নিল আদ্রিশ।

নিজ পিত্রালয় হতে বিদায় বেলায়, মায়ের সাথে শেষ বারের মতো দেখাটাও হলো না। খুব করে যে একটু জড়িয়ে ধরবে তাও আর হলো কই। অথচ এই মা-ই তার জীবনের সবটা জুড়ে ছিল। মেহরুনরা ছিল দুই ভাই-বোন। বড় ভাই আলভি আর মেহরুন ছোট। পরম মমতায় দুই ভাই-বোনকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন মা লাবিবা রহমান। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আজ মেহরুন মায়ের শীতল ছায়া হতে বঞ্চিত। আর মেহরুনের বাবা তো মেয়ে বলতে ছিল পাগল। কিন্তু সেই বাবাও আজ বিদায়বেলায় মেহরুনের সঙ্গে একটি বাক্যও বিনিময় করতে চাননি।

মেহরুন ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বাবার একটি হাত শক্ত করে আকড়ে ধরে। মেহনত আকবর ছাড়িয়ে নেন নিজের হাতখানা। মেহরুন কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে হাতের ইশারাও চুপ করতে বলেন তিনি। আড়ষ্ট কণ্ঠে আওড়ালেন

-‘ ছোটবেলা হতে যা চেয়েছো আমি আমার সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করেছি তোমায়। আমি তো আমার দিক দিয়ে কোনো কমতি রাখিনি। সবাই বলতো আমি নাকি খুব বেশি প্রশ্রয় দিয়ে মেয়েকে মাথায় তুলছি। আমি তার তীব্র প্রতিবাদও করেছি। তবে তার প্রতিদান সরূপ যে এমন কিছু আমার প্রাপ্য ছিল, আমি তা কল্পনাও করিনি। তোমার মা খুব কষ্ট পেয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে। যাইহোক এসব তোমায় বলে আর লাভ কি। নতুন জীবনে সুখী হও। যা চেয়েছ তা-ই তো পেয়েছো। আমার দায়িত্ব এখন শেষ। এ বাড়িতে আর এসো না। তোমার ছায়াও আমি দেখতে চাই না।

বাবার মুখে এমন বাক্য শুনে মেহরুন হাওমাও করে কেঁদে ওঠে। মেহনত আকবরেরও প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। নয়নের কোণে জল চিকচিক করছে। বাবা হিসেবে মেয়েকে যে এমন ভারী বাক্য শোনাতে হবে তিনি কখনো ভাবেননি। বুকের বাঁ পাশে তার চিনচিন করে ব্যথা অনুভুত হয়। বয়স হচ্ছে তো তার, এ বয়সে তো আর এতো কিছু নিতে পারেন না তিনি। অলক্ষ্যে তার চোখ হতে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ে শুষ্ক কপোলে। তিনি আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে মুখে গাম্ভীর্যতা এনে বলেন

-‘ আদ্রিশ, মেয়েটা বড্ড আদরের ছিল আমার, ওর খেয়াল রেখো। কষ্ট দিও না কখনো ওকে। আমি বাবা হিসেবে ব্যর্থ হলেও তুমি স্বামী হিসেবে ব্যর্থ হয়েও না।

মেহরুনের বুক ভারী হয়ে ওঠে বাবার কথা শুনে। চোখ থেকে তার অনবরত জল গরিয়ে পড়ছে। আদ্রিশ মেহনত আকবরকে আলিঙ্গন করে নেয়। হাত ধরে চোখের ইশারায় আশস্ত করে তাকে। মেহনত আকবর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

মেহরুন এক দৃষ্টে তার বাবা এবং চিরচেনা শৈশব কৈশরের স্মৃতি তার আবাসস্থলকে দেখে নেয় যতোক্ষণ না চোখের আড়াল হয়। গাড়ি ছুটে চলে তার আপন গতিতে। উদ্দেশ্য ‘খান বাড়ি’।

মেহরুনদের গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই তার চোখ জোড়া ভিজে ওঠে। বাবা শখ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন মেহনত। কিন্তু সন্তানের নামকরণকালে পিতা-মাতার চরম মূর্খ্যতা বিধাতাপুরুষ অন্তরীক্ষে থেকে অধিকাংশ সময়ে শুধু হেসেই ক্ষ্যান্ত হন না, তীব্র প্রতিবাদও করেন। এজন্য মেহনত আকবরেরও তার নামের মতো সমস্ত জীবন চরম দুঃখে কাটাতে হয়েছে। সুখের এক ফালি রোদ্দুর দেখার পূর্বেই তার জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বৃদ্ধ বয়সে এসে যে মেয়ের দ্বারা এরূপ কষ্ট পেতে হবে তা কখনো ভাবেন নি তিনি। বুকে হাত দিয়ে তিনি নিজ কক্ষে ফিরে চলেন।

