আমার হিয়ার মাঝে পর্ব-২৬+২৭

0
442

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৬

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রুটি বানানোর চেষ্টায় আছে অধরা। কিন্তু কোনভাবেই সে পারছে না গোল করে রুটি বানাতে। তবে এতে তার কোন আফসোস নেই, রুটি একরকম হলেই হলো। খাওয়া হলেই কথা।

এদিকে
অধরার কর্মকান্ড দেখতে লুকিয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে আশ্বিন। পানি খাওয়ার নাম করে অধরার পাশে দাঁড়িয়ে আড়চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
‘পৃথিবীতে যতো ধরনের আকৃতি আছে, সব আকৃতির রুটি তো বানিয়ে ফেললে। শুধু গোল করে বানানোটা এখন বাকি আছে।’
আশ্বিনের কথায় বিরক্ত হয় অধরা। কিন্তু তা আর প্রকাশ করে না সে।
‘কি চাই আপনার?’
‘তোমাকে কিছু বলতে চাই..।’

রুটি বানানো বন্ধ করে ফিরে তাকায় অধরা। আশ্বিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে।
‘এমন ভাবে কথাটা বলছেন যেন আমাকে কোন রোমান্টিক লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে এসেছেন। সোজাসুজি বলুন কি বলতে এসছেন।’
অধরার কথায় ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলে আশ্বিন। এই মেয়ের স্বভাব হলো সব বিষয়ে খুটা দিয়ে কথা বলা।
‘তোমার আজ সকালে হাসপাতালে ডিউটি ছিলো না?’
‘হ্যা।’
‘তাহলে কখন যাবে তুমি? নয়টা বাজতে আর বিশ মিনিট বাকি।’
ভড়কে যায় অধরা। দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ বড় হয়ে যায় তার। তাই তাড়াহুড়ো করে হাতে থাকা রুটি ভাজতে শুরু করে সে।
‘কি করছো এসব?’
‘দেখতে পারছেন না আপনি? নাস্তা না বানালে কি খেয়ে যাবো আমি? আপনার কথা জানি না, তবে আমি মোটেও না খেয়ে থাকতে পারবো না।’
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশ্বিন। এই মেয়েকে আর কিছুই বলার নেই তার। তাই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় সে।

হাসপাতালের সামনে আশ্বিন অধরাকে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। আজ মহাশয়ের অফ ডে। তাই অধরার কথা মতো উনাকেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই কথা শোনার পর আশ্বিনের মুখের অবস্থা মনে হতেই বারবার হাসি আসছে অধরার।

‘অবশেষে তোর দেখা পেলাম আমরা।’
‘হুম, কিরে ইশা! মনে হচ্ছে মোটা হয়ে গিয়েছিস! ব্যাপার কি? হ্যা?’
অধরার কথায় ঘাবড়ে যায় ইশা। ওজন নিয়ে সে দারুণ সচেতন মেয়ে। তাই অধরার কথা শুনে দৌড়ে গিয়ে একনজর নিজেকে আয়নায় দেখে নেয় সে। অতঃপর জারিফকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।
এদিকে ইশার কাজে হেসে যাচ্ছে বাকি সবাই।
‘কথাবার্তায় তো মনে হচ্ছে আমরা আমাদের আগের অধরাকে ফিরে পেতে যাচ্ছি।’
‘অধরা কখনো পরিবর্তন হয়নি অনিক। শুধু কোন এক বিশেষ কারণে নিশ্চুপ ছিলো এতদিন।’
মৃদু হাসি দেয় অনিক। এতোক্ষণে চলে এসেছে বাকি সবাই। তাই বাকি সবার সাথে ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে চলে আসে সবাই।
——————-

