আলতা রাঙা পা পর্ব-১০

0
286

#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১০)

অমিত রুমে ঢুকেই আমার রোষানলের শিকার হলো। অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে কাবু হলেও প্রকাশ করল না। ঘাড় নেড়ে নেড়ে রুমের চারদেয়ালে তাকিয়ে বললেন,
” বারান্দা দরকার আমাদের অথচ দখল করে আছে তোমার বাবা-মা। ”

তার রসাত্মক ভাব ও বচনে আমার দৃষ্টির প্রখরতা কমল না। পলক পড়ল না। আমার দিকে এক পলক তাকালেন তিনি, চোরা চাহনি। আমি ধরে ফেলেছি বুঝতে পেরে বললেন,
” কথার খেলাফ হয়নি এখনও, তায়্যিবাহ। ভয় দেখাচ্ছ কেন? ”

আমি আগের মতোই মূর্তি হয়ে বসে থাকলে তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
” কথা যখন দিয়েছি তখন একঘরে শুব না। একটু সময় দেও, ভেবে কিছু একটা উপায় বের করি। ”

অমিত খাটের এক কোণে বসলেন ভয়ে ভয়ে। আমার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে মগ্ন হলেন গভীর চিন্তায়। একটুখানি ভাবার ভঙ্গি করে সহসা বললেন,
” আমার মাথায় তো কিছু আসছে না। তুমি একটা বুদ্ধি দেও না। এ বাসা তোমার। বাসার মানুষগুলোও তোমার। তুমি চাইলেই একটা ব্যবস্থা করতে পার। ”

কথাটা বলেই অসহায় চোখে তাকালেন আমার দিকে। আমার ভাবভঙ্গিতে কোনো বদল না পেয়ে হতাশ হলেন। নিরাশ গলায় বললেন,
” দেখি বাবা-মাকে বুঝিয়ে বাইরে থাকার ব্যবস্থা করা যায় নাকি। ”

অমিত উঠে দাঁড়িয়ে আবার বললেন,
” চিন্তা করো না, তোমাকে কেউ ভুল বুঝবে না। ”

আমাকে আশ্বাস বাণী শুনিয়ে বের হতে চাইলেন তিনি। আমি চোখের পলকে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একহাত শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
” বাইরে থাকার কোনো দরকার নেই। আমরা এখন ফিরে যাচ্ছি। ”

প্রথমবারের মতো আমার স্পর্শ পেয়ে চমকেও সামলে নিলেন পর মুহূর্তেই। বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞেস করলেন,
” ফিরছি মানে? ”

আমি উত্তর না দিয়ে তাকে টেনে-ধরে রুম থেকে বের করলাম। তিনি বেতালে আমার পিছু ধরে হঠাৎ থমকে গেলেন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
” আমি তোমার কথা বুঝতে পারিনি। ”

আমি অনিচ্ছায় থেমে গেলাম। নিজের সর্বশক্তি দিয়েও একচুল নড়াতে পারলাম না তাকে। পাথরের মতো স্থির, নিশ্চল, অটল হয়ে থাকলেন। আমি নিরুপায়ে তার হাত ছেড়ে দিলাম। চোখে চোখ রেখে বললাম,
” আপনার গোপন চাল আমি ধরে ফেলেছি। আমাকে বোকা বানিয়ে যে এ বাড়িতে এনেছেন সেটাও বুঝতে পেরেছি। ”
” এসব কী বলছ? গোপন চাল আবার কী? তোমাকে বোকা বানাতে যাব কেন? ”
” আমাকে হাতের মুঠোয় করার জন্য। নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। ”

অমিত স্তব্ধ হয়ে নীরব চেয়ে থাকলেন এক মুহূর্ত। কাতর গলায় বললেন,
” তুমি আবার আমাকে ভুল বুঝছ। ”

আমি প্রতিবাদ করে বললাম,
” না, আমি ঠিক বুঝছি। বরঞ্চ আপনি আমাকে ভুল বুঝানোর চেষ্টা করেন। আর আমি বোকার মতো তাই বিশ্বাস করি বার বার। ”

অমিত করুণ চোখে তাকালেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন, পারলেন না। মা-বাবা চলে এসেছেন। তাদের দিকে একটুখানি নজর বুলিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। আমার দিকে একপা এগিয়ে ফিসফিসে বললেন,
” বাবা-মায়ের সামনে এমন করো না। রুমে চলো। ”

