#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৬
পড়ন্ত বিকেল!
দুপুরের দিকে সূর্যের তেজ বেশি থাকলেও সময়ের সাথে সাথে তা কমে এসেছে। তাই বারান্দায় দোলনায় বসে আপনমনে বই পড়ছে অধরা।
আশ্বিন এখনও ফিরে আসেনি। টুসি বুড়িও দুপুরের খাবারের পর ঘুমিয়ে পড়েছে। ফলে কাজ না পেয়ে কিছুক্ষণ ফোনে আরশি আর আশ্বিনের মায়ের সাথে কথা বললো সে। অতঃপর পড়ার বই নিয়ে এসে বসলো তার শখের দোলনায়।
হঠাত নিচে গাড়ির শব্দ পেয়ে অধরা দোলনা থেকে উঠে গ্রিল দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে আশ্বিন চলে এসেছে, সাথে রোদ্দুর। দৌড়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে রুমে চলে আসে সে। ইদানিং আশ্বিনের উপস্থিতি সে বুঝতে পারে। নিজের এমন কাজে নিজেই হতবাক হয় অধরা।
আশ্বিন আর রোদ্দুর এর মাঝেই উপরে চলে এসেছে। দরজার কাছে অধরা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের অপেক্ষায়।
‘আরে অধরা, কেমন আছো? অনেক দিন পর আমার ছোট বোনটাকে দেখলাম।’
‘আমি ভালো আছি রোদ ভাইয়া। আপনার কি খবর? একবার তো খোঁজ খবর নিতেও প্রয়োজন মনে করলেন না।’
‘নতুন নতুন জয়েন করেছি, বুঝতেই তো পারছো কেমন ব্যস্ত থাকা হয়। তবুও আমার ভুল হয়েছে তোমার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।’
মুচকি হেসে অধরা তাদের পিছু পিছু ড্রইং রুমে প্রবেশ করে। আশ্বিন এতোক্ষণ ধরে চুপচাপ তাদের কথা শুনছিল, এর মাঝেই তার চোখাচোখি হয়ে যায় অধরার সাথে।
রাগে একটা ভেংচি কাটে অধরা, আশ্বিন কপাল কুঁচকে ফেলে তা দেখে।
‘রোদ তুই থাক এখানে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
চলে যায় আশ্বিন। অধরা বসে থাকে রোদ্দুরের মুখোমুখি। টুকটাক গল্প করতে ব্যস্ত দুজন। রাশেদা খালাও এর মাঝে রোদ্দুরের খোঁজ খবর নিয়ে তার জন্য চা নাস্তার আয়োজন করতে গিয়েছেন।
‘অধরা, শুনেছি তুমি সেদিন আমার খোঁজ করতে হাসপাতাল গিয়েছিলে? কোন দরকার ছিল কি?’
চুপসে যায় অধরা। সে যে রোদ্দুরকে খোঁজার জন্য হাসপাতাল গিয়েছিল সেই খবর কি তবে আশ্বিন জানে গিয়েছে? সে যে আশ্বিনের অগোচরে ব্যাপারটা খোলাসা করতে চেয়েছিলো।
‘কোন বিশেষ প্রয়োজনে যাইনি, এমনি একটু কথা ছিলো আপনার সাথে।’
‘ওহ! আচ্ছা এখন বলো শুনি।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অধরা। আড়চোখে একনজর ফিরে তাকায় সে রুমের দিকে। আশ্বিন হয়তো শাওয়ার নিচ্ছেন। এই সুযোগে রোদ্দুরকে প্রশ্নগুলো করা মন্দ হবে না।
‘আসলে রোদ ভাইয়া, আমি আপনার কাছে সেদিনের কথা জানতে চেয়েছিলাম। আপনার আর রাফিন ভাইয়ার মাঝে কি হয়েছিলো সেদিন?’
চুপ হয়ে যায় রোদ্দুর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে বলে উঠে।
‘বাদ দাও না সেদিনের কথা অধরা। শুধু শুধু অতীত মনে করতে চাইছো কেনো?’
