আমার সংসার পর্ব-০৫

0
544

#আমার_সংসার
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৫

আকাশ নিকশ কালো। থেকে থেকে গর্জন করছে। চাঁদ নেই,তারা নেই। কি নিকৃষ্ট থমথমে আকাশ। কালো কুচকুচে মেঘ উড়ে বেরাচ্ছে আকাশ জুড়ে। হাড় কাঁপানো শিত পড়েছে। তার উপর আকাশের যা অবস্থা, বৃষ্টি নির্ঘাত নামতে। এই শিতে আবার বৃষ্টি নামবে? ভাবলেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। বেলকনি দিয়ে শিতল বাতাস সাঁ সাঁ করে ঘরে ডুকছে। শরীর হিম হয়ে আসছে। তবুও চোখে ঘুম নেই। উত্তেজনায় ঠান্ডাটাও গায়ে লাগছে না ঠিকমতো। কাল বড়মাকে, আব্বুকে দেখবো! তারাকি আনন্দে কেঁদে দেবে আমায় দেখে? বড়মা হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবে আনন্দে। আনন্দে থাকা চোখদুটি বুজলাম৷ না! ঘুমের লেশ মাত্র নেই। অনেকক্ষণ কিছু একটা ভাবলাম। পাশ ঘুরে শুতেই সিয়াম ভাইয়ার ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়লো। হঠাৎ করে খুব রাগ হয় লোকটাকে দেখে। কেন আমায় সংসারে ফেললো? আবার তার কষ্ট, নর্দমার মতো অতিত মনে পড়তেই শরীর ঝাঁকি দিয়ে বোঝায় যে আমার ভাবনা ভুল! পাষান ভাবনা!

দুপুরে কি ঠাট্টাটাই না করলো সিয়াম ভাই। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারো শুকরিয়া। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি আমি! কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম তখন। রাগও উঠেছিলো। তারপর রেজাল্ট পেয়ে সব গলে গেছে। মামা-মামী কি খুশি! মামীর চোখে পানি দেখেছি। আর মামার চোখে গর্ব। ইচ্ছে করেই আব্বুকে রেজাল্টটা বলিনি। আমিযে যাব তাও বলিনি। কাল বলবো! নিশ্চই আমার পছন্দের আলুর পরোটা বানিয়ে দিবে শুনে! দু দাঁত বের করে একাএকা হাসলাম অনেকক্ষণ।

হঠাৎ ঠান্ডাটা জেঁকে বসলো। হাড় কাঁপিয়ে শিত রগে রগে ডুকে পড়ছে। ছুটে গিয়ে বলকনির পর্দা টানিয়ে দিলাম। শরীর থেমেথেমে কাঁপছে। বিছানায় গা এলিয়ে কম্বল জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে রইলাম। চোখে ঘুমের আভাস পাচ্ছি। কখন তন্দ্রায় তলিয়ে গেলাম জানা নেই।

___

নিল রঙা কুর্তি পড়েছি। চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছি। এলোমেলো থাকুক একটু। ভেজা চুল। ওড়নাটা গলায় জড়িয়ে সিয়াম ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি বিরক্তিতে ‘চ’ জাতিয় কিছু উচ্চারণ করলেন। আমি মুখ বাকিয়ে বললাম,

‘ আমি রেডি,চলুন। ‘

‘ অবশেষে মহারানির সাজগোছ হয়েছে। ‘

শুনতেই কটমটে চোখে তাকালাম আমি। কি লোক রে বাবা! কি এমন সেজেছি আমি? চোখদুটি নিজেকে না চাইতেও দেখলো। সাজিনি বেশি। কাঠ কাঠ গলায় বললাম,

‘ চোখে ছানি পড়েছে আপনার? দেখতে পাচ্ছেন না আমি একটুও সাজিনি। ‘

‘ তোর কানে খোল জোমেছে! আমি বললাম কেউ এত দ্রুত কিভাবে সাজতে পারে? ‘

লোকটা অদ্ভুত! না না কিম্ভুত! না রে বাবা, এ কেমন লোক? কি অদ্ভুত সব কথা বলে। কি জানি, মাথার কি তারতুর ছিঁড়ে গেছে? মুখ বাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম। উনি রুমে পেটে হাত গুজে হো হো করে হাসছেন। আমি শুনলাম দরজার বাইরে থেকে। রাগে কপালে ভাজ পড়েছে আমার।

