আষাঢ়ে প্রণয় পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
274

#আষাঢ়ে_প্রণয়
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৪(অন্তিম পর্ব)

রিহিলা ডাইরির পাতা উল্টিয়ে দেখলো আর বাকি সব পাতা খালি। সে পাগলের মতো হন্য হয়ে ডাইরি উল্টাতে লাগলো কিন্তু হতাশ হলো। সে সবসময় দেখতো তার মা এই ডাইরিটা পড়তো আর কেউ তখন সেই রুমে গেলেই ডাইরিটা লুকিয়ে ফেলতো।তারও ইচ্ছে হলো এই ডাইরিটা পড়ার। কী এমন আছে এই ডাইরিতে! বাসায় মেহমান উপলক্ষে তার মা এখন রুমে কম থাকে যার কারণে রিহিলার ডাইরিটা পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। সে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে রইল। এরপর কী হয়েছে তা জানার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে আছে। কাল থেকে সে তার বিয়ে উপলক্ষে অনেক উৎফুল্ল ছিল কিন্তু এখন এসব কিছুই নেই। তার এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে এরপরের ঘটনা জানা। রুমের দরজা ধাক্কানোর শব্দে রিহিলার হুশ ফিরলো। সে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলতেই তার মা ঢুকল,
-‘কী রে! আজ তোর গায়ে হলুদ আর তুই সেই সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে আছিস? কী হয়েছে তোর? এই বিয়েতে কী তুই রাজি না? তোর মত না থাকলে বল, আমি এখনই ভেঙে দিতে রাজি। মেয়ের মত ছাড়া আমি কিচ্ছুতে বিয়ে হতে দিবো না।’

রিহিলা এক দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। হয়ত বা তার মায়ের বিশবছর আগের কথাগুলো মনে পড়ে গিয়েছে। রিহিলার আর কিচ্ছু বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু এসব ভাবতে গেলেই তার বাবার কথা মনে পড়ছে। আচ্ছা, তার বাবা কই? মা’কে জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত, শুধু বলতো উনি মা’রা গিয়েছে কিন্তু কী হয়েছিল এরপর!

-‘না, মা। আমার কিছু হয়নি। আমি আহিবের সাথে বিয়েতে পুরোপুরি রাজি আছি।’

রিহিলার কথা শুনে তার মা মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
‘কিছুক্ষন পর পার্লার থেকে মানুষ আসবে তোকে তৈরী করাতে। তুই এখন একটু বস, আমি খাবার নিয়ে আসছি। দুপুর থেকে তো তেমন কিছুই খেলি না।’ বলেই চলে যেতে নিলে রিহিলা তার মায়ের হাত ধরে ফেললে রিধি মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

-‘আজ তোমাকে সব বলতে হবে মা। নাহলে আমি কিছুই খাবো না। এতদিনেও কী তোমাদের কথা আমি জানতে পারবো না?’

মেয়ের কথায় রিহিলা হাসলো।

‘ডায়রিটা পড়েছিস?’

রিহিলা ‘হ্যাঁ’বোধক সম্মতি দিতেই রিধি মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
‘সব বলবো, আমি খাবার নিয়ে আসি।’ বলেই চলে গেল।

কিছুসময় পর রিধি এক প্লেট খাবার নিয়ে এসে রিহিলার পাশে বসতেই রিহিলা এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতেই রিধি বলে উঠল,’আগে কথা দেয়? সব শোনার পরেও তুই এই মাকে এখনের মতোই মা হিসেবে ভাববি?’

-‘ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি। তুমি সবসময় আমাকে আগলে রাখতে। তখন থেকেই তোমাকে আমি আমার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে ভেবে আসছি। সব শোনার পরেও তুমিই আমার প্রাণ।’

রিধি চলে গেল সেই বিশবছর আগের অতীতে।

-‘তুই আমার মেয়ে নস রিহু। তুই তিশা আদনানের মেয়ে।’

