আমার সংসার পর্ব-০৭

0
169

#আমার_সংসার
পর্বঃ ৭
কলমেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)

মরিয়ম বেগম এসে রহমান সাহেবের পাশে বসলো। মরিয়ম বেগমের চোখে মুখে কিছুটা চিন্তার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সুমন কি বলবে সেটা নিয়েই হয়তো চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সুমন দরজায় তাকিয়ে দেখলো রিমা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের বাইরে। সুমন ডেকে বললো,

— কিরে রিমা! দরজার বাইরে কেনো দাঁড়িয়ে আছিস? আয় ভেতরে আয়।

রিমা ভেতরে এসে মায়ের পাশে বসলো। মরিয়ম বেগম সুমনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— সবাইকে এভাবে ডাকলি, কিছু কি বলবি?

— হ্যাঁ মা।

— ওহ, তো কি বলবি বল!

— মা, সামনে তো রোজা। আর আমাদের তো উচিৎ রিমার শশুর বাড়ি ইফতারি সামগ্রী পাঠানো তাইনা? আর সে জন্যই সবাইকে ডাকা এখানে।

সুমনের আচমকা এমন কথা শুনে সবাই সুমনের দিকে তাকালো। মরিয়ম বেগম আর রহমান সাহেব চুপ করে থাকলেও মুখ খুললো সুজন।

— হঠাৎ রিমার শশুর বাড়ি ইফতারি সামগ্রী পাঠাতে হবে কেনো? ওরা কি পাঠাতে বলেছে?

— কি আজব! রিমা আমাদের বোন না? আর তাকে ভালো রাখাটাও তো আমাদেরই দায়িত্ব, তাইনা? সেটা ওদের বলতে হবে কেনো!

এবার মরিয়ম বেগম বললো,

— এখানে ভালো খারাপ রাখার কথা আসছে কেনো? আর তাছাড়া রিমা তো খারাপ নাই। ও তো ভালোই আছে।

সুজন আবার বললো,

— যে কয় বছর বিয়ে হয়েছে কখনও তো ইফতারি পাঠাইনি। তাহলে হঠাৎ এ বছর তুমি ইফতারি সামগ্রী পাঠাতে বলছো কেনো?

— এতো বছর পাঠাসনি তো কি হয়েছে এ বছর থেকে পাঠাবি। তাতে তো আমি সমস্যার কিছু দেখছিনা!

রাহমান সাহেব বসে বসে শুধু সবার কথা শুনছে। কেও বুঝতে না পারলেও রহমান সাহেব ঠিকই বুঝতে পেরেছে সুমন কেনো এই কথাগুলো বলছে। নিশ্চয় আবার বউদের বলেছে বাপের বাড়ি থেকে ইফতারি পাটঅনোর কথা। এই ইফতারি সামগ্রী পাঠানো বিষয়টা রহমান সাহেবও সমর্থন করেনা। মরিয়ম বেগমের সাথে প্রতি বছরই এটা নিয়ে ঝগড়া লাগে। মরিয়ম বেগমকে দু এক কথা বললে সংসারে অশান্তি হয়। তাই মুখের কথায় দু একবার নিষেধ করলেও জোরালো ভাবে তেমন কিছু করতে পারেনি কখনও, সংসারে ঝামেলার ভয়ে। রহমান সাহেব মনে মনে খুশিই হলেন। যাক এবার অন্তত মরিয়মের অন্যায় এর প্রতিবাদ করার মতো একটা লোক এসেছে।

সুজন বললো,

— যদি মনে করো যে ইফতারি সামগ্রী পাঠাবে তাহলে কিনে পাঠিয়ে দাও এভাবে সবাইকে ডাকার মানে কি?

— রিমার গার্জিয়ান তো আমি একা না যে একাই সব সিদ্ধান্ত নেবো! তুই, মা, আব্বা, আমি আমরা সবাই তো ওর গার্জিয়ান। তাই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবাইকে জানানো উচিৎ বলে আমার মনে হয়েছিল তাই তোদের ডাকলাম। আর আমার দ্বারা একা তো আর ওতো টাকা খরচ করে এতোগুলা জিনিস কিনে পাঠানো সম্ভব না! বাইরে থেকে যা টাকা পয়সা এনেছিলাম, এই দুই মাস তো সেই টাকা দিয়েই চলছি। আমার তো আর অঢাল টাকা নেই যে আমি একাই সবটা করতে পারবো! তুই আছিস তুই কিছু দিলি আব্বা কিছু দিলো আর আমি কিছু দিয়ে মিলে মিশে কিনলে কারোর উপরেই আর তেমন একটা চাপ পড়বেনা। কি বলো মা! আমি কি ভুল কিছু বললাম?

