আলতা রাঙা পা পর্ব-০৭

0
243

#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৭)

ভারী সাজ পাল্টে হালকা হয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পায়ে সুড়সুড়ি অনুভব হতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে পায়ের দিকে তাকাতে যারপরনাই বিস্মিত হলাম। চিৎকার করে বললাম,
” কী করছেন? ”

অমিত উত্তর দেওয়ার বদলে বলল,
” আরে! পা টেনে নিলে কেন? বিছানায় লাগবে তো। ”
” কী লাগবে? ”
” আলতা। ”

আমি টেনে নেওয়া পা আরও টেনে আনলাম। অমিত ছুটে গিয়ে আলো জ্বালাল। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
” গায়ের চাদরেও লাগবে। শুকাতে দেও। ”

আলো পেয়ে আমি পায়ে তাকালাম। আলতায় রঞ্জিত পাদুটো বড্ড অচেনা ঠেকল। দৃষ্টি বিভ্রম হতে তিনি বললেন,
” একটু নেমে দাঁড়াও। আমি দেখি কোথাও লেগেছে নাকি। ততক্ষণে শুকিয়েও যাবে। ”

আমি কথা শুনলাম না। আপত্তি দেখিয়ে ঠাঁই বসে থাকলাম। পায়ে পা ঘষে বললাম,
” আপনি না কথা দিয়েছিলেন, আমাকে ছুঁবেন না? ”

অমিতের উতলাভাব কেটে গেল মুহূর্তে। একটুখানি চুপ থেকে বললেন,
” ছুঁতে দেখেছ? ”

আমি আঁট হয়ে বললাম,
” ঘুমের মধ্যে ছুঁলে দেখব কী করে? ”
” ঘুমের মধ্যে অনুভব করা যায়। করেছ? ”

আমি দমে গেলাম। ঘুমের মধ্যে সুড়সুড়ির মতো একটা কিছু টের পেয়ে ঘুম ভাঙলেও সেটা পুরুষ ছোঁয়া ছিল না। তাহলে কি অমিত না ছুঁয়েই আলতা পরিয়েছে? আমি কপট রাগে বললাম,
” এসব পাগলামির মানে কী? ”

অমিত সাথে সাথে বলল,
” ভালোবাসা। ”

তার লজ্জাহীন উত্তরে আমি কুণ্ঠিত হলাম। চাহনি নরম হয়ে আসলে তিনি আদুরে গলায় বললেন,
” তোমার পা’দুটোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। ”

আমি অদ্ভুত কিছু শুনছি এমন ভঙ্গিতে তাকালে তিনি আবার বললেন,
” আমি ভালোবাসাকে সাজাতে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। ”

আমার অদ্ভূত দৃষ্টি আরও গাঢ় হলো। নিশ্বাসের গতি থামিয়ে নিশ্চুপ হলাম। অমিত দাঁড়ানো অবস্থায় আমার দিকে ঝুঁকে এলেন। প্রগাঢ় চাহনি রেখে বললেন,
” এই ভালোবাসায় কোনো অনুমতির দরখাস্ত করব না। একমাত্র এই জায়গায় তোমার বাঁধা মানব না। ইচ্ছের গুরুত্ব দেব না। আমার ইচ্ছের অগ্রাধিকার থাকবে সবসময়। ইচ্ছে হলেই আমি আলতা পরাব। আলতা রাঙা-পা’য়ের সৌন্দর্য উপভোগ করব। ”

আমি খানিকটা পেছনে হেলে বললাম,
” যদি বাঁধা দেই? ”

অমিত সোজা হলো। বিছানার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বলল,
” বলেছি তো মানব না। ”
” জোর করবেন? ”
” দরকার পড়লে তাই করব। ”

আমার চোখে-মুখে ভয়ের আভা ফুটে উঠতে তিনি বললেন,
” জোরাজুরি করতে গিয়ে কিন্তু আপনাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারি। সুতরাং সাবধান! ”

তিনি সাবধান বার্তা দিয়ে গোসলখানায় ঢুকে গেলেন। মিনিট দুই পর বেরিয়ে এসে জায়নামাজ আর কোরআন শরীফ রাখলেন আমার সামনে। জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আযান শুনতে পারছ? ”

ঠিক তখনই আমার কানে আযানের সমধুর সুর পৌঁছাল। তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন জানালার ধারে। পাল্লা সরিয়ে দিলেন। ভোরের শুভ্র আলো ও মৃদু বাতাস ভরে গেল পুরো রুমে। সেখানে দাঁড়িয়েই বললেন,
” অবশ্য একটু-আধটু ছোঁয়াতে তোমার সমস্যা হওয়ার কথা না। তুমি তো আর কিশোরী বয়সের প্রেমিকা নও যে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে লজ্জা লুকিয়ে থাকবে। আর আমিও প্রেমিক নই যে একটু হাত ছুঁয়ে দিলেই লজ্জায় কেঁপে উঠবে। পা ছুঁয়ে দিলেই গাল লাল হয়ে যাবে, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলে চোখে চোখ মেলাতে গিয়ে কেঁদে ফেলবে। ”

তার এমন কথায় আমার মুখ হা হয়ে গেল। চোখদুটো ছানাবড় হলে তিনি হেসে ফেললেন। নিজের জায়নামাজ কাঁধে ফেলে হাঁটা ধরেন। দরজার কাছে এগুলে আমি পিছু ডাকলাম। তিনি থামলেন। আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। আমি বিছানা থেকে নেমে তার সামনে দাঁড়ালাম। সন্দেহি গলায় বললাম,
” প্রেম নিয়ে তো আপনার দারুন অভিজ্ঞতা! গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা কত? ”

