আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৪৩

0
1240

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৪৩]

‘আমি কিন্তু আমার উত্তর পেলাম না স্যার।’

রাজকে চুপ থাকতে দেখে নুরা আবারো বলে উঠলো। সকচকিত হয়ে নুরার দিকে তাকালো রাজ। প্রশ্নের প্রত্যুত্তর কিভাবে করবে সেটাই ভাবছে সে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে শব্দ ভাণ্ডারে বাক্য সাজিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, ”কথায় আছে ‘পাই না পাই সাধন করতে মানা নাই’। আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশার মাঝে পার্থক্য আছে। পার্থক্য থাকলেও দুইটো শব্দ একে অপরের সাথে সংযুক্ত। কোনো কিছু পাবার তীব্র বাসনা কে আকাঙ্ক্ষা বলে। আমি কখনো বলবো না পাওয়ার আশা ছেড়ে দাও। তকদিরে থাকলে দেরি হলেও আসবে। যদি ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা মনে থাকবে।’

‘আপনার পছন্দের মানুষটার ফিরে আসার সম্ভাবনা কতোটুকু?’

হকচিকিত হলো রাজ। চমক দৃষ্টি চটপট নুরার দিকে তাকালো। অবাক হলো বেশ। এইটুকু সংক্ষিপ্ত আলাপে রাজের এতো বছরের গোপনীয়তা কিভাবে বুঝে গেলো মেয়েটা? সে তো কোনো প্রকার ইঙ্গিত দেয় নি। আশ্চর্যবোধক ব্যাপার। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুরা মৃদু শব্দে হেসে উঠলো। চোখ ফিরিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিভাবে জানলাম সেটা নাহয় পরে বলা যাবে। আর আপনি প্রশ্নের উত্তর দিতে এতো দেরি করেন কেন বলুন তো?’

নুরার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচে তাকালো রাজ। ফুঁশ করে একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকালো। নুরা এখনো প্রশ্নের উত্তরের আশায় তার দিকে অধীক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার এতো কৌতুহল দেখে মনে মনে হাসলো রাজ। কিছুটা সময় নিয়ে, মনে মনে উত্তর দেবার জন্য শব্দ গুচ্ছ সাজিয়ে, শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয় ভিজিয়ে বলে উঠলো, ‘তাকে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা তো দূর কখনোও পসিবল না।’

নুরা কারণটা জানে। তবুও না-বুঝের মতো জানতে চাইলো, ‘কেন? সে কি চলে গেছে?’

‘না! সে অন্য কাউ কে ভালোবাসে। আমি পারতাম তাকে জোরপূর্বক আমার করতে। কিন্তু আমি এতোটাও নিষ্ঠুর না যে নিজের ভালোবাসা পাবার জন্য অন্য কারোর ভালোবাসা ভেঙ্গে দিবো। আমি মন থেকেই চাই আমার ভালোবাসা যেন তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে সুখি থাকে।’

বিমুগ্ধ হলো নুরা। রাজ তাহলে দীবাকে পাবার জন্য কোনো পন্থা- অবলম্বন করবে না? তাহলে আরব ভাই আর দীবা দুইজনের জীবনে কোনো বাধা আসবে না। বুকের ভীতর থেকে চাপা ভয় এতোক্ষণে কেটে গেল। গতকাল রাতে যেই ভয়ে সে নির্ঘুম রাত কাটালো, আজ সকালে সেই ভয় রাজের কথায় নিমিষেই কেটে গেলো। রাজ তাহলে দীবাকে আর চাইবে না। তাহলে কি ভালোবাসবে? প্রশ্নটা মনে জাগতেই বিষণ্ণ হলো তার কোমলায়ন মন। কোনো মেয়েই চায় না তার ভালোবাসার মানুষটা অন্য কাউকে ভালোবাসুক। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। হয়তো এটাই তার কপালে ছিলো। নিরবে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। রাজ আরো কিছুক্ষণ কথা বললো নুরার সাথে। তারপর হাত ঘড়িতে সময় দেখে দেখলো অনেকক্ষণ হয়েছে এখানে আছে তারা। বাড়ি ফেরা দরকার।তাই বাড়িতে যাবার জন্য পা বাড়ালো দুজন। নুরার থেকে একটু এগিয়ে রাজ। নিজের মতো হেঁটে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। আর নুরা রাজকে দেখে হাঁটছে। রাজের বলা প্রতিটা কথা তার মনে নতুন করে প্রেম জাগিয়েছে। নতুন করে রাজের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছে। রাজের সর্বশেষ এইটুকু কথাই নুরার মনে গেঁথে রইলো। আর সেটা হলো,