মরিয়ম সুমনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— তোর আব্বাকে টাকা দিতে বলিস কোন হিসাবে! তুই কি জানিস না, তোদের দেয়া হাত খরচেই তোর আব্বা চলে, আলাদা করে তোর আব্বা টাকা কোথায় পাবে?

— আব্বার কাছে টাকা নাই মানলাম, তোমার কাছে থাকলে সেটা দাও?

— আমি কোথায় পাবো টাকা?

সুজন এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। এবার সুমনকে বলল,

— ভাইয়া তুমি কি শুরু করেছো এগুলো, আমি কিছুই বুঝতেছিনা। যদি রিমার শ্বশুরবাড়িতে কিছু দেয়ার সামর্থ্য থাকে তাহলে দাও, আর না থাকলে দিওনা। এত বছর যখন আমরা দেইনি তাহলে এ বছর আমাদের কেনো দিতে হবে! আর এমন তো না যে রিমার শ্বশুরবাড়ি থেকে দিতে বলা হয়েছে!

— তোদের মত সবাই কি ফকির মিসকিন নাকি যে তাদের বাড়ির বউকে পাঠাবে তোদের বাড়ি ইফতারি সামগ্রী নেওয়ার জন্য!

— মানে কি, কি বলতে চাইছো তুমি?

— আমি কিছুই বলতে চাইছি না আর যেটা বলার সেটা আমি স্পষ্ট ভাষায় বলেছি। সবাই মিলে টাকা দে, আমি ইফতারি সামগ্রী কিনে রিমার শশুর বাড়ি দিয়ে আসবো।

— এই মুহূর্তে আমি কোন টাকা দিতে পারবো না। তোমার যদি টাকার সমস্যা মনে হয় তাহলে দিও না। এর কাছে ওর কাছে টাকা চেয়ে ইফতারি সামগ্রী কিনে দিতে হবে এটা কেমন কথা ভাইয়া। আর আমার ব্যবসার অবস্থা তো তুমি জানো এই মুহূর্তে আমার কোন টাকা পয়সা দেয়ার মত পরিস্থিতি নাই। টাকা পয়সা দিতে পারবো না।

— কি হলো আব্বা-মা তোমরা দুজন চুপ করে আছো কেন? কিছু তো অন্তত বলো!

রহমান সাহেব এবার মুখ খুললেন

— দেখ বাবা আমার অবস্থা তো তুই জানিস। দেখ সুজন কিছু দিতে পারে কিনা, সুজন আর তুই দুজন মিলে যা কেনার কিনে দিয়ে আয়। এক তরফা শুধু আমরা ছেলের বউদের বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসবো সেটা তো আর হয়না। মেয়ের বাড়িতে দেওয়াও তো আমাদের দায়িত্ব।

সুজন বললো,

— আব্বা আপনি তো জানেন আমার অবস্থা। আমার কি ব্যাবসা থেকে লাখ লাখ টাকা আসে যে সেটা দিয়ে দেবো! আর আমার ব্যবসা-বাণিজ্য তেমন ভালো যাচ্ছে না। ভাইয়া যদি পারে তাহলে ভাইয়া কিনে দিয়ে আসুক। আমি এখন কোন টাকা পয়সা দিতে পারবো না।

এবার সুমন রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে সুজন কে বলল,

— ও নিজের বোনের বেলায় তুমি ইফতারি সামগ্রী কিনতে টাকা দিতে পারবে না। কিন্তু অন্যের বোনের বেলায় তুমি ঠিকই গায়ে হাত তুলে তাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিতে পারো!

— মানে কি! এসব কি বলছো তুমি?

— আমি এমন কঠিন কোনো কথা বলিনি যে, তোর সেটা বুঝতে অসুবিধা হবে। মনে করে দেখ তো গতবার লতা যখন তার বাবার বাড়িতে বলতে পারেনি ইফতারি সামগ্রী পাঠানোর কথা। তখন তার সাথে কি কি করেছিলি মনে করে দেখ তো! সে বলতে পারেনি কারন, তার ভাইয়েদের সংসার আলাদা তার ভাইয়েদেরই চালাতে হয় তার বাবা মাকে। তারাও কেও কোটি কোটি টাকা ইনকাম করেনা। তোর যেমন টাকার সমস্যা তাদেরও এমনটা থাকতে পারে। কিন্তু তোরা কোনো কিছু ওয়াক্কা না করে একতরফা তাদের উপর সবকিছু চাপিয়ে দিস।

— তোমাকে এসব কথা কে বলল?

