বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব-২+৩

0
428

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২
জাওয়াদ জামী

কুহুদের গাড়ি গ্রামের যত নিকটে পৌঁছাচ্ছে ততই ওর ভেতরে হাঁসফাঁস করছে। ছোটমা এসব জানলে কি হবে! সারা রাস্তা মনে মনে দোয়া-দরুদ পাঠ করে কুহু। সানাউল রাশেদিন একটু পরপর ভয়ে নেতিয়ে থাকা কুহুকে লক্ষ্য করছেন। উনার বুকটা ভারি হয়ে আছে এই অসহায় মেয়েকে আবার তার সৎমার কাছে ফিরে যেতে হচ্ছে বলে।

কায়েস কিছুক্ষণ বড় বোনের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দেয়। তার মনের আকাশে কালো মেঘ জমেছে। আজ মেয়েটা আসছে। আবার শুরু হবে ওর টিকে থাকার লড়াই। চোখের সামনে দেখবে মেয়ের লড়াই কিন্তু ওর পাশে থাকতে পারবেনা। তার থেকে বড় দুর্ভাগা আর কে আছে? মেয়ের পাশে যখনই দাঁড়াতে গেছে তখনই সংসারে শুরু হয়েছে অশান্তি। মেয়ের ওপর তখনই বেড়েছে শাস্তি। দিনের পর দিন এরূপ অশান্তি ভোগ করতে করতে এখন একটু শান্তি চায়। তাই চুপচাপ দেখে যায় মেয়ের ওপর হওয়া অন্যায়। এমনই কাপুরুষ পিতা সে।