রিহিলা তার মায়ের কথা শুনে চমকে উঠল। সে কিছু বলে উঠতে নিতেই রিধি আবারো বলে উঠল,

‘সেদিন রিহান তিশার বিয়ে হয়নি। আমার ধারণা ভুল ছিল।আমাকে অজ্ঞান হতে দেখে রিহান আর কবুল বলেনি। সে কারোর পরুয়া না করে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজেই গাড়িতে তুলে দিয়েছিলো। আর রিহান সেদিন বিয়েটা আদনানের সাথেই দিয়েছিলো। আদনান আর তিশা একে অপরকে ভালোবাসতো কিন্তু সেও চাপে পড়ে আদনানের কথা বলার সাহস পায়নি কিন্তু রিহান সেই সুযোগ করে দিয়েছিলো। রিহান তিশা-আদনানকে মিলিত করে। রিহান বুঝতে পারে তিশা-আদনান দুইজনেই একে অপরকে ভালোবাসে। সে তার বাবা মকবুল শেখকে সবকিছু খুলে বলে। তিশা-আদনান সুখেই চলছিল। সেসময় রিধির মেডিকেল পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে রিহান সেই বছর রিধির সাথে বিয়ের কথা বলে কিন্তু সবাইকে রাজি করিয়েছে। রিহান রিধির বিয়ে ঠিক হয়ে থাকে। তিশা-আদনানের বিয়ের এক বছরের মধ্যেই একটা ঝড় এসে তিশাদের সংসার জীবন পুরোপুরি শেষ করে দিল। তিশার ডেলিভারি করানোর জন্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে নিয়ে যাওয়ার সময়ই ওদের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়। আদনান সাথে সাথে মা’রা গিয়েছিল। তিশাকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল। তিশা রিহিলাকে সুস্থভাবে জন্ম দিয়েই প্ৰিয়জনের মৃ’ত্যুসংবাদ মেনে নিতে না পেরে স্টো’ক করে। এক মুহূর্তের মধ্যে তাদের সুখের জীবনটা শেষ হয়ে যায়। এরপর রিহান রিহিলাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। রিহান-রিধি একসাথেই দেখতো রিহিলাকে। রিধি হোস্টেল থেকে রিহিলার জন্য চলে এসেছিলো। রিহিলার পাঁচমাসের সময় রিহান-রিধির বিয়ের তারিখ পড়েছিল। সেদিন রিহান-রিধির মেহেদির আগের রাত ছিল। সম্পূর্ণ বাড়ি লাল-নীল বাতিতে জ্বলজ্বল করছিল। রিধিও ভীষণ খুশি, এতো অপেক্ষার পর নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে চলেছে। রিহান কল দিয়ে জানিয়েছিল, সে গাড়িতে উঠেছে। সবাই ভীষণ খুশি কিন্তু কে জানতো এই খুশি কিছুসময়ের ব্যবধানে একেবারের জন্য মিলিয়ে যাবে! রিহান-রিধির জীবনে সুখ যেন ধরা দিচ্ছে কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! মাঝরাতে রিহানের এক্সি’ডে’ন্টের খবর এসেছিলো। এক মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছে রিধির। সেই রাতেই রিহান কোমাতে চলে গিয়েছিল। কোনোরকম ভাবে নিঃশ্বাসটা আটকে ছিল। তাও রিধি নিজেকে বুঝ দিয়ে থাকতো যে অন্তত রিহান ভাই কাছেই আছে কিন্তু দুইবছরের মাথায় সে নিঃশ্বাসটাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে রিধি একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। সেও তো একটা সুখের সংসারের আশা করেছিল কিন্তু পারলো কই! হয়ত কপালে এমন কিছুই লেখা ছিল। এরপর থেকে সারাদিন রিহিলাকে নিয়েই চুপচাপ শুয়ে থাকতো। সিদ্ধান্ত নেয়, রিহিলাকে নিয়ে রিধির বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে। রিহিলার মধ্যেই যে রিধি রিহান-ভাইয়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। মা-বাবা’রা রিধিকে অনেক জায়গায় বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু রিধি করেনি। তারা রিধির উপর রেগেও ছিল কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাদের রাগ পড়ে গিয়েছিল। রিধি যে পারবে না, তার রিহান ভাইকে ভুলতে।এখনো আশেপাশে সে তার রিহান ভাইকে অনুভব করে।’
.
.
রিহিলা তার মায়ের কথা শুনে একটা ঘোরের মাঝেই চলে গিয়েছিল। তার মায়ের মনে এত্ত কষ্ট! অথচ তার ঠোঁটে সবসময় মিথ্যে হাসি ঝুলে থাকে। একটা মানুষ আরেকজনকে কতটা ভালোবাসলে তার বাকি জীবন ওই মানুষটাকে উৎসর্গ করে একলা কাটিয়ে দিতে পারে তা রিহিলা ভাবতে পারছে না। সে যদি পারতো তার রিহান বাবাকে এখনই এই মায়ের কাছে এনে দিতো।

ততক্ষনে পার্লারের মানুষ এসে যাওয়াতে রিধি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিহিলার কপালে চুমু দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

——-

দেখতে দেখতে রিহিলারও বিয়ে হয়ে গেল। মেয়েটা যাওয়ার আগে মা’কে ছাড়তেই চাইছিল না।
রিধি তার রুমের খোলা ব্যালকনিটাতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এই ব্যালকনিটাতে যতবারই আসে ততবারই রিধির রিহানভাইয়ের কথা মনে পড়ে। সিহান ভাই ঢাকাতে নিজের বাসাতে রিধিকে সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু রিধি যায়নি। দশবছর আগে মকবুল শেখও ওপারে চলে গিয়েছে। এই ব্যালকনিতে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালেই রিধির মনে হয় তার রিহান ভাই তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আজ চাঁদ আছে কিন্তু মেঘে কিছুসময় পর পর এসে চাঁদটাকে আড়ালে ঢেকে দিচ্ছে যার ফলে রিহিলার বিয়ে উপলক্ষে দেওয়া লাল-নীল বাতিগুলো জ্বলজ্বল করে রাতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দিচ্ছে। সেদিন রাতেও এমন ছিল রাতটা। যেদিন রিহান রিধির সাথে চন্দ্রবিলাস করেছিল।
রিধি এক ফলক ঢেকে যাওয়া চাঁদটার দিকে তাকালো। এরপর আপনমনেই বিড়বিড় করে উঠল,’আমার দায়িত্ব আমি শেষ করে ফেলেছি রিহান ভাই। দেখতে দেখতে আপনি আপনার রিধুকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আজ বিশবছর পেরিয়ে গেল। আজ আপনার বিশতম মৃ’ত্যুবার্ষিকীতে রিহিলাকে তারই ভালোবাসার মানুষটার হাতে তুলে দিলাম। রিহিলাও আজ আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। আমি কথা দিয়ে কথা রেখেছি অথচ আপনি পারলেন না। আমাকে একসাথে থাকার কথা দিয়ে কথা না রেখে হারিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু আমি হারায়নি রিহান ভাই। আমি কথা রেখেছি, আপনি আপনার কথা রাখতে পারেননি। আপনি বড্ড স্বার্থপর রিহান ভাই। বড্ড স্বার্থপর।’

#সমাপ্ত