#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৫৪]
শ্রাবণের আঠারোতম দিন। ভোর হতেই আবরার অভ্রকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। অদ্ভুত ভাবেই আজকের আকাশটা স্বচ্ছ। গতকাল সারাদিন ভারি বর্ষণে আগ্রাবাদ মুখরিত ছিল। কিন্তু আজ আকাশে কালো মেঘেদের আনাগোনা নেই। তাই তো নিশিতা রাজি হয়েছে। নাহলে কখনোই ঢাকা যাবার জন্য অনুমতি দিতো না।
.
কোলাহলময় আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ। তবে নিস্তব্ধ ক্লাসরুম। কারণটা অবশ্য একটাই। সেটা হলো রাজ। তার ক্লাসে স্টুডেন্টস কোনো প্রকার টুঁশব্দও করে না। ভুলেও যদি কেউ কোনো প্রকার শব্দ করে ফেলে তাহলেও বোধহয় রাজের কাছে রেহাই নেই। তাই খুবই মনোযোগ সহকারে ক্লাস করছে সবাই।
ক্লাস করানোর ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে নুরার দিকে তাকাচ্ছে রাজ। সে চাইছে নুরা তার দিকে তাকাক। চোখাচোখি হোক।দুজনের। অন্যান্য দিনের মতোই লাজুক হাসুক। কিন্তু অদ্ভুত ভাবেই নুরা আজ ভুলেও চোখ তুলে রাজের দিকে তাকাচ্ছে না। কিন্তু কেন? কারণটা ঠিক বুঝে আসছে না রাজের। গতকাল রাতের জন্য কি নুরা লজ্জা পাচ্ছে? কথাটা মাথায় আসলেই কপাল কুঁচকায় রাজ। বিয়ের কথা বলায় লজ্জা পাবার কি আছে? ভালো যখন বাসে তখন একদিন না একদিন বিয়ে করবেই তাই না? তাহলে এখানে লজ্জা পাবার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। এইসব প্রশ্ন আজগুবি চিন্তাভাবনা নিয়েই ক্লাসটা সম্পূর্ণ করলো রাজ। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যাবার আগে শেষবারের মতো নুরার দিকে তাকালো। এবং ভাগ্যক্রমে এখুনি চোখাচোখি হলো দুজনের। রাজ বোধহয় এই সময়টার জন্যই এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিল। চোখাচোখি হতেই মৃদু একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্লাসরুম থেকে। রাজ যেতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো নুরা। এতোক্ষণ যেন সে একটা ধম বন্ধ করার মতো অবস্থাতে ছিল। রাজের দিকে তাকাতে ভীষণ লজ্জা লাগছিল। কারণটা তার নিজেরও অজানা।
______________________
শ্রাবণের উনিশতম দিনের বিকেলবেলা। আকাশটা মেঘলা থাকলেও বর্ষণের দেখা নেই। ঠান্ডা বাতাস পরিবেশকে শীতল করে তুলেছে। শান্তি নিবাসে মেহমানদের আপ্যায়নের তোড়জোড় চলছে। রাইমার শ্বশ্রূ বাড়ি থেকে রাইমার শ্বশুর, শাশুড়ি ও রাইমা এসেছে। রাজিবের দরকারি কাজ থাকায় তাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে। তবে যাওয়ার আগে একবার দেখা করে তাদের নিয়ে যাবে বলে গেছে। হুট করে বেয়াই সাহেবের আগমনে রোশান ও হোসেন মহাখুশি। বাড়ির গিন্নীরাও আপ্যায়মে কম ব্যস্ত না। রাইমা রান্নাঘরে তাদের সাহায্য করছে। মনে মনে সে একটু বেশিই চিন্তিত। কারণ এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য টা তার জানা। ব্যাপার টা যতোটা সহজ লাগছে আসলেই কিন্তু ততোটা সহজ না। যদি সবাই নেমে নেয় তাহলে হয়তো খুব সহজ। নাহলে দুই পরিবারের মাঝে বড় কোনো ঝামেলা বাধবেই বাধবে। এই নিয়েই যতো ভয় রাইমার। গলা শুকিয়ে আসছে তার। জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করলো আতঙ্কে। তখুনি পিছন থেকে নুরা এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
‘আপুনিইই, জানো তোমাকে কত মিস করেছিলাম আমি।’
পিছু ফিরে তাকালো রাইমা। নুরার হাস্য উজ্জ্বল চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মলিন হাসলো। নুরার গালে আদুরে এক হাত রেখে বললো, ‘তোকেও খুব মিস করেছি।’
বিনিময়ে মুচকি হাসি দিল নুরা। কি কি নাস্তা তৈরি হচ্ছে তা দেখতে লাগলো। গরমগরম সিঙ্গারা দেখে একটা হাতে নিলো খেতে। রাইমা এখনো অবাক চোখে দেখছে নুরাকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না নুরা রাজের সঙ্গে সম্পর্কে আছে। এই সম্পর্ক কি তার বিয়ের পর থেকে নাকি আগে থেকেই? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। বাহির থেকে সাবিতের কণ্ঠস্বর শুনে আরো আতঙ্কিত হলো রাইমা। সাবিত আর আরব ভাই কি মেনে নিবে? চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা ধম নিলো রাইমা। মনে মনে চাইলো যেন কোনো প্রকার ঝামেলা না হয় দুই পরিবারের মাঝে।
রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে সিঙ্গারা খেতে খেতে উপরে যাবার জন্য হাঁটছে নুরা। সিঁড়ির কাছাকাছি এসে সিঁড়িতে পা রাখতেই রাজের মাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো। সাবলীল ভাবে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছেন আন্টি?’
