#আমার_সংসার
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৬
প্রিয় সুন্দরী,
কেমন আছো তুমি? ভালো নিশ্চই? ভালো থাকারই তো কথা। যাগগে, অনেকদিন পর ভারাক্রান্ত মনে লিখতে বসেছি। সম্মোধনটা প্রিয় দিয়ে করাটা উচিত হয়নি বোধহয়। কারন এখন তো তুমি আর আমার নও। চড়া দাতে ভুষীত আমার ব্যাক্তিত্ব। তোমায় না পাওয়ার যন্ত্রনা একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছে আমাকে। বুকে রক্তক্ষরণ চলছে! কেন চলে গেলে সুন্দরী? আমার সুন্দরী? নিজের থেকেও তো বেশি ভালোবাসি তোমায়! তোমার বড়বড় চোখ, অথই নদীর পানি তাতে। কত গভীর! সুন্দর! দেখলে মন জুড়িয়ে আসে। দিনে কতবার তোমার ছবি দেখি জানো সুন্দরী? হাজারবার! শ্যামলা চেহারার মুখখানা আমায় পাগল করে তোলে। ঘোরে ডুবিয়ে রাখে। তোমার ব্যাক্তিত্ব কত শক্ত ছিলো সুন্দরী? কত মজবুদ। সে ব্যাক্তিত্ব নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগবে ভাবতে পারিনি আমি। তুমিই তো বলেছিলে, অনার্স ফাইনাল না দিয়ে কখনোই বিয়ের কথা মুখে আনবে না। তাহলে কি করে পারলে বিয়ে করতে? কে সে সৌভাগ্যবান পুরুষ? চিনিনি তো! তাকে হিংসে হচ্ছে। খুন করতে ইচ্ছে করছে। আমার সুন্দরী আজ তার কাছে! কাছে থাকার হালাল সনদ তার হাতে! এ কেমন বিষাক্ত অনুভুতি? বুক জ্বালানো কষ্ট? চোখ ধাধানো আগুনে জ্বলা হৃদপিণ্ড? আমার যে সহ্য হচ্ছে না প্রেয়সী! হচ্ছে না সহ্য! এগুলো কি সপ্ন হলে পারতো না? ভয়াভয় দুঃসপ্ন হলে খুশি হতাম।
লিখতে হাত কাপেঁ, বুক কাঁপে। ডায়রির পাতা ভিজে ওঠে কোন পুরুষের কান্নায়। চোখ ডুমুরের মতো ফুলেছে। লাল টকটকে চোখ! সামি তপ্তশ্বাস ছাড়লো। বুক ছারখার হয়ে আসছে। হৃদপিণ্ড চিঁড়ে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। কষ্টে গলায় দলা পাকিয়ে আসছে তার। সামি অস্ফুটস্বরে উচ্চারন করে ‘ সুন্দরী…আমার সুন্দরী ‘ সে কন্ঠে কত কষ্ট! কত জ্বালা! ধা ধা আগুন! একটা মানুষকে এতটা নিখুঁত ভালোবাসা যায়? যায় বুঝি! নয়তো সামির এতটা কষ্ট হতো না।
অন্ধকার ঘর। টেবিল ল্যাম্পের বাতিটার পাওয়ার একদম লো। হালকা রশনি ছড়িয়েছে সে। যেন শুধু টেবিলটাই আলোকিত করা কাজ তার। সামি দু হাতে মুখ গুজে হু হু করে কেঁদে উঠলো। ছেলেরা নাকি কাঁদতে জানে না? তাদের নাকি কষ্ট হয় না? তাহলে সামির বুকপোড়া কষ্ট কেন হচ্ছে? ভেতরটা ছারখার হয়ে আসছে কেন? শুধুইকি তার সুন্দরীকে আর পাবে না বলে, নাকি অন্য পুরুষের সংস্পর্শে তার সুন্দরী! কোনটা?
