আরশি পর্ব-২৫

0
1821

#আরশি
#Part_25
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

দরজার সামনে আসতেই ক্যাঁচ করে দরজা খুলে কেউ বেড়িয়ে আসে৷ আমি তা দেখে ভয়ে হাতে থাকা স্টিকটা দিকে সামনের মানুষটির দিকে আঘাত করি। সাথে সাথে ভেসে এক চিৎকার,

— আরেহ ভাই! করছো টা কি?

আমি সাদের গলা শুনে চোখ খুলে তাকাই। আঘাত করার সময় আমি চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। লাইট বার বার অন অফ হচ্ছে। সেই লাইটের আলোয় আমি সামনে তাকিয়ে দেখি সাদ বা হাত দিয়ে স্টিকটা ধরে আছে আর আমার বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি সাদকে দেখে বুক ভরা নিঃশ্বাস নেই। হাতের স্টিকটা নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে ইতস্তত সুরে বলি,

— তুমি এইখানে করছো?

সাদ সরু চোখে তাকিয়ে বলে,

— এই একই প্রশ্ন আমার তোমাকেও করতে ইচ্ছে করছে। তুমি এইখানে কি করছো?

— কাজ করছিলাম। কাজের চাপ বেশি থাকায় আজ লেট হয়ে যায়। এখন চলেই যাচ্ছিলাম, কিছু আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে যাই। তোমার কেবিন থেকেই আওয়াজ আসছিল। তুমি তো সেই দুপুরে বেড়িয়েছিলে এরপর তো আসো নি। তাই ভাবলাম কে না কে।

সাদ আমার কথা শুনে হেসে বলে,

— তো তুমি ভেবেছ চোর ঢুকে পড়েছে আমার কেবিনে তাই তো? তা ওই চোর তাড়ানোর দায়িত্ব বুঝি তুমি নিয়েছিলে? নাইট শিফট করছ নাকি?

সাদের কথা শুনে আমি ফুঁসে উঠে বলি,

— মজা হচ্ছে?

— কি যে বলো না। মশকরা করিলে বুঝি আমার গর্দান যাইবে না? ইহা জানিবার পরও আমি কিভাবে এই দুঃসাহস দেখাই?

— ইউ আর টু মাচ।

— থ্যাংকস ফোর দ্যা কমপ্লিমেন্ট।

আমি কিছু না বলে আড় চোখে তাকাই। পাশে গিয়ে ফ্লোর ক্লিনিং স্টিকটা দেয়ালের সাথে কাত করিয়ে রেখে দেই। সাদের দিকে আসতেই বলি,

— তুমি কি অফিসেই ছিলে নাকি? কিন্তু তোমার দেখা তো সেই দুপুর থেকেই নেই।

সাদ নিজের কাঁধের ব্যাগ ঠিক কর‍তে করতে বলে,

— আরেহ জানোই তো অফিসের উপরের ফ্লোরে কিছু ঝামেলা হয়েছে। কিছু হিসাবে আর ফাইলে গড়মিল ছিল বিধায় এই ঝামেলাটা ক্রিয়েট হয়েছিল। তো এমডি স্যার এইটা সমাধানের জন্য মিটিং ডেকেছিল। সব সেকশনের মেনেজারদের নিয়ে। দুপুর থেকে সেখানেই ছিলাম। আমাদের মধ্যকার প্রবলেম সলভ হলেও কলিগদের মধ্যে একটা ঝামেলা রয়েই যাই। যা এখনো চলছে।
আমাদের মিটিং কিছুক্ষণ আগেই শেষ হলো। তো নিচে এসেছিলাম নিজের ব্যাগ নিতে। ব্যাগ নিয়ে যেই না বের হতে যাব তখনই এক বুনো বিড়াল ঝাঁপিয়ে পড়লো।

শেষের কথাটা বলেই সাদ ঠোঁট টিপে হাসে। আমি শুধু আড়চোখে তাকাই। এই ছেলে জীবনেও শুধরাবে না। সারাজীবন আমাকে পিঞ্চ করেই যাবে৷ আমি কিছু না বলে সামনের হাঁটা দেই। সাদ তা দেখে দৌড়ে আমার পাশে এসে হাটতে শুরু করি। অতঃপর সন্দিহান সুরে বলে,