গাঁয়ের সড়কের মাথায় গাড়ি প্রবেশ করতেই কুহুর বুকের মধ্যে ধুকপুক করতে শুরু করে। সামনে কি অপেক্ষা করছে তা ভেবেই ওর এই অবস্থা।
বাড়ির গেইটের সামনে গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে শিউলি আক্তার বুঝতে পারে তার তিন ননদের কেউ একজন এসেছে। বিরক্তিতে মন ছেয়ে যায়।
” বাপ-মা ম’র’ছে সেই কবেই, তাও তাদের বাপের বাড়ি না আসলে চলেনা। যত্তসব আদিখ্যেতা। ” গজগজ করতে করতে ধীরেসুস্থে দরজার কাছে যায়।
দরজা খুলেই সামনে সানাউল রাশেদিনকে দেখেই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তোলে। সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে। সানাউল রাশেদিনের পাশে কুহুকে দেখে আরেক রাশ বিরক্তি চেপে বসে শরীর-মনে। এই আপদ আজকেই আসল কেন!
সানাউল রাশেদিন কুহুর হাত ধরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। যতদিন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বেঁচে ছিলেন ততদিন আদরের কোন কমতি হয়নি এ বাড়িতে। কুহুর মা আইরিন সুলতানাও নিজের ননদ-ননদাইদের খুব আদর, যত্ন করত। আজ সেও নেই আবার শ্বশুর – শ্বাশুড়ি সেই কবেই চলে গেছে আর তখন থেকেই এই বাড়িতে মেয়ে-জামাইদের আদর,আপ্যায়নের পাট চুকেছে। এখন বছরে এক আধবার আসলেও এক গ্লাস পানির আশা করা যায়না। বাড়িতে কারও আসার আওয়াজ পেয়ে শিউলি আক্তারের ছেলে শিহাব দৌড়ে আসে। সামনে ফুপাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসে সালাম দেয়।
সানাউল রাশেদিন সালামের জবাব দিয়ে তার হাতে থাকা মিষ্টি, ফলমূলের প্যাকেট শিহাবের কাছে দেন। শিহাব ফুপাকে বসতে দেয়ার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভেতর থেকে চেয়ার নিয়ে আসে। কিন্তু শিউলি আক্তার তখনও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেতরে কোন আগ্রহ নেই অতিথিকে বসতে দেয়ার। সানাউল রাশেদিন সেসব লক্ষ্য করে মুচকি হাসেন। এতক্ষণে শিহাবের খেয়াল হয় ওর বড় আপু এসেছে। দৌড়ে আপুর কাছে যেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে নানান কথা জিজ্ঞেস করে। কুহুও হাসিমুখে সেগুলোর উত্তর দেয়।
” কুহু মা, এবার আমি যাই। দুপুর হতে চলল। তুমি সাবধানে থেক আর মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর। আর কোন কিছুর দরকার পরলে আমাকে জানাবে। ”
” আমার কিছুই লাগবেনা ফুপা। সবকিছু বাবা কিনে দেয়তো। আপনি শুধু দোয়া করবেন। ”
” একি দুলাভাই আপনি এখনই যাবেন ক্যান? কতদিন পর আসলেন দুপুরে না খাইয়া যাওয়া যাবেনা কইলাম। আর শিহাবের বাপেও এখন বাড়িতে নাই সে আসলে তারপর যাইয়েন। ” শিউলি আক্তার মুখে বলছে থেকে যেতে কিন্তু মনে মনে চাইছে সানাউল রাশেদিন এখনই চলে যাক। বাপের বাড়ির আত্মীয় ছাড়া আর কারও পাতে ভাত বাড়তে ইচ্ছুক নয় সে।
” আমার জন্য তোমার কষ্ট করে রান্না করতে হবেনা শিউলি। আমরা খেয়েই বেরিয়েছি। তাছাড়া একবেলায় কয়বার খাওয়া যায় বল। ” সানাউল রাশেদিন খুব ভালো করেই জানেন শিউলি আক্তারের সম্পর্কে।
” ফুপা আপনি একটু অপেক্ষা করেন আমি আসছি। ” বলেই বাড়ির দক্ষিণের ছোট দরজা দিয়ে বাগানের দিকে ছুট লাগায় কুহু। যাবার আগে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দা এবং প্লাস্টিকের ঝুড়ি নেয়। বাধ্য হয়ে সানাউল রাশেদিন চেয়ারে বসেন। শিউলি আক্তার সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই গলা বাড়িয়ে বাগানের দিকে তাকায়। কিন্তু কিছুই দেখতে পায়না। কিছুক্ষণ পর কুহু একটা মুরগী, একটা হাঁস আর কয়েকটা পুঁইশাকের ডগা, লাউয়ের ডগা, দুইটা লাউ, একটা মিষ্টিকুমড়া নিয়ে আসে। এসব দেখে শিউলি আক্তার চোখ বড় করে তাকায়।
ততক্ষণে শিহাব আর কুহু মিলে সবজিগুলো প্যাকেট করতে শুরু করেছে।
” কুহু মা এসব কি করছ তুমি? এগুলো রাখ আমি কিন্তু কিছুই নিবনা। ”
” ফুপা আমি মা’র নামের জমিতে কিছু সবজি লাগিয়েছিলাম। আর সেখানে আগে থেকেই একটা খোঁয়াড় ছিল। আমার হাঁস,মুরগী পালনের খুব শখ। পাড়ার কয়েকজন বাচ্চাদের পড়িয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে কয়েকটা হাঁস,মুরগীর বাচ্চা কিনেছিলাম। সেগুলোই বড় হয়েছে। এই দুইটা আপনার জন্য। মেজ ফুপু, ছোট ফুপুর জন্যও রেখেছি। ” সানাউল রাশেদিন আর না করতে পারেনা। সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেন কুহুর মাথায়।
” ভালো থেক মা, জীবনে অনেক বড় হও। তোমার চলার পথ আল্লাহ পাক যেন মসৃণ করে দেন এই দোয়াই করি। ” আর দাঁড়ায়না সানাউল রাশেদিন। শিউলি আক্তারের কাছে বিদায় নিয়ে সোজা গাড়িতে উঠেন।

এদিকে শিউলি আক্তার রা’গে ফুঁসছেন। দুইদিন পর তার বড় ভাই আসবে। তার ইচ্ছে ছিল এই হাঁসটা জবাই করে ভাইকে খাওয়াবেন। কিন্তু তার ইচ্ছেয় জল ঢেলে দিল কুহু৷