এদিকে,
বাসায় বসে বসে আরশির সাথে ফোনে কথা বলছে আশ্বিন। তার মাথায় আসছে না যে হুট করেই অধরা একাই কেনো চলে এসেছে ঢাকা? কি এমন জরুরি ছিলো যে এভাবে সবাইকে কিছু না জানিয়ে চলে আসার? অধরাকে সে অবশ্য অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু সে কোন উত্তর দেয়নি।
‘ভাই বিশ্বাস করো, ভাবির রাত থেকে মন খারাপ ছিলো। রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তারপর সকালে উঠে দেখি বাসায় নেই। সবাই খুব টেনশনে ছিলাম।’
কোন কথা না বলে মাথা চুলকে নেয় আশ্বিন। এতোক্ষণ ধরে সে ভাবছিলো হয়তো আরশির কাছে সে কিছু জানতে পারবে কিন্তু না, আরশি তো নিজেই কিছু জানে না।
‘আচ্ছা বাদ দে এসব কথা। মাকে বলিস টেনশন না করতে।’
‘হুম। আচ্ছা ভাই শোনো, রাশেদা খালা আর টুসি কদিন পর ঢাকা আসবেন। মা বলেছে তাদের কিছুদিন তার কাছেই থাকতে।’
‘ঠিক আছে।’
‘হুম। এটাই কিন্তু তোমার সুযোগ ভাইয়া..।’
অবাক হয় আশ্বিন। কিসের কথা বলছে আরশি?
‘কিসের সুযোগ?’
চোখ মুখে বিরক্ত ফুটে ওঠে আরশির। এমন একটা হাবা বড় ভাই তার কপালেই কেনো জুটলো? মাঝে মাঝে খুব মায়া হয় তার অধরার জন্য।
‘কিসের সুযোগ মানে? তোমার বাবা ডাক শোনার সুযোগ। বাপ হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি নাই?’
‘বেয়াদব মেয়ে। বড় ভাই আমি তোর। কথা বার্তা বুঝে বল।’
মুখ ভেংচি দেয় আরশি। আসছে বড় ভাই। জানা আছে তার লাজুক ভাইকে তার।
‘তোমার ভালোর জন্যই তো বলেছি। কথাটা মাথায় রেখো। রাখছি।’
ফোন কেটে দেয় সে। রেগে ফোনটা খাটের একপাশে রাখে আশ্বিন। দুইদিনের পিচ্চি কিনা তাকে উপদেশ দিতে এসেছে। কথাটা মনে হতেই রেগে রুম থেকে বেরিয়ে খাবারের আয়োজন করতে চলে আসে সে।

ঝিরঝির বৃষ্টিতে পরিবেশ মুখরিত। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে মৃদু মেঘের ডাক। এই অসময়ে বৃষ্টিতে অধরা পড়েছে বিপাকে।
হাসপাতাল থেকে আজ একা যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু হুট করেই এই বৃষ্টি যেন রাস্তার সব রিকশাকে শূন্য করে দিয়েছে। তাই বৃষ্টি কমে আসলে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা করছে সে।
‘আশ্বিন ভাই আসেনি তোকে নিতে?’
‘না, আজ আমার একা যাওয়ার কথা ছিল।’ ‘কোন সমস্যা নেই, আমি পৌঁছে দিবো তোকে। বাইক সাথে আছে আমার সাথে।’
‘আচ্ছা, বৃষ্টি একটু কমে আসুক তারপর নাহয় যাবো।’
জারিফ মাথা নেড়ে অধরাকে নিয়ে হাসপাতালের ক্যান্টিনে এসে বসে। টিনের চালে বৃষ্টির পানির ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে।