আমি তার কথা শুনলাম না। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি ফিরবেন না? ”

তিনি উত্তর দেওয়ার বদলে আমার হাত ধরতে চাইলেন। আমি দ্রুত পেছনে হটে গেলাম। দৃঢ় গলায় বললাম,
” ঠিক আছে, আমি একাই ফিরব। ”

উপস্থিত কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মূল দরজার দিকে পা বাড়ালাম আমি। একবারের জন্যও পেছনে তাকালাম না। সিটকানি খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।

___________
রাত খুব একটা গভীর না হলেও কোলাহল কমে এসেছে অনেকটা। রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই। দুই চাকা, তিন চাকার যান নেই বললেই চলে। মিনিট পেরিয়ে হঠাৎ চার চাকা, আট চাকা ছুটে আসছে তীব্র বেগে। আমি গা ছমছম করা আঁধারে হেঁটে চলেছি একমনে। কিছুদূর এগুতে একটা সিএনজি এসে আমার পথরোধ করল। ভয়ে জমে যাওয়ার অবস্থা হতে দেখলাম অমিত নামছে সিএনজি থেকে। আমার সমুখে এসে বললেন,
” তুমি বললে ঐ বাসা কেন সমস্ত রাজ্য ছাড়তে পারি, রাগিসাহেবা। ”

আমি বিরক্ত চোখে তাকালে তিনি সিএনজি দেখিয়ে বললেন,
” উঠো। ”

আমি এক মুহূর্ত চুপ থেকে উঠে বসলাম। তিনি আমার পাশে বসে বললেন,
” এবার তো এই রণচণ্ডী রূপ ছাড়ো। আমি হার স্বীকার করেছি। ”

আমার হাব-ভাব বদলাল না। তিনি একটু চুপ থেকে বললেন,
” তোমার মতো তোমার রুমটারও আমাকে পছন্দ না। পা ফেললেই তোমাকে রাগিয়ে দেয়। আর তুমি? আমাকে রেখে বেরিয়ে আস। বিয়ে করেও ভাগ্য বদলাতে পারলাম না। হায় আফসোস! ”

অমিতের কথাগুলো আমাকে মায়ায় ফেলতে পারল না। আমি একপাশে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। তখনই তিনি ডেকে উঠলেন,
” রাগিসাহেবা? ”

তার এই অদ্ভূত ডাক আমার কর্ণ পথ দ্বারা মস্তিষ্কে পৌঁছালেও আমি প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। পুরোদস্তুর এড়িয়ে গেলাম। মনোযোগ বসালাম শরীর ছুঁয়ে দেওয়া শীতল ও শান্তিপ্রিয় বুনো হাওয়ায়। তারপর কী হলো মনে নেই। যখন চোখ মেললাম তখন ভোরের দীপ্ত ছুঁয়ে আছে জানালার কাচে। আমি হুড়মুড়ে উঠে বসলাম। নজর বুলালাম চারপাশে। অমিতের দেওয়া সেই কাচের বোয়ামটায় চোখ পড়তে বুঝলাম আমি তার রুমে আছি। কীভাবে এসেছি জানি না!

বিছানা থেকে পা নামাতে গিয়ে মেজাজ খারাপ হলো। সেই পরিচিত আলপনায় পাদুটো আলতা রঙে সজ্জিত। আমি কঠিন রাগ নিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। একটু খুঁজতে আলতার কৌটো পেলাম। হেঁটে গেলাম বারান্দার দিকে। অমিত তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কোনো কিছু বিবেচনা না করেই আলতা ঢেলে দিলাম তার শরীরে। এক পলকেই সাদা রঙের পাতলা টি-শার্টে এলোমেলো দাগে ভরে গেল। আমি তৃপ্তি পেলাম। বিরল হাসলাম। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়ায় কুঁকড়ে থাকা শরীরটাতে প্রতিশোধ নিয়ে রুমে ফিরে আসলাম। ঘুমের ভাব ছুটাতে ঢুকলাম গোসলখানায়। একেবারে গোসল করে বেরিয়ে এসে মোবাইল হাতে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটি বার্তার প্রবেশ হলো। বার্তাটি পাঠিয়েছে অমিত। লিখেছে,
‘ আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করাটা কি ঠিক হলো? ‘