সন্ধ্যা নেমেছে ফুলতলা গ্রামে। আকাশের আনাচেকানাচে কালো মেঘ জমেছে। কখন যেন অঝোরে কাঁদতে শুরু করবে আকাশ। তার সকল কষ্ট বৃষ্টি হয়ে ঝরবে ধরিত্রীপুরে।
দুপুরের আগে কুহু এ বাড়িতে এসেছে কিন্তু এখন অব্দি শিউলি আক্তার কথা বলেনি ওর সাথে।
কুহু আপনমনে বাড়ির সব কাজ সেরেছে। বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিল তাই রাতের খাবার দিনের আলো থাকতেই রান্না করেছে। তাছাড়া দেখা গেল বৃষ্টি নামার সাথে সাথে লোডশেডিং শুরু হবে সেই সারারাতের নামে। সব কাজ সেরে বাগানের দিকে যায়। হাঁস , মুরগীগুলোকে খোঁয়াড়ে তুলতে হবে।

বারান্দায় বসে কুহু বৃষ্টি দেখছে। দক্ষিণের বড় ঘরে থাকে সে। এই ঘরেই ছোটবেলা থেকে ওর বাস। মা মারা যাবার পর দাদা-দাদীর সাথে থাকত। দাদা-দাদীর স্নেহের ছায়ায় কেটেছে কয়েক বছর। তারপর দাদা মা’রা গেল। তখনও দাদীর ছায়াতলে থেকেছে। কিন্তু চার বছর আগে যখন দাদী মা’রা যায় তখন থেকেই শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই।
চারদিকে অন্ধকারে ডুবে আছে। ছোটমা তার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নিজের ঘরেই আছেন। শিহাব কয়েকবার কুহুকে ডেকেছে ওর কাছে আসার জন্য কিন্তু ছোটমা আসতে দেয়নি। ওরা উত্তরের ঘরে নিজেদের মত আছে।
বাবা এখনও বাড়ি ফিরেনি। কখন আসবে তাও জানেনা কুহু। বারান্দায় হারিকেনের মিটিমিটি আলোয় এক আলো-আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে। বেশ লাগছে এই পরিবেশ।

