দ্বিধা চক্র পর্ব-০৩

0
244

#দ্বিধা_চক্র
পর্ব ৩

নিলয় ঠিক করল অবনির চ্যাপটার এখানেই ক্লোজ করবে। এ বয়সে পাড়ার বাউণ্ডুলে ছেলেদের মতো কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। নদীর কাছে ধরা খেলে কি বেইজ্জতি ব্যাপার হতো! নিলয়েরই মতিভ্রম হয়েছিল। ন্যাড়া বেলতলা গিয়ে ধরা খেতে খেতে বেঁচে এসেছে। আর না!
অবনি জীবনের এতোটা গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। এক অবনি গেলে হাজার অবনি আসবে।
আজ ঘুমটাও ভেঙেছে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে। যদিও সে ওসব স্বপ্নটপ্ন বিশ্বাস করে না।
কেমন আজগুবি স্বপ্ন! কলেজের গেইট থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মহিষের দল নিলয়ের দিকে তেড়ে আসছে। তারমধ্যে একটি মহিষের গায়ে নদী বসা আরেকটিতে বসা অবনি। দুজনই চেঁচাচ্ছে, ধর ধর ধর…

এমন বিভৎস স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে ছিল নিলয়। নিজ গালে চড় দিয়ে তওবা কেটেছে এ জীবনে আর কখনো কলেজের পথে যাবে না।
গোসল শেষে অফিসের জন্য তৈরি হতে হতে মত আবার পাল্টে গেল। পেটের ভেতর গুরগুড় করতে লাগলো। অবনিকে আরেকবার অন্তত দেখা উচিত। কেন নিলয়কে মানা করলো এ উত্তরটা তো জানাই হলো না। দরকার হলে প্রশ্ন শেষে নিলয় নিজেই মানা করে দিবে।
কলেজের সামনে না হয় আজ নাই দাঁড়ালো। কলেজ যাওয়ার পথের সোনাদীঘির মোড়ে দাঁড়ালে কেউ সন্দেহ করবে না।
সকাল নয়টা নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়ালে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। বরং আর একটু দেরী করলে অবনির দেখাই পেত না। লোকজনে ভরপুর সেখানের এক ব্যস্ততম হোটেল থেকে বের হচ্ছে অবনি, সাথে বান্ধবী। অবনিকে দেখেই ভ্রু দুটো কুচকে গেল নিলয়ের, মেয়েটা কি বাসা থেকে সকালে নাস্তা করে বের হয় না? এমন পরিবেশে বসে পরোটা ডিমভাজা খেতে হয়! ওহো…সাথে করে আবার প্লাস্টিকের পাত্রে চা নিয়ে বের হয়েছে। এমন প্লাস্টিকের পাত্রে চা খেলে ক্যান্সার হয় এটাও কী জানে না? নাকি পাত্তা দেয় না? নাহ্! মেয়েটার বদঅভ্যাসগুলো পরিবর্তন করাতে হবে।
মনের মধ্যে এমন সংকল্প করে নিজেই চমকে উঠল নিলয়। অবচেতন মন কি ধরেই নিয়েছে নিলয়ের বউ অবনিই হবে?
অবনির দিকে আবার তাকালো। হেসে হেসে হাত নেড়ে বান্ধবীর সাথে গল্পে মশগুল।
অজান্তে নিলয়ের ঠোঁটেও মৃদু হাসি ফুটল। অবনি বউ হয়ে এলে মন্দ হয় না। আস্তে ধীরে সব শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়া যাবে। সবাই তো জন্ম থেকেই সবকিছু শেখে না। নিলয় নাহয় একটু কষ্ট করবে। সমস্যা হচ্ছে অবনি আদৌ কিছু শিখতে চাইবে কিনা। নিলয়কে ফেলে রাগ দেখিয়ে বাপের বাড়ি না চলে যায়। বার বার রাগ ভাঙ্গানো নিলয়ের দ্বারা সম্ভব নয়। এসব ছেলেমানুষী ঢং নিলয় একদম পছন্দ করে না। অবনি কী চায়, নিলয় শ্বশুর বাড়ির গেটের সামনে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে ওর রাগ ভাঙাবে? অসম্ভব!
আকাশকুসুম স্বপ্ন ভাবতে না ভাবতেই খেয়াল করলো অবনি তাকিয়ে আছে নিলয়ের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই চমকে উঠল নিলয়। বামে ডানে তাকালো ব্যস্ত ভঙ্গিতে, আড়চোখে অবনিকে দেখে আবার বামে ডানে তাকালো।
-এই যে ব্লু শার্ট! নিলয় সাহেব।
ধক করে উঠলো নিলয়ের বুক। পালানোর পথ নেই। ধরা পড়ে গেছে ।
বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে রাস্তা পার হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো অবনি।
-আপনি আমাকে ফলো করছেন?
-ফলো? আমি? না না, প্রশ্নই আসে না। তোমাকে কেন ফলো করবো? তুমি কে?
– আপনি কি আমার সাথে কোনো কথা বলতে চান?
– হ্যাঁ, মানে, না না, প্রশ্নই আসে না। তোমার সাথে কি কথা আমার? তুমি তো জরুরি কেউ নও।