‘কারণ আমার সত্যিটা জানা দরকার।’
নির্বিকার ভাবে বসে আছে রোদ্দুর। সেদিনের কথা বলতে চাইছে না সে। কিন্তু অধরা নাছরবান্দা, সেভাবেই হোক তাকে সত্য জানতে হবে। যেই কারণে এতোগুলো মানুষ তাকে ভুল বুঝে গেলো সেই কারণ জানতে হবে তার।
‘সেদিন আমার আর রাফিনের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে রাফিন রেগে গিয়ে আমাকে আঘাত করে। তারপর তো সবটা তুমি জানোই।’
‘কি নিয়ে ঝগড়া শুরু হয় আপনাদের?’
‘আমি রাফিনকে…তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম অধরা। কিন্তু রাফিন আমাকে কিছুই বলতে চাইছিলো না, উল্টো আমার উপর রাগ দেখাচ্ছিল। তার এমন আচরণে আমারও রাগ উঠে যায়। কথায় কথায় ঝগড়া শুরু হয়। তারপর..। আমি তো তখন জানতাম না যে রাফিন…।’
থেমে যায় রোদ্দুর। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে সে। তারমানে তার কথার জের ধরেই দুজনের মাঝে ঝামেলা হয়েছিলো। আর মারিয়া এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।
‘আমাকে নিয়ে কি এমন কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন ভাইয়া?’
থেমে যায় রোদ্দুর। চুপচাপ বসে হাতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দেয় সে। অধরাকে সত্য বলা যাবে না। বলা যাবে না যে সে আশ্বিনের জন্যই…।
‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার কথা।’
অধরা বুঝতে পারে রোদ্দুর তাকে সত্যটা বলতে চাইছে না। তবুও সে জোর করে জানতে চাইবে ঠিক তখনই আশ্বিন প্রবেশ করে। একটা কালো টিশার্ট পরে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে সে।
‘কি নিয়ে কথা হচ্ছে?’
রোদ্দুর ফিরে তাকায় অধরার দিকে। অধরা পড়ে যায় বিপাকে। এখন যদি রোদ্দুর বলে দেয় আশ্বিনে?
‘খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম আমার বোনের। আর, এতক্ষণ লাগে তোর? অপারেশন কেইস নিয়ে আলোচনা করবো বলেই তো এসেছি, এখন তুই দেরি করলে কিভাবে কি হবে?’
‘কোথায় দেরি করলাম? একটু তো শুধু শাওয়ার নিয়েছি। যাই হোক, আমি ফাইল নিয়ে আসছি।’
চলে যায় আশ্বিন। অধরাও উঠে দাঁড়ায়। রান্নাঘরে গিয়ে রাশেদা খালাকে কাজে সাহায্য করতে শুরু করে।
——————–
রাতের খাবারের পর রোদ্দুর চলে গিয়েছে। অধরা সবটা জানতে চেয়েও কিছু জানা হলো না তার। কিছু একটা তো গোপন করছে রোদ্দুর। কিন্তু কি? খাটের এক প্রান্তে এসে বসে কথাগুলো ভাবছে অধরা।
‘কি ভাবছো?’
পাশ ফিরে আশ্বিনের দিকে ফিরে দেখে অধরা। সে যে কখন এসে এখানে বসেছে সেই খেয়াল নেই তার।
‘কিছু না।’
‘শুনেছি তোমাদের নাকি রবিবার থেকে হাসপাতালে ফিল্ড ওয়ার্ক?’
মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায় সে। আশ্বিন একনজর অধরার দিকে তাকিয়ে ফাইলগুলো আবারও দেখতে শুরু করে। অধরা চেয়ে আছে নির্বিকার ভাবে।
‘আশ্বিন, এতো কিছুর পরেও আপনি কিভাবে মারিয়া আপুর সাথে যোগাযোগ রেখেছেন?’
থমকে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয় আশ্বিন। অধরার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে শুধু।
‘আমি কখনোই মারিয়াকে পছন্দ করিনি অধরা, তুমি জানো ব্যাপারটা। এখনও চাই না সে আমার সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখুক।’
‘কিন্তু আমি তো অন্য কিছু দেখতে পারছি আশ্বিন। আপনার মনে হচ্ছে না আপনি মারিয়া আপুকে ইদানিং অনেক বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছেন?’
বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে আছে আশ্বিন। মারিয়া যে তাকে মেডিকেল কলেজ থেকেই পছন্দ করে তার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো, এ কথা তো অধরা জানে। এটাও জানে যে আশ্বিনের কখনও মারিয়াকে পছন্দ নয়। তবে এসব কথা কেন বলছে সে?
‘অধরা তুমি কি বলতে চাইছো?’