মহুয়া দরজা থেকে ছুটে গেলেন শ্বামীর কাছে। ছেলের এতো নির্মম বেদনা তার সহ্য হচ্ছে না। তারও ঠিক সামির মতোই ব্যাথায় বুক ফেটে আসছে। একটি মাত্র সন্তান। আর তার এই হাল? এ কিছুতেই মানতে পারছেন না মহুয়া। রুমে এসে দেখলেন তার স্বামী পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাচ্ছে। ছুটে গিয়ে স্বামীর পা জড়িয়ে বুক ফাটা আর্তনাৎ করে কেঁদে উঠলেন মহুয়া। কম্পিত কণ্ঠে বললেন,
‘ তুমি তো আই পি এস অফিসার। তুলে নিয়ে আসো ওই মেয়েকে। যেভাবেই হোক সামির মুখে হাসি ফোটাও। একমাত্র ছেলেটা একটা মেয়ের জন্য ধুকে ধুকে মরবে আমি মানতে পারছি না। কিছু করো তুমি। ফোর্স পাঠাও। তুলে আনো মেয়েটাকে। ‘
তজমুর বিরক্তি নিয়ে চেয়ার ছাড়েন। মহুয়ার হাত, পা থেকে ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে দাড়ান। মহুয়া স্বামীর অবহেলায় ফুঁপিয়ে ওঠে। দুদীন যাবৎ মহুয়া বলছে, মেয়েটাকে তুলে আনতে। এটা কি সম্ভব? সে নিজেও চিন্তিত ছেলের কষ্টে। কিন্তু সব জায়গায় কি জোর চলে? মেয়েটা হয়তো নিজ থেকে বিয়েটা করেছে। মহুয়া কঠিন গলায় বলে ওঠে,
‘ তুমি কিছু করবে না? ‘
চুপ রইলেন তাজমুর। বোঝাতে বোঝাতে সে ক্লান্ত।
মহুয়া উঠে দাড়ায়। স্বামীর কলারে হাত দেয়ার মতো স্পর্ধা দেখায় সে। হঠাৎ আক্রমণে থতমত খেয়ে গেলেন তাজমুর। মহুয়া কাটখোট্টা মানুষ। অল্পতেই ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকে। তাজমুরের মনে হচ্ছে মহুয়ার শরীরে জ্বিন প্রবেশ করেছে। আর সে’ই মহুয়াকে করে তুলছে ধৈর্যহারা, উত্তেজিত। মহুয়ার কন্ঠ শিতল,
‘ তুমি সত্যিই কিছু করবে না? ‘
এমন কন্ঠ কখনো শোনেনি তাজমুর। মহুয়ার ডান চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। তার চোখ আগুন ঝলসানো। গাঢ় লাল। তাজমুর ভিত গলায় বললেন,
‘ না। ‘
মুহুর্তে দমে গেলেন মহুয়া। দৃষ্টি শান্ত হতে লাগলো। হাত আলগা করে ছিটকে দূরে গিয়ে দাড়ালেন উনি। চোখমুখ কুঁচকে বললেন,
‘ আমি পারছি না সহ্য করতে। পারছি না। ‘
___
দুপুর হয়ে এসেছে। আকাশ পরিষ্কার। আকাশের জ্বলজ্বলে সূর্য কিরন ছড়াতে ব্যাস্ত। ঘরির কাটার তখন দুটোর ঘরে। আব্বু এখনো আসেনি। কোথায়, কি করছেন কে জানে। আসার পর থেকে একগ্লাস পানি অব্দি খাইনি। মামী আর আমার কথায় সিয়াম ভাইয়া খেয়েছে। ঘরে উনি। কি যেন কাজ আছে বললেন। আমার মন টিকছে না। দরজার দিকে চেয়ে আছি তীর্থের কাকের মতো। কখন আসবে আব্বু?
