আমার ভুল পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0
436

#আমার_ভুল
অরিত্রিকা আহানা
#অন্তিম_পর্ব

প্রাপ্তি বেরিয়ে গেলে আমার ঘরের বাইরে ওর গলার আওয়াজ পেলাম। হয়ত ফোনে কথা বলছে। ওর কথাবার্তা সব আমার কানে আসছে। আমি খাটের সঙ্গে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। ফাঁকা! অন্তঃসারশূন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। ফের প্রাপ্তির হতবাক কন্ঠস্বর কানে এলো,”আমার ধারণা কিরণ পাগল হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া। সত্যি বলছি। ওর আচার আচরণ মোটেও স্বাভাবিক নয়।”

আমি চোখ মুছে কান্না চাপার চেষ্টা করলাম। আমাকে পাগল প্রমাণ করে ওরা আমার সংসারটা ভেঙ্গে দিতে চাইছে।

হঠাৎ উনি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন! আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! উনি এসেছেন! ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম উনার দিকে। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছিলো না।

উনি নিজের স্বভাবসুলভ ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,’কি সমস্যা?

আমি কথা বলতে পারলাম না। আমার চোখের নিচের অনিদ্রার আস্তরণ কেউ দেখে নি। আমার বুকভাঙ্গা আর্তনাদ কেউ শোনে নি! কত অভিযোগ জমে আছে! ঝাঁপিয়ে পড়লাম উনার বুকের ওপর! হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। আমার মনে হচ্ছিলো এই আমার শেষ ভরসাস্থল! উনি ছাড়া কেউ আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম যে আমি পারলে উনার পাঁজর ভেদ করে হৃদপিন্ডে ঢুকে যাই। দুহাতে উনার পাঞ্জাবি খামচে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে শুধু বললাম,’আমি ডিভোর্স চাই না।’

-‘আমিও না।’

উনার চোখে পানি! নিঃশব্দে কাঁদছিলেন! সেটা দেখে আমার কান্না আরো জোরালো হলো। কান্নার শব্দ শুনে ড্রয়িংরুম থেকে আব্বা, আমার শ্বশুরমশাই, শ্বাশুড়িমা প্রান্ত সবাই ছুটে এলো। উনি দুহাতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলেন। দুজনেই কাঁদছিলাম। এতটাই ব্যাকুলভাবে কাঁদছিলাম যে দরজায় দাঁড়ানো মানুষগুলোর চোখের পানি আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো না! সেদিন আর কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো না। সবাই আস্তে আস্তে সরে গেলো।

এভাবে কতক্ষণ কেঁদেছি আমার মনে নেই। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামার অপেক্ষা করছিলেন। আমি অভিমান, অভিযোগ সব একসঙ্গে ঢেলে দিয়ে বললাম,’আমি ভালো ছিলাম না। খুব কষ্টে ছিলাম। আপনি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। একবার বলে পর্যন্ত যান নি। পাঁচবছর অপেক্ষা করে ছিলাম।’

উনি আমাকে খাটে বসিয়ে দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিলেন। তারপর নিজে আমার পাশে বসে আর্দ্র কন্ঠে বললেন,’শান্ত হও কিরণ। এত কান্নাকাটির কিছু হয় নি।’

-‘আমি খুব কষ্ট ছিলাম।’

উনি স্নেহের সহিত আমার মাথাটা টেনে বুকের কাছে নিয়ে বললেন,’তুমি একা সাফার করো নি। আমিও করেছি। আমাকেও শুনতে হয়েছে ভালো চাকরি নেই বলে বউয়ের টাকায় আমার সংসার চলে। তুমি চলে আসার পর বাবা মাকে শুনতে হয়েছে অত্যাচার করে তাঁরা ছেলের বউ ভাগিয়ে দিয়েছেন। বড় চাকরি নেই বলে আমার বউ ভেগেছে। লোভের কারণে আমার বাবা মা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছেন। আমরা সবাই সাফার করেছি কিরণ। সবাই। সবাই নিজেদের পার্স্পেক্টিভ থেকে ভুক্তভোগী। কেউ ভালো ছিলাম না। বিগত পাঁচবছর বিদেশে কি পরিমাণ অমানুষিক পরিশ্রম আমাকে করতে হয়েছে তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। এমনও সময় গিয়েছে, আমি চার দিনে ঘুমিয়েছি মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টা। ল্যাবে কাজ করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছি।’

আমি হু হু করে কেঁদে ফেললাম। উনার দুহাতে উনার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,’আমার জন্যই আপনাকে এত কষ্ট করতে হয়েছে। নিজের কাছে এখন আমি নিজেই অযোগ্য হয়ে গিয়েছি।’

