#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৪
ক্লাসে বসে নিজেদের পড়া ঠিকঠাক করছে আশ্বিন আর রোদ্দুর। কিন্তু আশ্বিনের চোখ বারবার যাচ্ছে সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে। মেডিকেলে পড়ার এতগুলো বছরেও তো এই ছেলেকে কোনদিন তাদের ক্লাসে দেখেনি সে। তবে আজ হঠাত তাদের ক্লাসে কি করছে?
‘আশ্বিন! ধ্যান কোথায় তোর? কখন থেকে বলছি এই টপিকটা বুঝিয়ে দে আমায়। শুনছিস না?’
‘খেয়াল করিনি। আচ্ছা রোদ, ওই ছেলেটা কে? মাহিনের পাশে বসে আছে যে।’
রোদ্দুর ফিরে তাকায় ছেলেটার দিকে। বুঝতে আর বাকি নেই, আশ্বিনও ছেলেটিকে দেখে তার মতোই অবাক হয়েছে।
‘ছেলেটার নাম রাফিন। হাসান স্যারের কেমন যেন পরিচিত হয়। শুনেছি কোন এক সমস্যার কারণে মাইগ্রেশন নিয়ে রাজশাহী থেকে এখানে এসেছে।’
‘এই ফাইনাল ইয়ারে মাইগ্রেশন? আমাদের ইন্টানশিপ তো আর কয়মাস পর থেকেই শুরু হবে। শেষ মুহূর্তে এসে মাইগ্রেশন নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল?’
‘হাসান স্যারই ভালো জানেন। তবে ছেলেটা কেমন যেন, খুব গম্ভীর। কথা বলতে গিয়েছিলাম আমি, আমার কোন প্রশ্নের উত্তরই দিলো না।’
ভ্রু কুঁচকে দূর থেকে রাফিনের দিকে ফিরে তাকায় আশ্বিন। কোন ভাবেই হিসেব মেলাতে পারছে না সে। কেমন যেন খটকা লাগে তার। তবুও আর চিন্তা না করে নিজের পড়ায় মনোযোগ দেয়।
লাইব্রেরি থেকে বেরুতেই আশ্বিন অধরাকে হাসান স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে। মুহূর্তেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার। নিশ্চয়ই আবার বকা খেয়ে এসেছে এই মেয়ে। না জানি আজ কোন কান্ড ঘটিয়ে এসেছেন উনি!
এদিকে অধরা স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দূর থেকে আশ্বিনকে দেখে হেসে উঠে দৌঁড়ে এদিকেই আসতে থাকে। তখনই পাশ কেটে একটি ছেলে দৌড়ে যাওয়ার সময় অধরাকে ধাক্কা দেওয়ার সে নিচে পড়ে যায়। দূর থেকে আশ্বিন তা দেখতে পেয়ে দৌড়ে এদিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
‘পাজি ছেলে! কতো বড় সহস আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, আবার সরি না বলেই চলে গেলো!’
অধরা হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ছেলেটির যাওয়ার দিকে রেগে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই একটি হাত অধরার দিকে এগিয়ে আসায়, অধরা কপাল কুঁচকে মুখ তুলে তার দিকে ফিরে একটি অপরিচিত মুখ দেখতে পায়। ছেলেটি তার উঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
‘এভাবেই বসে থাকবে নাকি উঠে দাঁড়াবে?’
অধরা কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়।
‘ধন্যবাদ।’
কোন উত্তর না দিয়ে ছেলেটি শুধু তাকিয়ে থাকে নির্লিপ্ত ভাবে। অস্বস্তি হয় অধরার। জোড় পূর্বক একটা হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই শুনতে পায় তার কণ্ঠস্বর।
‘এই পিচ্চি, কোন ইয়ার?’
ভড়কে যায় অধরা। কণ্ঠস্বরে কি অদ্ভুত কঠোরতা! ঠোঁটের কোণেও কোন হাসি নেই। যেন এই মুহূর্তে কোন কারণে চরম বিরক্ত উনি।
‘ফাস্ট ইয়ার।’
‘নাম কি?’