— মাননীয় দর্পণ বুঝি আমার প্রতি রুষ্ট হয়িয়াছে? যদি তাহি হইয়া থাকে তাহলে এই অধম খুবই লজ্জিত তাহার কাজে। কিন্তু কৃপা করিয়া শাস্তিস্বরূপ এই অধমের গর্দান চাহিবেন না। ইহা আমার বিনীত অনুরোধ।

সাদের কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দেই। সাদ আমার হাসির শব্দ শুনে বলে,

— হেসেছে তো ফেসেছে।

আমি কিছু না বলে মুচকি হাসি। লিফটের সামনে এসে আমি বলি,

— বাসায় এসো একবার। অহনা বেশ কয়েকদিন ধরে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।

— তাহলে আজকেই চলি। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।

বলে একগাল হাসলো। আমি মাথা নেড়ে বলি,

— আচ্ছা চলো।

— তা একসাথেই যাই?

আমি কিছু একটা ভেবে বলি,

— আচ্ছা চল।

_________________________

বাইক চলছে আপন গতিতে। আমি পিছনের দিকে চেপে বসে আছি। শক্ত করে সিটটা ধরে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর আমি আনমনে সাদকে জিজ্ঞেস করে বসি,

— তুমি বাইক কবে থেকে চালাও?

— ৪ বছর হবে আরকি। জয়নিং এর ১ বছর পর কিনেছিলাম আরকি।

— অহহ আচ্ছা।

— আমি ইচ্ছা ছিল একবারে গাড়ি কিনবো কিন্তু কেনা হলো না। অবশ্য এখন ইচ্ছাও নেই আর।

— কেন কিনতেই তো পারো। স্যালারি তো ভালোই পাও।

— টাকার বিষয় না আসলে। বাইকটার সাথে অনেক ছোট খাটো স্মৃতি মিশ্রিত আছে। একজনের শেষ স্মৃতিও এইটা। তিন্নির স্মৃতি। মেয়েটার বাইকে চড়ার অনেক শখ ছিল। আমার সাথে রাতের আঁধারে বাতাসের গতিতে ছুটে চলার তীব্র বাসনা ছিল তার। তার ইচ্ছা পূরণ করার জন্যই বাইকটা কেনা।

তিন্নির কথা শুনে আমি চট করে প্রশ্ন করে বসি,

— তিন্নি কোথায় সাদ? এতদিনের পরিচয়ে আমি কখনো ওকে সামনাসামনি দেখি নি। আর না তুমি কখনো ওর বিষয়ে তেমন কথা বলেছ, আর না আমি বলেছি। তাই ওর সম্পর্কে জানাই হয় নি। কোথায় ও?

সাদ স্মিত হেসে বলে,

— সে তো এখন দূর আকাশের শুকতারা। সাথেই আমার ছোট পরীটাও।

আমি বিষ্ময়কর কন্ঠে জিজ্ঞেস করি উঠি,

— মানে?

— ২ বছর আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে তিন্নি মারা যায়। সাথেই মারা যায় আমার সাত মাসের অনাগত সন্তানও।

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমার বুক মোচড় দিয়ে উঠে। মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি সাদের পিছনের দিকে। সাদের মুখমন্ডল আমার দৃষ্টির অগোচর হলেও বুঝতে পারছি যে, তার চেহেরায় ভেসে উঠেছে এক রাশ বিষন্নতা। মনের মধ্যে সাদ আর তিন্নির কাহিনী জানার তীব্র ইচ্ছা জাগ্রত হলেও তা প্রকাশ করার সাহস হলো না। কিছুক্ষণ পর সাদ নিজ থেকেই বিষাদ ভরা কন্ঠে বলতে শুরু করে,