‘জারিফ, তোকে একটা প্রশ্ন করার ছিলো?’
‘বল’
‘হাসান স্যার কি তোকে নিজ থেকে রাফিন ভাইয়ার রিপোর্ট গুলো দেখিয়েছিলো?’
‘না। আসলে কথায় কথায় স্যার রিপোর্ট দেখিয়েছেন আমাদের।’
‘কিন্তু এই রিপোর্ট কখন করেছেন?’
‘যখন রোদ ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো আর পুলিশ রাফিন ভাইকে ধরে নিয়েছিলো তখন স্যারের কথায় আইনি ভাবে এই রিপোর্ট করা হয়েছিলো।…’
কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে অধরা। তার মাথায় অনেক প্রশ্ন এসে জমাট বেঁধে যাচ্ছে।
‘তার মানে আশ্বিন ভাইয়া এই রিপোর্ট দেখেই কেইস তুলে নিয়েছিলো?’
‘সম্ভবত।’
‘তাহলে ভুল ঔষধ দেওয়ার বিষয়টি? এটা কেউ লক্ষ্য করেনি? এমন তো হতে পারে রাফিন ভাইয়াকে কেউ ইচ্ছে করে ঔষধ গুলো দিতো।’
‘এমন কিছু না। এই ঔষধের বিষয়ে স্যার কিছুই বলেননি। তাছাড়া, একবার ভেবে দেখ যদি আশ্বিন ভাইয়া কেইস অফ না করতো তবে হয়তো ভুল ঔষধের দেওয়ার দায়ে আমারা শাস্তি পেতাম।’

চুপ হয়ে যায় অধরা। জারিফ সত্য বলছে। রাফিন ভাইয়া উনার ঔষধের খবর জানেন না, তারা সবাই গোপনে তাকে এইসব ঔষধ খাইয়ে দিতো। মানে যদি কেইস অফ না হতো তবে তাদের পক্ষে কোন প্রমাণ থাকতো না। অনেক বড় বিপদ থেকে আল্লাহ্‌ রক্ষা করেছেন তাদের।
—————–

ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই খিচুড়ি আর মাংসের গন্ধ পায় অধরা। মহাশয় তাহলে বৃষ্টির দিন উপলক্ষে ভালোই আয়োজন করেছেন। চুপিচুপি রান্নাঘরে এসে উকি দেয় সে। আশ্বিন ব্যস্ত রান্নার কাজে।
‘কি রান্না হচ্ছে আজ?’
‘তুমি চলে এসেছো? তোমার না আরো পর ডিউটি শেষ হবে?’
‘আগে আগেই চলে এসেছি..।’
‘এই বৃষ্টির মাঝে একাই? আমাকে কল করতে পারতে।’
‘জারিফ পৌঁছে দিয়েছে।’
‘ওহ আচ্ছা।’
কথাটা বলে চুলা অফ করে আশ্বিন। অধরার দিকে একনজর তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে যায় সে ফ্রেশ হতে।

আশ্বিনের যাওয়ার পথে নিরবে তাকিয়ে থাকে অধরা। আশ্বিনকে অনেকগুলো প্রশ্ন করার আছে। তবুও কোন কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার।
তবে একটি ব্যাপারে সে নিশ্চিত যে আশ্বিন ইচ্ছে করে রাফিনের কেইস বন্ধ করেছে শুধু মাত্র তার জন্য। যেনো সে কোনভাবে এখানে ফেঁসে না যায়। মনে মনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা।

বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে একা বসে পুরনো কথাগুলো আর একবার মনে করছে অধরা। রাফিন সেদিনের ঘটনার পর অনেক পাল্টে গিয়েছিলেন। হুটহাট সেই ঘটনা উনার মস্তিষ্কে আরো বেশি আঘাত করে। যার ফল স্বরূপ সেই বছরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে। সেই থেকে তাদের সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি কারো। হাসান স্যারও হুট করেই রিটায়ার্ড নিয়ে নেন।
লোক মুখে শুনেছিলো রাফিন এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আর তারা স্থায়ি ভাবে সেখানেই থাকছেন।

‘কি ভাবছো একা বসে?’
পাশে ফিরে তাকায় সে। আশ্বিন ভাবলিসভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এসে চাপে তার। অনেক দিন হলো মহাশয়কে বিরক্ত করা হয়না।
‘আপনার কথাই ভাবছিলাম। জানেন তো, একজন আদর্শ বউয়ের কাজ হলো শয়নে স্বপনে সর্বক্ষণে তার স্বামীর কথাই স্মরণ করা।’
তাজ্জব লাগা চোখে ফিরে তাকায় আশ্বিন। অধরার কথাগুলো যেন হজম হচ্ছে না তার।
‘এটতাও স্বামী ভক্ত হওয়ার মানুষ তো তুমি না। কি ব্যাপার?’
‘আপনি কি জানেন আমি কেমন মানুষ?’
‘না। তুমিই বলো তুমি কেমন মানুষ?’
কিছুটা দমে যায় অধরা। তবে তা প্রকাশ করে না সে। চোখ এপাশ ওপাশ করে মুহূর্তেই কিছু ভেবে ফেলে।
‘আমি হলাম..’