কারো গলা কাখারীতে মেহরুনের ভাবনার ছেদ ঘটে।

আয়নাতে কারো প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতেই সে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহরুন। আদ্রিশ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহরুনের পানে। এক গাল হেসে মেহরুনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল

-‘ মাশাল্লাহ, আপনাকে তো বেশ সুন্দর লাগছে মিস মেহরুন ইবনাত। উহু একটু ভুল বলে ফেললাম আমার মিসেস মেহরুন আদ্রিশ খান। শুনেছি, বিয়ের ফুল ফুটলে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ে। আজ তার বাস্তব প্রমাণ পেলাম।

অন্যদিনের মতো হলে আদ্রিশের এমন মিষ্টি বাণী শুনলে হয়তো মেহরুন লজ্জায় একেবারে মিহিয়ে যেত। কিন্তু আজ আদ্রিশের কণ্ঠ মেহরুনের কর্ণকুহরে ঠেকতেই তার সমস্ত শরীর যেন ঝিনঝিন করে ওঠে ক্রোধে। ক্রুদ্ধ গলায় বলে ওঠে

-‘ আমার পবিত্র সত্তায় ক’ল’ঙ্কের দাগ দিয়ে ক্ষ্যা’ন্ত হননি। তাই নতুন ফন্দি আটছেন।

মুহুর্তেই আদ্রিশের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা চুপসে যায়। অপরাধীর দৃষ্টিতে মেহরুনের দিকে তাকায় আদ্রিশ। অস্ফুট স্বরে বলে

-‘ এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না যে…

মেহরুনের কর্ণকুহর অবধি পৌছাল না আদ্রিশের উচ্চারণকৃত বাণী। আবছা আবছা শুনতে পেলেও গুরুত্ব দেয়নি। হঠাৎ মেহরুন ডুকরে কেঁদে ওঠে। মেহরুনের আচমকা কেঁদে ওঠায় আদ্রিশ চমকায়। মেহরুনের কাছে গিয়ে মেহরুনকে নিজের দিকে ফিরিয়ে থুতনিতে হাত রেখে বলল

-‘ কাঁদছো কেন তুমি?

মেহরুন ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দেয় আদ্রিশের হাত। বাজখাঁই গলায় বলে উঠল

-‘ আমার জীবনটাকে বিষিয়ে দিয়ে আপনি এখন এসেছেন আমি কেন কাদছি জিজ্ঞেস করতে। লজ্জা করে না আপনার? আমি আপনার কি ক্ষতি করেছিলাম যে আমার এতো বড় সর্বনাশ করলেন? আমায় মিথ্যে অপবাদ দিতে আপনার বুক কাপল না একটুও?

একদমে কথাগুলো বলে থামল মেহরুন। আদ্রিশ ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছু বলার থাকলেও এখন এ মুহুর্তে কিছু বলতে চায় না মেহরুনকে। তাই প্রসঙ্গ পালটাতে আদ্রিশ বলল

-‘ মেহরুন, তুমি ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়ো এখন।

-‘ যা করেছেন তাতে করে সারাজীবনের জন্য ঘুম চলে গেছে আমার।

মেহরুনের কথা শুনে ওষুধের বক্স থেকে ওষুধ বের করে ধরিয়ে দিল মেহরুনের হাতে। মেহরুন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে আদ্রিশের দিকে।

-‘ হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ এটা। খাওয়ার সাথে সাথে ঘুমে কাত।

মেহরুন মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে কণ্ঠে বিষাদ ঢেলে বলল

-‘ ঘুমের ওষুধ না বিষ খাইয়ে মারতে চাইছেন?

আদ্রিশ হোঁচট খায় মেহরুনের কথা শুনে। কয়েক মুহুর্ত ব্যপী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহরুনের দিকে। গলা কাখারী দিয়ে মেহরুনের চোখে চোখ রেখে বলল

-‘ বিষ খাইয়ে যদি মারতেই চাইতাম তবে আগেই মারতাম। এতো কাঠ খড় পুড়িয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলতাম না।

মেহরুন কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে গলায় পানি ঢেলে ওষুধটা গিলে ফেলে। তা দেখে আদ্রিশ স্মিত হাসে।

মেয়েটা বড্ড ত্যাড়া স্বভাবের। এর সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বললে শুনবে না। তাই ত্যাড়া ভাবেই কথা বলতে হবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আদ্রিশ। মনে মনে বলে ‘যার জন্য করলাম চুরি, সে-ই কি-না বলে চোর।’

#চলবে~