‘এটাই বলতে চাইছি যে, আমাকে নিয়ে এতসব মিথ্যে বলার পরেও আপনি কিভাবে এখনও মারিয়া আপুর সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন?’
‘আমি চাইনি তার সাথে কোন যোগাযোগ করতে। সে নিজ থেকেই এসেছে। তাছাড়া, মারিয়া নিজেও তো না জেনে তোমার নামে কথাগুলো বলেছিলো। সে তো আর রাফিনের বিষয়টা জানতো না। এখানে তার কোন দোষ নেই, আসল দোষটা আমার ছিল। আর কেউ না হোক, আমি তো জানতাম তুমি কেমন মেয়ে। আমি কিভাবে তোমার নামে মিথ্যেগুলো সেদিন বিশ্বাস করলাম!’
কথাগুলো বলে আশ্বিন চলে যেতে নিতেই অধরার কথায় থেমে যায় সে।
‘আপনার কি সত্যিই মনে হয় মারিয়া আপু ইচ্ছে করে কোন কিছু করেনি?’
ফিরে তাকায় আশ্বিন। কি বলতে চাইছে অধরা?
‘মানে?’
‘যে মেয়ে সবার অগোচরে গোপনে আমার আর রাফিন ভাইয়ার মাঝে সকল বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছে। কোনদিন রাফিন ভাইয়ার সাথে আমি কোথায় গিয়েছি, কোন রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেয়েছি, দুজন কবে সেইম কালার ড্রেস পড়েছি সব খবর উনার কাছে ছিলো। অথচ আপনার মনে হচ্ছে সেই মেয়ে রাফিন ভাইয়ার অসুস্থতার ব্যাপারে কিছুই জানে না?’
চুপ হয়ে থাকে আশ্বিন। মিথ্যা বলছে না অধরা। সত্যিই তো মারিয়া যেখানে সব তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে সেখানে একটা ছোট বিষয়ে সে অবগত নয় সেটা বিশ্বাস করা বোকামি। অধরা উঠে দাঁড়িয়ে একনজর আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে চলে যায়। আশ্বিন নিরবে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে।
—————
আজ রবিবার,
হাসপাতালের সামনে অধরাকে পৌঁছে দিতে এসেছে আশ্বিন। আজ তার প্রথম ডিউটি, তাই দিনটি যেন ভালো ভাবে সম্পন্ন হয় সেই জন্য অধরাকে শুভকামনা জানিয়েছে দু পরিবারের সবাই।
‘বেস্ট অফ লাক অধরা। জানি তুমি সব ঠিকঠাক ভাবে সামলে নিতে পারবে। তবুও কোন প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করো।’
‘ঠিক আছে।’
গাড়ি থেকে নেমে যায় অধরা। ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে সে। মনে মনে খুব করে চাইছে আশ্বিন তাকে একবার ডাকুক। কিন্তু কেনো এমন চাইছে জানা নেই তার।
‘অধরা!’
থমকে যায় সে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে তার, হৃৎস্পন্দন বেড়ে চলেছে ক্রমান্বয়ে। ফিরে তাকায় সে পেছনে। আশ্বিন চলে এসেছে তার খুব কাছাকাছি। আচমকা কি জেনো হলো?
অধরা নিজেকে আবিষ্কার করলো আশ্বিনের বাহুজোরে। শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে আকড়ে রেখেছে তাকে আশ্বিন। অধরা স্তব্ধ, হতভম্ব! এই প্রথম আশ্বিন তাকে জড়িয়ে নিয়েছে বুকে। থমকে গিয়েছে পুরো পৃথিবী।
‘আ..আশ্বিন!’
কম্পিত কণ্ঠে কথাটা বলতেই ছেড়ে দেয় সে। অধরার দুগালে হাত রেখে চোখের দিকে ফিরে তাকায়।
‘সাবধানে থেকো অধরা।’
চলে যায় আশ্বিন। আর যাওয়ার আগে রেখে যায় অধরার কপালে আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে অধরা তার যাওয়ার পথে।
–চলবে।
#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৭
অধরা ধীর পায়ে হেঁটে হাসপাতালের ভেতর প্রবেশ করলো। আশ্বিনের হুটহাট এই কাজ তাকে লাজুক করে তুলেছে। কান দুটো গরম হয়ে আসছে তার। হয়তো আশেপাশের অনেকেই তাকিয়ে তাদের দেখছিলো। জনসমক্ষে এমন কাজ আশ্বিন কিভাবে করলো? আজ কোথায় ছিল সেই পুরনো লাজুক ছেলেটি?