আমি উত্তর দিলাম না। ফোন রেখে দিতে যাব তখন আবার লিখে পাঠাল, ‘ আমার মনে হয়, তোমার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা দূরে রেখে, চারপাশটা ভুলে একবার যদি আমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরো, চোখ বন্ধ করে মনে মনে উচ্চারণ করো, আমি তোমার স্বামী তাহলেই আমাকে ভালোবেসে ফেলবে। ‘ বার্তাটা পড়ে আমার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল। নিস্বাস এলোমেলো হলো। চিন্তাশক্তি লোপ পেল। অবশ হয়ে আসল শরীরখানা। স্থির দৃষ্টি কেঁপে উঠল অমিতের কণ্ঠস্বরে,
” একবার চেষ্টা করে দেখবে? ”

আমি চমকে সামনে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখ আটকে গেল তার খোলা বুকে। সেই দর্শন স্থায়ী হলো না। দরজার কড়া নাড়ছে কেউ। অমিত অনাবৃত শরীর নিয়েই দরজা খুললেন। পাহাড়ের মতো বইয়ের লাইন নিয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইল এক ছোকরা। অমিত দরজা থেকে সরে দাঁড়াতে সে ঢুকে পড়ল। খাটের উপর একে একে সব বই রেখে চলে গেল। আমি চোখে-মুখে প্রশ্ন জড়ো করতে সন্দেহে জড়িয়ে পড়লাম। বইয়ের কাছে ছুটে গিয়ে একটা তুলে নিলাম। তারপর আরেকটা। তেমন করে সবগুলো নাড়িয়ে-চাড়িয়ে বিস্মিত গলায় বললাম,
” এগুলো তো আমার বই! ”

অমিত টাওয়েল হাতে নিয়ে বললেন,
” চিনতে পেরেছ তাহলে। ”

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
” আমার বই আমি চিনব না? ”

উত্তরে তিনি হাসলেন। গোসলখানায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
” এখানে দুটো বই নেই। আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে রাখ। ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় কিনে নিও। ”

আমি বই ফেলে গোসলখানার দিকে ছুটে গেলাম। অবিশ্বাস্য গলায় সুধালাম,
” আমি ভার্সিটিতে যাব? ”

অমিত সোজা উত্তর দেওয়ার বদলে বললেন,
” ইচ্ছে না থাকলে যেও না। আমার আপত্তি নেই। ”

আমি মুখ কালো করে ফেললে তিনি বললেন,
” তোমার ভার্সিটি এখান থেকে অনেকটা দূরে। রোজ গেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই সপ্তাহে দুইদিন যেতে পারবে। তাও আমার ঠিক করে দেওয়া গাড়িতে। ”

আমি খুশি হতে গিয়েও নারাজ হলাম। বললাম,
” আবার আপনার ইচ্ছে তে আমাকে চালাতে চাচ্ছেন? ”

অমিত টাওয়ালটা গলায় প্যাঁচিয়ে বললেন,
” না, তোমার নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ”

কথাটা বলেই ভেতরে ঢুকে গেলেন। দরজা অর্ধেক খোলা রেখে ঝরণা ছাড়লেন। ভিজতে ভিজতে বললেন,
” আমার অফিস না থাকলে আমি নিজেই নিয়ে যেতাম। সম্ভব হচ্ছে না বলে এই ব্যবস্থা। ”

আমি বাইরে দাঁড়িয়েও তার গোসল করা দেখতে পারছিলাম। খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লেও কৌতূহল দমাতে পারলাম না। প্রশ্ন করে বসলাম,
” আপনার ছুটি শেষ? ”

তিনি সাবান মাখতে মাখতে বললেন,
” না। কিন্তু একটা জরুরি কাজে বস ডেকে পাঠিয়েছেন। মনে হয় আর ছুটি কাটানো হবে না। ”

আমি আর কিছু বললাম না। তার কাছ থেকে সরে আসলাম। বিছানায় বসতে গিয়ে খেয়াল হলো এ চাদরটা নতুন। কাল অন্যটা ছিল। কিন্তু আমি তো বদলাইনি। তাহলে কে বদলাল?

আমি ভাবনায় জড়িয়ে পড়তে অমিতের উন্মুক্ত শরীরটুকু মনে পড়ল। তার গায়ে তো টি-শার্ট ছিল। কোথায় গেল? আমি দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। আনাচে-কানাচে খুঁজেও পেলাম না। তন্মধ্যে অমিতের আপুর বলা কথাটি মনে পড়ল, অমিত দাগ একদম পছন্দ করে না।

চলবে