রাজের মা নুরার কাছে আসলো। সালামের জবাব দিয়ে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো নুরার দিকে। তার এমন চাহনীতে হকচিকিত হলো নুরা। কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো সে। রাজের মা নুরার এক গালে আদুরে এক হাত রেখে মুচকি হেসে শুধালো, ‘আমি জানতাম আমার ছেলের পছন্দ খারাপ হবে না।’
অবাক হলো নুরা। সকচকিত হলো তার মস্তিষ্ক। তাদের এখানে আসার কারণটা খুব সহজেই ধরে ফেললো। এই জন্যই রাজ ওইদিন রাতে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিলো? লজ্জাভূতি হলো নুরা। কোনো রকমে ঠোঁট টেনে হেসে লজ্জা নিভাতে উপরে চলে গেলো। স্মিতি হেসে উঠলো রাজের মা। নুরার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো, ‘তোমাকে আমার প্রথমেই ভালো লেগেছিলো। আমি জানি আমার পছন্দের সঙ্গে রাজের পছন্দের মিল আছে। তাই তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাকেই পছন্দ করলো সে।’
____________________
আফজাল চায়ের কাপে আলতোভাবে একটা চুমুক দিয়ে বলে উঠলো, ‘আসলে এখানে আসার একটা বিশেষ কারণ আছে রোশান। বিসনেজের খাতিরে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুত্বসুলভ হয়েছে। তারপর আত্মীয়তা।’
রোশান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। আফজাল চায়ের কাপ সামনের টেবিলের উপর রেখে ফের শুধাল, ‘পরিচয় যেহেতু আগে থেকে সেহেতু তুমি আমার দুই ছেলের সম্পর্কেই জানো। তারা কেমন সেটা অবশ্য তোমাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।’
‘ছেলে ভালো না হলে কি আর মেয়েকে তার হাতে তুলে দেই? হাহা!’
কথাটা বলেই প্রাণোচ্ছল হাসি দিলো রোশান। আফজাল কিছুটা চিন্তিত, জড়তাযুক্ত গলায় বললো, ‘আসলে রোশান, আমি রাজ আর নুরার ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছি।’
থমকে গেলো রোশান। অবাক চোখে তাকালো আফজালের দিকে। হোসেন নিশ্চুপ থেকে ভাইয়ের প্রত্যুত্তরের আশায় আছে। রোশান কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাবিত কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে উঠলো, ‘আলাপ মানে? কিসের কথা বলছেন আপনি?’
.
দুতলার বারান্দার সিঁড়ির কাছাকাছি আড়ালে দাঁড়িয়ে সবার কথোপকথন শুনছে দীবা ও রিমি। পাশেই নুরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছে। সে তো আগে থেকেই জানে সবার এখানে আসার কারণ। আফজালের মুখে “আলাপ” শব্দটা শুনেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো দীবা রিমি। মহা আনন্দে নুরার গাল টেনে আহ্লাদী গলায় বললো দীবা, ‘বাহ্, বিয়ের আলাপ এসেছে। তাও জাতির ক্রাশ রাজ স্যারের পক্ষ থেকে।’
লজ্জা পেলো নুরা। গাল লাল হয়ে এলো। দুইজন কে উপেক্ষা করে রুমে চলে যেতে নিলে রিমি বাধা দিলো। নুরার বাহু জড়িয়ে ধরে দুজন আবারো কথোপকথনে মনোযোগ দিলো।
.
