আমার ভুল পর্ব-১২

0
280

#আমার_ভুল
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২

‘তুলনা’ এই শব্দটার অপরনাম হওয়া উচিৎ মৃত্য। তুলনার কারণে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকা আত্মার মৃত্যু ঘটে, সন্তুষ্টির মৃত্যু ঘটে। মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে, সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। আত্মতৃপ্তি হারিয়ে ফেলে। খুব জঘন্য রকমভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
কাছের মানুষ অভিমানে চুপটি করে দূরে সরে যায়। তখন শুধু আফসোস আর গ্লানি নিয়ে জীবন কাটাতে হয়।

আমার জীবনের এই ভয়াবহ দুর্বিপাকে তুলনার কতটুকু ভূমিকা ছিলো আমি জানি না। তবে জানি আফসোস আর গ্লানি ছাড়া চোখের সামনে কিছুই দেখতে পাই না।
চোখের পানিতে আমার বুক ভিজে যায় তবুও উনার দেখা পাই না। উনার গায়ের জামা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি, উনার ছবি জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করি, উনার দেওয়া উপহার সঙ্গে নিয়ে বসে থাকি কিন্তু তবুও কারো মন গলে না। কেউ আমাকে উনার খবর দেয় না। উনার শূন্যতায় দিনে দিনে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো মৃত্যু যন্ত্রণাও এর চাইতে সহজ।

প্রিন্স সবার আদরের ছিলেন। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি বড় ছেলে বলতে দিশেহারা। প্রান্ত আর প্রাপ্তি তো ভাই ছাড়া কিছু বোঝে না। ওদের সেই ভাইকে আমি কষ্ট দিয়েছি, আঘাত করেছি এটা জানার পর ওরা কেউ আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে রাজি নয়। দুজনেই আমার নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলে দিলো। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িও আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিলেন।

আমি দিশেহারা হয়ে আব্বার কাছে ছুটে গেলাম। ভেবেছিলাম আব্বা কিছু করতে পারবেন। কিন্তু আব্বাও ব্যর্থ হলেন। আমার কান্নাকাটি দেখে আব্বা আমার শ্বশুর মশাইয়ের কাছে উনি ফোন করেছিলেন। ঠিকই কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় নি। আমার শ্বশুর ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। বেশি কিছু না বললেও উনারা যে আমার ওপর অসন্তুষ্ট একথা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

আব্বা আমার শ্বাশুড়ি সঙ্গেও কথা বললেন। উনি প্রথমে চুপ ছিলেন। কিন্তু আব্বা উনাদের ওপর অসন্তুষ্ট হচ্ছেন বুঝতে পেরে একে একে সব ঘটনা বর্ণনা করা শুরু করলেন।

আমি ভেবেছিলাম চিৎকার চেঁচামেচি না করলে বোধহয় কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারবে না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি আমি কতটা বোকা ছিলাম। এক বাসায় থেকে উনারা আমার আচরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবেন না এটা ভাবা নেহায়েত বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। আমার শ্বাশুড়ি সব খেয়াল করেছেন। আব্বার কাছে নিজমুখে সেকথা স্বীকার করলেন। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’এতদিন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলাম ভাইসাহেব। কিন্তু এখন যখন সেই ছেলেই অভিমান নিয়ে দেশ ছেড়েছে তখন আর এই সম্পর্কের কি মূল্য আছে! এই মিথ্যে সম্পর্ক আঁকড়ে ধরে কষ্ট তো বাড়ানোর দরকার নেই।’

এসব শুনে আব্বা হতবাক হয়ে গেলেন। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। নিজের রত্নের এমন অধঃপতন উনি সহ্য করতে পারছিলেন না!

হাহাকার করে বললেন,’তুই কি করেছিস কিরণ? কি করেছিস? নিজের সংসার কেউ এমন করে ভাঙ্গে?’

আমি কথা বলতে পারলাম না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার কান্না দেখে আব্বা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কঠিন করে কিছু বলতে পারলেন না। শুধু মাথা দুলিয়ে আফসোস করে বললেন,’ভুল করেছিস। মস্তবড় ভুল! যেই ছেলে তোকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে চারবছর অটল থাকতে পারে সেই ছেলে তোকে ত্যাগ করার ক্ষেত্রে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে একথা কেন তোর একবারের জন্যেও মাথায় এলো না!’