‘অধরা ওহি।’
ছেলেটি অধরার দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে কিছু বলার উদ্যোগ নিবে তখনই আশ্বিন চলে আসে। এক টানে অধরাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে,
‘ঠিক আছো অধরা? কোথাও লাগেনি তো? সবসময় শুধু লাফালাফি, একটু শান্ত হয়ে থাকতে পারো না?’
অধরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একজন অপরাধীর ন্যায়। আড়চোখে একবার ফিরে তাকায় পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে। এবার আশ্বিনও লক্ষ্য করে তাকে,
‘ধন্যবাদ তোমাকে। আসলে…।’
আর বলার সুযোগ হয়নি আশ্বিনের। ছেলেটা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,
‘তুমিই আশ্বিন, রাইট? কলেজ আসার পর থেকেই তোমার কথা শুনে যাচ্ছি। আমি রাফিন, রাফিন শাহরিয়ার।’
রাফিন তার হাত এগিয়ে দেয় আশ্বিনের দিকে। আশ্বিন মুচকি হেসে হাত মিলিয়ে নেয়।
‘শুনেছি তোমার ব্যাপারে, মাইগ্রেশন নিয়ে এসেছো। যাই হোক, কোন প্রকার সাহায্য প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব সাহায্য করার।’
হেসে উঠে রাফিন, তবে তা ক্ষণিকের জন্য। মাথা নেড়ে একনজর অধরার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে পাশ কেটে চলে যায় সে। আর কেউ না বুঝলেও আশ্বিন লক্ষ্য করে অধরার দিকে রাফিনের এরূপ দৃষ্টি। তবে সে এতে গুরুত্ব দেয়না।
আর অধরা বিস্ফোরণের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাফিনের যাওয়ার দিকে। ছেলেটির নাম শুনেই, মাথা ঘুরে উঠেছে তার। তবে কি এই সেই ছেলে যার কথা…।
‘হাসান স্যার কেনো ডেকেছেন তোমায়? আবার কোন অঘটন করেছো তুমি অধরা?’
চোখ ছোট ছোট করে অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। সবসময় তাকে নিয়ে এমন কেনো ভাবে আশ্বিন?
‘আমি কিছুই করিনি। বরং স্যার আমাকে ডেকে অনেক প্রশংসা করেছেন। আমি নাকি ভালো মেয়ে হয়ে গিয়েছি। যদিও আমি সব সময়ই ভাল ছিলাম।’
হেসে উঠে আশ্বিন। আলতো করে অধরার গাল টেনে ধরে, তার হাতের কনুইয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায় সে।
‘চলো ঔষধ লাগিয়ে দেই। তারপর শুনবো স্যার এবার কি শান্তি দিয়েছেন তোমাকে।’
‘আবার বলে এই কথা? আরে কিছু করিনি তো আমি। আশ্বিন ভাইয়া আপনিই বলেন, আমার মতো শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র মেয়ে আগে কখনো দেখেছেন আপনি?’
আশ্বিন কোন কথা না বাড়িয়ে অধরার হাত ধরে হেঁটে যেতে থাকে। এদিকে অধরা আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে একা একাই কথা বলে যাচ্ছে। যেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত সে।
আর এই সব কিছু দূর থেকে রাফিন এক ধ্যানে তাকিয়ে তাদের খুনসুটি দেখতে থাকে।
—————–
বর্তমানে,
রাশেদা খালার ডাকে হুশ ফিরে আসে অধরার। আশ্বিনের জন্য পাতলা করে সবজি খিচুড়ি রান্না করেছে সে। প্লেটে খাবার তুলে ধীর পায়ে হেঁটে সে চলে আসে রুমে। পুরনো স্মৃতিগুলো মাথা চারা দিয়ে উঠছে তার। রাফিনের কথা মনে হতেই তার সেই অতীত মনে পড়ে। কি এমন হতো যদি সেদিন রাফিনের জন্য আশ্বিন তাকে ভুল না বুঝতো। সে কি এতোই অবিশ্বাসের পাত্রী ছিলো?