রাইমা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সাবিতের চেহারা, ভ্রুঁ কুঁচকানো আর কণ্ঠস্বর শুনে যা বুঝার সে বুঝে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরবে। চোখ ঘুরিয়ে শ্বশুরের দিকে তাকালো। শব্দ করে নিশ্বাস ফেললো আফজাল। সাবিতের প্রশ্নোত্তরে খুশি মনে বললো, ‘আমি রাজের জন্য নুরাকে আমার পুত্রবধূ করতে চাইছি।’
চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেলো রোশান। বিস্মিত চোখেমুখে আফজালের দিকে তাকালো। কেবল রোশান নয়, উপস্থিত সকলেই আফজালের কথা শুনে বিস্মিত। হোসেন অবাক হয়ে অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠলো, ‘কি বলছেন আপনি? এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের আলাপ?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আফজাল। কণ্ঠস্বর কিছুটা মলিন করে বললো, ‘আসল কারণ কি হোসেন। ইদানীংকাল শরিরটা ভালো যাচ্ছে না। কখন কি হয় সেটার গ্যারান্টি তো আর কেউ দিতে পারবে না। তোমরা হয়তো জানো আমার দুই ছেলেই আমার জান। ছেলেদের সুখ দেখে যেতে কে না চায় বলো? তাই আমি চাইছি, আমার কিছু একটা হয়ে যাওয়ার আগেই তাদের সুখটা দেখে যেতে। রাজিবের টা হলো, এবার চাইছি যতো দ্রুত সম্ভব রাজের বিয়েটাও দিয়ে ফেলতে। আমার নিজের মনও মানছে। খুব বেশি দিন বাঁচবো বলেও মনে হচ্ছে না। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।’
শান্তশিষ্ট সাবিত সাবলীল ভাবে জবাব দিলো, ‘আপনি আপনার দিক দিয়ে ঠিক। কিন্তু দেখুন আঙ্কেল নুরা এখনো অনেক ছোট। আমরা তার বিয়ের কথা আপাতত চিন্তা করছি না। পড়ালেখা করছে যতো দূর পারে করতে থাকুক। তাছাড়া নুরার নিজস্ব মতামত আছে বিয়ের ব্যাপারে। হুট করেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।’
আফজাল মাথা নাড়িয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতো করে বললো, ‘আমার মনে হয়না নুরা না করবে। যতো দূর জানি তারা একজন আরেকজন কে পছন্দ করে। আর আমি তাদের সম্পর্কের কথা জানার পরেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।’
আরেক দফা বিস্মিত হলো সবাই। সাবিত হতভম্ব হয়ে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘সম্পর্ক মানে? এটা কিভাবে সম্ভব? কবে থেকে সম্পর্ক তাদের?’
আফজাল গম্ভীর মুখে মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘রাজ আর নুরার মাঝে সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেটা কবে থেকে জানি না।’
কথাটা বলে একবার সাবিতের দিকে তাকালো। তারপর রোশানের দিকে পুলকিত চেহারায় তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘তাদের বিয়েটা দিয়ে দিলেই ভালো হবে রোশান। যেখানে ছেলেমেয়ে দুইজনই রাজি সেখানে আমাদের রাজি না হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। বিয়ের পরে তো নুরা পড়ালেখা কন্টিনিউ করবেই। সমস্যা কি তাহলে? রাজ যেহেতু তারই কলেজের টিচার। সেহেতু নুরার পড়াশোনায় আরো ভালো করবে বলে আমার মনে হয়। আর সব চেয়ে বড় কথা আমাদের আত্মীয়তা আরো দ্বিগুণ হবে। কি বলো? হাহা।’
কথা গুলো নিজে নিজে বলে নিজেই উচ্চ শব্দে হাসলো আফজাল। রোশান ও হোসেন নিশ্চুপ। পারিবারিক আলোচনা ছাড়া হুট করে কোনো মতামত দিতে পারছে না তারা। সাবিত এখনো বাকরুদ্ধ। নুরা এমন কিছু করবে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এখানে নুরার সম্মতি থাকলেও কিছু করার নেই। শব্দ করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে কিছু বলার জন্য উদগ্রীব হতেই থেমে গেলো আবরারের কন্ঠ শুনে থেমে গেলো।
‘দুঃখিত আঙ্কেল। আমরা নুরার সঙ্গে রাজের বিয়ে দিবো না।’
ড্রয়িংরুমের সদর দরজার পাশ থেকে আবরারের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই সকলের দৃষ্টি সদর দরজার দিকে চলে গেলো তাৎক্ষনাৎ। আবরারের এমন কথায় বিস্মিত হলো আফজাল। হতবাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘মানে?’
আবরার এগিয়ে এলো সবার দিকে। আফজালের সামনে দাঁড়িয়ে জড়তাহীন গলায় আবারো বললো, ‘আমরা নুরার সঙ্গে রাজের বিয়ে দিবো না।’
আফজাল জানতে চাইলো, ‘কিন্তু কেন? রাজ ভালো ছেলে তোমরা জানো। তাহলে রাজি না হওয়ার কারণ কিসের?’
‘কারণটা তেমন কিছু না। আপনি প্রস্তাব দিয়েছেন আমরা না করেছি। বিয়ের প্রস্তাব কতো আসবে যাবে। সব প্রস্তাবেই তো আর হ্যাঁ বলা সম্ভব না। মনে কিছু নিবেন না। আর কিছুই তো খেলেন না। আরেক কাপ চা দিতে বলবো?’
আবরারের থেকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান হয়ে অপমানবোধ করলো আফজাল। মুখখানি কালো করে সাবিতের দিকে তাকালো। সাবিতের চোখমুখ দেখেও বুঝতে পারলো সে-ও রাজি না। তারপর রোশানের দিকে তাকাতেই রোশান বলে উঠলো, ‘দেখো আফজাল, এখানে আমি কোনো মতামত দিতে পারছি না পারিবারিক আলোচনা ছাড়া। আগে সবার সাথে আলোচনা করে নেই তারপর নাহয় ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আফজাল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তারপর সবার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো শান্তি নিবাস থেকে।
_____________________
ড্রয়িংরুমে সবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নুরা। সকলের সামনে একা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাতে অস্বস্তি লাগছে তার। হৃৎপিন্ড ধুকধুক করছে। ভয়ে বারবার শুকনো ঢোক গিলছে সে।
‘রাজের সাথে তোর সম্পর্ক কবে থেকে?’
হঠাৎ আবরারের গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠা প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠলো নুরা। গলা শুকিয়ে উঠলো তার। কোনো প্রকার প্রত্যুত্তর না করে মাথা নিচু করে রাখলো। নুরাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাবিত কিছুটা শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘কিরে কথা বলছিস না কেন তুই? রাজের সাথে কিভাবে রিলেশনে গেলি? রাজ যে রাইমার দেবর হয় সেটা জানতি না? তাও তুই…’
সাবিতের কথায় বাধা দিয়ে রোশান বললো, ‘আহ সাবিত। ধমকাচ্ছিস কেন মেয়েটাকে। দেখছিস না ভয় পাচ্ছে।’
সাবিত নুরার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রাগ রাগ গলায় বললো, ‘কাকা নুরা ভয় পায় না। ভয় পেলে কি আর সম্পর্কে জড়াত?’
রিমি ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো একটা। দীবার বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ভয়ার্ত চোখে আবরারের দিকে তাকালো একবার। নুরাকে যেভাবে শাসন করছে, সেভাবেই কি তাকেও শাসন করবে? রাগি আবরারকে দেখে ভয়ে ঘেমে গেলো রিমি। আরব ভাই যদি জানে তাহলে তো তাকে মে/রে/ই ফেলবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই গলা শুকিয়ে এলো তার।
আবরার এগিয়ে নুরার একদম সামনে দাঁড়ালো। পকেটে দুই হাত রেখে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। শীতল কন্ঠে বলে উঠলো, ‘যা হবার হয়েছে। আজকের পর থেকে রাজের সঙ্গে যেন যোগাযোগ বন্ধ থাকে।’
চোখ তুলে আবরারের দিকে তাকালো নুরা। পিছন থেকে রোশান বললো, ‘আহ্ আরব বেশি হয়ে যাচ্ছে না? রাজ তো ভালো ছেলে। জানাশোনার মধ্যে যেহেতু অসুবিধে কোথায়?’