–চলবে

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৭

কিছুটা দমে যায় অধরা। তবে তা প্রকাশ করে না সে। চোখ এপাশ ওপাশ করে মুহূর্তেই কিছু ভেবে ফেলে।
‘আমি হলাম..’
আর বলা হয়নি তার। আশ্বিনের ফোন বেজে উঠায় তার ধ্যান চলে যায় সেদিকে। মুখ ভেংচি কাটে অধরা। কিন্তু পর মূহুর্তে আশ্বিনের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে সন্দেহ হয়। তাই লুকিয়ে ফোনের দিকে একটা উঁকি দিতেই চোখ মুখের রঙ পাল্টে যায়।
‘বাহ, ভালোই। তাহলে এখনো কথা হয় আপনাদের!’
ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকায় আশ্বিন। মারিয়ার এই আকস্মিক কল তাকে নিতান্তই অবাক করেছে, তবে অধরার কথায় সে আরো হতভম্ব।

‘কথা হয় মানে কি? তোমার কি মনে হয় আমি মারিয়ার সাথে গল্প করে বেড়াই? হাসপাতালে আমার দম ফেলারও সময় থাকে না।’
কিছুটা দমে যায় অধরা। হাতে থাকা কাপে একটা চুমুক দিয়ে আবারও তেড়ে উঠে।
‘এক মিনিট, এর মানে আপনার সময় নেই বলে আপনি মারিয়ার সাথে কথা বলেন না। সময় থাকলে ঠিকই বলতেন, তাই না?’
হতভম্ব আশ্বিন। কি বোঝাতে গিয়ে কি বুঝলো এই মেয়ে!
‘আমি এমনটা কখন বোঝালাম?’
‘সব কথা বলে বোঝাতে হয়না। আমি সব বুঝতে পেরেছি নিজেই।’
‘খুব ভালো করেছো।’
কঠোরভাবে কথাটা বলেই চলে যায় আশ্বিন। এর মাঝে মারিয়ার আবারো কল আসায় রেগে ফোন অফ করে দেয় সে।
চোখ ছোট ছোট করে আশ্বিনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিস্কুট খেয়ে নেয় অধরা।
————–

সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশের অবস্থা ভালো নেই। মহাশয় কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছেন। অধরা একবার রুমে উকি দিয়ে দেখে আশ্বিন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হচ্ছেন। সকাল থেকে আজ মহাশয় মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন, কোন কথাই বলছেন না। আশ্বিনের এভাবে গম্ভীরতা তার সহ্য হচ্ছে না। আসলে সে নিজেও কথা না বলে থাকতে পারছে না।
তাই রান্নাঘরে এসে আশ্বিনের জন্য কফি বানাতে শুরু করে।

এদিকে,

আশ্বিন ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দায় টাওয়াল রেখে রুমে এসেই দেখে অধরা কফির মগ হাতে নিয়ে হাজির।
‘কি চাই?’
‘আপনাকে ছাড়া আমি আর কি চেয়েছি জীবনে?’
অধরার কথায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আশ্বিন। অধরা ততক্ষনে চলে এসেছে আশ্বিনের পাশে।
‘মনে হলো বিশ্বাস করলেন না আমার কথাটা!’
‘আরে না, অবিশ্বাস করবো কেনো? দাও আমার কফি।’
ঘাপটি মেরে বসে থাকে অধরা। মহাশয় কি সাবলীল ভাবে বসে নিজের ফাইল দেখতে দেখতে কফি খাচ্ছেন।
রাগে দুঃখে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়তে শুরু করে সে।