‘আশ্বিন, উঠুন। ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেয়ে নিন। আপনার ঔষধের সময় হয়ে যাচ্ছে।’
আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে আশ্বিন। রাতের আকস্মিক জ্বরে তীব্র মাথা ব্যাথা হয়ে আছে তার, শরীরটাও অনেক দূর্বল। তাই উঠে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না সে। অধরা আশ্বিনের অবস্থা দেখে তাকে ধরে ওয়াশরুমে এগিয়ে নিয়ে যায়।
‘আজ আর আপনার ডিউটিতে যেতে হবে না। মানুষের কি চিকিৎসা করবেন আপনি? ডাক্তার সাহেব তো নিজেই অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন।’
‘আমিও তাই ভাবছিলাম। তবে একদিক দিয়ে কিন্ত ভালোই হয়েছে। আজ তুমি আমার ডাক্তার, দেখি আমার বউ কিভাবে আমার সেবা যত্ন করে।’
ধক করে উঠলো অধরার বুক। বউ! শব্দটা যেন তাকে শিহরিত করতে চাইছে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। আশ্বিন এর মাঝেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে খাটে এসে হেলান দিয়ে বসেছে।
‘আপনার নাস্তা। জলদি খেয়ে নিন, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
‘খাইয়ে দাও।’
চলে আসতে নিতেই তার কথায় থমকে যায় অধরা। এসব কি বলছে আশ্বিন? হঠাত করে কি হয়ে গেল এই ছেলের? তাকে কি সে লজ্জায় ফেলতে চাইছে? অধরা কিভাবে পারবে তাকে খাইয়ে দিতে?
‘আমি চামচ এনে দেই?’
হেলান দিয়ে বসে এক দৃষ্টিতে অধরার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না বোঝায় আশ্বিন। অধরা পরে যায় দ্বিধা দন্ডে। এখন কি করবে সে?
আশ্বিন বেশ উপভোগ করছে অধরাকে বিরক্ত করে। অনেক কষ্ট দিয়েছে এই মেয়ে তাকে। পাগলের মতো তার জন্য কেঁদেছিলে একটা সময়, এখন সময় এসেছে সব শোধ তোলার। তবে অধরাকে কোন কিছু বুঝতে দিতে চায় না সে। তাই নির্বিকার ভাবে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে টিভি দেখতে শুরু করে।
অধরা পড়েছে দারুণ বিপাকে। সাত পাঁচ ভেবে হাত ধুয়ে এসে বসে পড়ে আশ্বিনের পাশে। স্বযত্নে খাবার মুখে তুলে দেয় তার।
নীরবে হেসে যায় আশ্বিন। পলকহীন ভাবে একমনে তাকিয়ে থাকে সে অধরার দিকে। অধরা যেন তাকে অদৃশ্য এক মায়ার টানে বাঁধতে চাইছে। অদ্ভুত নেশায় আকৃষ্ট করতে চাইছে তাকে।
‘আপনি টিভি ছেড়ে রেখে আমাকে দেখছেন কেনো?’