————-
‘অধরা চলে এসেছে।’
জারিফ অনিক আর সাদমান একসাথে দাড়িয়ে ছিলো। অধরাকে দেখেই তারা এগিয়ে চলে আসে।
‘ইশা আসেনি? বাকিরা সবাই কি চলে এসেছে?’
‘হুম। ইশা আসছে, পথেই আছে। চল আগে স্যারের সাথে দেখা করে আসি। স্যার কিছু কথা বলবেন।’
জারিফের কথায় অধরা তাদের সাথে ভেতরে চলে আসে।
হঠাত ওয়ার্ডে চোখ যেতেই মারিয়াকে দেখতে পায় অধরা। মূহুর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার। আসতে না আসতেই তাকেই কেনো দেখতে হবে। মারিয়া তখন রোগীর প্রেসার চেক করছে, দূর থেকে অধরাকে দেখতে পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। অধরাও এতে পাত্তা দেয় না। চলে আসে স্যারের কাছে। ক্লাসের সকলে দাড়িয়ে আছে এখানে, ইশাও চলে এসেছে এর মধ্যে।
‘আমি জানি তোমরা সব দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে পারবে। তবুও যেহেতু এখনো তোমরা অনভিজ্ঞ, তাই কোন প্রয়োজন হলেই একে অপরের সাহায্য নিবে। মনে সাহস রাখবে। আর যথাসম্ভব ভালো কিছু শিখতে চেষ্টা করবে। বেস্ট অফ লাক।’
স্যার চলে যান সবাইকে বিদায় জানিয়ে। ক্লাসের সবাই গ্রুপ হয়ে নিজেদের কাজ বুঝে নিয়ে চলে আসে।
অধরা আর তার বন্ধুমহল একসাথে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসার সময় তাদের পথ আগলে দাঁড়ায় মারিয়া। মুখ ফুলিয়ে আছে সে। অধরা নির্বিকার।
‘তাহলে এখানেও চলে এসেছো আমাকে বিরক্ত করার জন্য?’
কপাল কুঁচকে ফেলে অধরা। এমন ভাবে বলছে যেন তার আর কাজ নেই মারিয়াকে বিরক্ত করা ছাড়া।
‘আপনাকে আমি বিরক্ত করি? একটু বলবেন আপু আমি আপনাকে কবে বিরক্ত করেছি?’
‘মুখে মুখে তর্ক করবে না অধরা। তোমার সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে। নেহাত এটা হাসপাতাল বলে এখন কিছু বলছি না। তবে তোমাকে আমি দেখে নিবো।’
পাশ কাটিয়ে চলে যায় মারিয়া। অধরা বাদে বাকি সবাই তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকে।
‘এই মেয়ে নিজেকে কি মনে করে? আর কতো কাহিনী করতে চাইছে সে?’
জারিফের কথায় অধরা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়।
‘মারিয়া কখনোই দমে থাকার মেয়ে না। তার মাথায় কিছু না কিছু তো কাজ করছেই। দেখি এখন কি করে।’
————-
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্রথম দিনের ডিউটি শেষে এখন সময় বাড়ি ফিরে যাওয়ার। হাসপাতাল থেকে বেরুতেই আশ্বিনকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অধরা। হাতে লাল গোলাপের তোড়া।
‘আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে আসলেন কেনো? আমি তো একাই যেতে পারতাম।’
প্রতিউত্তর দেয় না আশ্বিন। আলতো করে ফুলগুলো এগিয়ে দেয় অধরার দিকে। অধরা কথা না বাড়িয়ে তা হাতে তুলে নেয়। গাড়িতে এসে বসে দুজন। আশ্বিন ড্রাইভ করছে।
‘কেমন ছিল আজকের দিন?’
‘ভালোই ছিলো। আশ্বিন জানেন আপনি? তিন নম্বর ওয়ার্ডে আজ একজন বৃদ্ধ লোককে ভর্তি করানো হয়েছে। আমাদের গ্রুপের দায়িত্ব ছিল এই ওয়ার্ডের উপর। বৃদ্ধ লোকটা পথে এক্সিডেন্ট করায় গুরুতর আহত হয়েছেন, স্থানীয় লোকজন উনাকে নিয়ে এসেছে। অতপর উনার ফোন থেকে নম্বর বের করে উনার পরিবারকে জানানোর পর ঘন্টা খানেক পর তারা চলে আসে।’
কথাগুলো বলে অল্প থামে অধরা। একনজর ফিরে তাকায় আশ্বিন।
‘তারপর? উনার অবস্থা কি বেশি গুরুতর?’