– আচ্ছা, ঠিক আছে, আসি। আমি আরো ভেবেছিলাম আমরা দুজনে অল্পস্বল্প কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যেতে পারি।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, মানে, না না, ঠিক আছে, এতো করে বলছো যখন নাহয় কিছুদূর হাঁটলাম।
অবনি নিলয়ের কথায় অবাক হলো না, নিলয়ের দিকে তাকালোও না। কেবল মুচকি হাসলো।
নিলয় দরদর করে ঘামছে। রাজশাহীর গরমে চাইলেও কেউ স্টাইল করে থাকতে পারে না। বরাবরের মতো পরিপাটি হয়েই বের হয়েছিল নিলয় অথচ অবনির সাথে দু কথা বলতেই শার্টটা ঘামে আধভেজা হয়ে গেছে।
অবনি অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে মিটমিট করে হাসছে। ওর কপালেও ঘাম জমেছে। তবুও দেখতে সতেজ লাগছে। ঘর থেকে সদ্য গোসল করে বেরিয়েছে বোধহয়। খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।
-আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন?
-এটা খুব অপমানকর কথা বললে তুমি। আমি তোমার পিছু কেন নিবো?
-আপনি গতকাল আমার জন্যই কলেজ যাননি?
-না না, অন্যকাজে গিয়েছিলাম।
-নতুন পাত্রী দেখা হচ্ছে বুঝি?
নিলয় চুপ হয়ে রইলো। মেয়েটা বেশি কথা বলে। এমন প্রশ্ন কেন করে যার উত্তরে মিথ্যা বলতে হবে।
নিলয় চুপ করে থাকায় অবনি কথা পাল্টালো। প্রথম দিনের হম্বিতম্বি করা নিলয় এখন যেন অনেকটাই দ্বিধার সাগরে ডোবা।
– আপনি কিছু জানতে চাইলে নির্দ্বিধায় বলে ফেলুন।
নিজের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণ জানতে চাওয়া বেশ অস্বস্তিকর। কপালের ঘাম আলতো করে মুছে নিল নিলয়।
অবনি আড়চোখে দেখলো। ছেলেটা দেখতে বেশ সুদর্শন!
-অবনি!
– বলুন?
– আমাকে মানা কেন করলে?
– আপনি বোকা টাইপ মানুষ বলে।
নিলয় চোখ বড় বড় করে অবনির দিকে তাকালো। চরম অপমান! সহ্য করা অসম্ভব। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠলো। অবনিকে ফেলে একাই উল্টোপথে হাঁটা দিলো। কিছুদূর এগিয়ে আবার ফিরে এলো। ফসফস করে বলল, নিজেকে তুমি কী মনে করো?
নির্বিকার চোখে অবনি বলল, বুদ্ধিমতী। কেন, আপনার মনে হয় না আমি অনেক বুদ্ধিমতী?
-বুদ্ধিমতী না ছাই! এমন বুদ্ধিমতী মেয়ে শামসুদ্দিন স্টোরে ডজন ডজন পাওয়া যায়।
-তাহলে শামসুদ্দিন স্টোর থেকে নিলেই পারেন, আমার পেছনে ঘুরছেন কেন?
-ঘুরছি না, শুধু জানতে চেয়েছিলাম কেন মানা করেছ। তুমি তো দেখি সাত আসমানে উড়ছো!
-উড়াটাই স্বাভাবিক, তাই না? আপনার সমস্যা কোথায় বলুন তো? আমি মানা করেছি তা আপনি মেনে নিতে পারছেন না? আমাকে যদি আপনি মানা করে দিতেন তবে কোনো ব্যাপারই ছিল না। মেয়েদের মানা করা তো রীতিমতো অবৈধ কাজ। এতে পুরুষ মানুষের ইগো হার্ট হয়, সত্যি কিনা বলুন?
নিলয় রাগে থরথর করে কাঁপছে। এই মেয়ে আস্তো একটা বেয়াদব! কেমন ঝাগড়াকুট্টি বাপরে বাপ! এই মেয়েকে বউ বানানোর চিন্তা করছিল?এমন মেয়ে পরিবারে গেলে সবকটার গলায় দড়ি পরিয়ে হাল চাষ করাবে। বাসার আঙ্গিনায় রোজ নদী ও অবনির চুলাচুলির দৃশ্য ভেবে কেঁপে উঠলো নিলয়।
না, না, বাস্তবে তো দূর স্বপ্নেও এই মেয়েকে বউ বানানো অসম্ভব।
অবনি জোরে শ্বাস টেনে বলল, কি হলো মুখ বন্ধ করে দিলাম? বড় বড় চোখ করে কি দেখছেন? গিলে খাবেন আমাকে? এতো সহজ নয়। আমাকে গিলে খেলেও হজম করতে পারবেন না। আপনার পেটে ঢুকে একটা একটা নাড়িভুড়ি এমন কুঁচি কুঁচি করে কাটবো যে সেলাই…..
নিলয়ের পেট গুলিয়ে এলো। জান হাতে নিয়ে ওখান থেকে পালালো।
অফিসে ঢুকতে দেরী হয়ে গেল। সব ওই ফাজিল মেয়ের দোষ। কাজে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলেও শরীর সাথ দিল না। ভেতরে ভেতরে হাস ফাঁস করতে লাগলো। ওয়াশরুম গিয়ে মাথায় পানি ঢাললো। এসির নিচে বসেও অনবরত ঘামছে। এতো বাজে দিন জীবনেও আসেনি।
ঘটককে কল দিয়ে বলল, রাজশাহী কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে বুদ্ধিমতী পাত্রীর সন্ধান চাই। যত দ্রুত সম্ভব। দরকার হলে আজই দেখতে যাবে, আজই বিয়ে করবে। নো নড়চড়!
অবনিকে দেখিয়ে দেবে কী হারালো সে। বুঝবে তখন কে বুদ্ধিমান আর কে বোকা!

চলবে।
ঝিনুক চৌধুরী।।