আমার বাহুডোরে আবদ্ধ তুমি পর্ব-০৪

0
179

#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ৪

আঁধারের পর পৃথিবীর বুকেতে ঘটেছে আলোর সঞ্চার। গাছের সবুজ পাতায় পরা ফোঁটা ফোঁটা শিশির জলের উপর পড়েছে আলোর কণা। তাতেই যেন মুক্তর মতো ঝিলমিল করেছে শিশির কণাগুলি। চারপাশে পাখপাখালিরা কিচিরমিচির করছে। ভোর হয়েছে খানিকক্ষণ আগেই।

জানালার ফাঁক দিয়ে এক ফালি রোদ্দুর এসে আছড়ে পড়ে মেহরুনের চোখে মুখে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে ফেলে সে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে হাই তুলতে তুলতে। মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে তার। ঘুমের রেশটা কাটেনি এখনো। ঘুম ঘুম চোখে আদ্রিশকে আরামে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মেহরুনের রাগ হয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে এখন নিজের ঘুমানো দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।’ হঠাৎ পাশে থাকা পানির জগের দিকে নজর পরতেই মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে মেহরুনের। গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে আদ্রিশের মুখের উপর ধাম করে পুরো জগের পানিটা ঢেলে দেয়।

আঁখিজোড়া সবেমাত্র লেগে এসেছিল, হঠাৎ মুখের উপর ঝপঝপ করে পানি পরায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আদ্রিশ। মেহরুনের মুখে শয়তানি হাসি ফুটে ওঠে।

আদ্রিশ এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মেহরুনের দিকে কিছুক্ষণ একহাত দিয়ে মুখের উপর থাকা পানির ঝাপটা দেয় মেহরুনের মুখে। মেহরুন চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। মেহরুন কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই একহাতে টান দিয়ে মেহরুনকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আদ্রিশ। মেহরুন হকচকিয়ে ওঠে আদ্রিশের এমন কাণ্ডে। আদ্রিশের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করে, বুকে কিল ঘুষি দেয় অনবরত কিন্তু কোনো লাভ হয়না।

মেহরুনের গালে হাত দিয়ে হালকা করে চেপে ধরে আদ্রিশ। গম্ভীর কণ্ঠে বলল

-‘ আমাকে নাস্তানাবুদ করতে গিয়ে নিজেই তো সকাল সকাল নাস্তানাবুদ হয়ে গেলে। যা পারো না তা করতে যাও কেন?

মেহরুন হাত পা ছুটাছুটি করে বলতে থাকে ‘ছাড়ুন, ছাড়ুন আমাকে।’

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে আদ্রিশ ছেড়ে দেয় মেহরুনকে। হাফ ছেড়ে বাঁচল মেহরুন। দরজা খুলতে খুলতে আদ্রিশ হেসে বলে ওঠে

-‘ নেক্সট টাইম আর এমন দুষ্সাহস দেখিও না মেহরুন। ভাগ্য ভালো ছিল তাই এখনের মতো হয়তো ছাড়া পেয়ে গেলে এরপর কিন্তু আর ছাড়া পাবে না।

দরজা খুলতেই দেখে অরনী হাজির। অরনীকে দেখতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে আদ্রিশের। হাত ধরে টেনে এনে বসায় অরনীকে, সেই সাথে নিজেও বসে পড়ে অরনীর পাশে। মেহরুন উৎসুক হয়ে দেখে। আদ্রিশ তা দেখে সূক্ষ্ম হাসে।

অরনী মেহরুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখটা ভার করে বলল

-‘ ঘরে নতুন বৌ এলে নাকি বোন হয়ে যায় পর। বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে সোজাসাপ্টা নিজের ঘরে চলে এলি। বউ এনেছিস নিজে দেখার জন্যে, আমি তো তোর কেউ হইনা, এজন্য তো আমাকে একবারও বলার বা দেখানোর প্রয়োজনবোধও করলি না। আমি যদি এখনো না আসতাম তাহলে তো আর দেখাই পেতাম না তোদের।

এতোটুকু বলে থামল অরনী। মেহরুনের বুঝতে অসুবিধা হয়না অরনী আদ্রিশের বড় বোন। আদ্রিশ মুচকি হেসে বলে

-‘ আসলে আপু হয়েছে কি…

আদ্রিশকে পুরো কথা বলতে না দিয়ে মেহরুন বলে উঠল

-‘ কোনো মেয়েকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তার পরিবার থেকে আলাদা করে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করাটা কতোটুকু যুক্তিসঙ্গত, বলতে পারেন আপু?

অরনী বুঝতে পারেনা মেহরুনের কথার মর্মার্থ। তাই সে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে ‘কি হয়েছে পরিষ্কার করে বলো।’ আদ্রিশ চোখের ইশারায় মেহরুনকে নিষেধ করে কিছু না বলতে। তা দেখে মেহরুন ভ্রুক্ষেপ না করে ক্রুর হেসে জবাব দেয়

-‘ আপনার ভাই কিন্তু আমায় ঠিক এভাবেই বিয়ে করেছে আপু। এইজন্যই হয়তো লজ্জায় আপনার সাথে ফেস করতে চায়নি।

মেহরুনের কথা শুনে অরনী তাকায় আদ্রিশের দিকে।অরনী এবার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। সন্দিহান চিত্তে সুধায়

-‘ ও যা বলছে তা কি সত্যি, আদ্রিশ?

