#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১৯
“এই যে ভাইয়া এই আমাদের পারিসা আপু।আপু খুব খুব ভালো ড্রয়িং পারে।”
ফাহিমের কথা অনুসরণ করে সামনে তাকাই।তাকিয়ে নীল শার্ট ইন করে পড়া একটি ছেলে।ছেলেটিকে অবশ্যি চিনলাম না।এই প্রথম বোধহয় দেখলাম।ছেলেটি আমার সামনে অনেকটা অসংযত হয়ে যায়।টগবগ চোখে এদিক ওদিক তাকায়।তারপর ফের আবার দিকে ফিরে।খোঁচা খোঁচা দাঁড়িময় মুখে একগাল হাসি টেনে বলে,
“আসলে ফাহিম আমাকে এখানে জোর করে নিয়ে এসেছে তার পারিসা আপুকে দেখাতে।তার পারিসা আপু নাকি খুব ভালো ভালো ড্রয়িং পারে।আসলে বাচ্চা মানুষ তো একবার জিলাস হলে তার রেশ না কাঁটা পর্যন্ত শান্তি হয়না।তাই অগত্যা আসতে হলো আমাকে ।কনফিউজড না হলে আপনি বোধহয় ফাহিমের আপু,আইমিন পারিসা,রাইট?”
আমি দুই সেকেন্ডসের মতন চুপ থেকে তারপর একটু চাপা হাসলাম।বললাম,
” ইট’স ওকে।জ্বী,আমিই পারিসা।”
“ওহ আচ্ছা। আচ্ছা আপনি ফাহিমের কেমন বোন?আইমিন সম্পর্কে কি হোন?”
ফাহিম পাশ থেকে ফোঁড়ন কেঁটে বলে উঠে,
“আমার বড় খালামণি মেয়ে।মানে আমার কাজিন।”
“আচ্ছা।বায় দ্য ওয়ে,আই’ম হৃদয় হাসান।এন্ড উই আর এ্যাবাউট এফেকশনেটিং রিলেটিভ অফ ফাহিম’স ফাদার।”
“বুঝতে পেরেছি।”
“ইয়াহ।এন্ড থ্যাংকস।”
হাসলাম।ছেলেটি এবার ঘড়ির দিকে তাকালো।তারপর ফাহিমের দিকে।বললো,
“ফাহিম তোমার ত কেক কাঁটার সময় হয়ে গেছে।”
“ওহ!তাহলে ভাইয়া পরে কথা বলো।আপু তুমিও পরে কথা বলো।দেরী হয়ে যাচ্ছে।আগে আমার ব্রার্থডে শেষ করো।”
“বাব্বাহ,নিজের জন্মদিনের প্রতি নিজেরই এত জেলাস! কেক কেউ খেয়ে ফেলবে না।ওই টেনশন করিস না, ফাহু।”
বলে হাসলুম।আমার কথায় ফাহিম দু’গাল ফুলিয়ে ফেললো।আর ছেলেটি নিচের দিকে তাঁকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ফাহিমের অভিমানী রাগ ভাঙ্গাতে ওর গালের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার বলি,
“আরেহ ফাহু ,মন খারাপ করে না!আপুদের কথায় মন খারাপ করতে নেই।মন খারাপ করলে আমাদের কে কেক কেঁটে খাওয়াবে।যাও।তাড়াতাড়ি যাও।আপু আসতেছি।”
ফাহিমের গম্ভীর মুখখানা মুহূর্তে ঝলকে উঠলো।চিকচিক দাঁতে বলে উঠলো,
“থ্যাংকুউউ আপু।”
ফাহিম এবং ছেলেটি হলরুমে চলে যাওয়ার পর আমিও কিছুক্ষণ বাদে সেদিকে যাই।গিয়ে দেখি জন্মদিনের হোল এলিমেন্টস রেডি।এখন শুধু মোমাবতিগুলো জালিয়ে কেক কাঁটা বাকি।
“আরেহ ম্যাম,ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?এখানে আসেন।”
আমি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে একদম পশ্চিমের কর্ণারে ফাহিমের বামপাশে নীল শার্ট পড়া সেই ছেলেটির দিকে তাকাই।কারণ কথাটা সেই ছেলেটিই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে।আমি তার দিকে তাকিয়ে একটা সৌজন্যতা হাসলাম ।ছেলেটিও তাই হাসলো।খালামণি পাশ থেকে বলে উঠেন,
“তাইতো, ওখানে দাঁড়িয়ে কি করিস!এখানে আয় তাড়াতাড়ি। ”