“ভালোবাসা মানেই হচ্ছে ভালো থাকার এক অনুভূতি। যাকে দেখলেই মনের সব বিষ ছু মন্তর ছু হয়ে যায়, আমরা তাকেই ভালোবাসি।”

ভালোবাসার মানুষটার কাছে অদ্ভুত এক জাদু শক্তি আছে। যেই শক্তির মাধ্যমে বিপরীত মানুষটাকে অনায়াসে নিজের অজান্তে ভালো রাখে। বিষন্ন মনকে প্রাণবন্ত করে তুলে। নুরার মনটাও তাই। রাজকে পাশে পেয়ে বিষণ্ণতা দূর হয়ে গেলো। মনে পরলো কয়েকটা লাইন। লাইন গুলো আজ কানে আপনাআপনি বেজে উঠলো।

“যা দিয়েছিলে, ফিরিয়ে নিয়েছিলে সেই কবে। আবারও যদি আমায় সব দিতে চাও, তবে নিয়ে নিলাম। তুমি যা দিতে চাও তার সব আমি নিয়ে নিলাম। আমার বুকে আঁতকে ওঠা প্রেমের ঝড়ে, কাছে টেনে নেবো তোমায় আমার করে।”
____________________

সকালটা সুন্দর ভাবে কাটলো সবার। কিন্তু দুপুরে সূর্য মাথার উপরে আসার আগেই অম্বর কাঁপিয়ে ভারি বর্ষণে মুখরিত হলো ধরনী। রুমের ভিতর থেকে বৃষ্টির ঝুম শব্দ শুনে উল্লাসিত হলো দীবা। দ্রুত পা বাড়িয়ে রুমের বাহিরে আসলো। রুমের বাহিরে বিশালাকৃতি লম্বা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালো। এক হাত বাড়িয়ে ধরনীর বুক চিঁড়ে পরা বৃষ্টির টুপটাপ ফোটা গুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে দীবা। ঠোঁটে তার আমোদিত হাসি। গতকাল বৃষ্টি ভেজার ফলে মাথা ব্যাথা করেছে। তাই আজ বৃষ্টি ভেজার ইচ্ছে হলেও বৃষ্টি ভেজার মতো দ্বিতীয়বার দুঃসাহস দেখালো না। তবে এইজন্য অবশ্য বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই তার। সে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বৃষ্টিময় দুপুর পর্যবেক্ষণ করছে। তার ঠিক পিছনে পকেটে দুই হাত গুঁজে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আবরার। সে এক মনে দীবার এই প্রফুল্লিত হাসি মুখ দেখছে। দীবার হাসিতে বিমুখিত হয়ে নিজেও মৃদু হাসলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে দীবার দিকে এগিয়ে গেলো। দীবার দুই পাশে দুই হাত রেখে রেলিং ধরে দীবার কাধে নিজের চিবুক রাখলো সে। নিজেও দেখতে লাগলো বৃষ্টিস্নাত দুপুর। হঠাৎ-ই পিছন থেকে আবরার জড়িয়ে ধরায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকালো একবার। ভাগ্যিস কেউ নেই। যদি কেউ এই অবস্থায় তাদের দুজনকে দেখতো তাহলে লজ্জায় ম’রে যেতো সে। মনে মনে স্বস্তি পেলেও চেহারায় রাগ ফুটিয়ে বলে উঠলো, ‘এভাবে ধরেছেন কেন? কেউ দেখে ফেলবে। ছাড়ুন।’

নির্বাক আবরার। গুরুত্ব দিলো না দীবার কথায়। ভাবলেশহীন ভাবে দীবার কাধে আলতো ভাবে চুমু খেয়ে বললো, ‘দেখলে দেখুক। আমি কি অন্য কারোর বউকে জড়িয়ে ধরেছি নাকি? আমি আমার বউকে জড়িয়ে ধরবো যেখানে খুশি সেখানে। তাতে কার বাপের কি?’