‘হ্যা, কিছুটা। জ্ঞান নেই। আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছে উনার স্ত্রীকে দেখে। অনেকটা ভেঙে পড়েছেন উনি। কান্না করছিলো অনেক। বৃদ্ধ বয়স, তবুও নিজ হাতে উনার স্বামীর সেবা যত্ন করছেন।’
মন খারাপ হয় অধরার। আশ্বিন মুচকি হেসে বলে উঠে,
‘কষ্ট পেয়ো না। মনে সাহস রেখে চেষ্টা করো উনাকে সুস্থ করে তোলার।’
‘হুম।’
আর কথা বাড়ায় না দুজন। ইতিমধ্যে গাড়ি এসে থামে তাদের ফ্ল্যাটের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে অধরা আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায়।
‘আপনি আসবেন না?’
‘না, আমার আজ নাইট ডিউটি আছে। তুমি রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। রাত জেগে অসুস্থ হয়ে যেও না।’
উত্তর দেয় না অধরা। আশ্বিন আর দেরি না করে চলে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। হাতে থাকা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা।
আশ্বিনের জন্মদিন কাল। ভেবেছিলো রাতে ছোট খাটো একটা আয়োজন করে তাকে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? বিষন্ন মনে উপরে চলে আসে সে।
———–
ঘড়িতে রাত আটটা। পড়ার টেবিলে বসে আপনমনে পড়ছে অধরা। হঠাত পেছন থেকে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরায় চমকে উঠে সে। ভড়কে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখে আরশি।
‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম ভাবি?’
‘অনেক বেশি। আমি তো চমকে গিয়েছিলাম।’
হেসে উঠে আরশি। তাদের কথার মাঝে দৌড়ে রুমে এসে উপস্থিত হয় টুসি।
‘মামি, খালামণি আসছে মামার জন্মদিন করার জন্য। কিন্তু মামা তো নাই।’
‘নেই মানে? ভাইয়া কোথায় গিয়েছে?’
অধরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আরশি। তিনজন একসাথে খাটে এসে বসেছে।
‘আজ নাইট ডিউটি উনার। রাতে ফিরবে না বলেছেন।’
‘মানে? আজই হতে হলো নাইট ডিউটি? রোদ কিছু করতে পারলো না?’
আফসোস হচ্ছে আরশির। বেচারি দূর থেকে একাই চলে এসেছে ভাইয়ের জন্য। এখন কিনা ভাই থাকবেই না!
‘আচ্ছা আরশি, তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। তারপর কথা বলছি।’
মাথা নেড়ে হ্যা বুঝিয়ে চলে যায় আরশি। টুসি বসে আছে অধরার পাশে।
‘মামি, আমার মনে হয় আজকে মামা ইচ্ছা করেই আসবে না। যে কিপটা আমার মামা, মনে হয় খরচের ভয়ে লুকিয়ে আছে।’
হেসে উঠে অধরা। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় তার মাথায়।
‘চিন্তা করো না টুসি বুড়ি। মামার জন্মদিন হবে। সারপ্রাইজ নাহয় আমরা হাসপাতালে গিয়েই দিবো।’
‘কিভাবে?’
একটা রহস্যের হাসি দেয় অধরা।
—————-
‘ভাবি তোমার মনে হয় আমাদের প্ল্যান সফল হবে? যদি এতরাতে আমাদের হাসপাতালে ঢুকতেই না দেয়? তখন কি?’