আমি ফাহিমের ডানপাশে এসে দাঁড়ালাম।ছেলেটি ম্যাচে আগুন তুলে সবগুলো মোমবাতি সাথে সাথে জ্বালিয়ে দিলো।আর বাসার লাইট অফ করে দেওয়া হলো।ফাহিমের শুরু হলো।মোমবাতিগুলো নেভানো।আমরা সবাই তাতে তাল মিলিয়ে হাতের তালি বাঁজিয়ে “হ্যাপী ব্রার্থডে টু ইউ!” বলে ফাহিমের সম্বোধন করতে থাকি।ফাহিমের সবগুলো মোমবাতি নেভানো শেষ হলে কেক কাঁটা শুরু হয়।তারপর এক এক করে আমাদের সবাইকে ফাহিম কেক পরিবেশন করে দেয়!অনেক জায়গায় দেখা যায় জন্মদিন পার্টিতে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক থাকে যারা কেক না পরিবেশন করে উল্টো সেই কেক মুখে, গাঁয়ে মেখে দেয়।কিন্তু ফাহিমের ব্রার্থ ডে তে তেমন কাউকে দেখা গেলো না।সবাই ভালো।খালামণিকে সো থ্যাংকস যে খালামণি ভদ্র মানুষগুলো দেখে দেখে ইনভাইট করেছে।নাহলে এই স্বাভাবিক সাঁজটা এতক্ষণে আমার অস্বাভাবিক হয়ে যেত।পা বাড়ালাম বেসিনের দিকে।এঁটো হাতটা ধুঁতে।এমন সময় ফাহিম এসে সামনে দাঁড়ালো আমার।বললো,
“আপু?একটু বসবে?”
ভড়কে গেলাম।সাডেন বসবো মানে?চারপাশে একফোঁড় তাঁকিয়ে বললাম,
“কেন?”
“আহা বসতে বলছি।বসো!”
“আগে কারণ বল কেন বসতে হবে।”
ফাহিম এবার কুটিল হাসলো।আমি ভ্রু যুগল কুঁচকালাম।ফাহিম বললো,
“আপু?তোমাকে এখনো ভালোমতন কেক খাওয়াতে পারি নি।সবার সাথে তখন কীভাবে পরিবেশন করালাম,না করালাম।প্লিজ আপু বসো।আর বসে বড় করে হা করো।আমি আমার প্রিয় আপুটাকে আবার কেক খাওয়াবো।”
ফাহিমের কথায় ইনোসেন্ট হয়ে গেলাম।আসলে বাচ্চাটা আপুটাকে খুব ভালোবাসে।ধরফর করে হাঁটু ভেঙ্গে বড় করে একটা হা করলাম।আর ফাহিম তার হাতের পুরো কেকটা সাথে সাথে আমার সারামুখে ক্রিমের মতন মাখিয়ে দিলো!আমি চিৎকার করে উঠলাম।আমার চিৎকার শুনে চারপাশে থাকা সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো!রাগ উঠে গেলো!জেদী গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
“তুই কি করলি এটা?”
সবাই আবারো হেসে উঠলো।আমাকে এহেন অবস্থায় দেখে সবাই যেনো বড্ড মজা পেলো।আমি আর এক সেকেন্ডও দাঁড়িয়ে থাকলাম না।সুড়সুড় করল রাগ মুখ নিয়ে রুমে চলে এলাম।দরজা বন্ধ করে দিলাম।
২৮.
দশটার পর পুরো বাসাটা এখন খালি।মেহমান সব সেই ন’টার দিকেই এক এক করে বিদেয় হয়েছে।আমার মাও চলে গিয়েছে।যাওয়ার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছেন।সাথে বলেছেন,
“আমি আবার আসবো।রাগ করে থাকিস না আমার উপর।আমিতো আমার ভুল বুঝতে পেরেছি রে মা।”
আমি এ’কথার পিঠে কুটিল হাসলাম।আসলে এ’কথার পিঠে উনাদের কি বলবো সেই ভাষাটুকুও এখন আর আমার নেই।আমি পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুললাম।ফেসবুকে ঢুকলাম।স্ক্রিনে চোখ রাখতে দেখি দুইটা ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এসেছে।আমি “রিকুয়েষ্ট ফ্রেন্ডস” অপশনে ঢুকলাম।ঢুকামাত্রই আমার চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেলো।আজকেই ওই নীল শার্ট পড়া ছেলেটি,যাকে ফাহিম আমাকে দেখাতে নিয়ে এসেছিলো!আমি চোখমুখ খিঁচে উুঁচু গলায় ফাহিমকে ডাকতে থাকলাম,
“ফাহিম?ফাহিম?ফাহিম?”
তিন সেকেন্ডের মাথায় ফাহিম আমার রুমে এসে হাজির!
“আপু এভাবে আওয়াজ করে ডাকতেছো কেন?কিছু হয়েছে?”