হোসেনও সম্মতি দিলো ভাইয়ের কথায়। কিন্তু আবরার শুনলো না। সে তার জায়গায় অটুট রইলো। শক্ত গলায় বললো, ‘আব্বু, আফজাল আঙ্কেল কে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দাও। এই বিয়ে কখনোই সম্ভব না। এই নিয়ে যেন বাড়িতে আর কথা না উঠে।’
সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো নুরার। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলো না। ভাইয়ের প্রতি এক রাশ রাগ, কষ্ট নিয়ে মুখের উপর বলেই ফেললো, ‘এটা কখনোই সম্ভব না।’
আবরার তীক্ষ্ণ চোখে নুরার দিকে ফিরে তাকালো। চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘কি বললি তুই?’
নুরা রোশান ও হোসেনের দিকে তাকিয়ে জেদি গলায় বললো, ‘বিয়ে করলে আমি রাজকেই করবো। মনে রেখো।’
কথাটা বলেই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। পিছু পিছু গেলো দীবা ও রিমি। দীবা উপরে যাবার আগে আবরারের দিকে তাকালো একবার।
আবরার নিশিতা ও আয়েশার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘নুরাকে বুঝাও। রাজের সঙ্গে আজকের পর থেকে কোনো প্রকার যোগাযোগ না থাকে। নাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।’
কথাটা বলেই উপরে চলে গেলো আবরার। দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোশান। সাবিতের দিকে তাকাতেই সাবিত বলে উঠলো, ‘আই’ম সরি। আমিও আবরারের সাথে এক মত।’
সাবিতও চলে গেলো। রইলো শুধু বাকিরা। আরিয়ান ও অভ্র বাড়িতে না থাকায় কিছু জানতেও পারলো না।
____________________
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে রাজ। হৃৎপিন্ড দ্রুত চলছে। অতিরিক্ত চিন্তায় এসি অন থাকার পরেও ঘেমে আছে সে। হাতে একটা পানির বোতল। বারবার পানি খেয়ে শুকিয়ে যাওয়া গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে। তখুনি বাড়ির নিচে গাড়ির শব্দ পেলো রাজ। ফুশ করে একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। কিন্তু সবার চেহারা দেখে মন আর স্বাভাবিক রইলো না। অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো।
আফজালের থমথমে মুখ দেখে রাজ কিছুটা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে?’
আফজাল জবাব দিলো না। চুপচাপ রাজকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে চলে গেলো। রাজের মা রাজের দিকে তাকালো একবার। শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে-ও চলে গেলো। হঠাৎ কি হয়েছে সবার? বাবা মায়ের কাছে উত্তর না পেয়ে রাইমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে ভাবি? তাদের এমন দেখাচ্ছে কেন?’
রাইমা মলিন চেহারায় তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করলো, ‘আসলে..”
‘কি? আপনার বাড়িতে কেউ মেনে নেয় নি?’
‘আব্বু কাকা কিছু বলে নি। কিন্তু আরব ভাই না করে দিয়েছে।’
কথাটা কিছুটা নরম স্বরে বললো রাইমা। রাজের হাতে থাকা পানির বোতলটা রাগে ফেলে দিলো। দাঁতে দাঁত পিষে ‘আবরার আবরার’ বললো কয়েকবার। তারপর রাইমার দিকে ফিরে চোয়াল শক্ত করে বিচলিত হয়ে রাগী গলায় বলে উঠলো, ‘আপনার ভাইয়ের সমস্যা কোথায় বলেন তো? পরিচয় হবার পরের থেকেই আমার সঙ্গে লেগে আছে। আমি যদি চুপচাপ আপনার ভাইয়ের রাস্তা থেকে সড়ে যেতে পারি তাহলে আপনার ভাই কেন আমার রাস্তায় বারবার আসছে? কেন???”
শেষের কথাটা একটু উচ্চস্বরে বলে ফেললো রাজ। কিছুটা কেঁপে উঠলো রাইমা। অবাক চোখে রাজের দিকে তাকালো। রাজ আর আবরারের মাঝে যে পারসোনাল কোনো ম্যাটারে দ্বন্দ্ব চলছে তা অনায়াসে বুঝে গেলো। রাজ আর কিছু বললো না। সোফার সামনের টি-টেবিলের উপর থেকে মোবাইল ও গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে। রাইমা হতবাক। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই ভয়টাই সে পেয়েছিলো। দুই পরিবারের মাঝে ঝা/মেলা বাধলো। রাগের বশে রাজ আবার না নতুন করে ঝা/মেলা বাধিয়ে ফেলে।
চলমান….