একা একা অনেকক্ষণ বসে থাকে বারান্দায়। বৃষ্টি ছাড়ার নামই নেই। থেকে থেকেই বৃষ্টির ছাট শরীরে লাগছে। একটু শীত শীতও করছে তাই কুহু ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। বাবা আসলেই তবে রাতের খাবার দিবে ছোটমা। কিন্তু তার ছেলে-মেয়েকে ঠিকই তাদের চাহিদা অনুযায়ী খেতে দেয়। শুধু কুহুর বেলায় সব নিয়ম ভিন্ন। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে। সেই সকালে ফুপুর হাতে খেয়েছে তারপর সারাদিন পেটে কিচ্ছুটি পরেনি। ক্ষুধার তাড়নায় এক গ্লাস পানি খায়। তখনই টেবিলের উপর থাকা ফোন বেজে ওঠে। এই ফোন মেজ ফুপু দিয়েছিলেন। কুহুর খোঁজ নিতে প্রতিদিনই ফুপুরা ফোন করত এতে ছোটমা খুব বিরক্ত হত। সেটা টের পেয়ে মেজ ফুপু একদিন ফোন নিয়ে হাজির হন। তাতেও সে কি রাগ ছোটমার। কিন্তু ফুপুর তাতে কিছুই যায় আসেনি এমন ভাব করেছে। নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করে। বড় ফুপু ফোন দিয়েছে।
” আসসালামু আলাইকুম ফুপু। তুমি ভালো আছ ফুপু? ”
” আমি ভালো আছি সোনা মা। তুই কেমন আছিস? কি করছিস এখন? সারাদিনে কিছু খেয়েছিস? ” এক নিঃশ্বাসে বলেন আফরোজা নাজনীন।
” ফুপু একসাথে এত প্রশ্ন করছ কেন! এত উতলা হচ্ছ কেন! আমিও ভালো আছি ফুপু। বৃষ্টি হচ্ছে এখানে তাই ঘরেই চুপচাপ বসে আছি। তুমি কি করছ ফুপু? দিদুন কেমন আছে? ”
” আমার সব প্রশ্নের উত্তর এখনো দিসনি তুই কুহু। খেয়েছিস তুই? আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিবি। ”
” নাহ্। ” এক বাক্যে ছোট্ট করে উত্তর দেয় কুহু।
আফরোজা নাজনীন কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কথা বলেন।
” তোর ব্যাগ খুলে দেখ কয়েকটা প্যাকেট দিয়েছি। সেখানে কেক, বিস্কুট আর কিছু ফল আছে। সেখান থেকে এখনই কিছু খেয়ে নে। আর প্যাকেটগুলো নিজের কাছেই রাখবি কাউকেই দিবিনা। তোর যখন ক্ষুধা লাগবে তখন খাবি। ওগুলো শেষ হওয়ার আগেই আমি আবারও খাবার পাঠাব। এখন তারাতারি খেয়ে নে। আমি ভিডিও কল দিচ্ছি। তুই খাচ্ছিস কিনা দেখব আর হ্যাঁ তোর দিদুন ভালো আছে ৷ ” কুহুকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি। কুহু ব্যাগ খুলে প্যাকেটগুলো বের করতেই আবারও ফোন দেন আফরোজা নাজনীন। তিনি ভিডিও কল দিয়েছেন। ফুপুর এহেন মমতায় কুহুর চোখে পানি আসে। চোখ মুছে কল রিসিভ করে কুহু। ক্যামেরা নিজের দিকে রেখে কুহু একটা কেকের প্যাকেট খুলে কেক খেতে শুরু করে। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। কুহুর চোখে পানি দেখে আফরোজা নাজনীনও কেঁদে ফেলেন। কিন্তু তিনি কুহুকে বুঝতে না দিয়ে চোখ মুছলেন।
” সোনা মা, খাওয়ার সময় কাঁদতে নেই জানিসনা! আর এক ফোঁটা পানিও যদি চোখ থেকে ঝরে তাহলে আমি কিন্তু আর ফোন করবনা বলে দিলাম। ” কুহু ফুপুর কথা শুনে ঝটপট চোখ মুছে নেয়। এরপর একমনে খেতে থাকে। প্রচন্ড ক্ষুধা থাকায় বেশ খানিকটা কেক খায়। ওর খাওয়া হলে আফরোজা নাজনীন প্যাকেটগুলো আলমারিতে লুকিয়ে রাখতে বলে। কারন শিউলি সেগুলো দেখলে কুহুর সাথে দূর্ব্যবহার করতে পারে। কুহু ফুপুর নির্দেশমত কাজ করে। এরপর বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখেন তিনি।
সারাদিনের না খাওয়া শরীরে খাবার পরই ঘুম পায় কুহুর। তাই বাবার জন্য অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পরে।
শিউলি আক্তার একবারও খোঁজ নেয়না কুহুর। সে তার ছেলে-মেয়েকে খাইয়ে দিয়েছে অনেক আগেই।