— আমার বাবা নেই জানোই তো। ছোট থেকে মা এই আমার সব। তো মা একদিন এসে বললেন তার একটা মেয়েকে খুব পছন্দ। নাম তিন্নি। সে চায় আমি যাতে তিন্নিকে বিয়ে করি। তখন সবে মাত্র আমি জবে ঢুকেছি। আমার কোন পছন্দ না থাকায় মায়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাই। তার কিছুদিন পরেই খুব সাদামাটা ভাবে আমাদের বিয়ে হয়। বলা বাহুল্য, তিন্নি এতিম ছিল। তার আপন বলতে কেউ ছিল না। সেই সাথে আমারও তেমন কোন আত্নীয়স্বজন ছিল না। বলতে গেলে থেকেও নেই। তাই বিয়েটা আমরা জাঁকজমকপূর্ণ করার তেমন ইচ্ছেও জাগে নি। বিয়ের পর তিন্নি সবাইকে একদম আপন করে নেয়। তিন্নি মেয়েটাই এমন ছিল যে মুহূর্তেই সকলকের সাথে একদম মিশে যেত। সাথে খুব সহজ মনের মেয়ে ছিল। ভিতরে যা বাইরেও তা। কিন্তু অভিমানিনী ছিল খুব। মুখ ফুটে কিছু না বললেও ভিতরে ঠিকই অভিমানের পাহাড় জমিয়ে ফেলতো। আর এই অভিমানিনীর ভালবাসায় মগ্ন ছিলাম আমি। সময়ের সাথে ওকে এতটা ভালবেসে ফেলেছিলাম যে ওকে ছাড়া নিজেকে কল্পনাও করা দুষ্কর ছিল আমার জন্য। আমাদের বিয়ের ২ বছরের মাথায় যখন জানতে পারি আমি বাবা হতে চলেছি তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি মনে হয়েছিল। খুশির আবেশে আমি প্রায় কেঁদেই দিয়েছিলাম। এরপর পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিলিয়ে ছিলাম।
এই ঘটনার এক মাসের মাথায় আমার প্রোমোশন হয়। কাজের চাপ বাড়ে। তিন্নিকে ঠিক মত সময় দিতে পারতাম না। তাও যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম যতটা সময় অবসর পাই তাকে দেওয়ার। দেখতে দেখতে কেটে যায় সাত মাস। আসে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিন সেইদিন ও ডাক্তারের কাছ থেকে চেকাপ করে আসছিল। আমার কাজের চাপ ছিল বিধায় আমি ওর সাথে যেতে পারি নি। মাও তখন অসুস্থ ছিলেন। তাই সেও যেতে পারে নি। তিন্নি যখন রাস্তা পার হতে যাবে তখন কোথ থেকে যেন দ্রুত গতিতে একটি কার আসে। আর মূহুর্তেই তিন্নিকে ধাক্কা মেরে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তিন্নি অন দ্যা স্পট মারা যায়। রাস্তায় পড়ে থাকে তার লাশ। সেই সাথে আমার অনাগত বাচ্চাটিরও।

এতটুকু বলে সাদ থামে। ওর কন্ঠ স্বর ভেজা ভেজা লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন সে আর কথা বলতে পারছে না। আটকে আসছে তার কথা। আমি চুপটি মেরে বসে রই। নিজের মধ্যেও চাপা এক কষ্ট বিরাজমান করছিল। আমার শুনেই কষ্ট লাগছে না জানি সাদের অনুভূতি ঠিক কেমন। একটু পর সাদ বলে উঠে,

— তিন্নির লাশের পাশে পড়েছিল একটা রিপোর্টে। আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট। রিপোর্টে ছিল যে, আমার অনাগত সন্তানটি ছিল এক পরী। যে নাকি আমার ঘর উজ্জ্বল করতে এসেছিল। যখন রিপোর্টটা দেখি তখন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কি বলে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবো তাও ভুলেও গিয়েছিলাম। শুধু এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিলাম সেই রক্তমাখা রিপোর্টটির দিকে। জানল আমি সর্বদাই মেয়ে চেয়েছিলাম। প্রত্যেক নামাজের মোনাজাতে আল্লাহ এর নিকট এক পরী চেয়েছিলাম। তাই হয়তো আল্লাহ আমায় এক পরী দিয়েও ছিল কিন্তু তাকে আমায় আগলে রাখার তৌফিক দেননি৷ তাকে ধরে ক্ষমতা দেন নি।

বলে সাদ চুপ হয়ে যায়। নিরব হয়ে যাই আমিও। কিছুই যে নেই বলার আমার। নিজের অজান্তেই হয়তো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ছেলেটাকে। পুরনো জখম খুঁড়ে তাজা করে দিয়েছি। অনুতাপের আগুনে জ্বলছি আমি। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না। ক্ষণিকের মাঝেই আমরা আমার বাসার সামনে এসে পড়ি। আমি চুপচাপ নেমে পড়ি। সাদ আমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলে,

— তুমি যাও। আমি অন্য কোন একদিন আসবো নে।

কথাটা বলেই সাদ বাইক স্টার্ট দেয়। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে শা শব্দ করে টান দিয়ে বাইক নিয়ে চলে যায় সে। আর আমি নিষ্পলকভাবে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রই। ক্ষণেকের মাঝে বুক চিরে বেড়িয়ে আসে এক মুঠো দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

#চলবে