নতজানু হয়ে অধরা অনেক কষ্টে কথাগুলো বললো। আশ্বিনের এই দৃষ্টি তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। একরাশ লাজ এসে ভর করছে মনে। চোখ মুখে খেলে যাচ্ছে রক্তিম আভা।
আশ্বিনের কোন উত্তর না পেয়ে সে ফিরে তাকায় তার দিকে। আশ্বিন যেন ধ্যান ছাড়া হয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় অধরা। এ কেমন পরিস্থিতিতে পড়লো সে? চোখ মুখ নতজানু করে আছে।
জানালা থেকে আসা বাতাসে সামনের ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অধরার। আশ্বিন চলে যায় ঘোরের মাঝে। টিভিতে বেজে ওঠে গান,
“আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই।
আমায় কতটা ভালোবাসো সেই কথাটা জানতে চাই।
ভালোবাসার যতো কথা হৃদয় দিয়ে শুনতে চাই।
তুমি শুধু আমার হবে, পৃথিবীকে বলতে চাই।
আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই।
আমায় কতটা ভালোবাসো সেই কথাটা জানতে চাই।”
লজ্জায় মাথা কা/টা যাচ্ছে অধরার। আর এখানে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে নিতেই হঠাত পা পিছলে গিয়ে পড়ে আশ্বিনের বুকের উপর। তাকে ধরতে গিয়ে অজান্তেই কোমরে হাত রাখে আশ্বিন। থমকে যায় অধরা। আশ্বিনের এতোটা কাছে কখনোই আশা হয়নি তার। তাই আচমকা এক চিৎকার করে ওঠে বসে দৌড়ে পালিয়ে যায় রুম থেকে। হেসে উঠে আশ্বিন।
‘আমার থেকে পালিয়ে যাবে কোথায় অধরা?’
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৫
দুপুরের খাবারের পর থেকে ঘুমিয়ে আছে আশ্বিন। হুট করেই জ্বর বেড়ে আসায় কিছুক্ষণ আগেই ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
এদিকে, আশ্বিনের পাশে পড়ার টেবিলে বসে অধরা বই খাতা নিয়ে পড়ছে। না চাইতেও অজান্তেই তার চোখ চলে যাচ্ছে ঘুমন্ত আশ্বিনের মুখ পানে। কি স্নিগ্ধ লাগছে মহাশয়কে! বাতাসে সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর পড়ে আছে। কাপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে, হয়তো ঔষধের প্রভাবে জ্বর কমে আসছে তাই।
‘মামি, টিভি দেখবে? শাহরুখ খানের সিনেমা হচ্ছে, চলো দেখি।’
টুসির কথায় অধরা আশ্বিনের থেকে মুখ ফিরিয়ে টুসির দিকে ফিরে তাকায়। ছোট ছোট দুটো বেণী করা চুল, হাসি মাখা মায়াবী মুখশ্রী!
‘টুসি বাবু, আমার পড়াটা শেষ করে নেই, তারপর দেখবো। ঠিক আছে?’
‘আচ্ছা।’
দৌড়ে চলে যায় টুসি। খালার সাথে বসে প্রতিদিন বিকেলে সিনেমা দেখা তাদের অভ্যাস। ইদানিং অধরাকেও তাদের দলে যোগ দিতে চাইছে দুজন। ব্যাপারটা ভালো লাগে তার। মুচকি হেসে পড়ায় মনোযোগ দেয় সে।
টিভির ঘর থেকে ভেসে আসছে সিনেমার কতো সব ডায়লগ। অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। দুদিন ধরে মহাশয় হঠাত যেন প্রেমিক পুরুষ হয়ে গিয়েছেন। পুরনো আশ্বিনের সাথে উনার কোন মিল খুঁজে পাচ্ছে না অধরা। কেননা, সে যে আশ্বিন চিনতো সে আশ্বিন অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছিলো। আর এখন হয়েছে ঠোঁট কা/টা স্বভাবের। হুটহাট কি সব কথা বলে অধরাকে লজ্জায় ফেলে দেয় এই মহাশয়।
ঘুমন্ত আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে অজান্তেই হেসে উঠে সে। পরমূহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে মনোযোগ দেয় পড়ায়।
ঘড়ির কাঁটায় চারটা বিশ।
অধরা যোগ দিয়েছে খালা আর টুসির সাথে সিনেমা দেখতে। হঠাত কলিং বেল বেজে উঠায় টুসি দৌড়ে চলে যায় গেইট খুলতে। দরজার অপর প্রান্তে দাড়িয়ে আছে একজন সুন্দরী রমণী, চোখে কালো সানগ্লাস।
‘কাকে চাই?’