চলবে…

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩
জাওয়াদ জামী

তাহমিদ খাবার টেবিলে বসে আছে। স্যারের বাসায় গিয়েছিল বইয়ের কিছু প্রবলেম সলভ করার জন্য। সেখান থেকে ফিরতে রাত হয়েছে। যদিও স্যার অনেকবার বলেছে খেয়ে আসার জন্য কিন্তু তাহমিদ খায়নি। বাসায় এসে ওর মা’কে সামনে দেখেই খেতে চেয়েছে। ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে বসে আছে ঠিকই কিন্তু ওর কিছুই ভালো লাগছেনা। সে প্রতিদিন বাসায় ঢুকেই বড়মাকে দেখে। কিন্তু গতরাতের পর আজ আজ রাত পর্যন্ত বড়মাকে একবারও দেখেনি। এমনকি ওকে খেতে দিতে আসেনি! বড়মা তো জানে তার হাতে না খেলে তাহমিদের পেট ভরেনা। তবুও কেন আজ সারাদিন বড়মা একবারও ওর সামনে আসলনা!
” মা, আজ তুমি খেতে দিচ্ছ যে! বড়মা কোথায়? সারাদিন একবারও বড়মাকে দেখিনি। বড়মা জানে তার হাতে ছাড়া আমি খেতে পারিনা তবুও আজ একবারও আমাকে খাইয়ে দেয়নি। ”
” তোর বড়মার শরীর আজ ঠিক নেই। তাই রুমেই শুয়ে আছে। আজ আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোকে। ” কাজের ফাঁকে উত্তর দেন তাহমিনা।
” কি হয়েছে বড়মার! আমি এখন খাবনা। আগে বড়মাকে দেখে আসি তারপর খাব৷ ” হন্তদন্ত হয়ে আফরোজা নাজনীনের রুমের দিকে ছোটে তাহমিদ।
আফরোজা নাজনীন সটান হয়ে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে। কোন অনুমতির অপেক্ষা না করে তাহমিদ হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে। ওকে দেখে সানাউল রাশেদিন কপাল কুঁচকে তাকায়।
” কি ব্যাপার তুমি হঠাৎ এ সময়ে এখানে? কারো রুমে ঢোকার আগে নক করতে হয় এটা বোধহয় ভুলে গেছ? এত কিছু জানো আর এই সামান্য বিষয়টা জানোনা! ” সানাউল রাশেদিনের রাশভারী গলার কথাগুলো শুনে তাহমিদ থমকে যায়।
যে বড় চাচ্চু ওকে প্রান দিয়ে ভালোবাসে আজ তিনি এভাবে বলছেন! নিজেকে সামলে নেয় তাহমিদ। ও বেশ বুঝতে পারছে গত রাতের ঘটনায় বড় চাচ্চু ওর ওপর রেগে আছে। সে সানাউল রাশেদিনের থেকেও রাশভারী গলায় বলে ওঠে, ” বাবা-মা’ র রুমে আসতে সন্তানের কোন পারমিশনের প্রয়োজন নেই। তাদের এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে তাই হুটহাট রুমে ঢুকলেই অপ্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের কৌশল অনেক আগেই শিখেছে। ” সানাউল রাশেদিন ভাতিজার কথা শুনে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। মনে মনে ভাবে, এই ছেলে কি বলছে এসব! লজ্জা জিনিসটা কি বেঁচে খেয়েছে!
তাহমিদ বড় চাচ্চুকে তোয়াক্কা না করে বড়মার দিকে এগিয়ে যায়। ঘুমন্ত বড়মার মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। সে কি খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে এই মমতাময়ীকে! এই অন্যায়ের কোন ক্ষমা ত্রিভুবনে আদৌ কি আছে?