নিচে নেমে এলাম। ড্রইংরুমের মামী আর সিনথি বসে আছে। ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, বললো ওর কোচিং, স্কুল আছে। তাই এলোনা। আমি আসতেই মামী আমার কাছে এসে চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘ আকাশ দেখেছিস সিয়া? কেমন গুমট! বৃষ্টি নামবে বোধহয়। মেঘও ডাকছে। যদি বৃষ্টি চলে আসে? ‘

থেমে গেলাম! মামীর কথায় যুক্তি আছে। সারারাত মেঘ ডেকেছে। আকাশ এখনো থমথমে। শিতও আছে অবশ্য। তাহলে কি আব্বুর সাথে দেখা হবে না আমার? বুক হু হু করছে। সিয়াম ভাইয়া লাগেজ নিয়ে নেমে পড়লেন। কাল সব কাপড় ওনার লাগেজে ডুকিয়ে দিয়েছি। ভাইয়া দূর থেকেই বললো,

‘ সিয়া দ্রুত গিয়ে গাড়িতে উঠ। বৃষ্টি আসার আগেই। ‘

আমি হাটতে যাচ্ছিলাম। মামী কিছু একটা বলতেই থেমে গেলাম। আকাশের গর্জন বাড়ছে। আমার থামাতে সিয়াম ভাইয়া ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললো,

‘ তোকে যেতে বলেছি না? যাবি নাকি থাকবি বলতো? ‘

আমি সোজা গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম। সিয়াম ভাইয়াও আসবেন তখনি পিছু ডেকে বললো মামী,

‘ তুই এ অবস্থায় যেতে রাজি হলি? ঝড় আসতে পারে। ‘

উনি ম্লান হেঁসে বললেন,

‘ সে সারারাত উদ্দিগ্ন হয়ে ছিলো কখন যাবে। হতাশায় ফেলতে চাইছি না। আসছি। ‘

সামনের ছিটে সিয়াম ভাইয়ার পার্শেই বসলাম। মেঘ হুড়মুড় করে উঠলো৷ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামতে লাগলো ঝিরিঝিরি। আমি ভাবতেই পারিনি আমরা বসতেই বৃষ্টি শুরু হবে। দিনটা অন্ধকার! সূর্য যে মেঘের কোন অতলে হাড়িয়ে গেছে তা জানা নেই। গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হাইওয়ের পথে চলতে লাগলো। আজ অতিরিক্ত গাড়ি নেই হাইওয়েতে। বৃষ্টি আসায় ঠান্ডার তিব্রতা বেড়েছে।
লোমকূপ খাড়া হয়ে উঠছে। কই বাড়িতে তো এতো শিত করেনি? হয়তো বৃষ্টি এসেছে বলেই এতো শিত করছে! আমার পাশের জন বেশ বিন্দাসে গাড়ি চালাচ্ছে। সাদা শার্ট পড়েছে, তার উপরে কালো ব্লেজার, আবার তার উপরে কোট। ঠান্ডা লাগার জায়গা আছে? এদিকে আমি মরছি ঠান্ডায়। রগে রগে কাঁপুনি ধরছে আমার।

‘ আসার সময় চাদরটা গায়ে জড়ালে কি সাজ নষ্ট হতো তোর? ‘

তুখোড় দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। মন দিয়ে ড্রাইভিং করছেন উনি। আরে বাবা সেটাই করো। কে বলেছে কম্পিত আমার দিকে তাকাতে? মুখ বাঁকিয়ে জানালার দিকে চোখ রাখলাম। চিবুক, চোখের পাপড়ি তিরতির কাপছে! গুটিশুটি হয়ে বসে রইলাম।

‘ যদি ভাবিস, সিনেমার নায়কের মতো কোট খুলে জড়িয়ে দেবো, তাহলে বলবো ইউ রং সিয়া। এমন কিছুই করছি না আমি। ‘