আমি কাঁদতে কাঁদতে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,’কেন এলো না আব্বা! কেন এলো না! আমি তো মরে যাচ্ছি।’

আমার জীবন থমকে গেছে। সব আনন্দ নাই হয়ে গেছে। উনি ছিলেন। আমার সুখ ছিলো। উনি নেই। আমার সুখও নেই। আমি নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারি না। সারাক্ষণই উনার কথা মনে পড়ে। কেঁদে বুক ভাসাই। আব্বা হতাশ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। কিন্তু কিছু করতে পারেন না।

মানুষ হারিয়ে চেনে। আর আমি চিনে হারিয়েছি। এতিদিনে বুঝতে পারলাম নিজের সম্পর্কে আমার সমস্ত ধ্যানধারণা, হিসেব নিকেশ ভুল ছিলো।


দেখতে দেখতে তিনমাস কেটে গেলো। অথচ আমি উনার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারি নি। কত চেষ্টা করেছি প্রাপ্তির কাছ থেকে উনার নাম্বার জোগাড় করার জন্য। কিন্তু প্রাপ্তি আমার গলা শুনলেই ফোন কেটে দেয়।

আমি পাগলের হয়ে যাচ্ছিলাম। উনার কথা মনে হলে দমবন্ধ হয়ে আসে। আর কিছু ভালো লাগে না। ইউনিভার্সিটিতে যেতে ইচ্ছে করে না। যখন তখন কেঁদে ফেলি।

দিনের বেলা তবুও ক্লাস করিয়ে সময় কাটাই। কিন্তু রাতের বেলা আর পারি না। রাত হলেও বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া শুরু হয়। কষ্ট বুক ফেটে যায়। চোখের পাতায় ঘুম আসে না! সারারাত বিছানায় ছটফট করি। সবই আছে। শুধু উনি নেই! আমার নিজের মানুষটা নেই!
আমাকে প্রচন্ডরকমভাবে ভালোবাসায় মুড়িয়ে দেওয়ার মানুষটা নেই!

আব্বা প্রথম প্রথম আমার ওপর রাগ ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে নরম হতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে রাগটা গিয়ে প্রিন্সের ওপর পড়লো। যত যাই হোক মা কেন মেয়ের কান্না দেখলে কোন বাবা সহ্য করতে পারেন না। আব্বা নিজের অজান্তেই প্রিন্সকে বকাবকি শুরু করলেন।

জোর করে আমাকে দিয়ে স্কলারশিপ এর আবেদন করালেন। জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অল্পকিছু দিনের মধ্যেই ডাক এসে গেলো।
কিন্তু আমি আগ্রহ পাই না। কি লাভ স্কলারশিপ দিয়ে! কি হবে এসব দিয়ে! জীবনের কোনো মানেই তো খুঁজে পাই না।

মা আমাকে বোঝালেন এভাবে কেঁদে কেটে জীবন নষ্ট করার কোন মানে নেই। জীবনে অনেক উত্থান পতন আসবে। তাই বলে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে। কপালের লিখন তো কেউ খন্ডাতে পারে না। আর কেউ পাশে না থাকলেও আব্বা, মা আছেন।

এই কথাগুলো সঙ্গে মায়ের স্নেহ এবং রাগ দুটোই জড়িত আছে। আব্বা, মা দুজনেই প্রিন্সের ওপর রাগ। এতদিন হয়ে গেলো অথচ প্রিন্স আমার কোনো খবর নিলো না। কিন্তু আমার রাগ হয় না! উনার সঙ্গে আমি কি কি করেছি তা তো কেবলই আমি জানি।

নিজের জীবনের ইতিহাস আমি সাদা খাতার মত মেলে ধরেছি। এখানে কোন অন্যায়, কোন ভুলের কথা বাদ রাখি নি। কিন্তু কিছু কিছু কথা আছে যা চাইলেও কাউকে বলা যায় না। লজ্জায় বলতে পারি না। এমনকি নিজের মাকেও না।

কতদিন উনি কাছে আসার মুহূর্তে আমি উনাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি! উনার আকুতিভরা চাহনি উপেক্ষা করে দূরে সরে গিয়েছি, উনার বুকভরা ভালোবাসাকে আদিখ্যেতা বলে উপহাস করেছি।
শুধু তো অবহেলায় নয়, লজ্জায় অপমানে দূরে সরে গেছেন উনি! এসব ভাবলেই আমার চোখ ভিজে যায়! যন্ত্রণায় আমি মরে যাই।

এখন মনে হয় সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শুধু একটাবার উনাকে দেখতে পারলেই আমার শান্তি। কিন্তু সেদিন আমি বুঝতে পারি নি। আজ আমার তৃষিত নয়নজোড়া বড় ব্যাকুল উনাকে দেখার জন্য কিন্তু যখন চোখের সামনে ছিলেন তখন ক্রমাগত অবহেলা করেছি।