আমার ভাবনার মাঝেই দরজায় এসে দাড়ালো আব্বু। ছুটে গেলাম আব্বুর কাছে।
‘ কই গিয়েছিলে তুমি? একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? ‘
আমাকে দেখেই শুকনো ঠোঁটে হাসলো আব্বু। মুখ ফ্যাকাশে। শরীর শুকিয়েছে অনেক। থমকে গেলাম। এ কি হাল আমার পিতার? উনি ভেজা গলায় বললেন,
‘ কখন এসেছিস শুনি? একবারও জানাবি না আমায়? তুই বললে কি আমি যেতাম রে পাগলি? ‘
‘ তার আগে এটা বল তুমি কেন গিয়েছিলে রাজধানী? কাউকে কিছু না বলে? ‘
কড়া গলায় বললাম। আব্বুর দৃষ্টি এলোমেলো। আমায়,আমার প্রশ্নকে এড়িয়ে ভিতরে ডুকলো আব্বু। কি হয়েছে ওনার? আমায় এড়াচ্ছে? তার সিয়াকে? চোখভর্তি পানি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি ভেতরে গিয়ে হাতের ফাইলটা রেখে জুতো খুলতে খুলতে বললো,
‘ তোর রেজাল্ট সিয়া? ‘
‘ ফার্স্ট ক্লাস। ‘ কথার ভঙ্গিতে বিরক্তি আমার। উনি আমার দিকে তাকালেন। ওষ্ঠদ্বয় টেনে বললেন,
‘ আমার সিয়ার এতো রাগ? জোর করে বিয়ে দিয়েছি বলে? নাকি এখন এড়ালাম বলে সে কষ্ট পেয়েছে? যাগগে,সন্ধ্যায় সব বলবো। ‘
বলেই একপ্রকার ছুটে উপরে চলে গেলো আব্বু। কোথথেকে বড়মা এসে টেনে নিয়ে গেলো টেবিলে। ভাত মেখে খাইয়ে দিলো। খাওয়ার মাঝে বললাম,
‘ তুষার ভাই কই বড়মা? ‘
‘ জানি না। কিছু বলে যায়? ‘ কন্ঠে ক্ষত বড়মার। একমাত্র ছেলেটা মাদকাসক্ত! কি নির্মম পরিস্থতি! শুকনো গলায় বললাম,
‘ বড় আব্বু? ‘
‘ উনি বরিশাল গেছে কোন কাজে। কাল ফিরবে। ‘
আর কথা হলো না। খাওয়া শেষে চুপচাপ ঘরে এলাম। রুমে ল্যাপটপে কাজ করছেন সিয়াম ভাইয়া। ঘরে ডুকলাম।
উনি ল্যাপটপে কিছু দেখছে আর নোটপ্যাডে লিখছে। শান্ত হয়ে বিছানার এক কোনে বসলাম আমি।
‘ আব্বা এসেছেন? ‘
‘ হুম মাত্রই। ‘
উনি ওনার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। যেন এটা শোনা ওনার আরেক কাজ ছিলো।
‘ শুনছেন? ‘
উনি ব্যাস্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে। মৃদু স্বরে বললেন,
‘ হুম। ‘
‘ কি করছেন আপনি? ‘
‘ ওয়ার্ক ফর্ম হোম। ‘
আগ্রহ বাড়লো। উৎফুল্ল কন্ঠে বললাম,’ আমি যখন চাকরি করবো তখন আমিও বাড়িতে শুধু কাজ করবো। অফিসে যাবোই না। ‘
‘ সবাই এটা পারে না। কাজে ভুল থাকতে পারে, যেটা অফিসে থাকলে শোধরানো সহজ। একজন দক্ষ কর্মীই পারে বাড়িতে কাজ করতে। আর তুই নাকি অফিসার হবি? তো তখন তো তোকে দিনরাত এক করে কাজ করতে হবে। বাড়িতে তো কাজ করা অসম্ভব! ‘
অবাক চোখে তাকালাম আমি। উনি কি করে জানলেন আমি অফিসার হতে চাই? অবাক কন্ঠে বললাম,
‘ কে বলেছে আমার হবি নিয়ে? ‘
‘ তোর আব্বু। ‘
চকিতে তাকালাম আমি। আব্বু বলেছে? আর কিছু বললাম না। উৎসাহ জেগেছিলো। ধামাচাপা দিয়ে জানালায় দৃষ্টি রাখলাম।
___
সন্ধ্যা নেমেছে। হালকা বাতাসে শরূর কাঁপিয়ে তুলছে একদম। ছাঁদের হাতল বরফের মতো ঠান্ডা। তাই একটু দুরুত্ব দেখেই দাড়িয়ে আছি। গায়ের চাদর বাতাসে উড়ছে। ঠান্ডা পড়ছে খুব! আব্বু সেই কখন আসতে বললো এখনো তার দেখা নেই।
‘ সন্ধ্যায় এখানে তুই? ‘
সিয়াম ভাইয়ার গলা পেতেই সেদিকে তাকালাম। সোয়েটারে হাত গুঁজে অন্যরকম মুখ ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে উনি। বললাম,
‘ আব্বু আসতে বলেছে! তা আপনি? ‘
হঠাৎ অবাক হলেন উনি। বললেন,
‘ তোকেও আসতে বলেছে? আমাকেও তো বললো। ‘
‘ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন হয়তো। ‘
#চলবে….