আদ্রিশ কটমট করে তাকায় মেহরুনের দিকে। আদ্রিশ উঠে চলে যেতে নিলেই অরনী জোর গলায় বলে ওঠে

-‘ কোথাও এক পাও রাখবি না। আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যা।

আদ্রিশ পেছন ফিরে গম্ভীর কণ্ঠে বলল

-‘ মেহরুনের কথায় কান দিয়েও না আপু। পরিবার ছেড়ে নতুন পরিবেশে এসেছে এজন্য হয়তো মাথার ব্যামো হয়েছে। আমি ফিরেই ওকে চেক করবো। চিন্তা করো না।

বলেই আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে এপ্রোনটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। অরনী আশাহত হয়। এই প্রথম তার ভাই এর এমন আচরণ। অজান্তেই অরনীর চোখের কোণে অশ্রুকণা জমা হয়। হাত ধরে মেহরুনকে কাছে টেনে বলল

-‘ চিন্তা করো না, তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে। ওহ্ যেজন্যে এসেছিলাম। এ নাও আমার মায়ের হাতের বালা। মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলের বউকে নিজ হাতে পরিয়ে দিবেন। কিন্তু তা আর হলো কই, মা গত হয়েছেন কিছুকাল আগেই।

কথাটা বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অরনী। মেহরুন সাদরে গ্রহণ করে বালা খানা। হাতটা অরনীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আবদারের সহিত পরিয়ে দিতে বলল। মুচকি হেসে অরনী মেহরুনকে পরিয়ে দিল বালাটা। মেহরুন বুঝতে পারে, আদ্রিশ খারাপ হলেও অরনী খারাপ নয়। তবে আদ্রিশকে সে প্রতি পদে পদে হেনস্তা করবে বলে মনে মনে পণ করে।

.

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের চেম্বারে এসে হাজির হয়েছিল আদ্রিশ। কয়েকটা রোগী দেখার পর এখন আর ভাল লাগছে না। ক্লান্তিতে চোখের পাতা ভার হয়ে আসে তার। তাই চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নেয় সে। ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কারণে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তার। এমন সময় এসিস্টেন্ট রফিক এসে বলে

-‘ ম্যা আই কাম ইন স্যার?

আদ্রিশ চোখ বন্ধ রেখেই বলল

-‘ কিছু বলবে রফিক?

-‘ স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে চাচ্ছে। আমি অনেকবার বলেছি আপনি ব্যস্ত, কিন্তু সে মানতে নারাজ।

-‘ যে-ই হোক না কেন। আমি এখন কারো সাথেই দেখা করব না।

রফিককে সরিয়ে মেয়েলি গলায় একজন এসে বলল

-‘ আমার সাথেও কি না?

আদ্রিশ চোখ মেলে তাকায় সেদিকে। জারাকে এই অসময়ে দেখে আদ্রিশ ভ্রু কুচকে ফেলে। গম্ভীর গলায় সুধায়

-‘ এখানে কেন তুমি?

-‘ কেন আমি আসতে পারিনা বুঝি?

আদ্রিশ হতে কোনো জবাব মেলে না। জারা মুখে হাসি হাসি নিয়ে বলল

-‘ আদ্রিশ ভাইয়া, আপনি আমার যা উপকারটা-ই না করলেন। আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আপনার সাহায্য ব্যাতিত আমি কিছুতেই আমার পথের কাঁটা মেহরুনকে সরাতে পারতাম না।

আদ্রিশ বিরক্তি ভঙ্গিতে বলল

-‘ তোমার কথা শেষ হয়েছে, এবার আসতে পারো। আমার কাজ আছে।

জারা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল

-‘ এভাবে কেন বলছেন ভাইয়া? আচ্ছা একটা প্রশ্ন ছিল, আপনি মেহরুনকে বিয়ে কেন করলেন? কথা তো ছিল ওকে বাড়ি থেকে অপমান করে বের করে দেওয়া, তাহলে?

-‘ আমার পার্সোনাল লাইফ, আমি বুঝবো। আমি কাকে বিয়ে করবো আর কাকে করবো না, তার কৈফিয়ত নিশ্চয়ই আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই।

জারার মুখটা একেবারে চুপসে যায়। তার ভাবনা ছিল মেহরুনকে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে অর্ধেক সম্পত্তির মালকীন হবে আর সেই সাথে আদ্রিশকে বিয়ে করে তার অর্ধাঙ্গিনী হবে। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো কই। প্ল্যানমাফিক আগাতে গিয়ে মেহরুনকে হঠাৎ আদ্রিশের বিয়ে করে নেওয়ায় মাঝ পথে বাধ সাধল আদ্রিশ। একেবারে সব আশায় জল ঢেলে দিল আদ্রিশ। জারা কাঁদো কাঁদো মুখ করে নিঃশব্দে প্রস্থান করে।

আদ্রিশ টেবিলের কার্নিশে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে। কিছু একটা চিন্তা করে সে ক্রুদ্ধ হাসে। মনে মনে বলে, ‘তুমি নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বুদ্ধিমান নও।’

#চলবে ~