আমি স্ক্রিনটা ওর দিকে তাক করে বলি,
“লুক এন্ড স্যা!উনি আমাকে রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে কেন?”
” আ মি জা নি না।”আমতা আমতা গলায়।
“তুই জানিস না,তাইতো?আচ্ছা, ওই ছেলে তোকে কয়টা ক্যান্ডি খাওয়াইছে?”
“ক্যান্ডি খাওয়াবে কেন?”
“উনাকে আমার আইডি বলে দিয়েছিস।এবং উনার কথায় আমার মুখে আজকে কেকও মেখে দিয়েছিস!বাহ,একদিনে এত বশ হয়ে গেছিস!?”
“আপু আমি তোমার আইডিও দিই নি।এবং কেকও উনার কথায় মাখি নি।”
বুঝতেছি!এই পোলা সত্যি কথা কইবো না।একে অন্যভাবে চাপাতে হবে। কীভাবে চাপানো যায়?কীভাবে…..?ইয়েস পেয়েছি।ফাহিমের দিকে সরু চোখে তাকালাম,
“ফাহিম? ”
ফাহিম আমার দিকে চোখ রাখে।
“এবারের পরিক্ষায় তুই গণিত বিষয়ে কত জানি পেয়েছিস?”
ফাহিম এবার নড়ে উঠলো।চোখমুখে ভয় স্পষ্ট হয়ে গেল!হুম আমি এই ওর ভয়টুকুর জন্যেই অপেক্ষা করলাম এতক্ষণ।দেখবো… বাছাধন এবার মিথ্যে বলে কীভাবে পার পায়!বললো,
“৪৩ যে পেয়েছি এখন তা বাবাকে বলে দিবা?”
“তুই কি চাস আঙ্কেলকে ডেকে বলে দিই?আঙ্কেল?আঙ্কেল?’
” আপু প্লিজ, নাহ নাহ বাবাকে বলো না।”
“তাহলে বল?”
“বলছি…।হ্যাঁ,উনি আমাকে চিপস,ক্যান্ডি,ফ্রুটস খাইয়ে তোমার আইডির নাম জেনে নিয়েছে।আর কেকের মাখিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও উনার কথায় করেছি।সরি আপু!”
বলে ফাহিম আবার মাথা নত করে ফেলে।থাক একে আর কি বলবো?এ ত বাচ্চা।একে যেভাবে জিলাস দেখিয়ে পেরেছে কাজ আদায় করে নিয়েছে।কিন্তু এতসব করে ওর কী লাভ?ওই ছেলে কি আমার জীবন সম্পর্কে জানে?জানে না!কিছুই জানে না!একটু সাময়িক মুগ্ধ হয়েছে বৈ কি!আমার সম্পর্কে শুনার পর এই মুগ্ধতাটুকুও থাকবে না।মনে মনে বলে মুখে একটা তাচ্ছিল্যকর হাসি ফুটে উঠলো।হাসি থামিয়ে ফাহিমকে বললাম,
“ফাহিম যা রুমে যা।”
“আচ্ছা, আপু।আর শুনো?বাবাকে বলো না প্লিজ?’
” বলবো না।আর হ্যাঁ,আমার ব্যাপারে আর ওই ছেলেকে কিছু বলিস না।”
“আচ্ছা,ঠিক আছে।”
ফাহিম চলে গেলো।মোবাইলটা ওয়ালেট অফ করে বালিশের পাশে রেখে দিয়ে কম্বল টেনে লাইট বন্ধ করে বালিশে মাথা রাখলাম।দুই চোখ বুজলাম।কিছুক্ষণ এভাবে বুজে রাখতেই হুট করে দুইফোঁটা অশ্রু বালিশের উপর গড়িয়ে পড়লো।চোখ মেললাম।চারপাশে অন্ধকার। ফোনের ওয়ালেটটা অন করে স্ক্রিন আনলাম।অন্ধকারে আলো ঝলঝল করে উঠলো।গটর গটর করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলাম।দুইদিন আগের পাঠানো অভির এবং তার নববধূকে আরেকটিবার দেখলাম।এই আঁধারে কষ্টগুলো যেন এখন আরো চেপে ধরলো ভেতরটায়। বুকটা আরো ভার হয়ে গেলো।চোখের পানি আরো জমা হতে থাকলো চোখের কোণে।চাই!খুব করে চাই সব ভুলে যেতে।আবার আগের মতন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে।হাসিখুশিতে রাখতে।প্রাণোচ্ছলে রাখতে।দিনশেষে রাতটা যখন আসে।কিন্তু তখন আর পারি না!কেন পারি না!কেন?কেন?কেন প্রতিরাতে দুই নয়ন কান্না করে!এই কান্না কি কোনোদিনই শেষ হবে না?
চলবে…