অমিত বাঁকা হাসলেন। জায়নামাজ এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে নিয়ে বললেন,
” এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রেম করতে হয় না। গোটা কয়েক বন্ধু থাকলেই হয়। ”
” আপনার বন্ধুরা বুঝি এসবও বলে? ”
” সবাই না, কেউ কেউ বলে। ”
” ছি! ”

আমি মুখ ঝামটি মেরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালে তিনি বললেন,
” আমি সেই কেউ কেউ এর দলে নেই। ”
” আমি বিশ্বাস করি না। ”
” একদিন করবে। আর সেই দিনটিও তোমার জীবনে আসবে শীঘ্রই। ”

____________
নামাজ পড়ে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যে ছোট আপুকে স্বপ্ন দেখলাম। দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অপরাধে একপায়ে দাঁড়িয়ে রুটি বেলছে। তার শাশুড়ি হাতে নাড়ুনি নিয়ে নজর রাখছে আপুর পায়ে। পা মাটিতে স্পর্শ করলেই পিঠে পড়বে। আপু রুটি বেলছে আর কাঁদছে। পায়ের ব্যথায় কাঁদছে নাকি শাশুড়ির হাতে মার খেয়ে কাঁদছে বুঝা গেল না।

ছোট আপু একপা উঁচু করে রুটি বেলতে বেলতে ক্লান্ত হয়ে পা মাটিতে ফেলে দিল। তখনই তার শাশুড়ি নাড়ুনি দিয়ে পিঠে সজোরে আঘাত করল। আপু চিৎকার করতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি অমিত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাঁটু ভর করা মেঝেতে। আমি উঠে বসলাম। ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কী করছিলেন? ”
” তোমাকে দেখছিলাম। ”
” আমি কি অনুমতি দিয়েছি? ”
” অনুমতি নেই এমনও বলোনি। ”
” মানে কী? ”

অমিত বসা থেকে দাঁড়াল। বলল,
” কাল রাতে বলেছিলাম, আমি তাকালে যদি রাগ করো তাহলে আলো নিভিয়ে দেও। দিয়েছিলে? ”
” পর্দা টেনে দিয়েছিলাম। ”
” তার মানে দাঁড়াল, আমি তোমাকে দেখতে পারব কিন্তু তুমি দেয়াল টানলেই দেখা বন্ধ। এই যে এভাবে। ”

বলতে বলতে তিনি আমার মাথায় ঘোমটা টেনে দিলেন। আমি ঘোমটাসহ বোকা চোখে তাকালাম। তিনি সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললেন,
” দুঃস্বপ্ন দেখছিলে নাকি? ঘেমে গেছ। ”

আমি তাৎক্ষণিক দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। প্রায় দশটা বাজে। মাথায় যেন ভারী আঘাত পড়ল! আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চেহারায়। অমিত ধরতে পেরে বলল,
” কী হয়েছে, তায়্যিবাহ? ”

আমি উত্তর দিলাম না। রান্নাঘরের দিকে ছুটলাম দ্রুতপদে। বসার রুম পেরিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ালাম। শাশুড়িমা চুলায় কিছু একটা করছেন। আমি ভেতরে ঢুকে বিনয়ের সাথে ডাকলাম,
” আম্মা? ”

তিনি পিছু ফিরলেন। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হলাম। এককদম সামনে এগিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। সাথে সাথে স্বপ্নে দেখা ছোট আপু আর তার শাশুড়ির সেই করুণ দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। আমি ভীত ঢোক গিলে বললাম,
” উঠতে দেরি হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন। ”

তার দিক থেকে কোনো উত্তর আসল না। আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। মনে পড়ল বধূবরণের মুহূর্তগুলো। তিনি আমায় খুশিমনে বরণ করেছিলেন। আদর করে খায়িয়েছিলেন, ভালোবেসে চুমু দিয়েছিলেন। সেই মমতাটুকু আমি আজও আশা করছিলাম। কিন্তু তেমনটা কি হয়? অসম্ভব! শাশুড়িরা মায়েদের মতো সবসময় মমতাময়ী হয় না। সময়ের সাথে সাথে রূপ বদলায়। ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। পুত্রকে নিজ মুঠিতে রাখতে চায়। ব্যবহারে, কার্যকলাপে বার বার প্রমাণ করে দেয় মেয়েটি অন্য ঘরের। এ ঘরে তার কোনো অধিকার নেই, কোনো প্রাপ্তি নেই, কোনো যত্ন নেই।

আমার সঙ্কিত চিন্তা-ভাবনার মধ্যে তিনি ডেকে উঠলেন,
” অমিত? এই অমিত। ”

আমার ভয় এবার কাঁপা-কাঁপি পর্যায়ে চলে এলো। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, অমিতকে ডাকছে কেন? বিচার দেবে? ছেলেকে দিয়ে শাস্তি দেওয়াবে? কী শাস্তি দেবে? মারধোর করবে ছোট দুলাভাইয়ের মতো?

আমি চোখ মেললাম। শাশুড়ির নিকট এগিয়ে এসে অনুরোধের সুরে বললাম,
” আর এমন হবে না। মাফ করে দিন। কী করতে হবে, বলুন। আমি করে দিচ্ছি। ”

তিনি কিছু বললেন না। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন। ততক্ষণে অমিত চলে এলো। মায়ের উদ্দেশ্য বলল,
” ডাকছিলে, মা? ”

শাশুড়িমা আমার কাছ থেকে সরে ছেলের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালেন। আমার ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করতেই বুঝি বললেন,
” তোর বউকে বাপেরবাড়ি রেখে আয়, এখনই। ”

চলবে