বড়মার মাথায় ছোট্ট করে চুমু দেয় সে।
” এ কি করছ তুমি? সে কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে। এখন তুমি বাইরে যাও। ওকে বিরক্ত করনা। ” সানাউল রাশেদিনের রা’গ এখনো কমেনি।
” তো তুমি কি করছ এখানে! এত বয়স হয়েছে এইটুকু জানোনা অসুস্থ কেউ ঘুমালে বাতি নিভিয়ে দিতে হয়? কিন্তু তুমি দিব্যি বই নিয়ে বসে আছ! বুড়ো হয়েছ ঠিকই কিন্তু বুদ্ধির ‘ব’ ও নেই দেখছি! ” তাহমিদ কৃত্রিম রা’গে’র সাথে বলে।
ওদের কথপোকথনের আওয়াজ কানে যেতেই চোখ মেলে চায় আফরোজা নাজনীন। তাহমিদকে এসময়ে রুমে দেখে একটু অবাকই হন বৈকি।
” তাহমিদ, কি হয়েছে বাপ? তোর চাচ্চুর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? ”
” বড়মা, আমিতো শুধু চাচ্চুকে বুঝাচ্ছি তার করনীয় কি। সেই সাথে কিছু ভুল শুধরে দিচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি উঠলে যে! তোমার শরীর এখন কেমন আছে? খেয়েছ কিছু? কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার? প্রেশার চেক করেছিলে আজকে? ” ব্যাগ্র হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করছে তাহমিদ।
আফরোজা নাজনীন হেসে দেন তাহমিদের অস্থিরতা দেখে।
” আমি ঠিক আছি বাপ। মাথা ব্যাথা করছিল তাই শুয়েছিলাম। তুই কখন এসেছিস? খেয়েছিস? তোর মুখটা এমন শুকনা লাগছে কেন? ”
” আমি আগেই জানতাম মা-ছেলে একসাথে হলে সব ভুলে বসে থাকবে। তাই দুজনের খাবার এনেছি। কষ্ট করে আর ডাইনিং টেবিলে খেতো যেতে হবেনা। ” তাহমিনা আক্তার খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।
তাহমিদ বড়মার হাত ধরে নিয়ে যায় ওয়াশরুমের কাছে। তিনি ওয়াশরুমে প্রবেশ করলেও তাহমিদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সানাউল রাশেদিন আঁড়চোখে ভাতিজার কার্যকলাপ দেখছেন। তাহমিনা আক্তার একে একে সব খাবার সেন্টার টেবিলে সাজিয়ে রাখে। আফরোজা নাজনীন বেরিয়ে আসলে তাহমিদ তাকে ধরে চেয়ারে বসায়।
” এবার আমাকে খাইয়ে দাও। ”
আফরোজা নাজনীন কিছু না বলে মুচকি হেসে প্লেটে ভাত বাড়তে থাকেন।
তাহমিদকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও অল্প পরিমানে ভাত খেয়ে নেন। সানাউল রাশেদিন আগেই খেয়েছেন তাই তার বসে বসে সামনের নাটক দেখা ছাড়া কোন উপায় নেই। হ্যাঁ তার কাছে এটা নাটকই মনে হচ্ছে। যার জন্য ভাতিজার উপর রাগ ঝাড়লেন তিনিই এখন তার ভাতিজাতে খাইয়ে দিচ্ছেন। এটা তার কাছে অতিনাটকীয় মনে হচ্ছে। তার নিজেকে অকালকুষ্মাণ্ড মনে হচ্ছে। এত রাগ দেখিয়ে কি হল! শেষে সেই আমে-দুধে মিলে গেল আর তিনি আঁটি হয়েই রইলেন!