— আমাকে কে বলল সেটা তো তোর জানার বিষয় না। তুই কি কি করেছিলি সেটা তুই মনে করে দেখ। আজ তোর সবকিছু থেকেও কিছু টাকা বের করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ওই মানুষটার ভাইদের অবস্থা তুই ও জানিস তাহলে কিভাবে পারলি তার উপর এভাবে অত্যাচার করতে?

সুজন কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে ফেললো। রিমা এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলো কিন্তু এবার বলল,

— ভাইয়া আমার শশুর বাড়ি থেকে তো ওরা কিছু চাইনি তাহলে বিষয়টা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেনো করছো?

— তাদেরই সবসময় চাইতে হবে কেনো! আমাদের বাড়ির বউদের যদি তাদের বাপের বাড়ি থেকে এসব জিনিস এনে দেওয়া কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাহলে তো তোর বাপ ভাইদের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে তাদের দেওয়াও তোর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে!

রিমা এবার মরিয়ম বেগমের দিকে তাকালো। রিমা কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে বললো,

— আমি এসবের কিছু জানিনা ভাইয়া। আর আমার শ্বশুরবাড়িতে কখনো কোনদিন এগুলো চাইনি।

— তারা যদি না চেয়ে থাকে তাহলে তোরা কেনো চাইলি? তোর শশুর বাড়ির সবাই অনেক বড়লোক, তাদের সব আছে তাই তোর ভাইদের কাছ থেকে তারা এসবের কিছুই চায়নি তাই না! কিন্তু তুই একটা কথা আমাকে বলতো! তোর ভাইয়েরা কি এতটাই গরীব যে বউদের বাপের বাড়ি থেকে ইফতারি সামগ্রী আসবে তারপর আমাদের মুখে ইফতারি উঠবে, তা না হলে উঠবে না! আমাদের অবস্থাটা কি এতই খারাপ? আমি এতদিন দেশের বাইরে ছিলাম যা পেরেছি ইনকাম করেছি। কম তো করিনি ইনকাম! সুজন ব্যবসা বাণিজ্য যেটুকু চালায় ছেলে বউ নিয়ে সংসার খুব ভালোভাবে চলবে আমার জানা মতে। আব্বা কিছু না করুক আমরা দুই ভাইতো করি, সেখান আব্বার হাত খরচ চলে যাবে। তাহলে বউয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে কেনো ইফতারি সামগ্রী আনতে হবে আমাদের!

— ভাইয়া তোমার কানে এসব কথা লাগিয়েছে কে?

— সুজন একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না! আমার দুটো কান আছে, দুটো চোখ আছে, এমন না যে আমি চোখে দেখি না কানে শুনি না। তুই হয়তো অনেক কিছু দেখে না দেখার ভান করিস, বুঝেও না বুঝিস। কিন্তু আমি তোর মত না আমি প্রতিটা কদম ফেলি চোখ কান খোলা রেখে। তাই একটাও উল্টা উল্টা কথা বলবি না। আর কারোর ওপরে দোষ চাপানোর আগে নিজের দোষ গুলো তুলে ধরার চেষ্টা কর। নিজে যেটা করছিস সেটা ঠিক কিনা, তারপর অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলবি।

মরিয়ম বেগমের মুখে কোনো কথা নাই। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। এবার সুমন উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

— মা, তোমার বাবার বাড়ি থেকে ইফতারি সামগ্রী আগে আসবে। রিমার শশুর বাড়ি ইফতারি সামগ্রী যাবে। তারপর লতা আর অথৈ তার বাবার বাড়ি থেকে ইফতারি সামগ্রী আনবে। নিয়ম যদি হয় বউরা তার বাবার বাড়ি থেকে ইফতারি সামগ্রী আনবে, তাহলে তোমাকে দিয়েই শুরু করো। সব নিয়ম যদি সঠিক ভাবে পালন করতে পারো তাহলে করবে। আর তা না হলে সকালে উঠে তোমার দুই ছেলের বউকে বলে দিবে যে তাদের কোনো ইফতারি সামগ্রী আনতে হবে না। আর সুজন তোকে বলছি, এখানে যেসব কথা হলো তার উপর ভিত্তি করে যদি লতাকে কোনো কথা শুনতে হয় বা ওর শরীরে যদি একটা আচঁড়ও লাগে তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেও হবেনা।

কথাগুলো বলেই সুমন রহমান সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

চলবে…