রাত ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আকাশ যেন আরো বেশি মেঘলা হয়ে উঠছে। বাতাসের বেগ বেশি, যেন বড় ঝড়ের পূর্বাভাস।
বই খাতা গুছিয়ে রেখে অধরা একবার নজর দেয় খাটে আয়েশ করে বসে থাকা আশ্বিনের দিকে। মহাশয় সারাদিন ব্যস্ত থাকবে হাসপাতালে, আর রাতে ব্যস্ত থাকবে ফাইল পত্র নিয়ে। বাহ, কি সুখি মানুষ!
বড় বড় পা ফেলে অধরা রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিতেই কারেন্ট চলে যায়। মূহুর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আধার।
‘বাহ! খুবই ভালো..।’
‘অধরা, অন্ধকারের মাঝে কোথাও যেও না। নাহয় হোঁচট খাবে।’
আশ্বিন কথাটা বলে নিজের ফোনের লাইট অন করে।
বাহিরে ঝড়ের সাথে শুরু হলো বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মৃদু মেঘের ডাক।
আশ্বিনের ফোনের আলোয় অধরা এসে খাটের একপাশে বসে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে শুরু করে।
খানিক বাদে ঘরে মোম নিয়ে এসে তার পাশে বসে আশ্বিন। অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নেয় অধরা।

‘তোমার জন্য একটা গিফট নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি তো দেখছি রেগে আছো, তাহলে এখন গিফটের কি হবে?’
‘কিসের গিফট?’
গম্ভীর হয়ে কথাটা বলতেই চোখের সামনে একটা গাজরা ফুলের মালা দেখতে পায় সে। অবাক হয় অধরা। কলেজে থাকাকালীন আশ্বিন মাঝে মাঝেই তার জন্য গাজরা ফুলের মালা নিয়ে আসতো। কথাটা মনে হতেই মহাশয়ের দিক ফিরে তাকায়।
‘হঠাত?’
‘শুনেছি বউ রেগে থাকলে নাকি উপহার দিতে হয়? তাই নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।’
একটা লাজুক হাসি দিয়ে হাত সামনে বাড়িয়ে দেয় অধরা। আশ্বিন কথা না বাড়িয়ে অধরাকে গাজরা পড়িয়ে দেয়।
‘তুমি জানো, এই গাজরা তোমার হাতে কতটা মানায়?’
‘হুম, আজ সুন্দরী না বলে…।’
থমকে ফিরে দেখে আশ্বিন।
‘কি? সুন্দরী না মানে? এই মেয়ে! তুমি শুধু অধরা না, আমার বাঁকা পাজরের হাঁড়। আমি যেহেতু এতো সুন্দর হ্যান্ডসাম, তাহলে আমার হাড্ডি হয়ে তুমি কি কম সুন্দরী হবে নাকি?’
আহাম্মক হয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে অধরা। এভাবে তো কখনো ভেবে দেখেনি সে। সত্যি বলেছে, মহাশয় অনেক হ্যান্ডসাম! কথাটা মনে হতেই একরাশ লাজুকতা ভর করে তার মনে।

হঠাত আশ্বিন অধরার কপালে পরে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কানের পিঠে গুজে দেয়। অধরা একধ্যানে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মোমবাতির মৃদু আলোয় তার ভালোবাসার মানুষ। অনেক বিরহ কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করে তাকে পেয়েছে সে, যদিও অনাকাঙ্খিত পাওয়া। তবুও তো তারই একান্ত ব্যক্তিগত।
কথাগুলোর মাঝে হঠাত একটি বড় বজ্রপাত হতেই অধরা চমকে উঠে আশ্বিনের টিশার্ট খামচে ধরে। হেসে উঠে আশ্বিন। অধরার ভীত চোখ মুখ আর কাঁপা ঠোঁট তাকে আকৃষ্ট করতে চাইছে। একধ্যানে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। এমনিতেই অধরা এখনও তাকে আর তার বিয়েকে মানতে পারছে না, এর মাঝে একটি ভুল কাজ তার অধরাকে চিরতরে না হারাতে হয়।