দীবা চোখ পাকিয়ে তাকালো, ‘আপনার মাঝে লজ্জার ল টাও নেই। আশ্চর্য লোক কোথাকার।’

দীবার কোমড় ধরে নিজের দিকে ঘুরালো আবরার। মুখের দুপাশে পরে থাকা ছোট চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে দীবার এক গালে হাত রাখলো। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠলো, ‘লজ্জা পেলে আব্বু ডাক জীবনেও শুনবো না। তাই আমি বউয়ের সাথে লজ্জা পাচ্ছি না।’

আবরারের বুকে ধা’ক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো দীবা। রাগে কটমট করতে করতে রুমের ভিতরে যেতে যেতে বললো, ‘এখানে আসাই আমার ভুল হয়েছে।’

দীবার কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো আবরার। চলে যাবার জন্য রুমের দিকে পা বাড়াতেই থেমে গেলো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালো। সেখানে রাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো আবরার। নিরবে চোয়াল শক্ত করে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।

দরজা বন্ধ করে পিছু ফিরে তাকাতেই জানালার পাশে দীবাকে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসলো। নিজেও নিঃশব্দে দীবার পাশে বসে দীবাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। দীবার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে আলতোভাবে বললো, ‘আই লাভ ইউ দীবা।’

দীবা মুচকি হেসে প্রত্যুত্তর করলো, ‘আই লাভ ইউ টু।’

আবরার দীবাকে নিজের দিকে ফিরালো। মুখের সামনের চুল গুলো যত্ন সহকারে গুছিয়ে দিয়ে দীবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বাহিরে শ্রাবণের মনোরম বর্ষণের দৃশ্যপট দেখে গান শুনার ইচ্ছে জাগলো দীবার। তাই সঙ্গে সঙ্গে আবদার করে বসলো, ‘আমাকে ওই গানটা শুনান।’

‘কোনটা??’

‘ভালোবাসি সুহাসিনী।’

আবরার মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। দীবা আবারো সামনের দিকে ফিরে বসলে আবরার তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। দীবার ঘাড়ে চিবুক রেখে আলতো স্বরে গাইতে লাগলো…

রোজ সকালে তোর মায়াবি ছবি
চোখে ভাসে তোর মিষ্টি হাসি
বেলী গাঁথা তোর চুলের বেণী
মায়াপূর্ন তোর চোখের চাহনি।
_____________________

নিচ তলায় রাজিব ও সাবিতের সঙ্গে বিয়ে সংক্রান্ত কিছু ব্যাপারে আলাপ আলোচনা শেষ করে মাত্রই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিল। একদম উপরের সিঁড়িতে উঠার পর দীবা ও আবরারকে পাশাপাশি বারান্দার রেলিংয়ের কাছে দেখে থেমে গেলো। বুকের বাম পাশটা ভারি হয়ে এলো তার। দীবাকে অন্য কারোর পাশে দেখার মতো সাধ্য তার ছিলো না। কিন্তু পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আজ সেই করুণ দৃশ্যটাই তার নজরে আটকালো। রাগ হলো প্রচুর। তবুও নিজেকে সংযত রাখলো যথাসম্ভব। দীবা রুমে যাবার পর আবরারও রুমের দিকে পা বাড়ালো। ডান দিকে রাজকে দেখে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সে নিজেও ভিতরে চলে গেলো। সিঁড়ির পাশে থাকা একটা মাটির ফুলের টবে রাগে লা:থি দিল একটা। ভাগ্যবশত টবটা ভাঙ্গে নি। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় নি রাজ। গটগট পায়ে তৃতীয় তলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।

দূর থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা দেখে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। রাজের অসহায়ত্ব দেখে কষ্ট লাগলো ভীষণ। চোখে জমে এলো পানি। রাজের এই ভালোবাসা যদি তার জন্য হতো তাহলে কি এমন ক্ষতি হতো? সে কি কখনো রাজকে কাছে পাবে না? ধীর পায়ে এগিয়ে চেয়ার টেনে টেবিলের কাছে বসলো। ব্যাগ থেকে কলম আর নীল রঙ্গের এ ফোর সাইজ কাগজ বের করলো। ছয় ইঞ্চি পরিমানের মাপ নিয়ে টুকরো করে কেটে নিলো কাগজটা। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা দম নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো নুরা। এক পাক্ষিক ভালোবাসার প্রতি হৃদয়ের সুপ্ত কোণে অভিমান জমলো। নিজের জন্য নিজের বড্ড মায়া লাগলো। কাগজটায় কলম চালিয়ে লিখে ফেললো প্রিয় একটা লাইন। চিরকুটটা লিখার পর ওইদিন রাতের পর আর ভুল করেনি। ব্যাগের সাইড পকেটে রেখে দিলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো নুরা। কোমল গোলাপি ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে মৃদু গলায় বললো,

‘সৃষ্টিকর্তা জোড়ায় জোড়ায় মানবজাতির সৃষ্টি করেছেন। যদি, আপনি আমার সেই জোড়া হোন, তবে আপনাকে আমি শেষ অব্দি ভালোবাসি।’
____________________

চলমান…