‘আশ্বিন বাসায় আছে? আমি আশ্বিনের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘মামা অসুস্থ, এখন ঘুমায়। দেখা করা যাবে না।’
বিরক্ত বোধ করলো মেয়েটি, তার চোখ মুখে ফুটে উঠলো সেই বিরক্তির ছাপ। টুসিকে ঠেলে ঢুকে পরে বাসার ভেতর। হতভম্ব টুসি। মেয়েটির পিছু পিছু যেতে যেতে অধরাকে ডাকতে শুরু করে সে।
‘কি হয়েছে টুসি?’
অধরার কণ্ঠ শুনে মেয়েটি অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকায়। অধরার চোখেও বিস্ময়!
‘মারিয়া আপু?’
‘অধরা!’
‘আপনি এখানে? হঠাত?’
‘প্রশ্নটা কি আমার করা উচিত ছিল না? তুমি এখানে কি করছো?’
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় অধরা। মারিয়া তাহলে এখনো জানে না তার আর আশ্বিনের বিয়ের খবর।
‘মামি এখানে থাকবে না তো কই থাকবে? মামা যেখানে মামিও সেখানে।’
ভ্রু কুঁচকে মারিয়া ফিরে তাকায় টুসির দিকে। কোমরে হাত রেখে রাগি রাগি ভাবে তাকিয়ে আছে পিচ্চি মেয়েটি।
‘হোয়াট? কি বললে তুমি?’
‘টুসির কথার অর্থ হলো, বিয়ের পর সকল স্ত্রী তাদের স্বামীর বাসায় থাকে। আমিও তাদের মতোই একজন।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মারিয়া। কি বললো এটা অধরা? তার মানে..?
‘আশ্বিনের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় অধরা। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো মারিয়া।
‘এতো কিছুর পর তুমি কিভাবে আশ্বিনকে বিয়ে করলে? আবারও ফাঁ/সি/য়ে/ছো আশ্বিনকে?’
হেসে উঠে অধরা। রাশেদা খালা আর টুসি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে ব্যস্ত।
‘ফাঁ/সা/নো কাকে বলে মারিয়া আপু? আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমার থেকে আশ্বিনকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান কি আপনার ছিলো না? আপনি মিথ্যা দিয়ে আশ্বিনকে জয় করতে চেয়েছিলেন। ফল স্বরূপ আজ আমি উনার স্ত্রী, আপনি নয়।’
রেগে যায় মারিয়া। মুহূর্তেই অধরার উপর চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করে সে।
‘কি হয়েছে? এতো শব্দ কিসের?’
ড্রইং রুম থেকে শব্দ শুনে আশ্বিনের ঘুম ভেঙে যায়। জ্বরের জন্য এমনিতেই তার মাথা ব্যাথা, তার উপর এই শব্দ! তাই বাধ্য হয়ে উঠে আসে এ রুমে। কিন্তু এখানে এসে যে মারিয়াকে দেখবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আশ্বিন।
‘মারিয়া, তুমি এখানে?’
মারিয়া দৌড়ে ছুটে আসে আশ্বিনের কাছে। অধরার চাহনি স্থির, স্বাভাবিক।
‘আমি তোমার হাসপাতালে গিয়েছিলাম আশ্বিন। তোমাকে না পেয়ে রোদ্দুরকে পেয়েছি। তার কাছে শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ, তাই ঠিকানা নিয়ে দেখতে চলে এসেছি।’
হতভম্ব আশ্বিন। রোদ্দুর মারিয়াকে তার বাসার ঠিকানা দিয়ে দিলো? আর সেই বা কেনো তাকে খোঁজার জন্য হাসপাতালে গিয়েছে?
‘আমি ঠিক আছি মারিয়া। সামান্য একটু জ্বর। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘দেখি তো কতো জ্বর..।’
কথাটা বলেই আশ্বিনের কপালে হাত দেয় মারিয়া। মুহূর্তেই দু’পা পিছিয়ে যায় আশ্বিন। অধরার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে সে কড়া চাহনিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
‘আশ্বিন, অধরা এখানে কি করছে? তুমি সত্যিই তাকে বিয়ে করেছো? এতকিছুর পরেও তুমি কিভাবে…?’