‘আশ্বিন…এইভাবে বিদ্যুত পড়ে আমাকে হার্টের রোগী বানাতে চাইছে নাকি?’
‘বিদ্যুতের কথা রাখো। আগে আমার টিশার্ট ছাড়ো। যেভাবে আমাকে বন্দি করে রেখেছো, কখন যেন খাপছাড়া হয়ে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলি। তখন করো না কোন আফসোস।’
আশ্বিনের কথায় চুপসে যায় সে। কিছুটা দূরে সরে গিয়ে মিনমিন কণ্ঠে,
‘আফসোস কেনো করবো? আফসোস করার কি আছে? আপনি তো আমার..।’
আর কিছু বলার সুযোগ হয়নি তার। মুহূর্তেই ওষ্ঠেদ্বয় দখল হয়ে যায় তার। বুজে আসে চোখজোড়া।
————

আজ অধরার ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে বন্ধু মহল মিলে অনেক্ষণ ধরে হৈচৈ করে পুরো কলেজ মাথায় তুলে অবশেষে রওনা হচ্ছে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
‘অনিক আর সাদমান, তোরা সত্যি করে বলবি যে কবে বিয়ে করবি? দেখ জারিফ আর ইশাও বিয়ে করে নিলো?’
‘আমাদের বিয়ে নিয়ে তুই এতো উতলা হচ্ছিস কেনো অধরা?’
‘কারণ, আমি কিছুদিন আগেই একটা নতুন ড্রেস কিনেছি, কিন্তু পড়ার মতো অনুষ্ঠান পাচ্ছি না।’
হেসে উঠে জারিফ আর ইশা। এদিকে তেলে বেগুনে জ্বলে যাচ্ছে অনিক আর সাদমান।
‘দাওয়াত দিবো না তোকে বিয়েতে। আর তাছাড়া আগে সাদমান বিয়ে করুক, তারপর আমি।’
‘জি না মামা, আগে তুই বিয়ে করবি।’
কথায় কথায় দুজনের মাঝে লেগে যায় ঝগড়া। শেষে সাদমান দৌড়ে পালিয়ে যায় আর অনিক যায় তার পিছু। দুজন চলে যেতেই,
‘এই অধরা, ভুলে যাস না আবার আজ কিন্তু আমাদের বাসায় পার্টি আছে। সময়মত চলে আসিস।’
‘ঠিক আছে, টেনশন নট!’
হেসে চলে যায় ইশা আর জারিফ। সবাই চলে যেতে একাই অধরা গেইট দিয়ে যেতে শুরু করে।
আজ মহাশয়ের জরুরি ওটি আছে। তাই একাই ফিরে যাচ্ছে সে।

হঠাত,
‘অধরা!’
কারো ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকায় সে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে দেখে সে থমকে যায়!
‘রাফিন ভাইয়া!’
হতভম্ব সে। আজ এতো বছর পর রাফিনকে সামনে দেখতেই অতীতের কথাগুলো মনে পড়ে যায় তার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাফিনের হিং/স্র রূপ।
সেদিনের পর আর রাফিনের সাথে দেখা হয়নি তার। আর আজ এভাবে হুট করেই?
‘কেমন আছো অধরা? অনেক সময় পর..।’
কথা বলার ভাষা নেই তার। যেন কণ্ঠ আটকে গিয়েছে।
‘আপনি দেশে ফিরে এসেছেন?’
‘গতকাল এসেছি, ভাবলাম পুরনো কলেজটা একবার ঘুরে আসি। তোমার সাথে দেখা করারও খুব ইচ্ছে ছিল, শুনেছি আশ্বিনকে বিয়ে করেছো?’
‘জি।’
‘ভালো, তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে অধরা। যদি তোমার সময় হতো..।’
আর কোন কথা বলছে না অধরা। গতবার অনেক কিছুই হয়েছে রাফিনের জন্য। তাই এবার সব বুঝে উত্তর দিতে হবে তার।

–চলবে