সকালে ফজরের আজানের একটু পর ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো কুহুর। চোখ কচলে বিছানা হাতড়ে ফোন হাতে নেয়। মেজো ফুপুর নাম দেখে মৃদৃ হাসি ফুটে ঠোঁটের কোনে।
” আসসালামু আলাইকুম মেজো ফুপু। কেমন আছো তুমি? ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম কুহুতান। আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? ”
” আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ফুপা, মাহিন ভাইয়া, মাইশা আপু কেমন আছে? তুমি কবে আসবে ফুপু? কতদিন এখানে বেড়াতে আসোনা। ”
” তোর ভাইয়ার পরিক্ষা শেষ হলেই তবে যাব । তোর রেজাল্ট দিতে এখনো তো কিছুদিন বাকি আছে, এ কয়দিন এখানে এসে ঘুরে যাবি কুহুতান? ” আচমকা ফুপুর এই প্রস্তাব শুনে কুহুর মুখ চুপসে যায়। মনে পরে সেদিন রাতের অপমান। সেদিনের পর থেকে কোন ফুপুর বাড়িতে যাওয়ার কথা মনে হলেই ভয় এসে ভর করে।
” বড় ফুপুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসলাম মাত্রই। আর কিছুদিন যাক তখন তোমার কাছে যাব। ”
ফুপুর সাথে বেশ সময় নিয়ে কথা বলে অজু করে এসে জায়নামাজে দাঁড়ায় কুহু।
নামাজ আদায় করে বাড়িঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিপাটি করে রান্নাঘরে আসে। শিউলি আক্তার তখনও ঘুমে। সে নামাজ রোজার ধারেকাছেও যায়না। কায়েস অনেক বলেও তাকে নামাজ ধরাতে পারেনি।
কুহু একে একে রুটি, আলু ভাজি, ডিম ভাজি বানিয়ে রেখে বাগানের দিকে যায়। খোঁয়াড় থেকে হাঁস-মুরগিগুলো বের করে শস্যদানা ছড়িয়ে দেয়। এরপর মাচা থেকে পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া শাক তুলে নিয়ে আসে।
অতঃপর সেগুলো বেছে, কেটে ধুয়ে নেয়। এরপর টুকিটাকি কাজ সেরে নেয়। ততক্ষণে শিউলি আক্তার উঠেছে। কায়েসও মসজিদ থেকে চলে আসে। কুহু বাবাকে দেখে দৌড়ে আসে। কায়েসও মেয়েকে দেখে গালভরা হাসি দেয়। দুই বাবা-মেয়ের হেসে হেসে কথা বলতে দেখে রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে ওঠে শিউলি আক্তারের।
” হইছে এত আল্লাদ দিতে হইবনা। এতদিন আল্লাদ দিয়া মাথায় তুইলাও সাধ মিটেনি? আরো দুইডা সন্তান আছে এবার তাগোর দিকে নজর দেন। খালি একটারে নিয়াই পইরা থাইকেননা৷ ” মুখ বেঁকিয়ে বলতে থাকেন শিউলি আক্তার।
” শিউলি, আমি আগেই বলেছি তুমি আমার ফুলের মত মেয়েকে নিয়ে এভাবে বলবেনা। ”
” আইছে ফুলের মত মাইয়া। ফুলতো সুন্দর হয় তা আপনের মাইয়া কোন ফুল শুনি। আমিতো তার চেহারায় কোন ফুলের ছাপ দেখিনা। আমিতো শুধু কালো রংই দেখি। ” হাসতে হাসতে ঢলে পরছে শিউলি আক্তার। সে নিজে দুধে-আলতা ফর্সার জন্য শ্যামলা কুহুকে খুব ঘৃণা করে। শিউলি আক্তার নিজেও যেমন সুন্দরী, তার ছেলে-মেয়েও মায়ের মতই রুপ পেয়েছে। যদিও কায়েসও কোন অংশেই কম নয়। আর কুহু ওর মায়ের রং পেয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের মায়াবী চেহারা মায়ের সাথে অনেকাংশে মিলে যায়।
কায়েস শিউলির কথার কোন প্রত্যুত্তর করেনা। সে যত কথা বলবে শিউলি ততই কথা পেঁচিয়ে ঝগড়া বাঁধাবে।
কুহু ছোটমার কথা শুনে খুব কষ্ট পায়। মাথা নিচু করে নিজের ঘরে আসে। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটে খুঁটে নিজেকে দেখছে। সে কি এতই কুশ্রী যে বারবার ছোটমা কালো বলে উপহাস করে! মাঝে মাঝেই ওর খুব আফসোস হয় বাবার মত, ফুপুদের মত ফর্সা না হবার কারনে।
কতবার মনে হয়, তার মায়েরই কেন শ্যামলা হতে হল! সবার মা কত ফর্সা, কত সুন্দর কিন্তু আমার মা’ই শুধু কালো। তাই আমিও কালো হয়েছি আর এখন প্রতিনিয়ত ছোটমার খোঁটা শুনতে হয়।
ছোট্ট মনে কত যে কথা কত যে প্রশ্ন এসে ভীর জমায়। যার কোন উত্তর নেই বা উত্তর দেয়ার মানুষ নেই।

চলবে….