-‘কে বলেছে তুমি অযোগ্য। তুমি আগেও যোগ্য ছিলে। ভবিষ্যতেও থাকবে। ওয়ান্স আ কিং, অলওয়েজ আ কিং। কিন্তু আমার নিজেকে প্রমাণ করা প্র‍য়োজন ছিলো। শুধু ভাগ্যের ওপর আর মানুষের ওপর দোষ দিয়ে বসে থাকলে তো চলে না। তাই নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি।’

-‘আমি ভেবেছিলাম আপনাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।’

উনি সামান্য হাসলেন। আপন মনেই বলে উঠলেন,’দ্যা প্রিন্সেস নেভার লস্ট হার প্রিন্স। সি জাস্ট লস্ট হারসেল্ফ! আমি শুধু চেয়েছিলাম তুমি নিজেকে ফিরে পাও।’

পাঁচ বছরের অনুতাপ। এত সহজে শেষ হবার নয়। আমি শুধু কাঁদছিলাম। উনি আমার কান্না থামানোর চেষ্টা করলেন না। শুধু বললেন,’তোমাকে আমি কোন সান্ত্বনা মূলক কথা বলতে চাই না। ভাগ্যিস তুমি ভুলটা করে ছিলে বলেই আমি এতবড় একটা অর্জন করতে পেরেছি। এই কথা আমি তোমাকে কখনো বলবো না। কারণ এর জন্য আমাকে ভুগতে হয়েছে। অনেক ভুগতে হয়েছে। তবে আমি যা বলবো একেবারে সত্যি বলবো। একবর্ণও মিথ্যে বলবো না।’

এইটুকু বলে উনি থামলেন। আমি কান্না থামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। উনি কোনোরকম দ্বিধা ছাড়া, সংকোচহীন গলায় বললেন,’আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। তোমার সব ভুলের উর্ধ্বে এই ভালোবাসা। তাই তোমার করা ভুলগুলোকে আমি আমার জীবনের ফুল হিসেবে ফুটিয়ে নিয়েছি। বাইরের মানুষ কখনোই জানবে না এই ফুল তুলতে গিয়ে কতটা কাঁটার আঘাতে জর্জরিত হতে হয়েছে আমাদের। তারা শুধু জানবে আমরা জয়ী।’

উনি আমার হাত ধরে বললেন,’চলো বাইরে চলো। সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’

ড্রয়িংরুমে সবাই অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য। আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম। সবাই কি বলে এই ভেবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। আব্বা, মা, আমার শ্বশুর, শাশুড়ি সবাই আমাদেরকে সংসার জীবন সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়ে আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে বললেন। সবাই আসলে আমাদের তখনকার কান্না দেখে বেশ প্রভাবিত হয়ে গেছে। তাই চাইলেও দুপক্ষের কেউই কড়া করে কিছু বলতে পারলো না।

আলোচনা শেষ হলে একফাঁকে আমি প্রাপ্তির হাত চেপে ধরে ওকে আমার রুমে নিয়ে এলাম। ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,’তুই তো জানিস আমি কেমন। আসলে তখন মাথা ঠিক ছিলো না। ভেবেছিলাম উনাকে হারিয়ে ফেলবো। তাই অনেক ভুলভাল কথা বলে ফেলেছি তোকে! সরি।’

-‘রাগের মাথায় আমিও তোকে অনেক কথা বলেছি। যেগুলো বলা আসলে আমার একদমই উচিৎ হয় নি। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। তুইও ভাইয়াকে ভালোবাসিস আমিও ভালোবাসি। দুজনে যা-ই বলেছি রাগের মাথায় বলেছি। যা হয়েছে ভুলে যা। আমিও ভুলে গেছি। এবার নতুন করে শুরু কর।’

আমার বুকের ভার অনেকটা হালকা হয়ে গেলো। আসলে বান্ধবী যতই প্রিয় হোক বোনেরা ভাইয়ের ব্যাপারে অনেক বেশি সেনসিটিভ। তাই প্রাপ্তির ওপর আমি চাইলেও রাগ করে থাকতে পারি নি। হাসিমুখে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম।

প্রাপ্তি চলে যাওয়ার পর প্রান্ত এলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে বললো,’আসবো ভাবি।’

আমি নিজেই অন্তর্মুখী স্বভাবের। কীভাবে এর বিব্রত ভাব কাটাবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। সামান্য হাসার চেষ্টা করে বললাম,’এসো।’

প্রান্ত ভেতরে ঢুকে অনুতপ্ত গলায় বললো,’সরি ভাবি। সেদিন তোমার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করা আমার উচিৎ হয় নি। আসলে ভাইয়া আমেরিকা চলে যাওয়ার পর আমাদের কারোরই মাথা ঠিক ছিলো না।’

-‘তোমার ওপর আমার আর কোনো রাগ নেই ভাই। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে আমি এতেই আমি সন্তুষ্ট।’