‘মারিয়া, তুমি জানো আমি একটা মিথ্যার ভিত্তিতে এতোদিন অধরাকে দোষারোপ করেছি। অধরা যে দোষী নয়, এটা বুঝতে আমার অনেকটা দেরি হয়েছে। তাই পুরনো কথাগুলো আমি তুলতে চাইছি না এখন।’
‘কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তোমার বিয়ে পারিবারিক ভাবে, হুট করেই হয়েছে। তুমি এই বিষয়ে আগে কিছুই জানতে না।’
‘আমি সত্যিই জানতাম না বিয়ের কথা। অধরার সাথে যে বিয়ে হচ্ছে আমি এটাও জানতাম না। অধরা আমার মায়ের সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর মেয়ে। দুই মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী হয়েছে এই বিয়ে।’
থমকে যায় মারিয়া। মাথা ঘুরছে তার। একটু হেটে গিয়ে পাশের সোফায় বসে পড়ে সে। অধরা নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। দুজনের কথা বার্তার ধরণ যেন গভীর ভাবে লক্ষ্য করে চলেছে সে।
‘এই নেন খালা, এক গ্লাস পানি খাইয়া নেন। অনেক তো কা/ই/জ্জা করছেন, গলা শুকিয়ে গেছে নিশ্চয়ই।’
আচমকা টুসি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় মারিয়ার দিকে। টুসির কথায় ফিক করে হেসে ওঠে অধরা। মুহূর্তেই রেগে উঠে মারিয়া। এক ধাক্কা দিয়ে গ্লাস ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।
অধরা মুচকি হেসে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকে।
‘গ্লাসটা ভাঙলো কেন? পানিই তো দিয়েছিলাম আমি।’
অধরা উত্তর না দিয়ে টুসির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
—————-
কলেজ ক্যাম্পাসের মাঠে গোল হয়ে বসে আছে অধরা আর তার বন্ধুমহল। গতকাল মারিয়ার কথা তাদের বলার পর সবাই মিলে একদফা ঝেড়ে দিচ্ছে মারিয়াকে।
‘এই মেয়ে কি আর শান্তি দিবে না তোকে? আর কতো ঝামেলা করতে চাইছে সে?’
‘জানি না ইশা। তবে এতোদিন পর যেহেতু সে জানতে পেরেছে আমাদের বিয়ের কথা, একটা কিছু তো সে করবেই।’
‘একদম চিন্তা করবি না তুই। আমরা আছি তোর পাশে। তাছাড়া এবার আমাদের আর কোন পিছুটান নেই, তাই মারিয়ার উপর কোন ভয় নেই।’
অনিকের কথায় অধরা মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়। সবাই যখন চুপ হয়ে যায় তখন সাদমান দৌড়ে এসে তাদের পাশে বসে পড়ে।
‘এই খবর শুনেছিস? আমাদের ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য হাসপাতাল সিলেক্ট করা হয়েছে। আগামী রবিবার থেকে ডিউটি।’
‘কোন হাসপাতাল?’
‘কোনটা আবার? প্রতিবার যেই হাসপাতাল দেওয়া হয়, সেটাই।’
‘বাহ! মারিয়া যেই হাসপাতালে আছে এখন ওই হাসপাতালে আমরাও ডিউটি করবো। ভালোই।’
ইশা আফসোস করে তাচ্ছিল্যের সাথে কথাটা বললো। জারিফ সম্মতি দেয় তার কথায়।
‘মারিয়ার ভয়ে আমরা পিছিয়ে থাকবো নাকি? তাছাড়া পড়ালেখার মাঝে ব্যক্তিগত কোন ব্যাপার নিয়ে আসবি না। তবে যত যাই হোক, মারিয়াকে এতো সহজে ছেড়ে দিচ্ছি না আমি। এর একটা হিসাব করা এখনও বাকি আছে।’
অধরা কথাগুলো বলেই সবার সাথে তার আগামী প্ল্যানের কথা তুলে ধরে। সবাই এতে সম্মতি জানায়। অতঃপর ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে যায় সবাই।
এদিকে,
রোদ্দুরের পিঠা ইতিমধ্যেই দুই ঘা বসিয়ে দিয়েছে আশ্বিন। গতকাল সে যদি মারিয়াকে তার বাসার ঠিকানা না দিতো তবে এতসব ঝামেলা হতো না।
কাল অধরা তার সাথে আর কোনরূপ কথা বলেনি। সেও আর আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায়নি।
‘রোদ তুই আমার বন্ধু নাকি শত্রু?’