‘আগে যেয়ে তো দেখি কি হয়।’
আর কথা বাড়ায় না কেউ। টুসি আরশি আর অধরা রওনা দিয়েছে আশ্বিনের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পথে একবার অধরা রোদ্দুরের সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নেয়।
এদিকে,
আশ্বিন ওয়ার্ডে একবার ঘুরে এসে তার কেবিনে এসে বসেছে। পাশে বসে আছে রোদ্দুর, মনোযোগ তার ফোনের দিকেই।
‘আমার বোন নিশ্চয়ই এতো রাতে তোর সাথে গল্প করছে না। কাকে লাইন দিচ্ছিস আবার? দেখ আমার আরশিকে কষ্ট দিলে কিন্তু তোর খবর আছে রোদ।’
ভড়কে যায় রোদ্দুর। যার জন্য করলো চুরি, সেই বলে চোর! আশ্বিনের জন্মদিনের জন্য কোথায় সে প্ল্যান করছে, আর মহাশয় উল্টো তাকেই দোষ দিলো।
‘তুই কি ভালো হবি না? আমাকে কি মনে হয় তোর?’
প্রতিউত্তরে একটা রহস্যের হাসি দেয় আশ্বিন। রেগে যায় রোদ্দুর। ধুম করে একটা ঘা বসিয়ে দেয় আশ্বিনের পিঠে।
‘বউ রেখে প্রথম নাইট ডিউটিতে এসেছিস তো, তাই মন মেজাজ ভালো নেই তোর। তাই তোর কথায় আমি কিছু মনে করলাম না।’
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আশ্বিন। মনে হয় বউ নিয়ে কতো সুখ শান্তিতে দিন পার করছে সে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোদ্দুরকে কিছু বলতে নিবে তখনই কেবিনের দরজা নক করে কেউ। রোদ্দুর দরজা খুলে দিতেই আরশি এসে জড়িয়ে ধরে আশ্বিনকে। হতভম্ব হয় সে। আর যাই হোক বোনকে এতো রাতে এখানে আশা করেনি মহাশয়।
‘আরশি? তুই এতো রাতে এখানে? কখন এসেছিস?’
‘ভাইয়া..ভাবি..!’
কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে সে। মাথা ঘুরে উঠে আশ্বিনের। অধরার কিছু হয়নি তো আবার?
‘কি হয়েছে অধরার? ঠিক আছে তো?’
মাথা নেড়ে না বুঝায় সে। চোখ মুখে কান্নার ছাপ।
‘ভাবি নিচে। তাকে নিয়ে এসেছি। জলদি চলো।’
এক মুহূর্ত দেরি করে না আশ্বিন। পাগলের মতো দৌড়ে নিচে যেতে শুরু করে সে। পিছু নেয় রোদ্দুর আর আরশি।
নিচে এসে গাড়ি পার্কিং এর কাছে টুসিকে দেখতে পায় আশ্বিন। ভ্যা ভ্যা করে কান্নায় ব্যস্ত সে।
‘টুসি, অধরা কোথায়? তোমার মামি কোথায়?’
উত্তর নেই টুসির। ভয়ে কান্নায় ব্যস্ত সে। কোনরকম হাত উঠিয়ে ইমার্জেন্সির দিকে ইশারা দিতেই তাকে নিয়ে চলে আসে এখানে।
সাদা বেডের উপর আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে অধরা। একজন নার্স তার কপালে ব্যান্ডেজ করতে ব্যস্ত। আশ্বিন দৌড়ে চলে আসে এখানে।
‘কি হয়েছে তোমার? অধরা!’
‘কপালে একটু কেটে গিয়েছে। তেমন গুরুতর কিছু হয়নি।’
‘দেখি আমি…কিভাবে হয়েছে এসব?’
ধমকে উঠে আশ্বিন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন।
রোদ্দুরের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এই না ঘন্টা খানেক আগে ফোন করে বললো তারা আসছে? এর মাঝে কি এমন হলো?
টুসি ভয় পেয়ে আছে, হেঁচকি তুলে কান্না করছে সে।
‘আরশি, বলবি আমায় কিছু?’
‘ভাইয়া আমরা তিনজন তোমার জন্মদিন পালন করতে গাড়ি দিয়ে আসছিলাম। ভাবি ড্রাইভ করছিলো। হঠাত গাড়ির ব্যালেন্স হারিয়ে এলোপাথাড়ি চলতে শুরু করলো। আর তখন একটা ছোটখাট এক্সিডেন্ট হয়।’
‘কিহ?’
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে অধরার দিকে। অধরা একটা মুচকি হাসি দেয়।
‘শুভ জন্মদিন আশ্বিন।’
রাগ হয় তার। এই সিরিয়াস মূহুর্তেও এই মেয়ে কিনা জন্মদিন নিয়েই আছে? রাগে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে থাকে আশ্বিন। অধরা চুপচাপ। সাথে বাকিরাও চুপ।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)