সংসার জীবন আসলেই বড় অদ্ভুত। এর সঙ্গে বোধহয় গড়ে নেওয়ার জন্মজন্মান্তরের সন্ধি। হয় তুমি সংসারকে গড়ে নেবে নয়তো সংসার নিজে তোমাকে গড়ে দেবে। কিন্তু ভাঙার কথা কথা ভাবতে দেবে না। চারপাশের মানুষগুলো ভাঙ্গার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত ভাঙ্গতে পারবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর নিজেদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরে।
আবার চাইলেও কেউ গড়ে দিতে পারবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত স্বামী স্ত্রী দুজনে তাদের সম্পর্কের উদ্ধারকর্তা হন।
তাই নিজেকে প্রকাশ করতে হবে। অপরদিকের মানুষটাকে বুঝতে দিতে হবে মন কি চায়। কারো ধ্যানধারণা কে আমরা পরিবর্তন করতে পারবো না। কিন্তু নিজেদের অবস্থান বদলাতে পারবো।

আসলে আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা অন্যের সম্পর্কে খুব সূক্ষ্মভাবে অসুস্থতার বীজ ঢুকিয়ে দিয়ে একধরনের পৈশাচিক আনন্দ বোধ করেন। এদের আসল উদ্দেশ্য কি এরা নিজেরাও জানে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব মানুষ নিজেরা খুব সুখে শান্তিতে সংসার করছে। কিন্তু অন্যের বেলাতেই এদের যত গাত্রদাহ।
সো জাস্ট লেট দ্যাম ডু বাট ডোন্ট গেট
ইনফ্লুয়েন্সড। ইউ নো ইউর হ্যাপিনেস! ইউ নো হোয়াট টু ডু! হয়্যার টু ডু! হয়্যেন টু ডু!


ডায়েরীতে বসে নিজের ভুলগুলো লিখছিলাম। আমার ছেলেমেয়ে হলে দেখাবো। মেয়ে হলে আমার মেয়ে তাঁর মায়ের জীবনের ইতিহাস থেকে অনেক কিছু শিখবে। আর ছেলে হলেও দেখাবো। সে দেখবে তার বাবা কি করে তাঁর মায়ের জীবনের ভুল গুলোকে সুবাসিত ফুলে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। আমার ছেলেকে আমি কখনো এমন গল্পের সাথে পরিচয় করাবো না যেখানে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে অবহেলা করে, অত্যাচার করে, অধিকার বঞ্চিত করে। আমার ছেলে শুধু জানবে ভালোবাসা দিয়ে ভুলকে ফুলে পরিনত করা যায়। স্ত্রী তাঁর একান্ত আপন। সে জানবে দ্যা রিয়েল প্রিন্স নেভার লিভস হিজ প্রিন্সেস। হি অলওয়েজ কনকার্স!

উনি শুয়েছিলেন। বিছানা থেকে ডাক দিয়ে বললেন,’ভুল সমাচার শেষ হলে এদিকে এসো। তোমার পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন।’

আমি ডায়েরী বন্ধ করে উনার পাশে গিয়ে বসলাম। উনি আমাকে টেনে শুইয়ে দিলেন। আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন,’তুমি ভীষণ রোগা হয়ে গিয়েছো। নিজের শরীরের ওপর এতটা অযত্ন করা তোমার ঠিক হয় নি।’

পুরোনো কষ্টের দিন গুলোর আমি ভুলে যেতে যাই। তাই প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে বললাম,’সত্যি করে বলবেন বিদেশে কয়টা মেয়ে আপনার সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করেছে?’

উনি ঠোঁট বিস্তৃত করে হাসলেন। বললেন,’বিদেশী মেয়েরা বাঙালি কিরণের মত বোকা নয় যে আমার মতন বোরিং একটা মানুষকে পছন্দ করবে। ওদের পছন্দ রাফ এন্ড টাফ!’

-‘আমি সত্যিই ভেবেছিলাম আপনি আর ফিরবেন না।’

-‘তুমি তো কত কিছুই ভাবো কিরণ। এর কয়টা সত্যি হয়েছে! এবার এসব ভাবনা চিন্তা বাদ দাও। আগামী মাসে আমরা আমেরিকা ফিরবো। তুমি পোস্ট ডক. করবে। আমি চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি।’

-‘কিন্তু বাবা, মা প্রান্ত, প্রাপ্তি ওরা তো সবাই এখানে।’

-‘তোমার পোস্ট ডক. শেষ হলেই আমরা চলে আসবো। ফেরার সময় মা বাবার জন্য একটা নাতনী নিয়ে আসবো সঙ্গে করে।’

আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললাম। উনি হেসে উঠে বললেন,’তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে কথায় কথায় লজ্জা পাওয়া। এই ভুলের জন্য কঠিন সাজা দেওয়া হবে তোমাকে।’
শাস্তির কথাটা আর নাই বলি….লজ্জা হচ্ছে!

সমাপ্ত।