‘আরে আশ্বিন থাম এখন। কখন থেকে আমাকে দোষ দিয়ে যাচ্ছিস। বুঝিস না কেনো, আমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে তোর ঠিকানা তাকে দিয়েছি।’
‘পরিস্থিতি তোকে আমার বাসার ঠিকানাই দিতে বাধ্য করলো? তাকে অন্য ভাবে বুঝিয়ে তো বাসায় পাঠিয়ে দিতে পারতি।’
‘চেষ্টা করেছি তো। লাভ হয়নি। মারিয়া কারো কথা কখনো শুনেছে নাকি? পাক্কা দুই ঘন্টা ধরে কানের কাছে এমনভাবে ঘেণঘেণ করেছে যে মনে হচ্ছিল, এখনই একটা ইনজেকশন দিয়ে তাকে বেহুঁশ করে দেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তার আচরণে নুরুল স্যার ভেবেই বসেছিলো মারিয়া আমার গার্লফেন্ড! কি সাংঘাতিক ব্যাপার!’
রোদ্দুরের কথায় হেসে উঠে আশ্বিন। বুঝতে আর বাকি নেই বেচারার উপর কাল অনেক চাপ গিয়েছে।
‘ঠিকই তো ভেবেছে। ভেবে দেখ রোদ, মারিয়া তোর গার্লফেন্ড হলে কিন্তু মন্দ হয় না।’
আঁতকে উঠে রোদ্দুর। এই ভয়াবহ মেয়ে হবে তার গার্লফেন্ড? অসম্ভব।
‘মাথা কি ঠিক আছে তোর আশ্বিন? ওই মেয়ের আশেপাশেও আমি না যাই। তাছাড়া আমার ভালোবাসার মানুষ আছে। আর সে হলো..।’
‘আমার ছোট বোন আরশি। জানি আমি।’
একসাথে হেসে উঠে দুজন।
আশ্বিনের মাথা ধরে আসছে চিন্তায়। এ কি বিপদে পড়লো সে। অধরার সাথে যতোই সে সম্পর্ক ঠিকঠাক করতে চাইছে, ততো বেশি করে ঝামেলা চলে আসছে তাদের মাঝে।
‘আশ্বিন এতো ভাবিস না তো। মারিয়া এখন কিছুই করতে পারবে না। আর করলেও ভয় নেই, আমরা এখন সবটা জানি।’
‘আমার মারিয়াকে নিয়ে যত না ভয় হচ্ছে তার থেকেও বেশি হচ্ছে অধরাকে নিয়ে। এই মেয়ে চুপচাপ বসে থাকার মেয়ে না রোদ। যেহেতু গতকাল মারিয়াকে সে কিছুই বলেনি তার মানে সামনে ভয়াবহ কোন চিন্তা ভাবনা আছে তার। হয়তো এখন বসে তার হিটলার বন্ধুদের মিলে কিসব প্ল্যান করতে ব্যস্ত সে।’
রোদ্দুর হেসে উঠে। অধরার চিন্তাধারা, কর্মকান্ড সব বুঝতে পারে আশ্বিন। এই দুইজনের জুটি অনেক ভালো লাগে তার। অনেকটা টক ঝাল মিষ্টির মতোই। আনমনে হেসে উঠে রোগী দেখার জন্য চলে যায় সে।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)