মেজাজ এবার তুঙ্গে চড়ে বসলো। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বললাম,

‘ আমিকি চেয়েছি, নাকি বলেছি? ‘

‘ চাসনি, হ্যা বলিস ও নি। আমার মনে হলো আশা আছে। ‘

শরীর রাগে কাঁপছে। বাড়ছে বৃষ্টির বেগ। ধুপধাপ শব্দ তুলছে। আছড়ে পড়ছে গাড়ির ছাঁদে, গ্লাসে। সময় কাটছিলো কষ্টে। দেখতে দেখতে চলে আসলাম বাড়ির সামনে। হুট করেই ব্রেক কষতেই হকচকিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। উনি আমাকেই দেখছেন। পেছন থেকে দুটো ছাতা বের করে এগিয়ে দিলেন,

‘ লাগবে? ‘

এমনিতেই ঘা, তার উপর লবন ছিটাচ্ছে। একটানে কেড়ে রাগে ফুসতে লাগলাম। উনি বেড়িয়ে গেলেন গাড়ি থেকে। আমিও বেরোবো তখনি, চোখ পড়লো পিছনের সিটে! সাদা কাগজ! মুড়িয়ে বলের মতো পড়ে আছে। মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো। রাগ গলে রহস্যের গন্ধে অবহিত হলাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, সিয়াম ভাইয়া লাগেজ বের করছে। এটাই সুযোগ। ভাগ্য ভালো তাই পেলাম। ঝুঁকে তুলে নিলাম চিঠিটা। হাত শিরশির করছে। নিশপিশ করছে পড়ার জন্য! কি লেখা আছে চিঠিতে? কে ছিলো সেই আগুন্তকঃ?

‘ বেরো এবার..’

সিয়াম ভাইয়ার গলায় ভাবনা ছুটলো। সময় আরো পাবো। হাতে মুঠো করে বের হয়ে এলাম গাড়ি থেকে। প্রবল বর্ষন হচ্ছে। বড়বড় ফোঁটা রাস্তায় পড়ে সেগুলো ছিটকে এসে গায়ে লাগছে।
__
কলিং বেল চেপে চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। মন খুশিতে টগবগ করছে। মনে হচ্ছে বছর খানেক বাদে দেখা পাবো সবার। একটু পর কন্ঠ ভেসে এলো,

‘ কে….

বলতে বলতেই দরজা খুলে দিলো বড়মা। ঝাপিয়ে পড়লাম বুকে। বড়মা হকচকিয়ে উঠে, হাত উঁচু করে নিলো। শান্তি! ময়াময় শান্তিতে ছেয়ে গেলো আমার বুক। ছটফটানি থেমে প্রসান্তির খেলা দুটো বুকে। ধুপপুক করছে দুটি হৃদপিণ্ড। যেন লাফিয়ে বাইরে আসতে চাইছে। কি অনুভুতি! শান্তি! অস্রুসজল চোখে মাথা উঁচু করে তাকালাম বড়মার দিকে। চোখ বেয়ে জল পড়ছে বড়মার।

‘ কই বলিস নি তো আজ আসবি? ‘

আমি কাঁপা গলায় বললাম,’ সারপ্রাইজ। ‘

‘ এখনো ছোট আছিস, জামাইয়ের সামনে…ছাড়! ‘

বলেই কিয়দংশ দূরে গিয়ে দাড়ালো বড়মা। এরপর হেঁসে আমাদের ভেতরে আসতে বললো। সোফায় বসতেই চিঠিটাকে শক্ত করে নিলাম। এরপর বড়মাকে বললাম,

‘ আব্বু কই বড়মা? ‘

‘ জানি না। বেরোনোর সময় বললো রাজধানী যাবে। ‘

টনক নড়লো আমার। কাল বাজারে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমায় কল করে বলেছিলো আব্বু। আর আজ ঢাকা চলে গেলো অথচ জানালো না? কিছু একটা লুকিয়ে রাখতে চাইছে কি আব্বু? কিন্তু কি? কটু ভাবনায় বিষিয়ে উঠলো মন। আব্বু অসুস্থ নয়তো?

#চলবে…..